প্রবাদ হল মানুষের দীর্ঘ ব্যাবহারিক অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ততম বাণীরূপ, যা মুখে মুখে প্রচলিত। সাধারণত প্রবাদের মধ্য দিয়ে স্থানীয় পরিবেশ, ধ্যানধারণা, সংস্কার, চিন্তা-চেতনা, মানসিক রুচি, ধর্মবিশ্বাস, লোকাচার, জীবিকা ইত্যাদি চিত্তাকর্ষকভাবে প্রকাশ পায়।
প্রবাদ ও প্রবচন প্রশ্ন উত্তর

১। প্রবাদ কাকে বলে? প্রবাদের উৎস সম্পর্কে আলোচনা করো।
প্রবাদ: প্রবাদ হল মানুষের দীর্ঘ ব্যাবহারিক অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ততম বাণীরূপ, যা মুখে মুখে প্রচলিত। সাধারণত প্রবাদের মধ্য দিয়ে স্থানীয় পরিবেশ, ধ্যানধারণা, সংস্কার, চিন্তা-চেতনা, মানসিক রুচি, ধর্মবিশ্বাস, লোকাচার, জীবিকা ইত্যাদি চিত্তাকর্ষকভাবে প্রকাশ পায়। তাই মানুষের জীবনে উঠতে-বসতে-চলতে-ফিরতে কথায়-কথায় প্রবাদের ব্যবহার দেখা যায়। প্রবাদ হল গোষ্ঠীজীবনের অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ততম সরস অভিব্যক্তি, যা একটি গূঢ়ার্থকে ধারণ করে রাখে।
উদাহরণ: ‘হাতি কাদায় পড়লে মশা মাছিও লাথি মারে।’-শক্তিমানের অসহায়ত্ব বোঝাতে এই প্রবাদটি প্রচলিত।
উৎস: প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, প্রবাদের নেপথ্যে কোনো- না-কোনো কাহিনির অস্তিত্ব থাকে। কোনো একটি বিশেষ ঘটনা বা সংস্কার অথবা কোনো একটি লৌকিক বা পৌরাণিক কাহিনি ইত্যাদি প্রত্যক্ষ উৎস সাধারণত প্রবাদ সৃষ্টির মূলে থেকেই থাকে। সেই বিশিষ্ট ব্যাপার বা উপলক্ষ্যটি সার্বিক বা নির্বিশেষ হয়ে ওঠে প্রবাদের মাধ্যমে। কালক্রমে একটি ঘটনা সেইরূপ বহু ঘটনার উপমাস্থল হয়ে ওঠে বলেই প্রবাদের চরিত্র সর্বজনীন।
প্রবাদের প্রত্যক্ষ উৎসের কাহিনিটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে বা হারিয়ে যায় বটে, কিন্তু সেই আপাত বিলুপ্ত গল্পগুলির ভাবমর্ম কোনো সময়েই মলিন হয় না; মৃদু একটা বিদ্রুপের ভঙ্গিমায় নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ব্যাখ্যানে তাঁর স্বতন্ত্র ও স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ ঘটে। তখন সেই উৎসের কাহিনিটির ভাবার্থটুকু নিয়ে তা দিয়ে অন্য অনেক ঘটনার নির্দেশ করা হয়, তৈরি হয় প্রবাদ।
২। উদাহরণ-সহ প্রবাদের অর্থভিত্তিক শ্রেণিবিভাগ করো।
অর্থদ্যোতকতার দিক দিয়ে প্রবাদ
অর্থের বিভিন্নতার দিক দিয়ে বিচার করলে প্রবাদকে যে কয়টি ভাগে ভাগ করা যায়, সেগুলি হল-
সাধারণ অভিজ্ঞতামূলক প্রবাদ: কান টানলে মাথা আসে। অর্থাৎ, উপলক্ষ্য ধরে লক্ষ্যে পৌঁছোনো যায়।
নীতিমূলক প্রবাদ: চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। অর্থাৎ, অসৎ বা দুষ্টকে সদুপদেশ দেওয়া বৃথা।
সমালোচনামূলক প্রবাদ : উচিত কথায় মামা বেজার। অর্থাৎ, ন্যায্যকথা শুনতে নারাজ হন অনেকেই আবার, সত্যকথা বলে দিলে আপনজনও (মামা) ক্ষুদ্ধ হয়।
সামাজিক রীতি বিষয়ক প্রবাদ: মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। অর্থাৎ, মোল্লার প্রতিদিনের যাতায়াত বাড়ি থেকে মসজিদ পর্যন্ত। মোল্লার কাজ নামাজ পড়া ও পড়ানো এবং তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতা এই ছোটো গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তার বাইরের খোঁজ তিনি রাখেন না এবং সীমিত জ্ঞানেই নিজেকে সর্বজ্ঞানী মনে করেন। যে যা কাজ করে সেই পর্যন্তই তার জ্ঞানের সীমা, একথা বোঝাতেই প্রবাদটির ব্যবহার।
ব্যঙ্গাত্মক প্রবাদ: ঠেলার নাম বাবাজি। অর্থাৎ, বিপদে পড়লে সবাই বাপ বাপ বলে। এমনকি যাকে অবজ্ঞা করে এসেছে, বিপদের ঠেলায় তাকেও সমাদর করতে বাধ্য হয়।
৩। প্রবাদ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করো। প্রবাদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
অথবা, প্রবাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্ণয় করো।
ব্যুৎপত্তিগত অর্থ: অভিধানে প্রবাদের ব্যুৎপত্তি ও ব্যাখায় বলা হয়েছে-প্রবাদ-[প্র + √ বদ (বলা) + অ (ঘঞ)-ভা]। অর্থাৎ, পরম্পরাগত বাক্য, জনরব, লোককথা, জনশ্রুতি প্রভৃতি। অর্থাৎ যেসব প্রাজ্ঞ উক্তি লোক-পরম্পরায় জনশ্রুতিমূলকভাবে চলে আসছে, তাই-ই প্রবাদ।
প্রবাদের বৈশিষ্ট্য: বাংলা লোকসাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল অঙ্গ, প্রবাদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল—
- প্রবাদের কোনো নির্দিষ্ট রচনাকাল বা রচয়িতার নাম জানা যায় না।
- প্রবাদ খেয়ালখুশিমতো বলার বিষয় নয়, উপযুক্ পরিবেশ-পরিস্থিতি-প্রসঙ্গ ছাড়া এর প্রয়োগ অর্থহীন।
- প্রবাদের অর্থ গভীর ও তাৎপর্যময়। এর তীক্ষ্ম অর্থভেদী মন্তব্য শ্রোতা ও পাঠককে সহজে সচকিত করে তোলে। এর শব্দার্থ নয়, রূপক অর্থই গুরুত্বপূর্ণ।
- প্রতিটি প্রবাদ লোক-অভিজ্ঞতা এবং লোকদর্শনের সংহত ভাষাগত প্রকাশ।
- প্রতিটি প্রবাদের সর্বজনীন এবং সর্বকালীন হয়ে ওঠার ক্ষমতা রয়েছে।
- সোজাভাবে বলা কথা সাধারণত প্রবাদ হয় না-এর মধ্যে থাকে ব্যঙ্গ, শ্লেষ এবং বক্রোক্তির তির্যক ব্যঞ্জনা।
- ভিন্ন পরিস্থিতিতে পরস্পরবিরোধী বাক্য প্রবাদের শ্রেণিভুক্ত হতে পারে। যেমন- ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ এবং ‘দুষ্ট গোরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’।
৪। প্রবাদের গঠনশৈলী সম্পর্কে ধারণা দাও।
গঠনশৈলী: প্রবাদের সহজসরল প্রকাশভঙ্গি এবং সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনরীতি অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক ও হৃদয়গ্রাহী। প্রবাদের মধ্যে সঞ্চিত থাকে সুদীর্ঘকালের বাস্তব অভিজ্ঞতা আর মানবিক আবেদন। বাংলা প্রবাদে সামাজিক রীতি-রেওয়াজ ও যুক্তিশৃঙ্খলার ছাপ সুস্পষ্ট থাকে। বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর ভর করে গড়ে ওঠে প্রবাদের কলেবর—
- প্রবাদের মধ্যে থাকে সাদৃশ্য ভাবনার প্রকাশ। যেমন- ‘কনের ঘরের মাসি, বরের ঘরের পিসি’। কিংবা ‘যেমন দেবা তেমন দেবী’ অর্থাৎ দুজনের চরিত্রই পরস্পরের পরিপূরক।
- প্রবাদের মধ্যে বৈপরীত্য ভাবনার প্রকাশও লক্ষ করা যায়। যেমন-‘যেমন বুনো ওল, তেমন বাঘা তেঁতুল’। অর্থাৎ দুষ্ট ব্যবহারের পরিবর্তে ততোধিক দুষ্ট ব্যবহার ফিরিয়ে দেওয়া।
- এখানে যুতসই বা উপযুক্ত সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। যেমন- ‘যেমন কুকুর, তেমন মুগুর’।
- প্রবাদে বহু ক্ষেত্রে কার্যকারণ সম্পর্কের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। যেমন-‘কান টানলে মাথা আসে’।
- প্রবাদ সৃষ্টিতে চিহ্নের বিশেষ ব্যবহার লক্ষণীয়। যেমন-‘শিকারি বিড়াল গোঁফে চেনা যায়’। এখানে ‘গোঁফ’ চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
- প্রবাদে সংখ্যার ব্যবহার বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। যেমন-‘দশচক্রে ভগবান ভূত’।
- প্রবাদে তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। যেমন- ‘শূন্য কলশির আওয়াজ বেশি’।
৫। বাংলা প্রবাদের বৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা দাও।
বাংলা প্রবাদের বৈচিত্র্য
প্রবাদ সাধারণত খুব সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর ব্যঞ্জনাবহ হয়। এর মধ্যে ছড়াসুলভ দ্রুত ছন্দঝংকার পরিলক্ষিত হয়। নানা বৈশিষ্ট্যের মেলবন্ধনে প্রবাদ হয়ে উঠেছে এক বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি। প্রবাদের বৈচিত্র্যের রূপগুলির কয়েকটি নিম্নে আলোচিত হল-
বিষয়গত বৈচিত্র্য: শুধু দেবদেবী, মানবদেহ, পুরাণ কিংবা ইতিহাস নয়; পারিবারিক জীবন, আচার-আচরণ, পেশা ইত্যাদি নানা বিষয় প্রবাদের মূল ভিত্তি হয়ে উঠেছে। যেমন-
দেবদেবী বিষয়ক: রাখে হরি মারে কে?
মানবদেহ বিষয়ক: সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না।
পুরাণ বিষয়ক: সাত কাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা কার পিতা?
আচার-আচরণ বিষয়ক: কাজের মধ্যে দুই, খাই আর শুই।… ইত্যাদি।
প্রকৃতিগত বৈচিত্র্য: লৌকিক প্রবাদগুলির মধ্যে সামান্য পরিবর্তন এনে সেগুলিকে সাহিত্যে প্রয়োগ করার উদাহরণ যথেষ্ট রয়েছে। আবার কখনো সাহিত্যিকদের ব্যবহৃত পঙ্ক্তিও প্রবাদের শিরোপা লাভ করেছে। যেমন- ‘ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর’-এর লেখা ‘হাভাতে যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়’-সাহিত্যিক প্রবাদের উদাহরণ।
উৎসগত বৈচিত্র্য: ভিন্ন ভাষা থেকে আগত প্রবাদও বহু সময় বাংলা প্রবাদের দলে সহজসরল ও সার্থকভাবে মিশে গিয়েছে। যেমন-
সংস্কৃত: ‘কণ্টকেনৈব কণ্টকম্’।
হিন্দি : ‘ধোবী কা কুত্তা, না ঘরকা না ঘাটকা’।
রাজস্থানি : ‘সৌ সুনার কী এক লুহার কী’।
লোকশিক্ষা: প্রবাদের মধ্য দিয়ে জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়া বা সচেতন করার পরোক্ষ প্রয়াস লক্ষ করা যায়। যেমন- ‘আলো হাওয়া বেঁধো না, রোগ ভোগ সেধো না’।
এগুলি ছাড়াও ব্যক্তিনাম, স্থাননাম, খাদ্যবস্তু, বাদ্যযন্ত্র, প্রেমসম্বন্ধীয় নানা বিষয়ক প্রবাদের কায়া নির্মাণ করে।
৬। প্রবাদ’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ কী? বাংলা প্রবাদে প্রকাশিত সমাজবাস্তবতার রূপটি প্রস্ফুটিত করো।
প্রবাদ-এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ: প্রবাদ হল মানুষের দীর্ঘ ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ততম বাণীরূপ, যা মুখে মুখে প্রচলিত। সাধারণত প্রবাদের মধ্য দিয়ে স্থানীয় পরিবেশ, ধ্যানধারণা, সংস্কার, চিন্তা-চেতনা, মানসিক রুচি, ধর্মবিশ্বাস, লোকাচার, জীবিকা ইত্যাদি চিত্তাকর্ষকভাবে প্রকাশ পায়। তাই মানুষের জীবনে উঠতে-বসতে-চলতে-ফিরতে কথায়-কথায় প্রবাদের ব্যবহার দেখা যায়। প্রবাদ হল গোষ্ঠীজীবনের অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ততম সরস অভিব্যক্তি, যা একটি গূঢ়ার্থকে ধারণ করে রাখে।
উদাহরণ: ‘হাতি কাদায় পড়লে মশা মাছিও লাথি মারে।’-শক্তিমানের অসহায়ত্ব বোঝাতে এই প্রবাদটি প্রচলিত।
প্রবাদে সমাজবাস্তবতা: লোকসমাজের সঙ্গে প্রবাদের ঘনিষ্ঠ সংযোগ। তাই মানবপ্রকৃতি, সংস্কার, বিশ্বাস, তার জীবনযাত্রা-এককথায় মানবসমাজের নানা দিক মূর্ত হয়ে উঠেছে প্রবাদে। সমাজবাস্তবতার ভিত্তিতেই তার আত্মপ্রতিষ্ঠা।
লৌকিক জীবন থেকে সৃষ্ট প্রবাদে সমাজবাস্তবতার বিভিন্ন উপাদান প্রকৃষ্টভাবে প্রকাশ পায়। এ প্রসঙ্গে প্রবাদের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল- সমাজবিষয়, পরিবার, মানুষের আচার-আচরণ, গার্হস্থ্য জীবনে ব্যবহৃত বস্তু, ব্যক্তিগত বিষয়, প্রেমবিষয়, সামাজিক মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি। দৃষ্টান্তসহ বলা যায়- পশুপাখি: ‘বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়া’। ভূপ্রকৃতি: ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’। পেশা: ‘খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে। কাল হল এঁড়ে গোরু কিনে’। নিসর্গ বিষয়ক: ‘মেঘ না চাইতে জল’। স্বাস্থ্যবিধি: ‘সকালে শুয়ে সকালে উঠে, তার কড়ি না বৈদ্যে লুটে’।
আচরণবিধি: ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’। সমাজ অভিজ্ঞতা: ‘অতি লোভে তাঁতি নষ্ট’।
৭। বিষয়বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে প্রবাদের প্রকারগুলি আলোচনা করো।
প্রবাদের প্রকার: বিষয়বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে প্রবাদকে যে সম্ভাব্যরূপরেখায় বিন্যস্ত করা যায়, সেগুলি হল-
দেবদেবী বিষয়ক: একে মা মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ। [ইন্ধন জোগানো]
পৌরাণিক চরিত্র বিষয়ক: সাত কাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা কার পিতা? [আদ্যন্ত জেনেও অজ্ঞতা প্রকাশ করা, অতিচালাক তাই না জানার ভান করা]
ইতিহাস প্রসিদ্ধ চরিত্র বিষয়ক: রানি ভবানী আর ফুল জেলেনি। [অসমর মধ্যে তুলনা]
সমাজ বিষয়ক: তেলক কাটলেই বোষ্টম হয় না। [বাহ্যিক আড়ম্বর বেশি কিন্তু অন্তরে নিষ্ঠার অভাব]
পরিবার বিষয়ক: ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই। [আপনজনের সঙ্গে শত্রুতা, বিবাদ]
মানবদেহ বিষয়ক: সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না। [ভালো কথায় কাজ হয় না]
আচার-আচরণমূলক: আমার নাম নিতাই। এক খাই আর এক থিতাই। [বর্তমানের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের সংস্থানও করে রাখে যে, সতর্ক ব্যক্তি]
গার্হস্থ্য জীবনে ব্যবহৃত বস্তু বিষয়ক: শূন্য কলশির আওয়াজ বেশি। [ফাঁপা তথা জ্ঞানশূন্য লোক অধিক অকারণ কথা বলে]
প্রকৃতি বিষয়ক: মেঘ না চাইতে জল। [কোনো জিনিস পাওয়ার উদ্যোগ নেওয়ামাত্রই প্রাপ্তি]
কৃষিকাজ সংক্রান্ত: চার আল উঁচু, মাঝখানে নীচু। [চাষের জমি]
খাদ্যবস্তু সংক্রান্ত: দুধের সাধ ঘোলে মেটানো। [উৎকৃষ্টের বদলে নিকৃষ্ট দ্রব্যেই সন্তুষ্ট থাকা]
পশুপাখি বিষয়ক: শকুনের নজর ভাগাড়ের দিকে। [যার যা স্বভাব সে তাই করে]
বাদ্যযন্ত্র বিষয়ক: খাইদাই ডুগডুগি বাজাই। [ক্ষণস্থায়ী জীবন উপভোগ করা]
বিলাসোপকরণ বিষয়ক: গোদা পায়ে আলতা-খাঁদা নাকে নথ। [বিসদৃশ সাজ]
প্রেম বিষয়ক: যদি হয় সুজন। তেঁতুল পাতায় ন’জন [মিলেমিশে থাকলে সকল অসুবিধা জয় করা যায়।
স্থাননাম বিষয়ক: চাল, চিড়ে, গুড়/তিন নিয়ে দিনাজপুর। [স্থানের বিশেষত্ব]
ব্যক্তি বিষয়ক: লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন। [যার কাছে টাকা চাইলেই পাওয়া যায়, অর্থের অপব্যবহার] লোকশিক্ষামূলক আলো হাওয়া বেঁধো না। রোগভোগ সেধো না। [ঘরে আলো হাওয়া না ঢুকতে দিলে, রোগভোগ বাড়ে]
লোক-সিদ্ধান্তমূলক: যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। [যার প্রতি ঈর্ষা আছে তার ত্রুটিহীন কাজেও ত্রুটি খুঁজে পাওয়া]
লোকসাংবাদিকতা বিষয়ক: কাগজ, কলম, কালি। তিন নিয়ে বালি। [স্থানের বিশেষত্ব প্রচার করা] বিবিধ: পড়েছি মোগলের হাতে। খানা খেতে হবে সাথে। [জোরজুলুম বা বিপদে পড়ে ইচ্ছাবিবুদ্ধ কাজ করা], জোর যার মুলুক তার। [শক্তিশালীর জয়লাভ সর্বত্র]
৮। সাহিত্যিক প্রবাদের সর্বোত্তম রূপকার কে ও কেন, তা উদাহরণ-সহ বুঝিয়ে দাও। বাংলা সাহিত্যে ব্যবহৃত কয়েকটি প্রবাদ-প্রবচনের দৃষ্টান্ত দাও।
সাহিত্যিক প্রবাদের রূপকার: সাহিত্যিক প্রবাদের সর্বোত্তম রূপকার হলেন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র রায় (১৭১২-১৭৬০) (আদি পদবি মুখোপাধ্যায়)। তিনি তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ (১৭৫২) কাব্যে এই প্রবাদগুলি সফল ও প্রাসঙ্গিকভাবে প্রয়োগ করেছেন।
কারণ: ভারতচন্দ্রের মৌলিক প্রতিভা শব্দশিল্পীর প্রতিভা, যে-কোনো বিষয়ই তাঁর রচনায় সরস হয়ে উঠেছে। এমনকি, তিনি লৌকিক প্রবাদগুলিকেও তাঁর শিল্পীসুলভ মননে স্বচ্ছ ও সরস করে তুলেছেন। এর ফলে তাঁর কাব্যে ব্যবহৃত সাহিত্যিক প্রবাদগুলি বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
উদাহরণ: ভারতচন্দ্রের শ্রেষ্ঠত্বের উদাহরণ-
- বুড়া বয়সের ধর্ম অল্পে হয় রোষ।
- সরম ধরম গেল উদরের লেগে।
- ঘরে অন্ন নাহি যার। মরণ মঙ্গল তার।
- মিছা বাণী সিঁচা পানি কতক্ষণ রয়।
- মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।
সাহিত্যে প্রবাদ: বাংলা সাহিত্যে বহু প্রবাদ-প্রবচন পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
- ‘পিপীলিকার পাখা হয় মরিবার তরে’- কবিকঙ্কণ মুকুন্দ
- ‘নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়?’-ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর
- ‘বিনে স্বদেশি ভাষা মিটে কি আশা?’-রামনিধি গুপ্ত
- ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম
- হে।’-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
- ‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি।’-কাশীরাম দাস
- ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’-সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
৯। প্রবাদ পরিবেশনে কোনো দিনক্ষণ নেই”-মতটি প্রতিষ্ঠা করো। লোকসাহিত্যের অন্যান্য শাখার থেকে প্রবাদ পৃথক কোথায়?
সপক্ষে যুক্তি: প্রবাদের বিশেষ স্বভাব হল, প্রবাদ সমাজ-শিক্ষক। প্রবাদ সর্বদা অভিজ্ঞতা এবং অতীতনির্ভর। প্রবাদ সামাজিক সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই রূপের পরিবেশ ও পরিবেশনেও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন-ছড়া পরিবেশিত হয় সাধারণত ঘুমপাড়ানি পরিবেশে বা ব্রতপালনে এবং লোকক্রীড়ায়, ধাঁধা রাত্রে, লোককথা রাতে কাজের অবসরে, মন্ত্র আচার-অনুষ্ঠানে ও লোকচিকিৎসায় আর প্রবাদ পরিবেশনের কোনো স্থান-কালপাত্রের ভেদাভেদ নেই। কাজে-অকাজে, দিনে-রাতে সবসময় প্রবাদ পরিবেশিত হয়ে থাকে।
সর্বোপরি, প্রবাদ যেহেতু সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত, তাই জীবনের যে-কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা অবস্থায় প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।
প্রবাদের অনন্যতা: ছড়ার মধ্যে ইতিহাস-ভূগোল-সমাজের কথা থাকলেও সেখানে শিশুর মনহরণের জন্য কল্পনা, উদ্ভটত্ব ও অর্থহীনতা দেখা যায়। আবরণের আড়ালে থাকে ধাঁধার মুক্তি। লোককথা আসলে গদ্যে রচিত কল্পলোকের দীর্ঘকথা। লোকনাট্য সমাজকে সঙ্গী করলেও, তার অন্তরালে ধর্মের প্রভাব স্পষ্ট; আর মন্ত্রের মধ্যে রয়েছে জাদুবিশ্বাস। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে লোকসাহিত্যের এই শাখাটি (প্রবাদ) সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত, অথচ সমাজ অভিজ্ঞতা ও সামাজিক সত্যে সমৃদ্ধ।
সর্বোপরি, প্রবাদ যেহেতু দীর্ঘ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাই এই সংরূপটির মধ্যে মিথ্যার যেমন জায়গা নেই, পাশাপাশি কোনোরকম ফাঁকি বা অসংগতি কিংবা অন্যায়কে প্রবাদ প্রশ্রয় দেয় না।
১০। প্রবাদে সংসারজীবন কীভাবে ধরা পড়ে, তা নিজের ভাষায় লেখো।
প্রবাদে সংসারজীবনের ছায়া: প্রবাদ মূলত নিরক্ষর লোকসমাজের সৃষ্টি। এই নিরক্ষর স্রষ্টা সমাজের লোকচক্ষুর আড়ালে অবস্থান করেন। প্রবাদে যেমন থাকে ঘরের কথা, পরিবারের কথা, তেমনই থাকে যৌথ জীবনের কথা, কৃষি ও কর্মের কথা। প্রবাদে বাঙালির পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের এমন নিখুঁত ঘরোয়া চিত্র পাওয়া সত্যিই অভূতপূর্ব।
চিড়ে বল মুড়ি বল, ভাতের বাড়া নেই।
পিসী বল, মাসী বল, মায়ের বাড়া নেই।
এই মায়ের কাছে সন্তান কানা, খোঁড়া, কালা যাই হোক না কেন, সে-ই সেরা।
‘মোরে বল কালো কালো,
যার ছেলে তার মায়ের ভালো।’
এই সন্তান যখন ঘরে বউ নিয়ে আসে তখন মায়ের মন বলে ওঠে-
‘যতক্ষণ দুধ, ততক্ষণ পুত’
পুত্র আজ আর ‘মায়ের পুত নয়, শাশুড়ির জামাই’। সন্তান গর্ভে ধারণ করে মায়ের দুঃখের শেষ নেই-
‘বেটা বিয়ালাম, বউকে দিলাম, ঝি বিয়ালাম জামাইকে দিলাম।
আমি হলাম বাঁদী, পা ছড়িয়ে বসে কাঁদি।’
এইভাবে বাঙালি গৃহস্থ পরিবারের দ্বন্দ্বমুখর দৈনন্দিন চিত্র প্রবাদে ধরা পড়ায়, তা একপ্রকার সাংসারিক দলিল হয়ে উঠেছে।
১১। প্রবাদে নারীর সাংসারিক অবস্থান কেমনভাবে ধরা পড়েছে, তা উদাহরণ-সহ বুঝিয়ে দাও।
প্রবাদে শাশুড়ি-বউ সম্পর্ক: প্রবাদ (Proverb) সম্পূর্ণভাবে সমাজ সম্পৃক্ত। প্রবাদের মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠে আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান। পুরুষের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে-‘ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার ঘোড়া’। সংসার জীবনের অকপট ছবি-হিংসা, দ্বেষ, জ্বালা, অপমান, অত্যাচার কিছুই বাদ থাকে না। প্রবাদের পঙ্ক্তিতে শাশুড়ি-বউ এর মনকষাকষি, দুই সতীনের ঝগড়ার ঝাঁঝ আমাদের কাছে এসে পৌঁছোয়। তাই প্রবাদের ভাষা ভাবের সৃষ্টি নয়-একান্ত ঘরের কথা, অনুভূতির কথা, সংসারিক ঘটনার অকৃত্রিম প্রকাশ। উদাহরণের মধ্য দিয়ে বিষয়টিকে তুলে ধরা যাক-
মা ও ছেলের সম্পর্কের মাঝে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত শুরু হয়, যথাক্রমে ছেলের বিয়ে দিয়ে বউ ঘরে আনার পর। যে ছেলে ছিল চোখের মণি, সেই ছেলে এখন-
‘মায়ের গলায় দিয়ে দড়ি, বউকে পরায় ঢাকাই শাড়ি।’
স্বাভাবিকভাবে ছেলের মায়ের রাগ সরাসরি গিয়ে পড়ে বাড়িতে আসা নতুন বউয়ের উপর-
‘বউয়ের চলন ফেরন কেমন,/ তুর্কি ঘোড়া যেমন
বউয়ের গলার স্বর কেমন, শালিক কেঁকায় যেমন।’
শাশুড়ি-বউয়ের দ্বন্দ্বে ননদ (ননদিনী রায়বাঘিনি) স্বভাবতই মায়ের পক্ষে। কারণ মা সবসময় মেয়ের পক্ষে-
‘পদ্মমুখী ঝি আমার পরের ঘরে যায়,
খেদানাকী বউ এসে বাটায় পান খায়।’
শাশুড়ি-ননদিনি-পাড়াপ্রতিবেশীর সাঁড়াশি আক্রমণে বউকে জব্দ করার শব্দ ব্যবহার করা হয়-
‘লোহা জব্দ কামারবাড়ি, । বউ জব্দ শ্বশুরবাড়ি।’
এহেন অত্যাচারিত বউ যেদিন সুযোগ পায়, সেদিন শাশুড়ি মৃত্যুশয্যায়। বউয়ের মা এসে জিজ্ঞেস করে-
‘একলা ঘরের গিন্নি হলি নাকি মা।’
মেয়ে জবাব দেয়-
‘নিশ্বাসকে বিশ্বাস নেই, নড়ছে দুটো পা।।’
সংসার জীবনের এই দ্বন্দ্বমুখর দিকটি প্রবাদের মধ্যে প্রতিফলিত হওয়ায়, প্রবাদ হয়ে উঠেছে সমগ্র সমাজের সমাজমনস্কতার দলিল।
সবশেষে এ কথা জোরের সঙ্গে বলা যায় যে, আজও বিশ্বায়নের যুগে প্রবাদের ব্যবহার এতটুকুও কমেনি-এখানেই প্রবাদের প্রাসঙ্গিকতা।
১২। প্রবাদে লোকচিকিৎসা প্রকাশের নিদর্শন দাও। প্রবাদে বিভিন্ন বৃত্তিধারী মানুষের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি ধরা পড়েছে, তা আলোচনা করো।
লোকচিকিৎসামূলক প্রবাদ: প্রবাদ বাস্তব জগৎ থেকে আহরিত দার্শনিক জীবনসত্যসমৃদ্ধ। সমাজবিজ্ঞান ও সমাজ-ইতিহাস নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রবাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাদের মাধ্যমে লোকচিকিৎসা বা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসচেতনতা সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়, যা আসলে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে প্রাপ্ত-
- যার আছে আম (আমাশয়), তার নেই দাম।
- অনেক খাবে অল্প খাও, অল্প খাবে অনেক খাও।
- বেড়াও যদি ভোরের বেলা, থাকবে না আর রোগের জ্বালা।
- সকাল বিকেল শৌচে যায়,। তার কড়ি না বৈদ্যে খায়।
- তপ্ত অম্বল, ঠান্ডা দুধ, এই জানবে যমের দূত।
প্রবাদে মানুষের বৃত্তি: প্রবাদ সমাজজীবনের দর্পণ। এই আয়নায় সমাজের বিভিন্ন বৃত্তিজীবী মানুষের কাজকর্ম সাবলীলভাবে ধরা পড়েছে। প্রাত্যহিক জীবনে কথায় কথায় উঠতে-বসতে প্রবাদ উচ্চারিত হয়। সহজবোধ্য অথচ সাধারণ বুদ্ধির বহুদর্শিতার পরিচয় ধরা পড়ে-
- বামনের বাড়ির ভাত,। পেটে মারো হাত।
- মোল্লা পাকলে গল্পেরসার, । বামন পাকলে হীরের ধার।।
- বামুনে দক্ষিণা ধরে, । ঢেঁকির নামেও চন্ডী পড়ে।
- কলমে কায়স্থ চিনি, গোঁফে রাজপুত।
- বৈদ্য চিনি তারে, যার ওষুধ মজবুত।।
১৩। প্রবাদে সংখ্যার ভূমিকা আলোচনা করো এবং আবহাওয়া ও কৃষি সংক্রান্ত প্রবাদের পরিচয় দাও।
প্রবাদে সংখ্যার ভূমিকা: প্রবাদ হল ব্যক্তি অথবা সমষ্টির প্রাত্যহিক জীবনের অর্থবহ গভীর উক্তি। এই সংরূপে নানা সংখ্যার ভূমিকা লক্ষ করা যায়। ‘এক’ (১) থেকে শরু করে ‘লক্ষ’ পর্যন্ত সংখ্যা প্রবাদের উপাদানরূপে উঠে এসেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়-
- একটাকার মুরদ নেই, ভাত মারবার গোঁসাই
- এক ঢিলে দুই পাখি মারা
- পড়ে পাই ষোল আনা।
- ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে, লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা।
- দশচক্রে ভগবান ভূত।
- মরা হাতির দাম লাখ টাকা।
আবহাওয়া ও কৃষি সংক্রান্ত প্রবাদ : অভিজ্ঞতানির্ভর, কৃষি বিষয়ক তথ্যমূলক প্রবাদকে ডাক ও খনা বা রাবণের বচন বলা হয়। এগুলি অবশ্যই ঐতিহ্যগত-কারও ব্যক্তিগত প্রতিভার অবদান নয়। কৃষি বিষয়ক ছড়ার আকারে প্রবাদগুলিতে চাষের সময় খরা, বর্ষা, ঝড়, শস্যহানি। কৃষিপদ্ধতির নামে চাষির জীবন অভিজ্ঞতাকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হয়। অনেকে অনুমান করেন, খনন বা খোঁড়া শব্দ থেকে খনা শব্দের উৎপত্তি হতে পারে। দীনেশচন্দ্র সেন খনার বচনকে চাষাদের নিজেদের শাস্ত্র বলেছেন। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, লোকজীবনে নিত্যকর্মে দিশা নির্দেশে আবহাওয়া ও কৃষি সংক্রান্ত প্রবাদের জুড়ি নেই-
- শনিতে সাত, মঙ্গলে পাঁচ, বুধে তিন-বাকি সব দিন দিন।
- যদি বর্ষে মাঘের শেষ। ধন্যি রাজার পুণ্যি দেশ।।
- ডাক দিয়ে রাবণ; কলা লাগবে আষাঢ় শ্রাবণ।
- পানে পোঁত শ্রাবণে; খেয়ে না ফুরায় রাবণে।।
- খনা ডেকে বলে যান, রোদে ধান ছায়ায় পান।
১৪। প্রবচন বলতে কী বোঝো? প্রবাদ ও প্রবচনের মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণ করো।
প্ৰৰচন: প্রবচন হল ‘প্রকৃষ্ট বচন’। প্রচলিত কোনো বিশিষ্ট উক্তিই প্রবচনের রূপ পায়। প্রবচন হলো প্রজ্ঞাবান, মননশীল কোনো ব্যক্তির অভিজ্ঞতাপ্রসূত সৃষ্টি, এটি গোষ্ঠীদ্বারা সৃষ্ট নয়। যদিও বাংলায় প্রবচনের স্বতন্ত্র উপস্থিতি দেখা যায় না, প্রবাদের সঙ্গে সমার্থক হিসেবেই প্রবচনেরও প্রয়োগ ঘটে। তবে প্রবাদে যে গল্পের ভার রয়েছে, প্রবচনে তা নেই। প্রবচন হল-ছাঁটা-কাটা কথামাত্র, ভাবের গাম্ভীর্য এতে নেই, কেবল আনন্দ-দুঃখ প্রকাশক ও অভিজ্ঞতালব্ধ কিছু জ্ঞান আছে। ‘বচন’ থেকেই প্রবচন-এর প্রচলন। যেমন-ডাকের বচন, খনার বচন, চাণক্য বচন ইত্যাদি। ‘প্রবাদ’ এবং ‘বচন’ মিশ্রিত হয়ে ‘প্রবচন’ রূপটি প্রকাশ ঘটেছে।
উদাহরণ: “ভরা হতে শূন্য ভালো যদি ভরতে যায়,
আগে হতে পিছে ভালো যদি ডাকে মায়।।”
এখানে বোঝানো হয়েছে যে, খালি কলশি দেখে যাত্রা করলে তা শুভ হয় না। কিন্তু, যদি সেই কলশিতে জল ভরতে যাওয়ার দৃশ্য দেখে যাত্রা শুরু হয় তবে তা শুভ। আবার, যাত্রা করার আগে মায়ের ডাক ভালো কিন্তু যাত্রার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ার পর মা যদি পিছন থেকে ডাকে তা আরও মঙ্গলসূচক। অর্থাৎ, এখানে কোনো ভাবগম্ভীর, অভিজ্ঞতালব্ধ তত্ত্বকথা নেই-কেবল কতকগুলি ঘটনাসমূহের ভালো-মন্দ নির্দেশ করা হয়েছে।
প্রবাদ ও প্রবচন: ‘প্রবচন’ হল প্রকৃষ্ট বচন। প্রচলিত কোনো বিশিষ্ট উক্তি প্রবচনের রূপ লাভ করে। বলা যেতে পারে, প্রবাদগুলোই সাধারণভাবে হয়ে উঠেছে প্রবচন। তুলনামূলকভাবে প্রবাদের জনপ্রিয়তা অধিক, কারণ লোকসমাজের সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ ও নিবিড় সংযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, প্রবচনের জনপ্রিয়তার কারণ হল তাকে প্রবাদের প্রতিচ্ছবি হিসেবে ধরা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতানুসারে, প্রবাদের মধ্যে একটি গল্পের ভাব বিদ্যমান কিন্তু প্রবচন কাটা-ছাঁটা কথা মাত্র।
১৫। প্রবাদ ও প্রবচন বলতে কী বোঝো? কয়েকটি প্রবাদ-এর উদাহরণ বাক্য-সহ লেখো।
সংজ্ঞা ও আলোচনা: কোনো জাতির ব্যাবহারিক জীবনের লোক দর্শন বা লোক-অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত ও সংহত ভাষাগত অভিব্যক্তি, যা লৌকিক পরম্পরায় বাহিত হয়, তাকে বলে প্রবাদ। প্রবচন হল ‘প্রকৃষ্ট বচন’। প্রচলিত কোনো বিশিষ্ট উক্তি প্রবচনের রূপ পায়। একে ‘সদালাপ’ ও বলা যেতে পারে, তবে প্রবচনের স্বতন্ত্র স্থিতি নেই। প্রবাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়েই এর উচ্চারণ ঘটে। এই দুইয়ের তুলনার মূল দিকগুলি হল-
- প্রবাদে সুদীর্ঘ লৌকিক অভিজ্ঞতা এবং লোকদর্শন সংহতরূপে থাকে। প্রবচনে তা নাও থাকতে পারে। কারণ প্রবাদেরই সমার্থক হিসেবে প্রবচনের আত্মপ্রকাশ।
- প্রবাদ হল-‘প্রকৃষ্ট বাদ’, প্রবচন হল-‘প্রকৃষ্ট বচন’। সুতরাং প্রবাদে যেখানে সহজ-সরল ও সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনায় হৃদয়স্পর্শী আবেদন থাকে, প্রবচনে সেখানে থাকে কাটাছেঁড়া কথা বা সদালাপ। তার আবেদন তাই গম্ভীর নয়। প্রবচন প্রবাদ অপেক্ষা দীর্ঘতর।
- রবীন্দ্রধারণায় প্রবাদ একটি গল্পের ভাবপ্রচার করে। প্রবচন টুকরো কথার উপস্থাপনে আনন্দ-দুঃখ বা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে প্রকাশ করে।
- প্রবাদের উপস্থিতি স্বতন্ত্র, ভাবগম্ভীর, প্রকাশ তীব্র অর্থদ্যোতক। কিন্তু প্রবচনের স্বতন্ত্র প্রকাশ নেই। প্রবাদের সমর্থনেই তার স্থিতি। তাই লোকমুখে উচ্চারিত হয়-‘প্রবাদ-প্রবচন’।
- প্রবাদ মূলত নিরক্ষর সমাজের সৃষ্টি। প্রবচন সভ্যসমাজের প্রথম জীবনদর্শন। প্রবাদ তার প্রথম সামাজিক নীতি।
- প্রবাদের উদাহরণ-শূন্য কলশির আওয়াজ বেশি হয়। প্রবচনের উদাহরণ-ডাক ও খনার বচন। চারটি জনপ্রিয় প্রবাদের উদাহরণ হল- (i) যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। (ii) কাজের বেলায় কাজি, কাজ ফুরোলেই পাজি। (iii) রাখে হরি মারে কে? (iv) প্রেমে যদি মজে মন কিবা হাড়ি কিবা ডোম।
১৬। বচনের ধারণাটি ব্যক্ত করো। ডাক ও খনার বচনের মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা করো।
বচন: শুভাশুভ সংস্কার, বিধিবিধান, নীতি ও উপদেশবাচক বুদ্ধিদীপ্ত ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উক্তিই সাধারণ অর্থে বচন। ইংরেজি Saying, Proverb বা বাংলা ‘প্রবাদ’ অনেকটাই সমার্থক। তবে বচনের তাৎপর্য আরও ব্যাপক ও ভিন্ন। লোকসাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় শাখা বচনের স্বতন্ত্র একটা প্রকৃতি, কাব্যরস ও গীতিধর্মিতা আছে। বচনের মাঝে মাঝে একটা ভণিতা লক্ষ করা যায়, যা লোকসাহিত্যের অন্যান্য শাখায় সচরাচর দেখা যায় না।
ডাক ও খনার বচন: খনার আত্মকথামূলক একটি বচনে দেখা যায়, “ভাষা বোল পাতে লেখি / বাচাহুব বোল পড়ি সাথি”-এখানে, ‘বোল’-এর অর্থ ‘বুলি’। এটি ব্যাখ্যা করলে বোঝা যায় খনা তাঁর বচনগুলিকে গাছের পাতায় লিখে পাঠ করতেন এবং বচনগুলিকে এইভাবেই বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন। আর, নেপালের রাজদরবারে ‘ডাকার্ণব’ বলে যে গ্রন্থটি উদ্ধার হয় সেটিকেই ‘ডাকের বচন’-এর প্রামাণিক গ্রন্থরূপে গণ্য করা হয়।
ডাক ও খনার বচন প্রায় একই ছন্দে রচিত হলেও খনার বচনে অধিক ছন্দবৈচিত্র্যের পরিচয় মেলে। দুই বচনেই অন্ত্যমিলযুক্ত চরণ এবং মিলের জন্য শব্দবিকৃতির পরিচয় মেলে। উভয়ের বচনে দুই ও চার চরণের উদাহরণ মিললেও খনার বচন বহু ক্ষেত্রেই গীতিকবিতার মতো দীর্ঘ হয়।
উদাহরণ:
খনার বচন:
“ষোল চাষে মূলা / তার অর্ধেক তুলা
তার অর্ধেক ধান / বিনা চাষে পান”
ডাকের বচন :
“ঘরে স্বামী বাইরে বইসে।
চারিপাশে চাহে মুচকি হাসে।
হেন স্ত্রীয়ে যাহার বাস।
তাহার কেন জীবনের আশ।”
১৭। খনা ও ডাকবচন-এর সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও।
খনা: খনা এক কিংবদন্তির নাম। ধারণা করা হয় তাঁর আবির্ভাব ৮০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। এক শুভক্ষণে জন্ম হওয়ায় তাঁর নাম দেওয়া হয় ক্ষণা বা খনা। বিভিন্ন মতানুসারে, তাঁর আসল নাম ছিল লীলাবতী এবং তাঁর বসবাস ছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাত সদরের দেউলি গ্রামে। খনা কৃষি, আবহাওয়া ইত্যাদি বিষয়ক যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তা ‘খনার বচন’ নামে পরিচিত।
খনার বচন: খনার বচনে ব্যবহারিক কথা বেশি থাকায় মানুষ সেগুলিকে অধিক স্মৃতিবদ্ধ করে রেখেছে। খনার বচনের বর্তমান ভাষা তার মূল ভাষা নয় তবে লীলাবতী আর্যার ভাষা অনেকটা মূল ভাষার কাছাকাছি। উল্লেখ্য, ওড়িয়া ও অসমিয়া ভাষায় প্রাপ্ত খনার বচনে প্রাচীনত্বের ছাপ থাকলেও বাংলা ভাষায় ভাষাগত বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে খনার বচনেও ভাষাগত পরিবর্তন ঘটেছে। খনার বচনে বহু প্রাচীন কিছু গাণিতিক পরিভাষার সন্ধান মেলে। যেমন-চাঁদা ১, পক্ষ ২, নেত্র ৩, বেদা ৪, বাণ ৫, ছটে ৬ ইত্যাদি।
ডাকবচন: কিংবদন্তি বা Legend-এর নায়ক ‘ডাক’-এর নামে প্রচলিত ছড়া-প্রবাদগুলিই ‘ডাকবচন’ নামে পরিচিত। ‘ডাক’ প্রাচীন বাংলার একজন বচনকার নামে কথিত। ‘ডাক’ অর্থে জাদুসিদ্ধ বা মন্ত্রসিদ্ধ কোনো অভিজ্ঞ পুরুষকে বোঝায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, ‘ডাকার্ণব’ বাংলা ভাষার আদিগ্রন্থ। তিব্বতি ভাষায় ‘ডাক’ শব্দের অর্থ প্রজ্ঞাবান এবং ‘ডাকার্ণব’-এর অর্থ জ্ঞানসাগর। ‘ডাক’ যে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিবিশেষ সে বিষয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। তবে যদি ‘ডাক’ কোনো ব্যক্তি হন তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কোনো গুণী ব্যক্তি। অবশ্য প্রচলিত মতে, ‘ডাক’ ছিলেন একজন গোপ। ডাকের বচনে বাংলাদেশের লোকাচার ও জীবনাচরণের অভিব্যক্তি-সহ সমসাময়িক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অভিযোজিত হয়েছে। ভাব ও ভাষাগত বিচারে ডাকের বচনগুলিকে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচিত বলে মনে করেন গবেষকেরা। ডাকবচন মোটামুটি একই ছন্দে রচিত। ডাকের বচনগুলিতে তিথি, নক্ষত্র, বার, কাল, দিক প্রভৃতি চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়।
আরও পড়ুন | Link |
নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
চার্বাক সুখবাদ প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা প্রশ্ন উত্তর | Click Here |