পশ্চিম ভারতে ভক্তি আন্দোলন – ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পশ্চিমাংশে বা বলা ভালো মহারাষ্ট্রেও ভক্তিবাদের উদ্ভব ও প্রসার ঘটেছিল। ত্রয়োদশ শতকে মহারাষ্ট্রে চারটি ভক্তিবাদী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। এগুলি হল-মহানুভব, বারকরী, ধারকরী ও দত্তাত্রেয়। এদের উপাস্য দেবতা ছিলেন যথাক্রমে শ্রীকৃষ্ণ, বিঠল, শ্রীরাম এবং দত্তাত্রেয়। তবে বিশেষ জনপ্রিয়তা ও প্রচার পেয়েছিল বারকরী সম্প্রদায়।
পশ্চিম ভারতে ভক্তি আন্দোলন

বারকরী সম্প্রদায়
‘বারকরী’ শব্দের অর্থ তীর্থযাত্রার পথ (Pilgrim’s Path)। পন্ধারপুরে ভীমা নদীর তীরে প্রতিষ্ঠিত বিঠোবার মন্দিরকে কেন্দ্র করে বারকরী ভক্তিবাদ বিকাশ লাভ করে। এঁদের উপাস্য দেবতা বিল বা বিঠঠু। এই ‘বিঠঠু’ হলেন বিষ্ণু। ঐতিহাসিক ডি আর ভান্ডারকরের মতে, ত্রয়োদশ শতকে বিঠোবা উপাসনাকে কেন্দ্র করে বৈয়ব ধর্ম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
বারকরী দর্শন: বারকরী ধর্মতত্ত্ব অনুসারে মনে করা হয় যে-
- প্রতিটি মানুষই ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভে ইন্দ্রিয়সমূহ দ্বারা যেমন সুখ, দুঃখ উপলব্ধি করে, তেমনই ঐকান্তিক ভক্তি দ্বারা আধ্যাত্মচেতনার উন্মেষ এবং নিরন্তর প্রশান্তি অর্জন করা সম্ভব হয়।
- একান্ত ভক্তিসাধনা দ্বারা মানুষের অন্তরে যখন বিষয়ী ও বিষয় (Subject and Object) একাকার হয়ে যায়, তখনই ঈশ্বরলাভঘটে।
- সদ্গুরু শিষ্যকে নিঃস্বার্থচিন্তা ও ভালোবাসার তত্ত্ব অনুধাবন করতে সাহায্য করেন।
- বারকরী ধর্মে জাতিভেদ বা বর্ণভেদ মানা হয় না। বারকরী সাধকরা সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্ত থাকার শিক্ষা প্রচার করেন।
- ঈশ্বরজ্ঞানই হল প্রকৃত জ্ঞান এবং প্রকৃত জ্ঞান হল নৈতিকতা, শুচিতা, পবিত্রতা, অহিংসা, নম্রতা এবং বহুর মধ্যে একের প্রকাশ সম্পর্কে আত্মজ্ঞান।
- ভক্তিসাধনার পথ হিসেবে বারকরী সম্প্রদায়ও নামসংকীর্তন, স্মরণ, পদসেবন, অর্চনা, বন্দনা, দাস্যভক্তি, সখ্য, আত্মনিবেদন ইত্যাদি কর্মে জোর দিয়েছেন।
বারকরী সাধকবৃন্দ: বারকরী ধর্মদর্শনের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন জ্ঞানদেব বা জ্ঞানেশ্বর। পরবর্তীকালে নামদেব, তুকারাম, একনাথ প্রমুখের উদ্যোগে এই মতবাদ জনপ্রিয়তা পায়।
জ্ঞানদেব
ত্রয়োদশ শতকে মহারাষ্ট্রে সর্বপ্রথম ভক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন প্রখ্যাত বারকরী সাধক জ্ঞানেশ্বর বা জ্ঞানদেব (১২৭৫-১২৯৬ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি মহারাষ্ট্রের পৈঠানের কাছে গোদাবরী তীরে আপেগাঁও নামক গ্রামে এক মারাঠি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা নিবৃত্তিনাথ জ্ঞানদেবকে বারকরী আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন বলে জানা যায়।
মতবাদ: জ্ঞানদেব বলতেন যে, ভক্তির সঙ্গে জ্ঞান, কর্ম, সাধনা ও আনুগত্যের সমন্বয় ঘটলে সাধক ঈশ্বরমুখী হতে পারেন। এজন্য নির্জন সাধনার দরকার নেই। সাধক ভক্তি সহকারে মান, যশ, গর্ব, ক্রোধ ঈশ্বরের পায়ে সমর্পণ করতে পারলেই পরম শান্তির অধিকারী হতে পারেন।
রচনাসমূহ: জ্ঞানদেব ভাবার্থ দীপিকা (বা জ্ঞানেশ্বরী), অমৃতানুভব, হরিপথ নামক গ্রন্থগুলি রচনা করেছিলেন। এগুলি মারাঠি সাহিত্যের এক-একটি অমূল্য সম্পদ।
নামদেব
মারাঠি ধর্মাচার্য নামদেব (আনুমানিক ১২৭০-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন পশ্চিম ভারতে ভক্তিবাদী আন্দোলনের অন্যতম মুখ্য প্রবক্তা। নামদেব ছিলেন একজন দর্জি এবং তাঁর অধিকাংশ সঙ্গীরাও ছিলেন নিম্নকোটির মানুষ। জ্ঞানদেবের পরবর্তীতে মহারাষ্ট্রে বারকরী আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ প্রচারক ছিলেন তিনি।
ধর্মদর্শন: একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী নামদেব ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, হিন্দু-মুসলমান সকলেই অন্ধ। রাম ও রহিমে কোনও পার্থক্য নেই। ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে তিনি অমুসলিম ও মুসলিমদের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। নামদেব জাতিভেদ, মূর্তিপূজা বা ধর্মের বাহ্যিক অনুষ্ঠানের বিরোধী ছিলেন। শুচিতা, ভক্তি ও আন্তরিকতাকেই তিনি ধর্মলাভের সর্বশ্রেষ্ঠ সোপান বলে মনে করতেন। নামদেবের আন্দোলন মহারাষ্ট্রে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
একনাথ
বিশিষ্ট ভক্তিবাদী ধর্মগুরু একনাথ (১৫৩৩-১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দ) মহারাষ্ট্রের পৈঠানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সাধু ভানুদাসের প্রপৌত্র এই সাধক ছিলেন বিশিষ্ট কবি ও সন্ত জনার্দন স্বামীর শিষ্য।
ধর্মমত: একনাথ প্রচলিত সমাজবিধিকে অগ্রাহ্য করে নিজ ধর্মমত প্রচার করতেন। অস্পৃশ্যদের সঙ্গে ছিল তাঁর অবাধ মেলামেশা।
গ্রন্থসমূহ: ভাবার্থ রামায়ণ, একনাথী ভাগবত-এর মতো গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তিনি। অতীন্দ্রিয়বাদী এই সাধকের ভক্তিসংগীতগুলি মারাঠি সংস্কৃতির এক মূল্যবান সম্পদ।
তুকারাম
শুধুমাত্র মহারাষ্ট্র নয়, সম্ভবত সমগ্র ভারতে মহান ভক্তি কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন তুকারাম (১৫৯৮/ ১৬০৮-১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি মহারাষ্ট্রের পুনাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ভাবাদর্শ: তুকারাম প্রেমের মধ্য দিয়েই উপলব্ধি করেছেন অনন্ত শক্তির প্রকৃত স্বরূপকে। তাঁর ভক্তিবাদী চিন্তার মূল কথা হল, সাধারণ মানুষকে অন্ধ কুসংস্কারের পথ থেকে বের করে তাদের প্রেম ও অতীন্দ্রিয়বাদের পথে পরিচালিত করা। তুকারাম রচিত ভক্তিকাব্যগুলি আভঙ্গ নামে পরিচিত।
রামদাস
মহারাষ্ট্রের অপর বিশিষ্ট ভক্তিসাধক ছিলেন রামদাস (১৬০৮-১৬৮২ খ্রিস্টাব্দ) তিনি মহারাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন। জানা যায় যে, মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করেছিলেন। পরবর্তীতে কৃষ্ণা নদীতীরে মন্দির স্থাপন করে তিনি তাঁর মতাদর্শ প্রচারকার্যে ব্রতী হন।
মতবাদ ও কর্মজীবন: রামদাস ছিলেন রামের উপাসক। তিনি সম্ভবত ৭০০-১১০০ টির মতো মঠ নির্মাণ করেছিলেন। সাধক কবি রামদাসের প্রেমভক্তি সক্রিয় সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। তিনি মারাঠাবীর শিবাজি কর্তৃক মারাঠা জাতীয়তাবাদের সূচনা করেছিলেন।
রামদাসের রচনা: রামদাস রচিত বিখ্যাত গ্রন্থটি হল দাসবোধ। এই গ্রন্থে তিনি শিষ্যদের সংযত বাক্য, অচলা ভক্তি এবং নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের নির্দেশ দিয়েছেন।
Read More – The Model Millionaire MCQ Questions and Answers