১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি | The character and nature of the 1857 rebellion

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র (Character) বা প্রকৃতি (Nature) সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দীর্ঘ বিতর্ক আছে। সমসাময়িক ইংরেজ আমলা ও দেশি-বিদেশি ঐতিহাসিকেরা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে এই অভ্যুত্থানের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করার ফলে বিদ্রোহের প্রকৃত চরিত্র নিরূপণ করার কাজ বেশ জটিল হয়ে পড়েছে। ভারতবাসীর ব্রিটিশবিরোধী এই আন্দোলনকে ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা স্বাভাবিক কারণেই লঘু করে দেখাতে প্রয়াসী হয়েছেন। কিন্তু বহু দেশীয় ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহকে যেমন গণ আন্দোলন বা জাতীয় অভ্যুত্থান-এর মর্যাদা দিয়েছেন, তেমনই ইংরেজ লেখকদের সঙ্গে সহমত হয়ে কেউ কেউ এই বিদ্রোহকে নিছক সিপাহিদের স্বার্থরক্ষা সম্পর্কিত একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেও মন্তব্য করেছেন। একদিকে সামান্য সিপাহি বিদ্রোহ বা সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া এবং অন্যদিকে গণবিদ্রোহ বা জাতীয় অভ্যুত্থান ইত্যাদি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ও পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্যে থেকে ১৮৫৭-র বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি নিরূপণ করতে হবে আমাদের। এক্ষেত্রে আমরা ইতিহাসের পাঠক হিসেবে সমকালীন ঘটনাবলি, প্রাপ্ত তথ্যাদি এবং লেখক ও গবেষকদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি।
সিপাহি বিদ্রোহ / সামরিক বিদ্রোহ
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ প্রসঙ্গে তদানীন্তন ভারত-সচিব আর্ল স্ট্যানলি (Earl Stanley) তাঁর প্রতিবেদনে সিপাহি বিদ্রোহ (Mutiny) কথাটি প্রয়োগ করেন। বিদ্রোহের অব্যবহিত পরে ইংরেজ ঐতিহাসিক চার্লস রেকস (Charles Raikes) তাঁর Notes on the Revolt in the North-Western Provinces of India নামক গ্রন্থে ১৮৫৭খ্রিস্টাব্দের এই বিদ্রোহকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও লোভী সিপাহিদের বেআইনি অভ্যুত্থান বলে মন্তব্য করেছেন। টি আর হোমস (TR Holmes) এই বিদ্রোহকে আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে মধ্যযুগীয় বর্বরতার সংঘাত বলে নিন্দা করেছেন। পাশাপাশি স্যার জন লরেন্স (John Lawrence), চার্লস রবার্টস (Charles Roberts), স্যার জন সিলি (John Seeley) প্রমুখ ব্রিটিশ লেখক ও ঐতিহাসিকেরাও একে নিছকই একটি সামরিক বিদ্রোহ বা সিপাহিদের বিদ্রোহ ছাড়া কিছুই ভাবতে পারেননি।
অন্যদিকে একই সুরে কথা বলেছেন- অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, রাজনারায়ণ বসু, কিশোরীচাঁদ মিত্র, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দাদাভাই নৌরজি, সৈয়দ আহমেদ খান-এর মতো বিশিষ্ট ভারতীয়রাও। বাঙালি বুদ্ধিজীবী কিশোরীচাঁদ মিত্র লিখেছেন, ‘এটি ছিল একান্তই সিপাহিদের বিদ্রোহ, এখানে গণ আন্দোলনের কোনও উপাদান ছিল না।’F মারাঠি পর্যটক গডসে ভাটজী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ মনে করেন যে, সিপাহিরা নিজেদের স্বার্থেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন। এরা ছিলেন দুষ্কৃতি, মুক্তিযোদ্ধা নয়। এই আন্দোলনে গণসমর্থন আদৌ ছিল না।
সিপাহি বিদ্রোহ / সামরিক বিদ্রোহ বলার সপক্ষে যুক্তি:
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে শুধুমাত্র সিপাহি বিদ্রোহ কিংবা সামরিক বিদ্রোহ বলার পিছনে ঐতিহাসিক ও বিশিষ্টজনেরা কিছু যুক্তি দেখিয়েছেন। সেগুলি হল-
(i) সূচনা: ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর বহু ক্ষোভ জমা থাকলেও এই বিদ্রোহের মতো এত বড়ো বিদ্রোহ এর আগে কখনোই হয়নি। ভারতীয় সিপাহিরাই এই বিদ্রোহের সূচনা করেন।
(ii) বিদ্রোহের কারণ: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল সিপাহিদের অসন্তোষ। তাদের বেতন, পদমর্যাদা, পদোন্নতি, ভাতা বা অন্যান্য সুযোগসুবিধা যেমন ইউরোপীয়দের থেকে কম ছিল, তেমনই তাদের পদে পদে নেটিভ, নিগার বলে অপমানও করা হত। এ ছাড়া ধর্মীয় রীতি পালনে বাধা প্রদান তো ছিলই। সর্বোপরি সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজ সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে সিপাহিরা বিদ্রোহমুখী হয়ে পড়েন।
(iii) অংশগ্রহণ: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ঘটনায় যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল দেশীয় সিপাহিরা।
(iv) নেতৃত্ব: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রধান নেতানেত্রীরা বেসামরিক ব্যক্তি হলেও তাঁরা সিপাহিদের সমর্থন পেয়েছিলেন। সেনাছাউনি থেকে বিদ্রোহকে জনগণের মধ্যে সিপাহিরাই ছড়িয়ে দেন। সরকারি সৈন্যদের সঙ্গে সম্মুখসমরে তারাই লড়াই করেন।
(v) বিস্তার: ব্রিটিশ ভারতের যেসব সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল, সেই সকল অঞ্চলের জনগণের মধ্যেও বিদ্রোহ ছড়িয়েছিল। যেসব সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ হয়নি সেখানকার অবস্থা স্বাভাবিক ছিল।
(vi) শাস্তিভোগ: বিদ্রোহের সূচনায়, অংশগ্রহণে, নেতৃত্বে যেহেতু সিপাহিদের প্রধান ভূমিকা ছিল, তাই বিদ্রোহ শেষে সিপাহিদেরই বেশি শাস্তি ভোগ করতে হয়। এমনকি তাদের প্রাণ দিতে হয় কামানের গোলা, বন্দুকের গুলি বা ফাঁসির দড়িতে।
বিরুদ্ধ মত: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে দেশীয় সিপাহিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল- এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, সব দেশীয় সিপাহি বিদ্রোহে যোগদান করেননি। ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ দেখিয়েছেন, যত সংখ্যক সিপাহি বিদ্রোহ করেছিলেন ততোধিক সিপাহি বিদ্রোহ দমনে অংশ নিয়েছিলেন। তাছাড়া সিপাহিদের দ্বারা এই বিদ্রোহের সূচনা হলেও কালক্রমে তা দেশীয় রাজন্যবর্গ, সাধারণ কৃষক, কারিগর, দিনমজুর শ্রেণির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
গণবিদ্রোহ
বিশিষ্ট আইনবিদ ও শিক্ষাবিদ জে বি নর্টন (John Bruce Norton) তাঁর Topics for Indian Statesmen (1858) গ্রন্থে বিশেষ এক আঙ্গিকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, ১৮৫৭-র বিদ্রোহ শুধুমাত্র সিপাহি বিদ্রোহ ছিল না, এই অভ্যুত্থান একটি গণবিদ্রোহের রূপ নিয়েছিল। উইলিয়ম কে (William Kaye), ম্যালেসন (Malleson), বল (Ball) প্রমুখ নর্টনকে সমর্থন করে লিখেছেন যে, ১৮৫৭-র বিদ্রোহ প্রাথমিকভাবে সিপাহিদের বিদ্রোহ ছিল। কিন্তু ক্রমে ব্যাপক সংখ্যক সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এটিকে গণবিদ্রোহে পরিণত করে। অধ্যাপক শশীভূষণ চৌধুরীও জোরের সঙ্গে এই অভ্যুত্থানকে একটি গণবিদ্রোহ আখ্যা দিয়েছেন। প্রমোদ সেনগুপ্ত তাঁর ভারতীয় মহাবিদ্রোহ ১৮৫৭ গ্রন্থে লিখেছেন যে, অযোধ্যা, বিহার প্রভৃতি অঞ্চলে এটি গণবিদ্রোহে উন্নীত হয়। আলোচ্য পর্বে বিদ্রোহীরা গেরিলা যুদ্ধপদ্ধতি অনুসরণ করে ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করতে প্রয়াসী ছিলেন।
গণবিদ্রোহ বলার সপক্ষে যুক্তি:
যেসকল বিষয়কে ভিত্তি করে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে গণবিদ্রোহ বলা হয়েছে, সেগুলি হল-
- বিদ্রোহে ভারতের বেশকিছু অঞ্চলে জনসাধারণ সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি লখনউ, কানপুর, ঝাঁসি, বেরিলি ইত্যাদি জায়গাগুলিতে বিদ্রোহের একেবারে গোড়া থেকেই পরিচালক হিসেবে ছিলেন বেসামরিক জনগণ।
- অযোধ্যায় ১৮৫৭-র বিদ্রোহ কার্যত জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল। সাধারণ নাগরিকের পাশাপাশি চাষি, জমিদার সকলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করেছিলেন এতে। মুজফ্ফরনগর, সাহারানপুর প্রভৃতি এলাকাতে জনসাধারণই প্রথম বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে ধরেন এবং সিপাহিদের অংশগ্রহণে বাধ্য করেন।
- হোমস-এর মতে, বিদ্রোহ চলাকালীন অযোধ্যায় যে ১.৫ লক্ষ বিদ্রোহী মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তার মধ্যে সিপাহির সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৫ হাজার। রেভারেন্ড ডাফ-এর কথায়, এই বিদ্রোহ নিছক সিপাহি বিদ্রোহ নয়, এটি একটি বিপ্লব।
বিরুদ্ধ মত: ঐতিহাসিক সি এ বেইলি (C A Bayly) তাঁর Indian Society and the Making of the British Empire গ্রন্থে বলেছেন, বিদ্রোহের শুরু থেকেই বেসামরিক বিদ্রোহ বা গণবিদ্রোহ এবং সিপাহি বিদ্রোহ পরস্পরকে শক্তিশালী করেছিল। তবে এই গণবিদ্রোহের চরিত্রকে মেনে নেননি বিশিষ্টজনেরা। কিশোরীচাঁদ মিত্র, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, স্যার সৈয়দ আহমেদ খান, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ মনে করেন ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে গণ বিদ্রোহের আবশ্যিক উপাদানসমূহের একান্ত অভাব ছিল।
- অংশগ্রহণ: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে কোথাও কোথাও জনগণ সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয়ভাবে বিদ্রোহীদের সমর্থন করলেও বিদ্রোহ কবলিত এলাকার আপামর জনগণ বিদ্রোহে অংশ নেননি। নিম্নবর্গের তপশিলি জাতি-উপজাতির কৃষক, শ্রমিক, শিল্পী, কারিগর, সাধারণ মানুষ সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেননি। বরং জমিদারি থেকে বঞ্চিত কতিপয় বিক্ষুব্ধ ভূস্বামী ছাড়া সমাজের উচ্চবিত্ত কিংবা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশই বিদ্রোহীদের প্রতি বিরূপ ছিলেন। বিদ্রোহীরা অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করায় বণিক শ্রেণিও ছিল বিপক্ষে। অন্যদিকে, মধ্য গাঙ্গেয় অববাহিকার সীমিত অঞ্চলে এই বিদ্রোহের প্রসার ঘটে। ব্রিটিশ ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলই ছিল বিদ্রোহমুক্ত।
- উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য : ইংরেজ বিরোধিতা ছাড়া বিদ্রোহীদের কোনও দর্শন ছিল না। নেতাদের ঐক্য, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এমনকি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনারও নিতান্ত অভাব ছিল। বিদ্রোহ ছিল ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত, জনগণের স্বার্থ দ্বারা নয়।
তবে বিতর্ক থাকলেও বলা যায় যে, ইতিপূর্বে কখনোই কোনও বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থানে ভারতবর্ষের এত সাধারণ মানুষের সংযুক্তি ঘটেনি। এই গণ অংশগ্রহণই ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে এক অন্য মাত্রা দান করেছিল।
কৃষক বিদ্রোহ
১৮৫৭-র বিদ্রোহে কৃষকদের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ইংরেজদের ভূমি বন্দোবস্ত ও রাজস্বনীতির ফলে কৃষকরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। সারা দেশে কৃষকরা খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। গুজর ও ভূমিহীন কৃষকরা গোচারণভূমি হারানোর প্রতিবাদে, বনবাসীরা বনকর-এর বিরুদ্ধে, গ্রামীণ মোড়লরা তাদের প্রচলিত অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার প্রতিবাদে এই বিদ্রোহে যোগ দেন। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়-এর মতে, সিপাহিদের আত্মীয়রা গ্রামাঞ্চলে কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিলেন। তাই বিদ্রোহ শুরু হলে তারাও ব্রিটিশ অনুগত জমিদার, মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হন। গবেষক তালমিজ খালদুন এই বিদ্রোহকে দেশীয় সামন্ততন্ত্র ও বিদেশি সাম্রাজ্যবিরোধী কৃষক যুদ্ধ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
বিরুদ্ধ মত: তবে এই তত্ত্বও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। ঐতিহাসিক নরহরি কবিরাজ-এর মতে, ১৮৫৭-র বিদ্রোহে কৃষকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল ঠিকই, তবে এটিকে কৃষক বিদ্রোহ বলা ঠিক নয়। তাঁর মতের সমর্থন মেলে গবেষক এরিক স্টোকস (Eric Stokes)-এর বক্তব্যে। স্টোকস লিখেছেন যে, ১৮৫৭-র বিদ্রোহ এক সুরে বাঁধা ছিল না। বিভিন্ন ধারার মিলন ছিল এই অভ্যুত্থান। এখানে কৃষকদের প্রতিরোধ যেমন ছিল, তেমনই ছিল ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থের সমবেত বিদ্রোহও। তাই এককথায় একে কৃষক বিদ্রোহ বলা যুক্তিযুক্ত নয়।
সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া / সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের উদ্দেশ্য, ঘটনাপ্রবাহ, নেতৃত্ব, অংশগ্রহণ ও পরিণতির দিক থেকে বিচার করে অনেক ঐতিহাসিক ও গবেষক একে সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া বা সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ বলেছেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুরেন্দ্রনাথ সেন, বিশিষ্ট মার্কসবাদী ঐতিহাসিক রজনীপাম দত্ত বিদ্রোহের এই প্রকার চরিত্রের কথা উল্লেখ করেছেন।
সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া তথা সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ বলার সপক্ষে যুক্তি
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া বা সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ বলা যায় কি না, তার সপক্ষে গবেষকেরা বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেছেন।
- সামন্ততান্ত্রিক অসন্তোষ : ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি, যুদ্ধজয় এবং স্বত্ববিলোপ নীতির দ্বারা বহু দেশীয় রাজ্য (ঝাঁসি, উদয়পুর, করৌলী, সাতারা, জয়িতপুর, তাঞ্জোর, সুরাট) গ্রাস করে। কুশাসনের অভিযোগে দখল করে অযোধ্যা রাজ্য। শুধু তাই নয়, নাগপুর ও অযোধ্যার রাজপ্রাসাদে নির্লজ্জভাবে লুণ্ঠনও করে। এর ফলে রাজ্যহারা রাজা-রানি, জমি হারানো তালুকদার ও কৃষক, চাকুরি হারানো সৈনিকের দল- সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
- বিদ্রোহের নেতানেত্রী: সামন্ততন্ত্রের যাঁরা ধারক ও বাহক সেই দেশীয় রাজন্যবর্গ নিজেদের হৃতরাজ্য, পুরোনো পদমর্যাদা ও সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য বিদ্রোহের মশাল নিজেদের হাতে তুলে নিতে চেয়েছিলেন। সুতরাং, বিদ্রোহে সিপাহিরা প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করলেও কানপুরে নানাসাহেব, ঝাঁসির লক্ষ্মীবাঈ, বিহারের জমিদার কুনওয়ার সিং, অযোধ্যার হজরত মহল প্রমুখ দেশীয় সামন্ত ও শাসকবৃন্দই হয়ে উঠেছিলেন প্রধান মুখ।
এই সকল কারণে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার এই ঘটনাকে ক্ষয়িষু অভিজাত ও মৃতপ্রায় সামন্তদের মৃত্যুকালীন আর্তনাদ বলে অভিহিত করেছেন। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুও এই বিদ্রোহকে প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন তাঁর Eighteen Fifty-Seven গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের নেতাদের লক্ষ্য ছিল প্রতিবিপ্লব। জুডিথ ব্রাউন (Judith Brown), এরিক স্টোকস-এর কাছে ১৮৫৭-র বিদ্রোহ ছিল মূলত সামন্তশ্রেণির নেতৃত্বে সংঘটিত উচ্চকোটির মানুষের বিদ্রোহ। আবার রজনীপাম দত্ত এবং তালমিজ খালদুন-এর মতে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা ছিল জমি হস্তান্তর ও শ্রেণিসংঘাতের প্রতিক্রিয়ার ফল।
বিপক্ষে যুক্তি: সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া বা সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ তত্ত্বটি সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য নয়। অধ্যাপক সুশোভন সরকার-এর মতানুযায়ী নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ, হজরত মহল প্রমুখ সামন্ত-জমিদার ও তালুকদারদের হাতে বিদ্রোহের নেতৃত্ব ছিল বলে এই নয় যে তাকে সামন্ত বিদ্রোহ বলে আখ্যা দেওয়া যাবে। তাঁর বক্তব্য অনুসারে, সামন্তব্যবস্থার স্তম্ভস্বরূপ দেশীয় রাজন্যবর্গ বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেননি, বরং অযোধ্যার বাইরে জমিদারদের বৃহৎ অংশই ইংরেজদের পক্ষে ছিলেন। তাই এই বিদ্রোহকে কোনোভাবেই সামন্ত বিদ্রোহ বলা যুক্তিযুক্ত নয়।
জাতীয় সংগ্রাম বা অভ্যুত্থান
ভারতের ইতিহাসে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের স্বরূপ বা প্রকৃতিকে বিদগ্ধ পণ্ডিতবর্গ ও ঐতিহাসিকগণ বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ নির্দিষ্ট যুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে একে জাতীয় সংগ্রাম বা জাতীয় অভ্যুত্থান হিসেবে দেখেছেন।
ইংল্যান্ডের টোরি দলের নেতা ডিজরেইলি (Disraeli) ১৮৫৭খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে এই বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি পার্লামেন্টে বলেছিলেন যে, ‘এটি কোনও সিপাহিদের সাধারণ অভ্যুত্থান নয়, এটি আসলে একটি জাতীয় আন্দোলন, যেখানে সিপাহিরা হাতিয়ারমাত্র। পাশাপাশি কার্ল মার্কস (Karl Marx) New York Tribune পত্রিকায় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম জাতীয় বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘যাকে ব্রিটিশ সরকার সামরিক বিদ্রোহ ভাবছে, আসলে তা একটি জাতীয় বিদ্রোহ।’ ফ্রেডরিক এঙ্গেলস (Friedrich Engels)-ও এই বক্তব্যে সহমত পোষণ করেছেন।
জাতীয় সংগ্রাম’ বলার পক্ষে যুক্তি:
- জনগণের অংশগ্রহণ: অধ্যাপক সুশোভন সরকার বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বলেছেন, কোনও দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কখনোই সেই দেশের আপামর জনগণ অংশগ্রহণ করেন না, উদ্দেশ্যের নিরিখে সেই ঘটনাকে বিচার করতে হয়। তাই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ঘটনাকে তিনি জাতীয় সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন।
অন্যদিকে সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন, শত বছরের শোষণে জর্জরিত ভূমিহীন ও গৃহহীন কৃষক এবং জনসাধারণ যে সংগ্রামের মূল শক্তি তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা উদ্দেশ্যমূলক। তিনি আরও বলেন, কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনের চেয়ে ১৮৫৭খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে কৃষকদের যোগদান ছিল বেশি। তাই একে জাতীয় বিদ্রোহ না বলার কোনও যুক্তি নেই।
- নিম্নবর্গের মানুষের যোগদান: অধ্যাপক রণজিৎ গুহ বিদ্রোহে নিম্নবর্গের মানুষদের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানের কথা বলেছেন। ড. শশীভূষণ চৌধুরী বিদ্রোহে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, স্থায়িত্বে, ব্যাপকতায়, অভিনবত্বে এই বিদ্রোহ আগের বিদ্রোহগুলিকে অতিক্রম করে যায়।
- ঘোষণাসমূহ: সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের দিল্লি ঘোষণা, আজমগড় ঘোষণায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এবং ইংরেজ বিতাড়নের আহ্বান ছিল। বিরজিস কাদির-এর ইস্তাহারে ইংরেজমুক্ত ভারত গঠনের কথা বলা হয়।
বিরুদ্ধ মত: ঐতিহাসিক টমাস মেটক্যাফ (Thomas R Metcalf) তাঁর The Aftermath of Revolt, India 1857-1870 গ্রন্থটিতে দেখান যে, এই বিদ্রোহ কোনও কোনও সময় সিপাহি বিদ্রোহকে ছাপিয়ে গেছে, কিন্তু জাতীয় বিদ্রোহের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। পাশাপাশি ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুরেন্দ্রনাথ সেন-ও ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে জাতীয় চরিত্রদানে অসম্মত হয়েছেন। এ ছাড়া সি এ বেইলি বলেছেন যে, বিদ্রোহে গ্রাম-শহরের নানা স্তরের মানুষ যোগ দিয়েছিলেন একথা ঠিক, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্বতন্ত্র। এমনকি তারা নিজেদের মধ্যে অন্তর্বিরোধেও লিপ্ত ছিলেন।
তবে বিরুদ্ধ মত সত্ত্বেও এটা অস্বীকার করা যায় না যে, এই বিদ্রোহ ভারতে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রথম বৃহত্তম অভ্যুত্থান। সুশোভন সরকার মন্তব্য করেছেন, ‘যাঁরা মারাঠা ও রাজপুত জাতীয়তাবাদের প্রতি গৌরবান্বিত, তাঁরা কেন ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে জাতীয় আন্দোলন বলতে দ্বিধাগ্রস্ত, তা বুদ্ধির অগম্য।’
প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ
বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর The Indian War of Independence, 1857 গ্রন্থে
১৮৫৭-র বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ। বলে উল্লেখ করেছেন। তবে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা যায় কি না, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।
সপক্ষে যুক্তি: সাভারকরের মত সমর্থন করেছেন অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক সুশোভন সরকার, পি সি যোশি প্রমুখ। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত অভ্যুত্থানের মধ্যে স্বাধীনতার যুদ্ধের ছবি প্রত্যক্ষ করেন। অধ্যাপক সুশোভন সরকার এই যুক্তি দিয়েছেন যে, ইটালির কার্বোনারি এবং নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে স্পেনীয় জুন্টা আন্দোলনকে যদি মুক্তিযুদ্ধ বলা যায়, তাহলে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকেও ভারতের মুক্তিযুদ্ধ বা জাতীয় আন্দোলন বলা যাবে। পি সি যোশিও তাঁর 1857 in Our History প্রবন্ধে ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলেছেন।
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে, সাভারকর ইংরেজ ঐতিহাসিকদের কিছু মন্তব্য থেকে ১৮৫৭-র বিদ্রোহ সম্পর্কে এমনতর সিন্ধান্তে পৌঁছেছেন। জাস্টিন ম্যাকার্থি (Justin H McCarthy) তাঁর A History of Our Own Times গ্রন্থে লিখেছেন যে, একসময় সিপাহিদের বিদ্রোহ জাতীয় ও ধর্মযুদ্ধ-এ রূপান্তরিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক হোয়াইট (SD White) তাঁর Complete History of বইয়ে ১৮৫৭-র বিদ্রোহে অযোধ্যার তালুকদারদের যোগদানকে স্বরাজ ও স্বদেশের জন্য লড়াই বলেছেন।
বিপক্ষে যুক্তি: সুরেন্দ্রনাথ সেন, রমেশচন্দ্র মজুমদার-সহ বেশকিছু ঐতিহাসিক ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধ বলতে নারাজ। রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর History of the Freedom Movement in India (Vol. I) গ্রন্থে বলেছেন যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত তথাকথিত প্রথম জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ – না তো প্রথম, না জাতীয়, এমনকি স্বাধীনতা সংগ্রামও নয়। এর সপক্ষে তিনি যে সমস্ত যুক্তি দিয়েছেন, সেগুলি হল-
- এই বিদ্রোহে ভারতের সকল জনগণ যোগ দেননি। কেবলমাত্র কয়েকটি ক্ষুদ্র অঞ্চলের মধ্যে বিদ্রোহ সীমাবদ্ধ ছিল।
- ১৮৫৭-র বিদ্রোহ দমনে ভারতের বেশ কয়েকজন নৃপতি ইংরেজদের সাহায্য করেছিলেন। এমনকি গোর্খা ও শিখ সৈনিকেরাও ইংরেজদের পক্ষে ছিলেন। পাঞ্জাব, সিধু প্রদেশ এবং রাজপুতানায় এই বিদ্রোহের বিন্দুমাত্র স্ফুরণ ঘটেনি। দাক্ষিণাত্য ও বাংলার শিক্ষিত জনসমাজও বিদ্রোহ থেকে দূরেই ছিলেন। বলতে গেলে শুধুমাত্র অযোধ্যাতেই বিদ্রোহ জাতীয় রূপ ধারণ করে।
- দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের সম্রাট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ শিখ, রাজপুত ও মারাঠাদের ক্ষুব্ধ করে।
- ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্য স্থির ছিল না। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, লক্ষ্মীবাঈ, নানাসাহেব প্রমুখ নেতৃবর্গ নিজ নিজ স্বার্থ দ্বারাই অনুপ্রাণিত ছিলেন।
- সর্বোপরি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষই ঘটেনি। কাজেই এই বিদ্রোহকে যদি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা হয়, তাহলে পূর্ববর্তী সাঁওতাল বিদ্রোহ, ওয়াহাবি আন্দোলনকেও সমমর্যাদা দান করা উচিত। রমেশচন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে অনেকাংশে সহমত পোষণ করেছেন সুরেন্দ্রনাথ সেনও। তবে আচার্য শশীভূষণ চৌধুরী অবশ্য তাঁর English Historical Writings on the Indian Mutiny 1857-1859 গ্রন্থে একটু অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে বলেছেন যে, ঐতিহাসিক হিসেবে সাভারকরের কিছু দুর্বলতা থাকলেও তিনি আসলে এর মাধ্যমে ভারতবাসীকে দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরুর জন্য উৎসাহিত করতে চেয়েছিলেন।F
মূল্যায়ন: এমন বিচিত্র, বহুমুখী ও পরস্পরবিরোধী অভিমতের প্রেক্ষিতে ১৮৫৭-র বিদ্রোহের চরিত্র নির্দিষ্ট করার কাজ বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এত বড়ো একটি আন্দোলনের একমাত্রিক সংজ্ঞা দেওয়া অবশ্যই ইতিহাসসম্মত হবে না। একথা সত্য যে, ১৮৫৭-র বিদ্রোহ যেমন শুধুমাত্র সিপাহিদের স্বার্থপূরণের আন্দোলন ছিল না, তেমনই একে জাতীয় আন্দোলন বা স্বাধীনতার যুদ্ধ বলাও সঠিক নয়।
ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার দেখিয়েছেন যে, তিন শ্রেণির মানুষ এই বিদ্রোহে যুক্ত হয়েছিলেন- সিপাহি, ভূস্বামী ও সাধারণ জনতা। সিপাহিদের লক্ষ্য ছিল পেশাগত বৈষম্য দূর করা এবং তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য ছিল ধর্মনাশ থেকে বাঁচা। ভূস্বামী শ্রেণি অর্থাৎ সামন্তপ্রভু, জমিদার, তালুকদার প্রমুখ ইংরেজদের ভূমিসংস্কার আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। তাঁরা সিপাহিদের আন্দোলনকে সামনে রেখে ভৌমিক সুবিধা আদায় করতে আগ্রহী ছিলেন। আর সাধারণ মানুষ, কৃষক প্রমুখ ভূস্বামীদের প্ররোচনায় আন্দোলনে যোগ দেন। অর্থাৎ, কোনও শ্রেণির ক্ষেত্রেই জাতীয় স্বার্থচিন্তা সক্রিয় ছিল না।
তবে নানা ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও ১৮৫৭-র বিদ্রোহের গণচরিত্রকে অস্বীকার করা যায় না। সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষের যোগদান একে এক জাতীয় চরিত্র দান করেছিল। আর এই বিদ্রোহ যে ভাবীকালের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি তৈরিতে সহায়তা করেছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরো পড়ুন : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের মনোভাব কেমন ছিল