১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের কারণগুলি আলোচনা করো | Causes of the Great Revolt of 1857

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের কারণগুলি আলোচনা করো | Causes of the Great Revolt of 1857

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের কারণগুলি আলোচনা করো
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের কারণগুলি আলোচনা করো

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের মূলশক্তি ছিল সিপাহিরা। তবে এদের পাশাপাশি দেশীয় রাজন্যবর্গও কিন্তু নেতৃত্বদানকারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণবশত এদেশের রাজশক্তির মনে ব্যাপক ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল।

রাজনৈতিক কারণ

(i) সাম্রাজ্যবাদী নীতি: ১৭৫৭-১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ -এই সময়পর্বে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। রবার্ট ক্লাইভ (Robert Clive), ওয়ারেন হেস্টিংস (Warren Hastings)-দের সুযোগ্য উত্তরসূরি লর্ড কর্নওয়ালিস (Lord Cornwallis), লর্ড ওয়েলেসলি (Lord Wellesely) ও লর্ড ডালহৌসি (Lord Dalhousie)-র ঘোরতর সাম্রাজ্যবাদী নীতির কবলে পড়ে একের পর এক দেশীয় রাজ্যগুলি চলে যায় ব্রিটিশ শক্তির অধীনে। ছলে-বলে-কৌশলে ইংরেজদের এই রাজ্যগ্রাস নীতি ভারতীয় রাজন্যদের ক্ষুব্ধ করেছিল।

(ii) অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি: সাম্রাজ্যবাদী গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি (১৭৯৮-১৮০৫ খ্রি.) অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি (১৭৯৮ খ্রি.) প্রয়োগ করে ভারতীয় রাজন্যবর্গকে। ইংরেজদের অধীনস্থ প্রজায় পরিণত করতে উদ্যোগী হন। তাঁর এইরূপ নগ্ন সাম্রাজ্যবাদের জালে জড়িয়ে একে একে হায়দরাবাদ, অযোধ্যা, মারাঠাশক্তি ব্রিটিশদের পদানত হতে থাকে।

(iii) স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ: লর্ড ডালহৌসি (১৮৪৮-১৮৫৬ খ্রি.) শাসকরূপে ভারতে এসে দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতি যে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তারই অন্যতম হাতিয়ার হল স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ। এই নীতি অনুসারে স্থির হয়, যদি ব্রিটিশ-সৃষ্ট কোনও রাজ্যের রাজা অপুত্রক অবস্থায় মারা যান, তাহলে সেই রাজ্য সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অঙ্গীভূত হবে। ব্রিটিশ-সৃষ্ট রাজ্যে দত্তক পুত্রের উত্তরাধিকার স্বীকার করা হবে না। পাশাপাশি, কোম্পানির করদ বা আশ্রিত রাজ্যের অপুত্রক কোনও শাসকও যদি দত্তক গ্রহণ করতে চান, তাহলে তাঁকে অতি অবশ্যই কোম্পানির পূর্ব অনুমতি নিতে হবে। তা না হলে দত্তক পুত্রের উত্তরাধিকার তো স্বীকৃত হবেই না, উপরন্তু ওই রাজ্য ইংরেজ কোম্পানির প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে চলে যাবে। ডালহৌসির এই স্বত্ববিলোপ নীতির কবলে পড়ে সাতারা, ঝাঁসি, তাঞ্জোর, নাগপুর, সম্বলপুর, উদয়পুর ইত্যাদি দেশীয় রাজ্য স্বাধীনতা হারিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। স্বাভাবিকভাবেই স্বত্ববিলোপ নীতি রাজ্যচ্যুত রাজন্যবর্গের মনে ব্রিটিশদের প্রতি যে ঘৃণা ও রাজনৈতিক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল, তার প্রতিক্রিয়ায় তাঁরা নিজেদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশায় ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে সচেষ্ট হন। আর শুধু তাই নয়, কোম্পানি এর দ্বারা ভারতে দীর্ঘকাল যাবৎ প্রচলিত দত্তকপুত্র গ্রহণের সামাজিক রীতিকে নস্যাৎ করে রাজপরিবারগুলির উপর নির্ভরশীল সাধারণ মানুষেরও ক্ষোভের মুখে পড়ে সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। স্বাভাবিকভাবেই স্বত্ববিলোপ নীতি রাজ্যচ্যুত রাজন্যবর্গের মনে ব্রিটিশদের প্রতি যে ঘৃণা ও রাজনৈতিক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল, তার প্রতিক্রিয়ায় তাঁরা নিজেদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশায় ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে সচেষ্ট হন। আর শুধু তাই নয়, কোম্পানি এর দ্বারা ভারতে দীর্ঘকাল যাবৎ প্রচলিত দত্তকপুত্র গ্রহণের সামাজিক রীতিকে নস্যাৎ করে রাজপরিবারগুলির উপর নির্ভরশীল সাধারণ মানুষেরও ক্ষোভের মুখে পড়ে।

(iv) ভাতাবন্ধ: ডালহৌসি এরপর স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে কর্ণাটকের নবাবপদ বাতিল করেন। অন্যদিকে ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে পেশওয়া দ্বিতীয় বাজিরাও মারা গেলে তাঁর দত্তকপুত্র হিসেবে নানাসাহেব উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার সম্পত্তির অধিকার এবং বার্ষিক ৮ লক্ষ টাকা ভাতা পাওয়ার জন্য কোম্পানির কাছে আবেদন করেন। কিন্তু ডালহৌসি এই আবেদন নাকচ করেন এবং পেশওয়া পদ লোপ করে নীতিহীন রাজনীতির পরিচয় দেন। উল্লেখ্য যে, এই কাজের জন্য ডালহৌসিকে ঘোরতর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। ঐতিহাসিক জন কে (John Kaye)-র মতে, ডালহৌসির আচরণ ছিল খুবই কর্কশ ও কঠোর। আবার এডুইন আর্নল্ড (Edwin Arnold)-এর কাছে এটি ছিল ইংরেজদের স্বার্থলোলুপতার পরিচায়ক। এ ছাড়া মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ডালহৌসি সপরিবারে প্রাসাদ থেকে বহিষ্কার করে কুতুবে স্থানান্তরিত করেন। তাঁর উপাধিও বাতিল করা হয়। বলাবাহুল্য, এই হীন আচরণ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সাধারণ ভারতবাসীকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।

(v) কুশাসনের অজুহাতে রাজ্যদখল: গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপের চূড়ান্ত নিদর্শন হল কুশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা দখল। এর দ্বারা তিনি কোম্পানির বিশ্বাসযোগ্যতার মূলে আঘাত করেছিলেন। কারণ- অযোধ্যা ছিল একান্তভাবে ব্রিটিশ অনুগত একটি রাজ্য। কোম্পানির বেঙ্গল আর্মির অধিকাংশ সিপাহি ছিলেন অযোধ্যার অধিবাসী। ইতিপূর্বে যদিও অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি অনুসারে অযোধ্যা (১৮০১ খ্রি.) ইংরেজদের উপর নির্ভরশীল রাজ্যে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু ডালহৌসির আমলে রেসিডেন্ট আউট্রাম (Outram) ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে অযোধ্যাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত বলে ঘোষণা করেন। ওই বছরেই অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে প্রেরণ করা হয় কলকাতায়। অযোধ্যা দখলের পর সেখানকার তালুকদারদেরও অস্ত্রহীন করা হয় এবং ধ্বংস করা হয় দুর্গগুলি। অযোধ্যা জয়ের এই ঘটনা অযোধ্যার জমিদার, মুসলমান, অভিজাত শ্রেণি, ব্যবসায়ী, সেনাবাহিনী ও কৃষকদের মনে জন্ম দিয়েছিল ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষ।

(vi) নির্বিচারে লুণ্ঠন: শুধু রাজ্য দখলই নয়, ডালহৌসির শাসনকালে নির্বিচারে নাগপুর ও অযোধ্যার রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠন করা হয়। সেখানকার আসবাবপত্র, অলংকার, মণিমুক্তো তো বটেই এমনকি লুণ্ঠনের হাত থেকে বাদ যায়নি হাতি, ঘোড়াও। লুণ্ঠনের মালপত্র কলকাতায় প্রকাশ্যে বিক্রিও করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক জন কে-এর ভাষায়, এই লুঠতরাজ, লুঠের মাল বিক্রি শুধু বেরারেই (নাগপুর ছিল কেন্দ্রীয় প্রদেশ ও বেরারের রাজধানী) নয়, এর সন্নিহিত প্রদেশগুলিতেও অধিকতর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল।

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন যে, অযোধ্যার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্তির প্রতিক্রিয়া অযোধ্যা ছাড়িয়ে ভারতের অন্যান্য রাজন্যবর্গের মধ্যেও তীব্রভাবে দেখা গিয়েছিল। দেশীয় নৃপতিবর্গের কাছে এই সংকেত পৌঁছেছিল যে, কোম্পানির অনুগত থেকে সর্বস্ব হারানোর চেয়ে লড়াই করে মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষার প্রয়াসই অধিক শ্রেয়।

অর্থনৈতিক কারণ

১৮৫৭-র বিদ্রোহের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল কোম্পানির অর্থনীতির বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শোষণ ও লুণ্ঠন ভারতীয়দের বিদ্রোহী হতে বাধ্য করে। অধ্যাপক শশীভূষণ চৌধুরীর মতে, জমিসংক্রান্ত স্বার্থ ও অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ায় সাধারণ ভারতীয়রা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে লিপ্ত হয়েছিলেন।

(i) সম্পদ লুণ্ঠন: ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মূল লক্ষ্যই ছিল ভারতবাসীর উপর অর্থনৈতিক শোষণ চালিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধশালী করে তোলা। পলাশির যুদ্ধের পর থেকে পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর ধরে কোম্পানি ও তার অর্থলোলুপ রাজকর্মচারীরা নির্লজ্জভাবে এদেশ থেকে প্রচুর সোনারুপো ইংল্যান্ডে পাচার করতে থাকেন। ফলে ভারতের অর্থনীতি ধসে পড়ে। কার্ল মার্কস (Karl Marx) তাঁর দাস ক্যাপিটাল (Das Kapital) গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে উল্লেখ করেছেন যে, ১৭৫৭-১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে শুধুমাত্র উপহার বাবদ ৬ মিলিয়ন পাউন্ড ভারত থেকে বাইরে চালান করে দেওয়া হয়। উপঢৌকন ও উৎকোচের মাধ্যমে জলের মতো অর্থের এই নির্গমনকেই দাদাভাই নৌরজি এবং রমেশচন্দ্র দত্ত Drain of Wealth বলে উল্লেখ করেছেন।

(ii) কোম্পানির বাণিজ্যনীতি এবং দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়: কোম্পানির বাণিজ্যনীতি দেশীয় বণিক ও কারিগরদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। দেশীয় শিল্পপণ্যের (প্রধানত সুতিবস্ত্র) রফতানি কমিয়ে এবং ব্রিটেনের কারখানায় প্রস্তুত পণ্যের আমদানি বাড়িয়ে সরকার বিদেশি পণ্যে ভারতের বাজার ভরিয়ে দেয়। কিন্তু অন্যদিকে ভারতের রফতানি করা পণ্যের উপর ব্রিটিশ সরকার চড়া হারে আমদানি শুল্ক চাপায়। পাশাপাশি ভারতে আমদানি করা শিল্পপণ্যের উপরও আমদানি শুল্ক অনেকটাই শিথিল করে দেয়। ফলে ভারতের শিল্পপণ্য অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। ভারত মূলত পরিণত হয় ইংল্যান্ডের (ম্যাঞ্চেস্টার ও ল্যাঙ্কাশায়ার) শিল্পক্ষেত্রে কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশে। ভারতে সুতিশিল্পে নিযুক্ত প্রায় দশ হাজার মানুষ, যার মধ্যে অসংখ্য তাঁতি, সুতা কাটুনি ও রঞ্জক ছিলেন, তারা অনাহারে মৃত্যুমুখে পতিত হন। ফলে দারিদ্র্যপীড়িত বণিক, কারিগররা ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে শামিল হন।

(iii) কোম্পানির ভূমিরাজস্ব নীতি: ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অধিক পরিমাণে রাজস্ব আদায়ের জন্য বিভিন্ন প্রকার ভূমিরাজস্ব নীতি চালু করে। চিরস্থায়ী, রায়তওয়ারি, মহলওয়ারি- প্রতিটি ভূমি বন্দোবস্ত গ্রামীণ সমাজকে সরাসরি আঘাত করে। বস্তুত, এই সকল ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার একটি সাধারণ (Common) বৈশিষ্ট্যই ছিল কৃষকদের উপর চড়া রাজস্বের চাপ। চিরস্থায়ী ব্যবস্থা যেমন জমিদার ও তালুকদার কর্তৃক অবাধ কৃষক শোষণের পথ উন্মুক্ত করেছিল, তেমনই রায়তওয়ারি বা মহলওয়ারি ব্যবস্থাতেও অতিরিক্ত রাজস্বের চাপ কৃষিজীবী শ্রেণির নাভিশ্বাস তোলে। একটি পরিসংখ্যান মতে, মাদ্রাজে রায়তওয়ারি ব্যবস্থার ফলে ভূমিরাজস্বের পরিমাণ প্রায় ৩০-৪০ গুণ বেড়ে গিয়েছিল।

আবার বকেয়া রাজস্ব বা ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ কৃষকদের জমি নিলামে বিক্রির নিয়ম চালু হলে বহু কৃষক জমিহারা কৃষিমজুরে পরিণত হন। অন্যদিকে মহাজন ও বেনিয়া (বণিক) শ্রেণি নিলামের ফলে পরিণত হয় জমির মালিকে।

(iv) মহাজন ও নীলকরদের শোষণ: কোম্পানির রাজস্ব ব্যবস্থার ফলে মহাজন শ্রেণির উদ্ভব ও তাদের শোষণ কৃষকদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। চড়া রাজস্বের বোঝা সামাল দিতে কৃষকেরা জমি বন্ধক রেখে মহাজনের কাছে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হন। ফলে ঋণের দায়ে কৃষকদের আর্থিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। এ ছাড়া কৃষকেরা নীলকর সাহেবদের দ্বারাও নির্যাতিত হতেন, যা তাদের গভীর রোষানলে পতিত করে। গবেষক প্রমোদ সেনগুপ্ত, এরিক স্টোকস, তালমিজ খালদুন প্রমুখ ১৮৫৭খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে কৃষকদের ব্যাপক অংশগ্রহণের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

(v) অতিরিক্ত কর আরোপ: ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ সেন তাঁর Eighteen Fifty-Seven গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য, বাড়িঘর, খেয়াঘাট, যানবাহন, গোচারণ ভূমি, বনাঞ্চল, পথঘাট ইত্যাদি ক্ষেত্রে কর আরোপ করে জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল।

(vi) জমিদার শ্রেণির সংকট: কোম্পানি প্রবর্তিত ভূমিরাজস্ব নীতি কেবল কৃষক সমাজকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল এদেশের জমিদারদেরও। সূর্যাস্ত আইন অনুসারে, জমিদারদের বছরের নির্দিষ্ট দিনে সূর্য ডোবার আগে সরকারি কোশাগারে রাজস্ব জমা দিতে হত। তা জমা দিতে না পারলে জমিদারি হাতছাড়া হয়ে যেত। অন্যদিকে, লর্ড বেন্টিঙ্কের (William Bentinck) ভূমিসংস্কার নীতির প্রভাবেও বহু বনেদি জমিদার বংশ জমিদারি থেকে বঞ্চিত হয়। আবার ডালহৌসি কর্তৃক নিযুক্ত ইনাম কমিশন বোম্বাই প্রেসিডেন্সির প্রায় ২০,০০০ জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল। মাদ্রাজের উত্তর সরকার অঞ্চলেও নতুন প্রবর্তিত ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার কবলে পড়ে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল জমিদার শ্রেণি।

(vii) অযোধ্যার উপর অন্যায়: অযোধ্যা দখল করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেখানে নতুন ভূমি বন্দোবস্ত চালু করে। ফলে করের বোঝা অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। এতে সিপাহি-সহ সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হয়। উপরন্তু অযোধ্যার মুখ্য কমিশনার কোলভিল কোভারলি জ্যাকসন (Colville Coverly Jackson) সাহেবের উদ্ধত আচরণ ও সহানুভূতিহীন মনোভাব সেখানকার তালুকদার ও কৃষকদের চরম দুর্দশার মুখে ফেলে দিয়েছিল। বহু প্রতিষ্ঠিত তালুকদার তাদের সামাজিক প্রতিপত্তি ও জমির উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য হন। অধ্যাপক রুদ্রাংশু মুখার্জি তাঁর Awadh in Revolt, 1857-1858: A Study of Popular Resistance গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ছোটো এবং বড়ো উভয় তালুকদাররাই ১৮৫৭খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়েছিলেন।

(viii) সিপাহিদের ক্ষোভ: বেঙ্গল আর্মি-র সিপাহিরা প্রায় সবাই ছিলেন বংশানুক্রমিকভাবে কৃষিজীবী মানুষ। কোম্পানির ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা তাদের উপরেও প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। জনৈক ঐতিহাসিকের ভাষায়- এরা ছিলেন উর্দিপরা কৃষক। স্বভাবতই সাধারণ ভূমিনির্ভর মানুষ ও সিপাহিদের ক্ষোভ মিলিত হয়ে বিদ্রোহে রূপান্তরিত হয়। ঐতিহাসিক কে এম পানিক্কর মনে করেন যে, সরকার গ্রামীণ কৃষকদের চিরাচরিত অধিকারে হস্তক্ষেপ করে গোটা কৃষকসমাজকে বিদ্রোহী সিপাহিদের অনুগামী হতে বাধ্য করেছিল। এমনকি কোম্পানির পরিচালক সভা (Board of Directors) ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং (Lord Canning)-কে লেখা একটি চিঠিতে (১৯ এপ্রিল, ১৮৫৮ খ্রি.) জানিয়েছিল যে, কোম্পানির অযোধ্যা নীতির প্রতিক্রিয়াতেই উক্ত অঞ্চলে মানুষের ক্ষোভগণবিদ্রোহের রূপ নিয়েছে।

(ix) জীবিকাচ্যুত কর্মচারীদের অসন্তোষ: ইংরেজ কোম্পানি দেশীয় রাজাদের রাজ্য গ্রাস করলে সেই রাজার অনুগত সৈন্য ও কর্মচারীরা কর্মচ্যুত হত। গবেষক জন কে-র বক্তব্য অনুযায়ী, জীবিকাচ্যুত কর্মচারীদের অবস্থা এতটাই করুণ হয়ে গিয়েছিল যে, মূল্যবান আসবাবপত্র, অলংকার বিক্রি করার পরও যখন তাদের হাতে অর্থ থাকত না, তখন এইসব অভিজাত পরিবারের মহিলারা রাতের অন্ধকারে ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য হতেন। তাছাড়া দেশীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে শিল্প, স্থাপত্য, সাহিত্য প্রভৃতির বিকাশও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এইভাবে নানা অর্থনৈতিক ক্ষোভ ভারতীয় সমাজের এই সকল ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণিকে বিদ্রোহে উদ্দীপিত করেছিল।

সামাজিক কারণ

বিভিন্ন সামাজিক কারণেও ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল।

(i) সামাজিক বৈষম্য ও ইংরেজদের দুর্ব্যবহার: ভারতবাসীর প্রতি ইংরেজদের মনোভাব ও আচরণ ছিল বিজেতাসুলভ। ভারতীয়দের তারা অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। সিয়ার-উল-মুতাখরিন (আনুমানিক ১৭৮০ খ্রি.) গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, ইংরেজরা ইচ্ছা করে ভারতীয়দের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতেন। ব্রিটিশদের রেস্তোরাঁ, পার্ক, হোটেল, ক্লাব প্রভৃতি স্থানে ভারতীয়দের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। এমনকি অনেক জায়গায় লেখা থাকত কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ (Dogs and Indians are not allowed)। শ্বেতাঙ্গ ইংরেজগণ ব্যঙ্গ করে ভারতীয়দের নিগার, নেটিভ, অসভ্য-বর্বর ইত্যাদি ভাষায় সম্বোধন করতেন। স্যার সৈয়দ আহমেদ খান-এর লেখা থেকে জানা যায় যে, ইংরেজ রাজকর্মচারীদের সঙ্গে কোনও কারণে দেখা করতে গেলে সম্ভ্রান্ত ভারতীয়রাও ভয় পেতেন।F ব্রিটিশদের এহেন তাচ্ছিল্য এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ভারতীয়দের ব্যথিত করে। ফলে শাসক ও শাসিতের মধ্যে একটা সামাজিক ব্যবধান গড়ে ওঠে। স্যার রিচার্ড টেম্পল (Sir Richard Temple, 1st Baronet)-এর ভাষায়, ভারতীয় জনগণের সঙ্গে ইংরেজদের এই ব্যবধান ছিল ক্রমবর্ধমান।

(ii) ইংরেজ রাজকর্মচারীদের মনোভাব: ইংরেজরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মনে করতেন। কর্মক্ষেত্রেও ঘটত তার প্রতিফলন। ঔপনিবেশিক ভারতে সকল সরকারি উচ্চপদে পরিকল্পিতভাবে ভারতীয়দের নিয়োগ বাতিল করা হত। স্বয়ং গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসের ধারণা ছিল যে, সকল ভারতীয় দুর্নীতিগ্রস্ত। এজন্য তিনি সরকারি উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছিলেন। এই নীতি লর্ড বেন্টিষ্কের সময় পর্যন্ত কার্যকর ছিল।

(iii) সংস্কৃতির উপর আঘাত: ভারতে কোম্পানির শাসন প্রবর্তিত হওয়ার সময় থেকেই ইংরেজরা ভারতীয়দের আচার-আচরণ ও সামাজিক রীতিনীতিকে ঘৃণা করতেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয়রাও ইংরেজদের সংস্কারমূলক কার্যাবলিকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। তারা মনে করতেন যে, ইংরেজদের এসমস্ত কাজের পিছনে দুরভিসন্ধি আছে। এই সমস্ত কার্যাবলি ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। ফলে সতীদাহ ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবা বিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ-এর পক্ষে ইংরেজ সরকার আইন পাস করলে ভারতীয় সমাজ ক্ষুধ হয়ে ওঠে।

(iv) ধর্মনাশের গুজব: গণ অভ্যুত্থানের পিছনে গুজবেরও একটা ভূমিকা ছিল। ১৮৫৭-র গোড়ার দিকে উত্তর ভারতে গুজব রটে যে, ইংরেজ সরকার হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মনাশের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই লক্ষ্যে সরকার আটার সঙ্গে গোরু ও শূকরের হাড়ের গুঁড়ো মিশিয়ে দিচ্ছে এবং সেনাছাউনি ও শহরের বাজারগুলিতে তা বিক্রি করছে। এই দুই প্রাণী খাদ্যদ্রব্য হিসেবে যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মে নিষিদ্ধ ছিল। তাই এটিকে সাধারণ ভারতবাসী ধর্মনাশের অশুভ উদ্দেশ্য বলেই মনে করতে থাকে এবং এহেন অপপ্রয়াসের প্রতিবাদে তারা বিদ্রোহে লিপ্ত হন।

সুতরাং, এটা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, এক অশান্ত সামাজিক পটভূমিকায় ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব নিয়ে এক তীব্র প্রতিবাদের তাগিদ অনুভব করেন। এই তাগিদ থেকেই জন্ম হয়েছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের।

ধর্মীয় কারণ

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড ক্যানিং-এর শাসনকালে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল অভূতপূর্ব এক বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল সিপাহি ও অন্যান্য ভারতীয়দের ধর্মনাশের আশঙ্কাজনিত ক্ষোভ।

(i) খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টা: ভারতে আগত খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ ভারতীয়দের শঙ্কিত করেছিল। খ্রিস্টান মিশনারিরা দরিদ্র ভারতীয়দের খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের জন্য প্রলুব্ধ করতেন। তারা হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের নিন্দার পাশাপাশি তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে ব্যঙ্গবিদ্রুপও করতেন। খ্রিস্টান মিশনারিদের অবাধে ভারতে প্রবেশ করা, বসবাস করা এবং সেনা শিবিরে প্রবেশ করে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করার সুবিধাদান ভারতীয় সিপাহিদের আতঙ্কিত করে। তারা মনে করেন, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তাদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার প্রচেষ্টা হল সরকারি ষড়যন্ত্রের ফসল।

(ii) ধর্মীয় রীতিতে বাধা: সামরিক বাহিনীতে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচার ছাড়াও ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু সিপাহিদের তিলক কাটা এবং মুসলমান সেনাদের দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল চামড়ার টুপি পরা। ইংরেজ কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তকে ভারতীয় সিপাহিরা নিজেদের ধর্মাচরণের উপর আঘাত বলে মনে করেন। তাদের মনে এই ধারণা জন্মায় যে, ইংরেজদের শাসনে ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অবহেলিত। অন্যদিকে, ভারতীয় হিন্দু সিপাহিদের সমুদ্র পেরিয়ে (কালাপানি) যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশকেও তারা ধর্মনাশের অশনি সংকেত হিসেবেই দেখেছিলেন। আবার ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে কর্নেল কলিন ম্যাকেঞ্জি (Colonel Colin Mackenzie)-ও মহরমের দিন শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করেছিলেন, যা মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হেনেছিল। এ ছাড়া মন্দির, মসজিদ পরিচালনার কাজে নির্দিষ্ট জমি এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানের উপর সরকারের কর আরোপ এদেশবাসীর ক্ষোভ বৃদ্ধি করেছিল।

(iii) ২১-এ আইন: পূর্বে ভারতীয় সমাজে প্রচলিত নিয়ম অনুসারে ধর্মচ্যুতরা কখনোই পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকার পেত না। কিন্তু ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ২১ নং রেগুলেশন জারি করে ইংরেজ সরকার খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া ভারতীয়দের বংশগত সম্পত্তি ভোগদখলের অধিকার সুনিশ্চিত করে। নবঘোষিত এই আইন সরকার কর্তৃক ধর্মপ্রচারের মনোভাব স্পষ্ট করে দেয়। স্যার সৈয়দ আহমেদ মনে করেন যে, আরও বেশি সংখ্যক ভারতীয়কে খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যে এই আইন প্রণীত হয়েছিল।

(iv) সরকারি ঘোষণা: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পূর্বে কোম্পানির তৎকালীন চেয়ারম্যান আর ডি ম্যাঙ্গেলস (Ross Donnelly Mangles) ঘোষণা করেছিলেন, খ্রিস্ট ধর্মের বিজয় পতাকা ভারতের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত উড্ডীন রাখার জন্য ঈশ্বর (God) হিন্দুস্থানের শাসনভার ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তাই ভারতীয়দের খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করা প্রতিটি ইংরেজদের পবিত্র কর্তব্য।

(v) সংস্কারমূলক কার্যাবলি: ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন এবং গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জনের মতো নিবারণ আইন পাস হলে ভারতীয়দের মনে ইংরেজদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া গঙ্গা নদীতে সেচব্যবস্থা প্রবর্তন এবং রেলওয়ে ও টেলিগ্রাফ প্রতিষ্ঠা রক্ষণশীল ভারতীয়দের অসন্তুষ্ট করে।

(vi) নিষিদ্ধ কার্তুজ ব্যবহারে চাপ: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে প্রচলিত ব্রাউনবেস গাদা বন্দুকের পরিবর্তে নতুন এনফিল্ড রাইফেল ব্যবহারের সিদ্ধান্ত সিপাহিদের ধর্মনাশের আশঙ্কা জোরালো করে। সিপাহিদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, এই বন্দুকের কার্তুজের মুখে গোরু ও শূকরের চর্বি মিশ্রিত একটি আচ্ছাদন আছে। এই কার্তুজ দাঁতে কেটে বন্দুকে ভরতে হত। অথচ গোরু ও শূকর ভক্ষণ যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলমানদের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ রূপে গণ্য হয়। স্বভাবতই, এই বিষয়টি সিপাহিদের কাছে ধর্মনাশের জঘন্য ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রতিভাত হয়। বস্তুত এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল।

(vii) সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ও যুবরাজ ফিরুজ শাহের ঘোষণাপত্র: বিদ্রোহ শুরুর অব্যবহিত পরে জারি করা বিভিন্নঘোষণাপত্রে বিদ্রোহীদের ধর্মীয় অসন্তোষের আভাস পাওয়া যায়। সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ-র আজমগড় ঘোষণাপত্র (২৫ আগস্ট, ১৮৫৭ খ্রি.) এবং অযোধ্যার যুবরাজ ফিরুজ শাহ-র ঘোষণাপত্রে (১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৮ খ্রি.) এই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে, কোম্পানির নির্দিষ্ট কর্মসূচি হল ভারতীয়দের ধর্মান্তরিত করে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা। এমতাবস্থায়, ইংরেজ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার মধ্যেই তারা নিজ নিজ ধর্ম রক্ষার সম্ভাবনা খুঁজে পান। এই উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত হয়েই আজমগড় ঘোষণাপত্রে ধর্মীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও বিধর্মীদের ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা ঘোষিত হয়।

বিতর্ক: অবশ্য ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পশ্চাৎপর্টে ধর্মসংক্রান্ত ক্ষোভকে গুরুত্ব দেওয়া নিয়ে বিতর্ক আছে। কেমব্রিজ ঐতিহাসিক জুডিথ ব্রাউন (Judith Brown) যেমন তাঁর লেখা Modern India: The Origins of an Asian Democracy গ্রন্থে বলেছেন যে, ধর্মসংক্রান্ত আতঙ্কই যে ভারতীয়দের অসন্তোষ তথা সিপাহিদের আনুগত্যহীনতার পিছনে দায়ী ছিল, একথা মনে করার বিশেষ কারণ নেই। কিন্তু ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার-সহ বহু জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক নিশ্চিত যে, ধর্মীয় অসন্তোষ এবং ধর্মান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা সিপাহিদের বিদ্রোহমুখী হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দায়ী ছিল।

সামরিক কারণ

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম একটা কড়া চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় সিপাহিরা। অথচ এক সময় এই দেশীয় সিপাহিদের বাহুবলের উপর ভিত্তি করেই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইমারত প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু নানা কারণে এই সেনাদের পেশাগত ক্ষোভ তাদের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবকে আরও তীব্র করে তোলে।

(i) ভারতীয় সৈন্যদের স্বল্প বেতন: ঐতিহাসিক সীমা অলাভি (Seema Alavi)-র মতে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক সেনা নিয়োগই ছিল এদেশে তাদের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মূলভিত্তি। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ভারতে নিযুক্ত কোম্পানির সৈন্যসংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ১৫ হাজার ৫২০ জন এবং এদের জন্য বেতনবাবদ মোট বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ছিল ৯৮ লক্ষ ২ হাজার ২৩৫ পাউন্ড। উল্লেখ্য, এই বিশাল বাহিনীর মাত্র ১৬.২ শতাংশই ছিল ইউরোপীয়। অথচ সামরিক খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের ৫৭.৮ শতাংশই ব্যয় করা হত শ্বেতাঙ্গদের জন্য। ইউরোপীয়দের তুলনায় ভারতীয় সেনাদের বেতন ছিল খুবই কম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন ভারতীয় পদাতিক সিপাহির মাসিক বেতন ছিল ৭ টাকা এবং একজন অশ্বারোহী সেনা পেতেন ২৭ টাকা। খাবার, উর্দি ও ঘোড়া প্রতিপালনের খরচ বাদ দিয়ে তার হাতে বাঁচত মাত্র ১ বা ২ টাকা। এরূপ বঞ্চনা ভারতীয় সিপাহিরা মেনে নিতে পারেননি।

(ii) পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্য: শুধু বেতনের ক্ষেত্রেই নয়, পদমর্যাদা, পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রেও ভারতীয় সিপাহিরা বৈষম্যের শিকার হতেন। টমাস মনরো-এর লেখা থেকে জানা যায় যে, একজন ভারতীয় সিপাহি তার চাকুরি জীবনে সর্বোচ্চ সুবাদার পদ পর্যন্ত উন্নীত হতে পারতেন। লক্ষণীয় যে, এই পদের স্থান ছিল সর্বনিম্নপদস্থ ইউরোপীয় অফিসারের অনেক নীচে। ব্রিটিশ কর্মচারী মিস্টার কে (Kaye) স্বীকার করেছেন যে, ভারতীয় সিপাহিদের পদোন্নতিজনিত ক্ষোভছিল যথেষ্ট তীব্র। পাশাপাশি টি আর হোমস (TR Holmes)-ও উল্লেখ করেছেন যে, একজন ভারতীয় সিপাহি যদি হায়দর আলির মতো সামরিক প্রতিভাধরও হন, তবু তার বেতন কখনোই একজন সাধারণ ইউরোপীয় সৈনিকেরও সমান হত না। এমনকি সেই যুগে ইংল্যান্ড থেকে সদ্য আগত কোনও তরুণ সৈনিকও বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ যে-কোনো ভারতীয় সিপাহির উপর হুকুম জারি করতে পারতেন।

(iii) দুর্ব্যবহার: ভারতীয় সিপাহিদের প্রতি ইংরেজ কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। ভারতীয়দের অপমানজনক অভিধা যেমন- কালা আদমি (নিগার), অসভ্য (আনকালচারড্) ইত্যাদি সম্বোধন করে কথা বলা হত। তাদের বাসস্থানও ছিল নিম্নমানের। শুধু সিপাহি নয়, সকল ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজদের জাত্যভিমানজনিত উগ্রতা ও অসম্মান প্রকাশিত হত।

(iv) সিপাহিদের পরিবারের উপর অত্যাচার: ভারতীয় সিপাহিরা ছিলেন সাধারণত কৃষক পরিবারের সন্তান। কৃষকরা বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে ইংরেজদের প্রতি ক্ষুব্ধ হলে সিপাহিদের পরিবারের প্রতি ইংরেজরাও দুর্ব্যবহার করতে শুরু করেন। তাছাড়া বেঙ্গল আর্মির অধিকাংশ সিপাহি ছিলেন অযোধ্যার অধিবাসী। লর্ড ডালহৌসি কুশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা গ্রাস করলে এদের পরিবার ও আত্মীয়-পরিজন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হন। আর সিপাহিদের এই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৮৫৭-র বিদ্রোহে।

(v) অতিরিক্ত ভাতাবন্ধ: যুদ্ধের জন্য সিপাহিদের দূরদেশে যেতে হত। এরজন্য ভারতীয় সিপাহিদের কিছু অতিরিক্ত ভাতা বা বাট্টা দেওয়া হত। কিন্তু ১৮৫৭-র বিদ্রোহ শুরুর কিছু আগে (১৮৫৬ খ্রি.) সামরিক কর্তৃপক্ষ স্থির করে যে, পাঞ্জাব বা সিন্ধুপ্রদেশে যুদ্ধে লিপ্ত সিপাহিদের এই ভাতা দেওয়া হবে না। এই আর্থিক বঞ্চনা সিপাহিদের অসন্তোষ আরও বাড়িয়ে তোলে।

(vi) ধর্মীয় অসন্তোষ: ইংরেজ সামরিক কর্তৃপক্ষ ভারতীয় সিপাহিদের তিলক কাটা, দাড়ি ও টিকি রাখা নিষিদ্ধ এবং চামড়ার টুপি পরা বাধ্যতামূলক করলে সিপাহিরা ক্ষুব্ধ হন। আবার ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার পাস করে General Service Enlistment Act; যার দ্বারা কোম্পানির অধীনস্থ সেনাদের দেশের মধ্যে বা বাইরে যে-কোনো স্থানে নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়। অথচ তৎকালীন সময়ে কালাপানি পার করা হিন্দু সৈনিকদের কাছে ছিল জাতিচ্যুত হওয়ার সমান।

(vii) আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি: ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (১৮৫৪-৫৬ খ্রি.) এবং প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে (১৮৩৯ খ্রি.) ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছিল। ইংরেজদের এই দুর্গতির কাহিনি ভারতীয় সিপাহিদের মনে আশার আলো দেখায়। তারা একদিকে যেমন ব্রিটিশ সৈনিকদের বীরত্বের প্রতি শ্রদ্ধা হারায়, অন্যদিকে আবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে জয়লাভের আশায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।

(viii) সাধুসন্তদের ভবিষ্যদ্বাণী: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রাক্কালে ভারতের নানা স্থানে বহু সাধু, সন্ন্যাসী ও দরবেশ প্রচার করতে থাকেন যে, পলাশির যুদ্ধের ১০০ বছরের মধ্যেই ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী সিপাহিদের উদ্দীপিত করেছিল।

তাৎক্ষণিক বা প্রত্যক্ষ কারণ

ব্রিটিশ শোষণ ও পীড়নের কারণে পুঞ্জীভূত এই ক্ষোভের মুহূর্তে গণবিস্ফোরণে প্রত্যক্ষভাবে ইন্ধন দিয়েছিল এনফিল্ড রাইফেল (Enfield Rifle)-এর কার্তুজের ব্যবহার সংক্রান্ত অসন্তোষ।

(i) রাইফেলের কার্তুজ সংক্রান্ত বিক্ষোভ: এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজ (টোটা) একটি মোড়কের মধ্যে থাকত। মোড়কটি দাঁত দিয়ে কেটে বন্দুকের মধ্যে ভরতে হত। মোড়কটিকে নরম রাখার জন্য চর্বি লাগানো থাকত। গুজব রটেছিল যে, ওই মোড়কটিতে গোরু ও শূকরের চর্বি মাখানো থাকে। ফলে ধর্মচ্যুত হওয়ার ভয়ে হিন্দু ও মুসলমান সিপাহিরা এই কার্তুজ ব্যবহার করতে অসম্মত হন।

এমতাবস্থায়, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ ব্রিটিশ প্রধান সেনাপতি অ্যানসন (Anson) বড়োলাট ক্যানিংকে সিপাহিদের আপত্তির কথা একটা চিঠিতে জানান। সম্ভবত তখনই এই কার্তুজের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু সিপাহিদের সন্দেহ ও আতঙ্ক থেকেই যায়। ধর্মনাশের গভীর ও গোপন ষড়যন্ত্র ধ্বংস করার জন্য মরিয়া হয়ে ১৯ এবং ৩৪ নং নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির সিপাহিরা বিদ্রোহের সূচনা করেন।

বিরুদ্ধ মত: তবে বেশকিছু ঐতিহাসিক ও বিশিষ্টজনেরা এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজের ঘটনাকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ বলতে চাননি। এ প্রসঙ্গে সি বল মনে করেন যে, কার্তুজের ব্যবহার সংক্রান্ত অভিযোগ গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ দেখা গেছে বিদ্রোহীরা দিল্লি ও মিরাটে ইংরেজদের বিরুদ্ধে এই কার্তুজ যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেছিল। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ বেঞ্জামিন ডিজরেইলি (Benjamin Disraeli)-ও বলেছেন যে, এনফিল্ড রাইফেলের টোটা ছিল অজুহাতমাত্র। সেসময় আর্থসামাজিক পরিস্থিতি এতটাই বিদ্রোহাত্মক হয়ে উঠেছিল যে, এই টোটা না এলেও বিদ্রোহ হত।

আরো পড়ুন : আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানসমুহ MCQ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment