নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর | Class 11 Philosophy

নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর

নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর
নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর

ব্যাপকতর অর্থে নৈতিক’ পদটির অর্থ কী?

ব্যাপকতর অর্থে ‘নৈতিক’ বলতে বোঝায় এমন ক্রিয়া যার নৈতিক গুণ আছে। অর্থাৎ নৈতিক দিক থেকে সেটিকে যেমন ভালো বলা যায়, তেমন মন্দও বলা যায়। সুতরাং ব্যাপক অর্থে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি উভয় প্রকার কর্মই নৈতিক ক্রিয়ার অন্তর্গত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘সত্য কথা বলা ভালো’, এটি যেমন নৈতিক, ‘মিথ্যা কথা বলা খারাপ’ এটিও তেমনি নৈতিক।

সূচিপত্র

সংকীর্ণতর অর্থে ‘নৈতিক’ শব্দটির অর্থ কী?

সংকীর্ণতর অর্থে ‘নৈতিক’ শব্দের দ্বারা যে বস্তু নৈতিক দিক থেকে কেবল ভালো বা ঠিক, তাকেই বোঝায়। সেক্ষেত্রে ‘নৈতিক’ পদটি ‘নীতিগর্হিত’ বা Immoral শব্দের বিরুদ্ধপদ। অর্থাৎ সংকীর্ণ অর্থে নৈতিক ক্রিয়াকে ভালো বলা গেলেও মন্দ বলা যায় না। যেমন- ‘সত্য কথা বলা’ হল নৈতিক ক্রিয়া। কিন্তু ‘মিথ্যা কথা বলা’ নৈতিক ক্রিয়া নয়।

নীতিবিজ্ঞানে ‘নৈতিক’ শব্দটি কোন্ অর্থে ব্যবহৃত হয়?

নীতিবিজ্ঞানে ‘নৈতিক’ শব্দটি ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ নীতিবিজ্ঞানে নৈতিক বলতে ভালো ও মন্দ উভয় প্রকার ক্রিয়াকেই বোঝায়। কেন-না ‘মন্দ’ ভালোর মতই একটি নৈতিক গুণ এবং এই গুণ কোনো বস্তু বা ক্রিয়াকে নৈতিক বিচারের অধীনে নিয়ে আসে। ঔচিত্য- অনৌচিত্যের মানদণ্ডে বিচার করে ভালো কর্মকে নৈতিক কর্ম বলা হয়, কারণ তা উচিত কর্ম। আবার মন্দ কর্মও নৈতিক কর্ম। কারণ সেটি উচিত কর্ম নয়, অনুচিত কর্ম। সুতরাং নীতিবিজ্ঞানে ভালো ও মন্দ উভয়ক্ষেত্রেই ‘নৈতিক’ শব্দ ব্যবহৃত হয়।

নৈতিক ক্রিয়া কাকে বলে?

স্বেচ্ছাকৃত কর্মের (Voluntary Action) ক্ষেত্রে, বিশেষ অভ্যাসজাত কর্মেরও (Habitual Action) নৈতিক বিচার অর্থাৎ ভালো-মন্দ, উচিত- অনুচিত ইত্যাদির বিচার হয়। স্বেচ্ছাকৃত কর্ম বারংবার অনুশীলনের ফলে তা অভ্যাসজাত কর্মে পরিণত হয়। যেসব ক্রিয়ার ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বিচার করা হয়, তাকেই নৈতিক ক্রিয়া বলে। যেমন-সত্য কথা বলা, অপরকে প্রতারণা করা ইত্যাদি নৈতিক ক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। কেন-না এগুলি আমাদের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।

অনৈতিক ক্রিয়া কাকে বলে? অথবা, নীতি-বহির্ভূত ক্রিয়া কাকে বলে?

নীতবিজ্ঞানে অনৈতিক ক্রিয়া বলতে নীতি-বহির্ভূত ক্রিয়াকে বোঝানো হয়। যে ক্রিয়া নৈতিক গুণ বর্জিত অর্থাৎ যে ক্রিয়াকে ভালো বা মন্দ কোনোটাই বলা যায় না, তাকে অনৈতিক বা নীতি বহির্ভূত ক্রিয়া বলে। যেমন-গরম কেটলি হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে যাওয়া।

নীতিগর্হিত ক্রিয়া কাকে বলে?

নৈতিক শব্দটি যখন মন্দ কোনো ক্রিয়াকে বোঝায়, তখন তাকে নীতিগর্হিত ক্রিয়া বলে। অর্থাৎ যে কাজ কোনো নৈতিকতার নিয়মকে লঙ্ঘন করে বা কোনো নৈতিক আদর্শের মানদণ্ডের বিচারে মন্দ, অন্যায়, অনুচিত বলে গণ্য হয়, তা হল নীতিগর্হিত কাজ। যেমন-মিথ্যা কথা বলা হল নীতিগর্হিত ক্রিয়া কেন-না এটি নৈতিকতার নিয়মকে লঙ্ঘন করেছে।

নৈতিক ক্রিয়ার কয়টি স্তর ও কী কী?

নৈতিক ক্রিয়ার তিনটি স্তর। যথা- মানসিক স্তর, দৈহিক স্তর এবং দেহাতিরিক্ত স্তর।

ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মানসিক স্তর কী?

জোয়া যে ক্রিয়া মানুষ সচেতনভাবে কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সম্পাদন করে সেই ক্রিয়াই হল ঐচ্ছিক ক্রিয়া। এই ঐচ্ছিক ক্রিয়াই নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু। মানুষের ঐচ্ছিক ক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করলে মূলত তিনটি স্তর পাওয়া যায়, যেগুলির মধ্যে প্রধানতম হল মানসিক স্তর। কেন-না-কোনো ক্রিয়া সম্পাদনের পূর্বে মানসিক প্রস্তুতি আবশ্যিক।

ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মানসিক স্তরটির মূলে হল আমাদের অভাববোধ। এই অভাববোধ থেকেই বিষয়টির প্রতি আমাদের কামনা, সংকল্প ইত্যাদি দেখা দেয়। যেমন-কোনো ব্যক্তি ক্ষুধার্ত হওয়ায় দোকানে খাবার কিনতে গেল। এখানে ব্যক্তিটির মধ্যে খাদ্যের অভাববোধই হল মানসিক স্তর, আর ওই অভাববোধ থেকেই ব্যক্তিটির মধ্যে-খাদ্যলাভের কামনা, সংকল্প ইত্যাদি দেখা দেয়।

ধূমপানের অভ্যাসকে কি নৈতিক বিচারের বিষয় বলা যায়?

‘ধূমপানের অভ্যাস’ অভ্যাসজাত ক্রিয়া হলেও এটিকে নৈতিক বলা হয়। কারণ এই অভ্যাসটি গড়ে ওঠার একদম প্রথম স্তরে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক এই ক্রিয়ায় অভ্যস্ত হয় এবং এটি নৈতিক নিয়মকে লঙ্ঘন করে। তাই এই অভ্যাসকে নৈতিক দিক থেকে মন্দ বলা যায়।

অভাববোধকে কেন ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মূল উৎস বলা হয়?

কোনো কিছুর প্রয়োজনীয়তা বা চাহিদার বোধ থেকেই অভাববোধের সূচনা হয়। যে অভাব পূরণ হলে মনে সুখ আসে আর পূরণ না হলে মন দুঃখে ভরে যায়। এই অভাববোধই হল ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মূল উৎস।-কেন-না অভাববোধ না হলে ব্যক্তি কোনো কর্মে প্রণোদিত হয় না। আর ঐচ্ছিক ক্রিয়া সম্পাদন করতে কর্ম প্রবৃত্তির প্রয়োজন। অভাববোধই মনে কামনার জন্ম দেয়। সুতরাং অভাববোধই ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মূল উৎস। অভাববোধ ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মানসিক স্তরের অন্তর্গত।

কামনা কাকে বলে?

ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মানসিক স্তরের উপস্তর হিসেবে আমরা কামনার উল্লেখ পাই। কামনা হল বিশেষ এক মানসিক অবস্থা যা মূলত আমাদের অভাববোধ এবং সেই অভাববোধ দূর করতে পারে যে কাম্যবস্তু তার ধারণা থেকে উৎপন্ন। মানুষের মধ্যে যখন কোনো বস্তুর অভাববোধ দেখা দেয় তখন সেই কাম্যবস্তু লাভ করার জন্য মানুষ আকুল হয়ে ওঠে এবং কর্মে প্রবৃত্ত হয়। এই আকুলতাই হল কামনা। বাস্তবিক পক্ষে, কামনা হল এক জটিল মানসিক অবস্থা। কামনাকে বিশ্লেষণ করলে তিনটি উপাদান এক জটিল মানসিক অবস্থা। কামনাকে বিশ্লেষণ করলে তিনটি উপাদান পাওয়া যায়। যথা- জ্ঞানাত্মক উপাদান, অনুভূতিমূলক উপাদান এবং কর্ম-প্রবৃত্তিমূলক উপাদান।

কামনার অন্তর্ভুক্ত তিনটি উপাদান কী কী?

নীতিবিদ্যায় মানুষের ঐচ্ছিক আচরণের নৈতিক বিচার করা হয়। এই ঐচ্ছিক ক্রিয়ার তিনটি স্তরের মধ্যে মানসিক স্তরের একটি উপস্তর হল কামনা। কামনা তিনটি উপাদানের সমষ্টি। যথা- জ্ঞানাত্মক উপাদান, অনুভূতিমূলক উপাদান এবং কর্ম-প্রবৃত্তিমূলক উপাদান।

জ্ঞানগত উপাদান কী?

কামনার জ্ঞানগত উপাদানের ব্যাখ্যায় বলা যায়, কামনার জ্ঞানগত উপাদানে যেমন নিজের অভাববোধ সম্বন্ধে চেতনা থাকে তেমনি অপরের অভাববোধ সম্বন্ধেও চেতনা থাকে। তবে শুধু অভাব সম্বন্ধে চেতনাই নয়,সেই অভাববোধ দূর করতে পারে যে কাম্যবস্তু তার সম্বন্ধেও ধারণা। থাকে। আবার ওই কাম্যবস্তু লাভ করার উপায় সম্বন্ধে এবং কাম্যবস্তু লাভের ফলে তৃপ্তিবোধের প্রত্যাশা থাকে। তাই কামনার জ্ঞানগত উপাদানকে এভাবে বিশ্লেষণ করা যায়- অভাব সম্বন্ধে চেতনা, অভাব দূর করতে পারে এমন কাম্যবস্তুর ধারণা, কাম্যবস্তুলাভের উপায় সম্বন্ধে ধারণা এবং তৃপ্তিবোধের প্রত্যাশা।

অনুভূতিমূলক বা আবেগগত উপাদান কী?

কামনার সঙ্গে অনুভূতি বা আবেগ অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। তাই কামনার অনুভূতিমূলক বা আবেগগত উপাদানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কামানার আবেগগত উপাদান দু-রকমের হতে পারে। বেদনাময় বা অপ্রীতিকর অনুভূতি এবং সুখকর বা প্রীতিপূর্ণ অনুভূতি। অভাববোধ থেকেই কামনার উৎপত্তি হয়, ওই অভাববোধের জন্য মানুষের মনে যে অপ্রাপ্তির অনুভূতি জন্মায় সেটিই হল বেদনাময় বা অপ্রীতিকর অনুভূতি। আর অভাব পূরণ করতে পারে যে কাম্যবস্তু সেই কাম্যবস্তু লাভ করার ফলে ভবিষ্যতের যে তৃপ্তিবোধ তাই হল সুখকর বা প্রীতিপূর্ণ অনুভূতি।

কর্ম-প্রবৃত্তিমূলক বা কর্ম-প্রবণতামূলক উপাদান কাকে বলে?

কামনার যে উপাদানটি মানুষকে কর্মে প্রবৃত্ত বা চালিত করে তাই হল কামনার কর্ম-প্রবণতামূলক উপাদান। অভাববোধ থেকে মানুষের মনে যে কাঙ্ক্ষিত কাম্যবস্তুর ধারণা জন্মায়, সেই কাম্যবস্তু লাভ করতে না পারলে কামনার পরিতৃপ্তি হয় না। তাই মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত কাম্যবস্তু লাভে ব্যাকুল হয়ে ওঠে এবং এই ব্যাকুলতাই মানুষকে কর্মে প্রবৃত্ত করে। তবে কর্মে প্রবৃত্তির পথ সকল ক্ষেত্রে সহজ হয় না, ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করে মানুষকে কাম্যবস্তু লাভ করতে হয়। কামনার এই কর্ম-প্রবণতামূলক উপাদানই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

নীতিতত্ত্বে কামনার উপাদানগুলি কি পারস্পরিকভাবে বিচ্ছিন্ন?

কামনাকে বিশ্লেষণ করে তিনটি উপাদান পাওয়া যায়। যথা-  জ্ঞানাত্মক উপাদান, অনুভূতিমূলক উপাদান ও কর্ম-প্রবণতামূলক উপাদান। কামনার জ্ঞানগত উপাদানে ব্যক্তি অভাববোধ সম্বন্ধে সচেতন হয়। কামনার অনুভূতিমূলক উপাদানে অভাববোধ থেকে ব্যক্তির মনে বেদনাময় অনুভূতি, আর অভাব পূরণে সুখময় অনুভূতি উৎপন্ন হয়।

পরিশেষে কামনার কর্ম-প্রবণতামূলক উপাদানে ব্যক্তি কাম্যবস্তু লাভের জন্য কর্মে প্রবৃত্ত হয়। সুতরাং স্পষ্টভাবে লক্ষ করলে বোঝা যায় কামনার তিনটি উপাদান একসঙ্গে ক্রিয়া করলে তবেই কামনার পরিতৃপ্তি সম্ভব হয়। তাই বলা যায়, কামনার উপাদানগুলি পারস্পরিকভাবে বিচ্ছিন্ন নয়, এগুলির একটি অন্যটির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধে সম্বন্ধযুক্ত।

কামনার বিরোধীতা কাকে বলে?

ঐচ্ছিক ক্রিয়ার অন্তর্গত মানসিক স্তরের উপস্তর হিসেবে আমরা কামনার বিরোধীতা সম্বন্ধে জানতে পারি। অনেক সময় আমাদের মনে একই সঙ্গে একাধিক কামনা উপস্থিত হয়। সব কামনাগুলিকে পূরণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না, একটি কামনা পূরণ করতে গেলে অপর কামনাকে ত্যাগ করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে কোন্ কামনাটিকে পূরণ করা হবে আর কোন্টিকে ত্যাগ করতে হবে-সে বিষয়ে কামনাগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কামনাগুলির এরূপ পারস্পরিক দ্বন্দ্বই হল কামনার বিরোধীতা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনো ব্যক্তির মনে বিভিন্ন কামনা যেমন- খাবার কেনা, জামাকাপড় কেনা, বই কেনা, উপহার কেনা ইত্যাদি একই সঙ্গে উপস্থিত হতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিটির কাছে যা টাকা রয়েছে তা দিয়ে যে-কোনো একটি কামনা পূরণ করা যাবে। এমন অবস্থায় কামনাগুলির মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।

কামনার তীব্রতা কখন বাড়ে?

মানুষের জীবনে কামনার অন্ত নেই। একটি কামনার পরিতৃপ্তি হতে না হতেই মনের মধ্যে আর একটি কামনা এসে পড়ে। কামনার অনুভূতিমূলক উপাদানের মধ্যে অভাববোধ সংক্রান্ত যে দুঃখানুভূতির সৃষ্টি হয় তার পরিতৃপ্তি লাভের প্রত্যাশায় ব্যক্তি কর্মে প্রবৃত্ত হয়। অর্থাৎ যখনই কামনার ফলে ব্যক্তির মধ্যে লক্ষ্যবস্তুটি লাভের প্রত্যাশা বৃদ্ধি পায় তখনই কামনার তীব্রতাও বৃদ্ধি পায়।

অনুকরণমূলক ক্রিয়া কাকে বলে? এই ক্রিয়া কি ঐচ্ছিক ক্রিয়া?

অন্যকে অনুকরণ করে যে ক্রিয়া সম্পাদন করা হয় তাকে অনুকরণমূলক ক্রিয়া বলে।

অনুকরণমূলক ক্রিয়া ইচ্ছাকৃত হতে পারে আবার ইচ্ছাকৃত নাও হতে পারে। যেমন-শিশুরা অন্যকে অনুকরণ করে যে ক্রিয়া করে তা শিশুদের ইচ্ছাকৃত নয়। এই অনুকরণ স্বতঃস্ফূর্ত বলে অনৈচ্ছিক ক্রিয়া। অপরদিকে, কোনো আত্মসচেতন ব্যক্তি যখন অপর কোনো ব্যক্তিকে অনুকরণ করে তখন সেই অনুকরণমূলক ক্রিয়া হল নৈতিক ক্রিয়া।

আবশ্যিক ক্রিয়া কীভাবে অনৈতিকরূপে গণ্য?

সমাজবদ্ধ মানুষের ক্রিয়া নীতিবিদ্যার আলোচ্য বিষয় হলেও মানুষের সকল ক্রিয়াই নীতিবিদ্যার আলোচ্য বিষয় নয়। এমন অনেক ক্রিয়া আছে যেগুলি মানুষ বাধ্যতামূলকভাবে সম্পাদন করে। মানুষের এই জাতীয় ক্রিয়া হল আবশ্যিক ক্রিয়া। যেমন- নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া, তীব্র আলোকে চোখের পাতা বন্ধ করা ইত্যাদি। মানুষের এই আবশ্যিক ক্রিয়াকে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়,উচিত-অনুচিত ইত্যাদি নৈতিক বিশেষণে বিশেষিত করা যায় না। আর নীতিবিদ্যায় যেসকল ক্রিয়াকে নৈতিক বিশেষণে বিশেষিত করা যায় না তাদের অনৈতিকরূপে গণ্য করা হয়। যেহেতু মানুষের আবশ্যিক ক্রিয়াগুলিকে কোনোভাবেই নৈতিক বিশেষণে বিশেষিত করা যায় না, সেহেতু আবশ্যিক ক্রিয়া অনৈতিকরূপে গণ্য হয়।

অনুকরণমূলক ক্রিয়াকে কখন অনৈতিক বলা হয়?

কিছু কিছু অনুকরণ আমরা সচেতনভাবে করে থাকি। অর্থাৎ ইচ্ছাপূর্বক, জ্ঞাতসারে করে থাকি। কিন্তু কিছু অনুকরণ আমরা অজ্ঞাতসারে করি। যেমন-একটি শিশু যখন তার গুরুজনের কথার মানে না বুঝে সেটিকে অনুকরণ করে তখন কথাটি খারাপ হলেও তার ক্রিয়াটিকে নৈতিক বলা যায় না। এইরূপ অনুকরণ অনৈচ্ছিক। এক্ষেত্রে অণুকরণমূলক ক্রিয়াকে অনৈতিক বলা হয়।

অনিচ্ছাকৃত হাত থেকে কাচের দামি ফুলদানি ভেঙে যাওয়া কি নৈতিক?

অনিচ্ছাকৃত হাত থেকে কাচের দামি ফুলদানি ভেঙে যাওয়া-এই ধরনের ক্রিয়াকে আকস্মিক (Accidental) বলা হয়। কারণ ফুলদানিটি ভেঙে যাওয়ায় ক্ষতি হল ঠিকই কিন্তু এইরূপ ক্রিয়া একটি দুর্ঘটনামাত্র। এইরূপ ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তির, ইচ্ছার কোনো ভূমিকা থাকে না। অনৈচ্ছিক বলে এই ক্রিয়া অনৈতিক।

নিম্নলিখিত ক্রিয়াগুলির মধ্যে কনটি নৈতিক ও কনটি অনৈতিক?

(i) হঠাৎ হাত থেকে পড়ে দামি ফুলদানি ভেঙে যাওয়া। (ii) একটি বড়ো পাথর পাহাড়ের উপর থেকে গড়িয়ে পড়ে কোনো ব্যক্তির মাথায় লাগে। (iii) সত্য কথা বলা। (iv) অপরকে সাহায্য করা।

  1. হঠাৎ হাত থেকে পড়ে দামি ফুলদানি ভেঙে যাওয়া-অনৈতিক ক্রিয়া।
  2. একটি বড়ো পাথর পাহাড়ের উপর থেকে গড়িয়ে পড়ে কোনো ব্যক্তির মাথায় লাগা-অনৈতিক ক্রিয়া।
  3. সত্য কথা বলা-নৈতিক ক্রিয়া।
  4. অপরকে সাহায্য করা-নৈতিক ক্রিয়া।

এমন একটি বাধ্যতামূলক ক্রিয়ার উল্লেখ করো যেটিকে নৈতিক বলা যায় না।

ধরা যাক, কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে এমন একটি কাগজে সই করানো হল যাতে অন্যের ক্ষতি হয়। লোকটি বাধ্য হয়ে সই করল। এই কাজ সে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে করতে বাধ্য হয়েছে। তাই তার এই ক্রিয়া ঐচ্ছিক নয়। সুতরাং এই ক্রিয়াকে নৈতিক বলা যাবে না অনৈতিক  বলতে হবে।

ঐচ্ছিক ক্রিয়ার দৈহিক স্তর বলতে কী বোঝায়?

ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মানসিক স্তর হল মূলত কামনার স্তর। একাধিক কামনার মধ্যে থেকে যখন একটি কামনাকে নির্বাচন করে নেওয়া হয়, তখন ওই নির্বাচিত কামনাকে কার্যে রূপায়িত করার জন্য দেহযন্ত্র ও পেশিগুলি সবল হয়ে ওঠে। যেমন- আমার ইচ্ছা হল যে ছেলেটি জলে ডুবে যাচ্ছে তাকে উদ্ধার করি। আমি তখন জলে ঝাঁপ দিয়ে ছেলেটির কাছে সাঁতার কেটে যাব এবং তাকে উদ্ধার করব। এই যে আমার দেহযন্ত্র সবল হল এটিই ঐচ্ছিক ক্রিয়ার দৈহিক স্তর।

ঐচ্ছিক ক্রিয়ার দেহাতিরিক্ত স্তর কাকে বলে?

কাম্য বস্তু লাভ করার জন্য কোনো কর্ম সম্পাদনের ফলে ব্যক্তির মধ্যে তৃপ্তি বা সুখানুভূতি যেমন ঘটে তেমনি বস্তুটিকে লাভ করার জন্য অঙ্গ সঞ্চালনের ফলে বাহ্য জগতেও কিছু পরিবর্তন ঘটে। এটিই হল ঐচ্ছিক ক্রিয়ার দেহাতিরিক্ত স্তর। যেমন-কোনো ব্যক্তি অভাববোধের তাড়না থেকে দোকান থেকে একটি বই কিনলেন। বইটি কেনার পর তার মনে যেমন তৃপ্তিবোধ হল তেমনি তার দেহ-মনের বাইরের জগতে কিছু একটা পরিবর্তন ঘটলো। কারণ দোকান থেকে বইটি তার বাড়িতে এলো। বাহ্য জগতের এই পরিবর্তনটিকে বলে বাহ্যিক স্তর।

ঐচ্ছিক ক্রিয়ার স্তরগুলির মধ্যে কোন্ স্তরটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ?

ঐচ্ছিক ক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করলে তিনটি স্তর পাওয়া যায়।যথা- মানসিক স্তর, দৈহিক স্তর ও দেহাতিরিক্ত স্তর।

মানসিক স্তরের মধ্যে অভাববোধ হল ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মূল উৎস। এর সঙ্গে লক্ষ্যের ধারণা এবং কামনা যুক্ত হয়। এগুলি না হলে ঐচ্ছিক ক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে না। তাই মানসিক স্তরকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়।

একটি নৈতিক ও একটি অনৈতিক ক্রিয়ার উদাহরণ দাও।

একটি নৈতিক ক্রিয়ার উদাহরণ হল অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করা। আর অনৈতিক ক্রিয়ার উদাহরণ হল লোভনীয় খাবার দেখে জিভের জল নিঃসৃত হওয়া।

নিম্নলিখিত ক্রিয়াগুলির কোল্টিন্ট নৈতিক; অনৈতিক ও নীতিগর্হিত নির্বাচন করো। 

(i) পরীক্ষায় নকল করা। (ii) মাকে তীর্থক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া। (iii) যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু সৈন্য নিধন করা। (iv) নির্দোষ ব্যক্তির প্রাণরক্ষার জন্য মিথ্যা বলা। (iv) বিছানার চাদর পরিষ্কার করা।

পরীক্ষায় নকল করা-নীতিগর্হিত ক্রিয়া। মাকে তীর্থক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া-নৈতিক ক্রিয়া। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুসৈন্য নিধন করা-নৈতিক ক্রিয়া; কিন্তু কান্টের মতে মন্দ কাজ। নির্দোষ ব্যক্তির প্রাণরক্ষার জন্য মিথ্যা বলা-নীতিগর্হিত ক্রিয়া হলেও ভালো কাজ। বিছানার চাদর পরিষ্কার করা-অনৈতিক ক্রিয়া।

নৈতিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ফলাফলের কথা কারা বলেন?

সুখবাদী অর্থাৎ ফলাফল সাপেক্ষবাদীরা নৈতিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ফলাফলের কথা বলেন। উপযোগবাদী মিল ও বেথাম মনে করেন কাজের ফলাফল নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু। কর্মের ফল যদি সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক সুখ সাধন করে তাহলে সেই কার্য অধিকতর কাম্য। একটি কাজের নৈতিক মূল্যের সঙ্গে উদ্দেশ্যর কোনো সম্পর্ক নেই।

ম্যাকেঞ্জি ‘উদ্দেশ্য’ বলতে কী বুঝিয়েছেন?

ম্যাকেঞ্জির মতে, ‘উদ্দেশ্য’ শব্দটি দ্ব্যর্থক। প্রথমত, উদ্দেশ্য বলতে সহজাত প্রবৃত্তির তাড়নাকে বোঝায়, যা আমাদের কর্মে প্রবৃত্তি করে। দ্বিতীয়ত, উদ্দেশ্য বলতে লক্ষ্যের বা কাম্যবস্তুর ধারণাকে বোঝায়।

অ্যারিস্টটলের মতে ‘উদ্দেশ্য’ কী?

অ্যারিস্টটল তাঁর ‘De Anima’ গ্রন্থে বলেছেন, “উদ্দেশ্য হল সর্বদাই এমন এক কাম্যবস্তু যা ব্যক্তিকে কোনো কর্ম করতে প্রবৃত্ত করে।” (“Motive is always the desired object that moves to action.”)

লিলি উদ্দেশ্য বলতে কী বুঝিয়েছেন?

অধ্যাপক উইলিয়াম লিলি তাঁর ‘An Introduction to Ethics’ গ্রন্থে বলেছেন, “উদ্দেশ্যকে সংজ্ঞায়িত করা যায় একটি সচেতন মানসিক প্রক্রিয়া হিসেবে যা ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট পথে কর্ম করতে প্রবৃত্ত করে।” (“A Motive may be defined as a conscious. mental process which moves a man to act in a particular way.”)

বিভিন্ন প্রকার অভিপ্রায়গুলি উল্লেখ করো।

অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জির মতে, অভিপ্রায় বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। যথা- তাৎক্ষণিক ও দূরবর্তী অভিপ্রায়, বাহ্য ও আন্তর অভিপ্রায়, অপরোক্ষ ও পরোক্ষ অভিপ্রায়, চেতন ও অচেতন অভিপ্রায় এবং আকারগত ও বস্তুগত অভিপ্রায়।

তাৎক্ষণিক অভিপ্রায় ও দূরবর্তী অভিপ্রায়ের মধ্যে পার্থক্য লেখো?

অভিপ্রায় বলতে উদ্দেশ্য, উদ্দেশ্য সাধনের উপায় এবং উদ্দেশ্য সাধনের পরিণাম এসবের সমষ্টিকে বোঝায়। এই অভিপ্রায় তাৎক্ষণিক হতে পারে আবার দূরবর্তী হতে পারে। তাৎক্ষণিক অভিপ্রায় অভিন্ন হলেও দুই জন ব্যক্তির দূরবর্তী অভিপ্রায় ভিন্ন হতে পারে। যেমন- দুই জন যুবক সামরিক বাহিনীতে যোগদান করল। এক্ষেত্রে ওই দুই জন যুবকের তাৎক্ষণিক অভিপ্রায় অভিন্ন, তা হল সামরিক বাহিনীতে যোগদান। কিন্তু একজনের অভিপ্রায় হল প্রচুর অর্থ উপার্জন করা আর অন্যজনের অভিপ্রায় হল দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা। স্পষ্টতই দুই জন যুবকের দূরবর্তী অভিপ্রায় ভিন্ন ভিন্ন।

আকারগত ও বস্তুগত অভিপ্রায়ের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো।

অভিপ্রায়ের মধ্যে উদ্দেশ্য, উদ্দেশ্য সাধনের উপায় এবং পূর্বচিন্তিত ফলাফল-এই তিনটির সমন্বয় রয়েছে। বস্তুগত অভিপ্রায়ে উদ্দেশ্য প্রধান আর আকারগত অভিপ্রায়ের ক্ষেত্রে উপায় ও পূর্বচিন্তিত ফল প্রাধান্য পায়। যেমন-একজন ব্যক্তি সরকারের পতন চায় অতিরিক্ত প্রগতিশীল বলে, আর অন্য একজন ওই একই সরকারের পতন চায় অতিরিক্ত রক্ষণশীল বলে। এক্ষেত্রে দুজনের বস্তুগত অভিপ্রায় অভিন্ন হলেও আকারগত অভিপ্রায় ভিন্ন ভিন্ন। তা হল একজন সরকারের প্রগতিশীল নীতিকে আর অন্যজন রক্ষণশীল নীতিকে মন্দ মনে করে তার পতন ঘটাতে চায়।

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিপ্রায়ের মধ্যে পার্থক্য কী?

প্রত্যক্ষ অভিপ্রায় বলতে উদ্দেশ্যর লক্ষ্যের দিকটিকে বোঝায় আর পরোক্ষ অভিপ্রায় বলতে বোঝায় প্রত্যাশিত অথচ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতিকে। যেমন-কোনো ব্যক্তি উচ্চ বিদ্যার্জনের জন্য বিদেশে গমন করলেন। এটি তার প্রত্যক্ষ অভিপ্রায়। পরোক্ষ অভিপ্রায় হল এজন্য তাকে স্বদেশ, আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে।

বাহ্য ও আন্তর অভিপ্রায়ের মধ্যে পার্থক্য কী?

অভিপ্রায়ের ক্ষেত্রে যেমন একটি বাহ্যিক দিক থাকে তেমন একটি অন্তরের দিকও থাকে। যেমন-এক পথচারী যখন পথে একটি শিশুকে দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচায় তখন সেটি হল তার অভিপ্রায়ের বাহ্যিক দিক। আর শিশুটির প্রতি তার যে মায়া-মমতা, সেটি হল তার অন্তর অভিপ্রায়।

অভিপ্রায় কি অচেতন হতে পারে?

আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা মনের অচেতন স্তর স্বীকার করেন। তাই অভিপ্রায় অচেতন হতে পারে। ম্যাকেঞ্জি অচেতন অভিপ্রায় স্বীকার করেন। কিন্তু লিলি বলেন, সচেতন অভিপ্রায় আমাদের নৈতিক বিচারের বিষয়। তবে শুধু সচেতন অভিপ্রায়ের সাহায্যে আমাদের সব আচরণ ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই অচেতন অভিপ্রায় স্বীকার করতে হয়।

বেত্থাম কীভাবে উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ের মধ্যে পার্থক্য করেন?

উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে গিয়ে ব্যোম বলেছেন উদ্দেশ্য হল তাই যার জন্য কাজটি সম্পন্ন হয় এবং অভিপ্রায় হল সেই উদ্দেশ্য এবং সেই উদ্দেশ্যের অতিরিক্ত বা উদ্দেশ্য ভিন্ন আরও কিছু। কেন-না উদ্দেশ্য হল অভিপ্রায়ের একটি অঙ্গ বা উপাদান। আর অভিপ্রায় হল সেই উদ্দেশ্যকে লাভ করার উপায় এবং তার ফলাফল।

লিলি উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ের মধ্যে পার্থক্য করেন কীভাবে?

উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে গিয়ে লিলি বলেছেন অভিপ্রায় বাইরের জগতকে নয় কর্মকর্তার আগে থেকে প্রত্যাশিত ফলাফলের জগতকে বোঝায়। অভিপ্রায়ের ক্ষেত্রে কাজটির বাহ্যিক দিকটির প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। আর উদ্দেশ্যর ক্ষেত্রে মানসিক দিকের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি কর্মকর্তার মনোভাব, তার মানসিক অবস্থাকে বোঝায়।

যথোচিত বা ঠিক কাজ এবং অনুচিত বা ভুল কাজ বলতে কী বোঝায়?

যথোচিত কাজ হল সেই কাজ যার সঙ্গে নৈতিক নিয়মের সংগতি আছে। অর্থাৎ নিয়মানুগ বা বিধিসম্মত কাজই যথোচিত বা ঠিক কাজ। 

অনুচিত কাজ হল সেই কাজ যার সঙ্গে নৈতিক নিয়মের সংগতি নেই। অর্থাৎ নিয়ম বহির্ভূত কাজই অনুচিত বা ভুল কাজ।

Read More – The Garden Party Question Answer

Leave a Comment