ছুটি গল্পের প্রশ্ন উত্তর (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ক্লাস 11 দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা

ছুটি গল্পের প্রশ্ন উত্তর (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ক্লাস 11 দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা | Chuti Golper Long Question Answer | Class 11 4th Semester Bengali

ছুটি গল্পের প্রশ্ন উত্তর
ছুটি গল্পের প্রশ্ন উত্তর

১। “যে অকূল সমুদ্রে যাত্রা করিতেছে বালক রাশি ফেলিয়া। কোথাও তাহার তল পাইতেছে না।”-‘ছুটি’ গল্প অবলম্বনে বালকের পরিচয় দিয়ে আলোচ্য উক্তিটি ব্যাখ্যা করো। ২+৩

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পটিতে উল্লিখিত বালকটি হল ফটিক। তেরো-চোদ্দো বছরের এক কিশোর, যে নতুন নতুন খেলার উদ্ভাবনে ছেলের দলের নেতৃত্ব দিত, আপন ছন্দে নদীতীরে গ্রামের পথে কৈশোরের উদ্যাপন করত এবং তার দুরন্তপনার কারণে মার রাগের কারণ হয়ে উঠত।

সূচিপত্র

দুরন্ত ফটিককে সামলাতে না-পেরে ফটিকের মা তাঁর দাদা বিশ্বম্ভরবাবু যখন প্রস্তাব দেন যে ফটিককে কলকাতায় নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে পড়াশোনা শেখাবেন সে প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। ফটিক নিজেও সেখানে যাওয়ার জন্য অধীর হয়ে ওঠে। কিন্তু মামার বাড়িতে মামির কাছ থেকে ফটিক কোনোরকম সমাদর তো পায়ই না, বরং এক অনাকাঙ্ক্ষিতের মর্যাদা পায়। মা-র কাছে ফিরে যাওয়ার আকুলতা তার মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে। কিন্তু কার্তিক মাসে পুজোর ছুটির অনেক দেরি। এরই মধ্যে বই হারানোয় গঞ্জনা তীব্রতর হয় এবং ফটিক এই অসহ্য পরিবেশ থেকে পালিয়ে যেতে চায়। স্থানান্তরে পালিয়ে ফটিক মুক্তি খুঁজেছিল, অসুখ তাকে চিরমুক্তির পথ দেখায়। জ্বরাক্রান্ত ফটিক বিকারের ঘোরে খালাসিদের মতো জল মাপতে থাকে। কিন্তু মৃত্যুর যে মহাসমুদ্রে তার যাত্রা, কোনো রশির সাধ্য নেই তার তল পাওয়ার। ফটিকও পায় না-

"ক্ষণিকের পরে অসীমের বরদান 
আড়ালে আবার ফিরে নেয় তারে 
দিন হলে অবসান।"

২। ছুটি’ গল্পে ফটিক চরিত্রের মধ্য দিয়ে নিসর্গপ্রকৃতির সঙ্গে মানবাত্মার একাত্মতার যে পরিচয় পাওয়া যায় তা নিজের ভাষায় লেখো।

উত্তর: ছুটি গল্পে নিসর্গপ্রকৃতি এবং মানবাত্মার অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে।

কাহিনির সূচনায় ফটিকের নেতৃত্বে ছেলের দল যখন নদীর তীরে খেলা করছিল সে খেলায় যেন ছিল নদীর স্রোতের মতোই চাপল্য। আবার খেলায় বাধা দিলে বালকেরা যখন মাখনলালকে গুঁড়িসুদ্ধ গড়িয়ে দেয় তখন মাখন ফটিকের নাকে-মুখে আঁচড় কেটে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে চলে যায়। সেই সময়ে ফটিককে দেখা যায়, কাশ উপড়ে তার ডাঁটা চেবাতে। প্রকৃতির মতোই ফটিক তখন তুচ্ছ বিষয়ে যেন উদাসীন। কিন্তু ফটিকের মধ্যে প্রকৃতির সঙ্গে এই সংলগ্নতা অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যখন কলকাতায় থাকাকালীন প্রকৃতির সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে। মামার বাড়িতে অনাদরে-অপমানে থাকার সময়ে ফটিকের মন শুধু তার মা-র জন্য আকুল হয়নি, অবাধ বিচরণের প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার জন্যও সে অস্থির হয়েছে। প্রকান্ড ঘুড়ি নিয়ে উড়ে বেড়ানোর মাঠ, অকর্মণ্যভাবে আপনমনে ঘুড়ে বেড়ানোর নদীতীর, যখন-তখন ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটার সংকীর্ণ স্রোতস্বিনী-এসবই তাকে তার মা-র মতোই আকর্ষণ করত। মামার বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়ার পরে ফটিককে যখন ফিরিয়ে আনা হয় তখন মুশলধারে শ্রাবণের বর্ষা চলছে। প্রকৃতি যেন অশ্রুকাতর হয়ে তৈরি করে দিয়েছে ফটিকের চিরবিদায়ের পটভূমি। এভাবেই প্রকৃতির সঙ্গে মানবাত্মার সংযোগ তৈরি হয়েছে ফটিকের চরিত্রে।

৩। “তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।”-মন্তব্যটির তাৎপর্য আলোচনা করো।

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পটি বয়ঃসন্ধিকালের সংকটের কাহিনি। ফটিক নামে এক কিশোর চরিত্রকে অবলম্বন করে কাহিনির নির্মাণ। আপাত-দুরন্ত এক কৈশোরের সংকটের সূচনা মামার বাড়িতে যাওয়ার পরে। ফটিককে তার মামা বিশ্বম্ভরবাবু কলকাতায় নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন পড়াশোনা শেখাবেন বলে, আর ফটিকের মা তাতে সম্মতি দিয়েছিলেন। কারণ ফটিকে দুরন্তপনা ক্রমশই নিয়ন্ত্রণের অতীত হয়ে উঠছিল। কিন্তু মামার বাড়িতে পৌঁছানোর পরে মামির কাছে ফটিক একেবারেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। একদিকে নিজের তিনছেলে নিয়ে সংসারের দৈনন্দিনতায় বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা যেমন তৈরি হয়েছিল, অন্যদিকে ফটিকের বয়স তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরির পথে বাধা হয়ে উঠেছিল- “….. তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।” এই বয়সের ছেলেদের শোভাও নেই, কোনো কাজেও লাগে না। তারা স্নেহের উদ্রেক ঘটায় না, আবার তাদের সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থিত নয়। “তাহার মুখে আধো আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগলভতা।” তার হঠাৎ বড়ো হয়ে ওঠা, কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা চলে যাওয়া-এসব তার পারিপার্শ্ব মেনে নিতে পারে না। ফটিকের ক্ষেত্রেও ঠিক এটাই ঘটেছে। তার মনে হতে থাকে যে, এই পৃথিবীর সঙ্গে সে ঠিক খাপ খাচ্ছে না। তাই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সে সর্বদা লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে ওঠে। চারপাশের পৃথিবীতে ফটিক শুধুই স্নেহহীনতা দেখে এবং একটা সময়ে মা-র কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য আকুল হয়ে ওঠে।

৪। ছুটি’ গল্পে গ্রাম শহরের দ্বন্দ্বের ছবি কীভাবে ফুটে উঠেছে আলোচনা করো।

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্প আপাতভাবে ফটিকের কিশোর বয়সের সমস্যা ও সংকটের মর্মস্পর্শী উপস্থাপন। কিন্তু সেই সংকটের প্রেক্ষাপটে অন্তর্লীন থেকেছে কাহিনির পটভূমির পালটে যাওয়া এবং গ্রাম-শহরের দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষাপট। নদীর ধারে অনাবিল প্রকৃতিতে ফটিকের বেড়ে ওঠা। ছেলের দলকে নিয়ে তার অকারণ হুল্লোড়, ভাই মাখনলালকে শাসন ইত্যাদির মধ্যে ছিল প্রকৃতির মতোই অনায়াস উচ্ছ্বলতা।

মামারবাড়িতে গিয়ে ফটিক যে জীবনকে প্রত্যক্ষ করে, তা শহরের প্রকৃতির মতোই শুকনো প্রাণহীন। বিশেষত তার মামির আচরণে ফটিক যা লক্ষ করে, তার সঙ্গে শহুরে প্রকৃতির প্রাণহীনতা যেন মিলে যায়। স্কুলে তার প্রতি ব্যবহার, তার মামাতো ভাইদের তাকে এড়িয়ে চলা বা তাদের সেভাবে চলতে শেখানো-এসবের মধ্য দিয়ে শহরজীবনের জটিলতা ও কৃত্রিমতার প্রকাশ ঘটেছে। বাইরের প্রকৃতির সঙ্গে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের অন্তঃপ্রকৃতি, যা গ্রাম-শহরভেদে আলাদা হতে বাধ্য। এই জটিলতা থেকে মুক্তির জন্য ফটিক আবার ফিরে যেতে চেয়েছে তার গ্রামে। প্রকাণ্ড ঘুড়ি নিয়ে ছুটে বেড়ানো সেই মাঠ, আপনমনে সুর বেঁধে অকর্মণ্যভাবে ঘুরে বেড়ানো নদীটি, ইচ্ছামতো তীর থেকে নদীর বুকে সাঁতারের অবাধ স্বাধীনতা ইত্যাদি তার মায়ের মতোই তাকে আকর্ষণ করত। দ্বন্দ্বমুক্তির জন্য ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজেছিল ফটিক। স্বপ্নের মধ্যে জল মেপেছে সে। অতলে চির অবগাহন করেছে ফটিক।

৫। ছোটোগল্প হিসেবে ‘ছুটি’ গল্পের সার্থকতা আলোচনা করো।

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ ছোটোগল্পটি তাঁর সামগ্রিক ছোটোগল্পের ধারায় এক অনবদ্য সৃষ্টি। ঘটনার আকস্মিকতা দিয়ে গল্পের সূচনা।-“বালকদিগের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় চট করিয়া একটা নূতন ভাবোদয় হইল…।” গল্পের সমাপ্তিতেও থেকে যায় এক অতৃপ্তি। ফটিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক অনন্ত ছুটির দেশে যাত্রা করে। স্তব্ধ পারিপার্শ্বিকে থেকে যায় ‘বালাই’ বলে বিবেচিত হওয়া কিশোর বয়সের অসমাধেয় সমস্যা, ছুটিতে বাড়ি ফিরে যাওয়ার ফটিকের অপূর্ণ ইচ্ছা।

ফটিককে কেন্দ্রে রেখে কাহিনিবিন্যাস ঘটানো হয়েছে। ফটিকের বাড়ি আর তার মামার বাড়ির মধ্যে কাহিনি সীমাবদ্ধ থেকেছে। বাড়ি থেকে মামার বাড়িতে যাওয়ায় ফটিকের আগ্রহ যদি প্রথম অংশের অভিমুখ হয়, তাহলে দ্বিতীয় অংশে আছে বাড়িতে ফেরার আকুলতা। কেন্দ্রাতিগ আর কেন্দ্রমুখী দুটি ধারাকে রবীন্দ্রনাথ মিলিয়েছেন ফটিক চরিত্রকে আশ্রয় করে।

ফটিক ছাড়া গোটা কাহিনি জুড়ে আর কোনো চরিত্র নেই। মাখন, ফটিকের মা, মামা, মামি ইত্যাদি চরিত্রগুলি প্রয়োজনসাপেক্ষে এসেছে কাহিনির ক্ষণপরিসরে। জ্বরের ঘোরে জল মাপতে মাপতে ফটিকের মৃত্যুর মহাদেশে অনন্ত ছুটিতে চলে যাওয়া যে করুণ আবহ তৈরি করে, তা গল্পকে অসামান্য পরিণতি দেয়। ‘ঘটনার ঘনঘটা’, ‘অতিকথন’, ‘বহুচরিত্রের সমাবেশ’, ‘তত্ত্ব’ বা ‘উপদেশ’ বাদ দিয়ে ‘ছুটি’ ছোটোগল্প হিসেবে এক অসামান্য শিল্পসিদ্ধি লাভ করেছে।

৬। ‘ছুটি’ গল্পে কিশোর-মনস্তত্ত্বের যে প্রকাশ ঘটেছে তা নিজের ভাষায় লেখো।

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পটি কিশোর মনস্তত্ত্বের এক অসামান্য প্রকাশ। তেরো বছরের এক কিশোরের স্বভাবসুলভ চঞ্চলতা নিয়ে এই গল্পের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। প্রত্যাশিতভাবেই অভিভাবকদের কড়া শাসনের মুখোমুখি হতে হয় এই বয়সে। ফটিকের ক্ষেত্রেও তার মা ছোটো ছেলে মাখন-এর থেকে ফটিককে শাসন করেছিলেন অনেক বেশি। কিন্তু ফটিকের কিশোর বয়স এবং মন প্রকৃত সংকটের মুখোমুখি হয় তার মামার বাড়িতে গিয়ে। ফটিক চরিত্রকে সামনে রেখে রবীন্দ্রনাথ এই বয়সের সমস্যা ও সংকটের ছবিকে তুলে ধরেছেন অসাধারণভাবে। তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলে পৃথিবীতে এক ‘বালাই’ হিসেবে উপস্থিত হয়, যার কোনো শোভা নেই এবং যে কোনো কাজে লাগে না, যাকে দেখে কোনো স্নেহের উদ্রেক হয় না এবং যার সঙ্গসুখ কেউ বিশেষভাবে প্রার্থনা করে না। এই বয়সের কিশোরের মুখে “আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও-জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগলভতা”। তার চেহারা বেমানানভাবে বেড়ে ওঠে এবং কাপড়-চোপড় ছোটো হয়ে গেলে, লোকে ‘কুশ্রী স্পর্ধা’ হিসেবে চিহ্নিত করে। লালিত্য যেমন হারিয়ে যায়, সেরকমই কণ্ঠস্বরের মিষ্টতাও অদৃশ্য হয়ে যায়। এর জন্য চারপাশের মানুষজন তাকে অপছন্দ করতে থাকে। লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মানুষজন মাফ করে দিতে পারে, “কিন্তু এই সময়ে কোনো স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও যেন অসহ্যবোধ হয়।” এই বয়সের কিশোর নিজেও মনে করে পৃথিবীর কোথাও সে ঠিকমতো খাপ খাচ্ছে না, তাই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সে সবসময় লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে থাকে। আর একারণেই তার মধ্যে তৈরি হয় অতিরিক্ত স্নেহকাতরতা। যদিও তা তার কাছে অতি দুর্লভ বস্তু। তার চেহারা এবং ভাব “অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হইয়া যায়।” এই সংকটই গভীরভাবে ঘনিয়ে এসেছিল ফটিকের জীবনে। তার মামি তেরো বছরের এই অশিক্ষিত পাড়াগেঁয়ে ছেলেটির উপস্থিতি একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। তাঁর স্নেহহীন চোখে ফটিক যেন এক ‘দুগ্রহের মতো’ উপস্থিত হয়েছিল এবং ফটিক তা নিজেও বুঝতে পারত। স্নেহকাতর ফটিক তাই তার মায়ের জন্য আকুল হয়ে উঠত এবং সম্ভবত এই বিরূপ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েই সে ‘ছুটি’র সন্ধান করেছিল। এ হল বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত এক কিশোরের নিজেকে আলাদা করে নেওয়ার আকুলতা, মনস্তাত্ত্বিক সংকটে নিজের মতো করে সমাধান খুঁজতে চাওয়া।

৭। “দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়িয়া কেবলই তাহার সেই গ্রামের কথা মনে পড়িত।”-কার কথা বলা হয়েছে? “দেয়ালের মধ্যে আটকে পড়া’ কথাটির তাৎপর্য কী? তার যা যা মনে পড়ত সেগুলি নিজের ভাষায় লেখো। ১+২+২

অথবা, “দেয়ালের মধ্যে অটিকা পড়িয়া কেবলই তাহার সেই গ্রামের কথা মনে পড়িত।”-‘দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়া’ কথাটির তাৎপর্য কী? তার যা যা মনে পড়ত সেগুলি নিজের ভাষায় লেখো। ৩+২

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্পের উল্লিখিত অংশে মুখ্য চরিত্র ফটিকের কথা বলা হয়েছে।

কলকাতায় মামার বাড়িতে এসে ফটিক তার মুক্ত গ্রামজীবনের থেকে বিচ্ছেদ যন্ত্রণা অনুভব করেছে। সেখানে তার জীবন স্কুল আর বাড়ির গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বাইরের পৃথিবীতে যখন হাত ছাড়ার কোনো সুযোগ ছিল না তখন বাড়ির ভেতরটাও তার জন্য ছিল প্রতিকূল। সেখানে মামির কাছে ফটিক ছিল অবাঞ্ছিত। প্রথম থেকেই নিজের সংসারে অতিরিক্ত একজনের উপস্থিতি মামি মেনে নিতে পারেননি। ফটিক তার কাছে ‘বালাই’ হয়ে উঠেছিল। এমনকি মামি কোনো কাজ দিলে উৎসাহের সঙ্গে ফটিক যদি কিছুটা বেশি কাজ করে দিত, তাহলেও তাকে তিরস্কৃত হতে হত। এই অনাদর এবং উপেক্ষার কারণে চারপাশের দেয়াল যেন দুর্ভেদ্য হয়ে উঠেছিল ফটিকের কাছে।

ফেলে আসা গ্রামজীবন বার বার ফটিককে যেন ইশারা করত। প্রকান্ড ঘুড়ি নিয়ে উড়ে বেড়ানোর সেই মাঠ, নিজস্ব ছন্দে নৃত্যপর হয়ে আপন মনে গান গেয়ে বেড়ানোর সেই নদীতীর, দিনের মধ্যে যখন-তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটার সেই সংকীর্ণ স্রোতস্বিনী, প্রিয় বালকদল, অবাধ স্বাধীনতা এবং সকলের ওপরে তার ‘অত্যাচারিণী অবিচারিণী মা’ প্রতিটা মুহূর্ত অসহায় ফটিকের মনকে আকর্ষণ করত।

৮। – ‘ছুটি’ গল্পে মামাবাড়িতে গিয়ে ফটিকের যে দুরবস্থা হয়েছিল তা নিজের ভাষায় লেখো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে ফটিককে তার মামা বিশ্বম্ভরবাবু যখন কলকাতায় তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে চান, ফটিক সাগ্রহে সেই প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল এবং কবে, কখন সেখানে যেতে পারবে তা জানতে চেয়ে মামাকে অস্থির করে তুলেছিল। অতি উৎসাহে সে বিনিদ্র রজনী যাপনও করেছিল। কিন্তু মামার বাড়িতে তার অভ্যর্থনা প্রত্যাশিত হয়নি। তার মামি এই ‘অনাবশ্যক পরিবার বৃদ্ধি’-তে একেবারেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কারণ নিজের তিনটি ছেলেকে নিয়ে তাঁর যে ব্যস্ততার সংসার সেখানে তেরো বছরের অপরিচিত পাড়াগেঁয়ে ফটিককে তিনি ‘বিপদের সম্ভাবনা’ বলে মনে করেছিলেন। সেই মামির স্নেহহীন চোখে ফটিক ‘একটা দুগ্রহের মতো’ প্রতিভাত হচ্ছিল এবং মামি তাকে কোনো কাজ করতে বললে তাঁকে খুশি করতে সে মনের আনন্দে যতটা আবশ্যক তার থেকে বেশি কাজ করে ফেলত এবং তাতে মামি আরও বিব্রত হতেন। তিনি ফটিককে পড়াশোনায় মন দিতে বললে, তার মানসিক উন্নতির প্রতি মামির এই যত্ন ফটিকের কাছে ছিল ‘নিষ্ঠুর অবিচার’। স্কুলেও ফটিক ছিল সকলের চোখে নির্বোধ এবং অমনোযোগী। মাস্টারমশাই ফটিককে এতটাই মারধোর ও অপমান করতেন এবং তার এতটাই দুরবস্থা হত যে মামাতো ভাইরা পর্যন্ত তার সঙ্গে সম্পর্ক স্বীকার করতে লজ্জাবোধ করত। এরমধ্যে বই হারিয়ে ফেলায় তাকে আরও অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়তে হয়। মামি সেকথা শুনে তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, “আমি তোমাকে মাসের মধ্যে পাঁচবার করে বই কিনে দিতে পারিনে।” ফটিক এই অনাদর, উপেক্ষা স্পষ্টই বুঝতে পারত। যে কারণে তার জ্বর এলেও সে মনে করেছিল মামি এটাকে ‘অনর্থক উপদ্রব’ এবং ‘অনাবশ্যক জ্বালাতন’ হিসেবে দেখবে। ঠিক এই কারণেই সে মামার বাড়ি ত্যাগ করে। কিন্তু পুলিশের সাহায্য নিয়ে যখন তাকে ফিরিয়ে আনা হয় তখন ফটিকের দুরবস্থা আরও বেড়ে যায়। অসুস্থ ফটিককে দেখে তার মামি ‘পরের ছেলেকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলেন। এভাবেই মামার বাড়িতে অপমান আর অনাদরে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছিল ফটিককে, যেখান থেকে সে হয়তো মুক্তি পেয়েছিল মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

৯। ছুটি’ গল্পের কাহিনিতে বিশ্বস্তরবাবুকে যে ভূমিকায় পাওয়া যায় তা আলোচনা করো।

কথামুখ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে বিশ্বম্ভরবাবু ছিলেন ফটিকের মামা। কাহিনিতে তাঁর সক্রিয়তা খুব বেশি না থাকলেও বিশ্বম্ভরবাবুর চরিত্রটি কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।

দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতার নিদর্শন: পশ্চিমের কাজ থেকে বহুকাল পরে দেশে ফিরে বিশ্বম্ভরবাবু তাঁর ‘বিদেশি নৌকা’ করে এসেছিলেন ফটিকের মা অর্থাৎ তাঁর বোনকে দেখতে। এই ঘটনায় গল্পের কাহিনি নতুন খাতে প্রবাহিত হয়, কারণ ফটিকের মার কাছে ফটিকের উচ্ছৃঙ্খলতা, পাঠে অমনোযোগ ইত্যাদির কথা শুনে তিনি তাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রেখে পড়াশোনা করানোর প্রস্তাব দেন। এই সিদ্ধান্তের জন্য নিজের স্ত্রীর গঞ্জনার মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। কিন্তু বিশ্বম্ভরবাবুর এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে বিধবা বোন ও ভাগিনেয়-র প্রতি তাঁর দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতার নিদর্শন।

স্নেহপরায়ণ: পরবর্তীতে বিশ্বম্ভরবাবুর এই স্নেহপরায়ণতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে যখন অসুস্থ ফটিক কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় সেই সময়ে। ফটিককে উদ্ধারের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরে তিনি পুলিশে খবর দেন। পুলিশ যখন ফটিককে উদ্ধার করে আনে তখন বিশ্বম্ভরবাবুকে দেখা যায় প্রায় কোলে করে ফটিককে অন্তঃপুরে নিয়ে যেতে। এই ঘটনাতেও তাঁকে নিজের স্ত্রীর গঞ্জনার মুখোমুখি হতে হয়। ফটিকের অসুস্থতা যখন বেড়ে উঠেছে, তার মায়ের অনুপস্থিতিতে বিশ্বম্ভরবাবুই ফটিকের কাছে বসে তার শীর্ণ তপ্ত হাত নিজের হাতের ওপর তুলে নিয়েছেন। দিন কেটে গিয়েছে, কিন্তু ফটিকের রোগশয্যার পাশে বিশ্বম্ভরবাবু তাঁর বোন আসা পর্যন্ত বসে থেকেছেন।

শেষকথা: সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে উদারতা, স্নেহপরায়ণতা ও সন্তানবাৎসল্যের যে নিদর্শন বিশ্বম্ভরবাবু দেখিয়েছেন তা তার চরিত্রকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে।

১০। ‘ছুটি’ গল্প অবলম্বনে ফটিকের মামির চরিত্র বিশ্লেষণ করো।

কথামুখ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে ফটিকের মামি আপাতভাবে এক নেতিবাচক চরিত্র। মূলত একমুখী এবং সরলরৈখিক চরিত্র হলেও ফটিকের মামির কিছু নিজস্ব স্বভাববৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।

ফটিকের প্রতি বিরূপতা: ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু যেদিন প্রথম ফটিককে কলকাতায় তার বাড়িতে নিয়ে আসেন সেদিন থেকেই ফটিকের মামির মধ্যে ফটিকের প্রতি বিরূপতা লক্ষ করা যায়। স্বামীর কান্ডজ্ঞান নিয়েই তার মনে প্রশ্ন তৈরি হয়। ফটিক বুঝতে পারত যে, মামির চোখে সে একটা দুর্গ্রহের মতো প্রতিভাত হচ্ছে। মামির দেওয়া কোনো কাজ ফটিক অতি উৎসাহে একটু বেশি করে ফেললে তিনি তাকে তিরস্কার করতেন এবং নিজের কাজে মন দিতে বলতেন। ফটিক বই হারিয়ে ফেললে তিনি রীতিমতো বিব্রত হন এবং ফটিককে তিরস্কার করে বলেন যে ‘মাসের মধ্যে পাঁচবার’ তিনি বই কিনে দিতে পারবেন না। ফটিকের মামির আচরণ ফটিককে শুধু ‘হীনতা এবং দৈন্য’-এ অবসন্ন করে তুলেছিল।

সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতা: ফটিকের প্রতি তার মামির যে বিরূপতা তার অন্যতম কারণ ছিল তাঁর নিজের সংসারের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা। নিজের তিন ছেলেকে নিয়ে তাঁর যে ‘ঘরকন্না’ সেখানে আর-একটি তেরো বছরের ‘অপরিচিত অশিক্ষিত পাড়াগেঁয়ে’ ছেলের উপস্থিতি তিনি মেনে নিতে পারেননি।

দায়িত্ববোধ: ফটিককে পছন্দ না করলেও ফটিকের মামির মধ্যে দায়িত্ববোধের অভাব ছিল না। সেই কারণেই দেখা যায় ফটিক যখন বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, সেই সময় সমস্ত দিন তিনি খাওয়া-দাওয়া করেননি এবং নিজের ছেলেদের সঙ্গেও অনেক খিটমিট করেছিলেন। নিজস্ব দায়িত্ববোধের কারণেই তার মধ্যে এই অস্থিরতা দেখা গিয়েছে। আধুনিককালের অণু পরিবারের আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার প্রতীক হলেও ফটিকের মামির মধ্যে স্বভাবগত স্বাতন্ত্র্য এভাবেই স্পষ্ট হয়েছে।

১১। “মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”-কে, কেন এ কথাটি বলেছে? এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যে গভীর তাৎপর্যের প্রতিফলন ঘটেছে, তা লেখো। ২+৩

অথবা, “মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”-কোন প্রসঙ্গে এই উক্তি? মন্তব্যটির তাৎপর্য লেখো। ২+৩ 

অথবা, “মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”-কে, কখন এ কথা বলেছে? এ কথা বলার কারণ কী? ২+৩ 

অথবা, “মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”-এই আকুলতার কারণ কী? শেষ পর্যন্ত বক্তা তার কাঙ্ক্ষিত ছুটি কীভাবে পেয়েছিল? ২+৩ 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে প্রশ্নোদ্ভূত মন্তব্যটি কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিক তার মা-কে উদ্দেশ করে বলেছে।

ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে কলকাতায় পড়াশোনার জন্য নিয়ে গেলেও একদিকে মামার বাড়িতে মামির অনাদর, অন্যদিকে শহরের বদ্ধ জীবন ফটিককে কখনোই পড়াশোনায় আকৃষ্ট করতে পারেনি। ফলে স্কুলে সে ‘নির্বোধ এবং অমনোযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। মাস্টারমশাই তাকে পড়া না পারার জন্য মারতেন, এমনকি তার মামাতো ভাইরা পর্যন্ত তার সঙ্গ এড়িয়ে চলা পছন্দ করত। ঘরে এবং বাইরে এত অনাদর এবং উপেক্ষার মধ্যে থাকতে থাকতেই ফটিকের মা-র কাছে যাওয়ার ইচ্ছা হত। তার মামা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে কার্তিক মাসে পুজোর ছুটির সময় সে বাড়ি যাবে। তখন থেকেই শুরু হয় ছুটির জন্য ফটিকের অধীর অপেক্ষা।

অসুস্থ হওয়ার পরে ফটিক নিজেই নিজের ছুটি করে নিতে চেয়েছিল, কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে। কিন্তু মামার উদ্যোগে পুলিশের গাড়ি তাকে ফিরিয়ে আনে। নশ্বর জীবনে যে ছুটি ফটিক চেয়েছিল সে তা পায়নি, কিন্তু মৃত্যু তাকে সেই ছুটির সুযোগ করে দিয়েছে। ছুটিতে সে তার মা-র কাছে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু সফল হয়নি। সেই মা-কে পাশে রেখেই ফটিক যাত্রা করেছে অনন্ত ছুটির দেশে।

১২। “পরদিন প্রাতঃকালে ফটিককে আর দেখা গেল না।”-ফটিককে পরদিন সকালবেলা কেন দেখা যায়নি? কীভাবে তার খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল? ৩+২

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে ফটিক তার মামার বাড়িতে মামির কাছে ছিল অপাঙ্ক্তেয়। নানা কারণে বারেবারে সেখানে তাকে তিরস্কৃত হতে হয়েছিল। এই কারণে একদিন স্কুল থেকে ফেরার পরে যখন তার মাথাব্যথা শুরু হয় এবং শীত করতে থাকে, আর সে বুঝতে পারে যে তার জ্বর আসছে। তখনই ফটিকের উপলব্ধি হয় যে, অসুস্থ হলে মামির প্রতি অনর্থক উপদ্রব করা হবে। মামি তার অসুস্থতাকে এক ‘অনাবশ্যক জ্বালাতন’ হিসেবে দেখবে-এটা সে স্পষ্ট বুঝতে পারে। অসুস্থতার সময়ে মা ছাড়া অন্য কারও কাছে কোনোরকম সেবা প্রত্যাশা করা যে উচিত নয় তা-ও ফটিক সহজেই বুঝতে পারে। এই সমস্ত কারণেই বাড়ির লোকদের বিড়ম্বিত না করার জন্যই সে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই পরদিন সকালবেলায় ফটিককে আর দেখা যায় না।

ফটিক নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর চারপাশে প্রতিবেশীদের বাড়িতে খোঁজ করা হয়, কিন্তু তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। রাত্রি থেকেই যেহেতু মুশলধারে বৃষ্টি পড়ছিল সেইকারণে সকলেই ফটিককে খুঁজতে গিয়ে রীতিমতো ভিজে যায়। অবশেষে কোথাও তাকে না পেয়ে তার মামা বিশ্বম্ভরবাবু পুলিশে খবর দেন। সমস্ত দিনশেষে সন্ধের সময় বিশ্বম্ভরবাবুর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় পুলিশের গাড়ি এবং অবিরাম বৃষ্টিতে এক হাঁটু জলের মধ্য দিয়ে দুজন পুলিশের লোক ফটিককে ধরে নামিয়ে বিশ্বম্ভরবাবুর কাছে নিয়ে আসে।

১৩। “নিজের হীনতা এবং দৈন্য তাহাকে মাটির সহিত মিশাইয়া ফেলিল।”-কার সম্পর্কে, কোন্ পরিপ্রেক্ষিতে এই মন্তব্যটি করা হয়েছে তা নিজের ভাষায় লেখো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের প্রশ্নোদ্ভূত অংশে কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিকের কথা বলা হয়েছে।

ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে তাঁর কাছে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিলেন ভালো করে লেখাপড়া শেখানোর জন্য। কিন্তু একদিকে মামির কাছে অনাদৃত হওয়া, অন্যদিকে তার ফেলে আসা জীবনের জন্য মনখারাপের অনুভূতি-এইসব কারণ পড়াশোনার প্রতি ফটিককে উদাসীন করে রাখে। স্কুলে সে চিহ্নিত হয় ‘নির্বোধ এবং অমনোযোগী’ বালক হিসেবে। মাস্টারমশাইয়ের মার, অপমান ইত্যাদির আবহেই একদিন ফটিক স্কুলে তার বই হারিয়ে ফেলে। ফলে ‘অমনোযোগী’ ফটিকের পক্ষে পড়াশোনা করা একেবারে দুরূহ হয়ে ওঠে। অবস্থা এমন পর্যায়ে যায় যে, ফটিকের মামাতো ভাইরা পর্যন্ত তার সঙ্গে সম্বন্ধ স্বীকার করতে লজ্জাবোধ করতে থাকে এবং তার কোনো অপমানে তারা অন্যান্য বালকদের থেকেও অনেক বেশি আমোদ জোর করে প্রকাশ করতে থাকে। পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠলে ফটিক একদিন তার মামির কাছে গিয়ে ‘নিতান্ত অপরাধীর মতো’ বই হারানোর কথা জানায়। মামি দৃশ্যতই যথেষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করে রূঢ়ভাবে বলেন যে, ‘মাসের মধ্যে পাঁচবার’ তার পক্ষে বই কিনে দেওয়া সম্ভব না। ফটিক আর-কিছু না বললেও ‘পরের পয়সা নষ্ট’ করার গ্লানি তার মনের মধ্যে চেপে বসে। মায়ের প্রতি তার তীব্র অভিমান হয় এবং তখনই নিজের ‘হীনতা এবং দৈন্য’ তাকে যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়।

১৪। “….পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।”-কাকে ‘বালাই’ বলা হয়েছে, তা লেখককে অনুসরণ করে মনোভাবটি বিশ্লেষণ করো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের প্রশ্নোদ্ভূত অংশে ফটিকের মামির ভাবনাসূত্রে লেখকের মনে হয়েছে যে তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলে পৃথিবীতে একটা ‘বালাই’।

ফটিককে তার মামা বিশ্বম্ভরবাবু কলকাতায় নিজের বাড়িতে নিয়ে এলে তাঁর স্ত্রী সেই সিদ্ধান্ত মানতে পারে না। নিজের তিন ছেলের সঙ্গে অতিরিক্ত আর-একজনের দায়িত্ব নেওয়া কতটা ঝামেলার হতে পারে তা বিশ্বম্ভরবাবু বোঝেননি বলে তাঁর স্ত্রী তাঁর প্রতি ক্ষোভপ্রকাশ করেন। এই প্রসঙ্গে লেখকের মনে হয়েছে যে, ফটিকের বয়স তার বিরুদ্ধে যায়। একটি তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলের কোনো শোভা নেই, আবার কোনো কাজেও লাগে না। তাকে দেখে স্নেহের উদ্রেক হয় না, আবার তার সঙ্গসুখও একেবারেই প্রার্থনীয় নয়। “তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগলভতা।” তার হঠাৎ বেড়ে ওঠার কারণে কাপড়-চোপড় ছোটো হয়ে যায় এবং সকলে সেটাকে একটা ‘কুশ্রী স্পর্ধা’ বলে মনে করে। শৈশবের সৌন্দর্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা হঠাৎ করে চলে যায় এবং তার জন্য সকলে সেই কৈশোরকেই দায়ী করে। শৈশব ও যৌবনের অনেক দোষ মাফ করে দেওয়া যায়, কিন্তু এই বয়সের কোনো স্বাভাবিক ত্রুটিকেও সকলের অসহ্য বলে মনে হয়।

১৫। বিধবা এ প্রস্তাবে সহজেই সম্মত হইলেন।”-কে, কী প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং কখন? সেই প্রস্তাবে বাড়ির সকলের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? ৩+২

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের প্রশ্নোদৃত অংশে যে প্রস্তাবের কথা বলা হয়েছে সেটি ফটিকের মা-কে দিয়েছিলেন ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু।

বহুদিন পশ্চিমে কাজ করার পর দেশে ফিরে বিশ্বম্ভরবাবু এসেছিলেন তাঁর বোনের সঙ্গে দেখা করার জন্য। খুব সমারোহে কয়েক দিন কাটানোর পরে বিদায় নেওয়ার দু-একদিন আগে বিশ্বম্ভরবাবু তাঁর বোনের কাছে ছেলেদের পড়াশোনা এবং মানসিক উন্নতি বিষয়ে জানতে চান। ফটিকের মা ফটিকের অবাধ্যতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, পাঠে অমনোযোগ ইত্যাদির অভিযোগ করেন; অন্যদিকে মাখনলালের শান্ত স্বভাব এবং পড়াশোনায় আগ্রহের প্রশংসা করেন। এ কথা শোনার পরেই বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রেখে লেখাপড়া শেখানোর প্রস্তাব দেন।

এই প্রস্তাবে ফটিকের মা সহজেই সম্মত হয়েছিলেন, কারণ ফটিকের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগের তালিকা দীর্ঘতর ছিল। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে, ফটিক তাঁর ‘হাড় জ্বালাতন’ করে দিচ্ছে। ছোটো ছেলে মাখনলালকে ফটিক কখন কোন্ দুর্ঘটনার মধ্যে ফেলে দেয়, সেই আশঙ্কাও ফটিকের মায়ের ছিল। অন্যদিকে ফটিকও এই যাওয়ার প্রস্তাবে আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়ে যায়। অতি-আগ্রহী হয়ে সে তার মামাকে অস্থির করে তোলে। উৎসাহে রাতে তার ঘুম হয় না। ফটিকের যাওয়ার বিষয়ে তার মা-র পূর্ণসম্মতি থাকলেও ফটিকের অতি-উৎসাহ তাকে ‘ঈষৎ ক্ষুণ্ণ’ করে। যাওয়ার সময়ে আনন্দিত ফটিক উদারভাবে তার ছিপ, ঘুড়ি, লাটাই সমস্ত কিছুর সম্পূর্ণ অধিকার মাখনকে দিয়ে যায়।

১৬। “গুঁড়ি এক পাক ঘুরিতে-না-ঘুরিতেই মাখন তাহার গাম্ভীর্য, গৌরব এবং তত্ত্বজ্ঞান-সমেত ভূমিসাৎ হইয়া গেল।”-ঘটনাটি উল্লেখ করো এবং ফটিকের ওপরে এর কী প্রভাব পড়েছিল লেখো। ২+৩

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে ফটিকের নেতৃত্বে বালকদল নদীর ধারে থাকা একটা শালের গুঁড়ি গড়িয়ে দেওয়ার খেলায় মেতেছিল। কিন্তু ফটিকের ছোটোভাই মাখনলাল সে খেলার পথের বাধা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ সে সেই গুঁড়ির ওপরে গিয়ে বসে এবং কোনোভাবেই তাকে গুঁড়ি থেকে নামানো যায় না। সেই কাজে ব্যর্থ হয়ে অতঃপর তাদের মনে নতুন একটা খেলার পরিকল্পনা আসে এবং তারা ঠিক করে নাছোড় মাখনলালকে সুদ্ধ শালকাঠের গুঁড়িটিকে গড়িয়ে দেবে। মাখনলাল মনে করে যে, এতে তার গৌরব বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এই ঘটনার পরিণতি কী হতে পারে তা মাখনলাল কিংবা দলের অন্য সদস্যরা কেউই অনুমান করতে পারেনি। গুঁড়ি এক পাক ঘোরার সঙ্গে সঙ্গেই মাখনলাল মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনার দিকেই এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

মাখনলাল কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে চলে যাওয়ার পর ফটিকদের খেলা ভেঙে যায়। ফটিক একটা নৌকার গলুই-এর ওপরে বসে কাশের গোড়া চিবোতে থাকে। কিছু সময় পরে বাঘা বাদি এসে ফটিককে জানায় যে, তার মা তাকে ডাকছে। ফটিক যেতে না চাইলে বাঘা তাকে আড়কোলা করে তুলে নিয়ে যায়। ফটিককে দেখামাত্রই তার মা জানতে চান সে মাখনকে মেরেছে কি না। ফটিক অস্বীকার করলেও তার মা তার কথা বিশ্বাস করেন না। অন্যদিকে মাখন জানায় যে, ফটিক তাকে মেরেছে। ফটিক এই মিথ্যাচার সহ্য করতে না পেরে মাখনকে ‘এক সশব্দ চড়’ কষিয়ে দেয়। ফটিকের এই আচরণ সহ্য করতে না পেরে তার মা ফটিককে পালটা দু-তিনবার চড় মারেন, ফটিকও এইসময় তার মাকে ঠেলে দেয়। ফটিকের মা এই আচরণের প্রতিক্রিয়ায় যখন চিৎকার করছেন, সেই সময়েই তাদের বাড়িতে ফটিকের মামার প্রবেশ ঘটে এবং অশান্তিপূর্ণ ঘটনাটির আপাত-উপসংহার ঘটে।

১৭। ছুটি’ গল্প অবলম্বনে নদীর ধারে বালকদলের খেলার দৃশ্যটি নিজের ভাষায় বর্ণনা করো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে নদীর ধারে বালকদলের খেলার দুটি দৃশ্য তৈরি হয়েছিল। ফটিক ছিল সেই দলের নেতা এবং দুটি ক্ষেত্রেই পরিকল্পনা ছিল তারই। দলের অন্য সদস্যরা সেই পরিকল্পনা অনুমোদন এবং কার্যকরী করেছিল মাত্র।

দৃশ্য: ১-নদীর ধারে একটা প্রকাণ্ড শালকাঠের গুঁড়ি কেউ রেখে দিয়েছিল মাস্তুল তৈরি করার জন্য। ফটিক পরিকল্পনা করে যে, সেটিকে সকলে মিলে গড়িয়ে নিয়ে যাবে। যার কাঠ প্রয়োজনের মুহূর্তে সে অত্যন্ত বিস্মিত, বিরক্ত ও অসুবিধাবোধ করবে-এই উপলব্ধি থেকে বালকেরা সেই প্রস্তাব সম্পূর্ণ অনুমোদন করে এবং সকলে মিলে মনোযোগের সঙ্গে সেই কাজে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু ফটিকের ছোটোভাই মাখনলাল গম্ভীরভাবে সেই গুঁড়ির ওপরে গিয়ে বসায় ছেলেদের সেই প্রাথমিক উদ্যম আঘাতপ্রাপ্ত হয়। কয়েকজন এসে তাকে একটু ঠ্যালার চেষ্টা করে, কিন্তু তাতেও সে বিচলিত হয় না। ফটিক এসে ভাইয়ের প্রতি আস্ফালন করে কিন্তু মাখনলাল নিজের অবস্থানে অনড় থাকে, বরং আসনটি যেন স্থায়ীভাবে দখল করে নেয়।

দৃশ্য: ২-মাখনের অনড় মনোভাব দেখে ফটিকের মনে নতুন একটা

পরিকল্পনা আসে। তার মনে হয় যে, সেটি আগের থেকে আরও একটি ‘ভালো খেলা’ হতে পারে, কারণ তাতে ‘আরেকটু বেশি মজা আছে’। সে প্রস্তাব করে যে, মাখনকে সুদ্ধ কাঠের গুঁড়িটি গড়িয়ে দিতে হবে। মাখন মনে করে যে, তাতে তার গৌরব আছে। কিন্তু অন্যান্য পার্থিব গৌরবের মতোই তাতেও যে কিছু বিপদের সম্ভাবনা আছে তা সে ভাবতে পারেনি। মাখন তার সমস্ত ‘গাম্ভীর্য গৌরব এবং তত্ত্বজ্ঞান-সমেত’ মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। খেলার শুরুতেই এই আশাতীত ফল লাভকরে অন্যান্য বালকেরা অত্যন্ত আনন্দিত হলেও ফটিক এই বিপর্যয়ে শশব্যস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে মাখন মাটি থেকে উঠে দাদার প্রতি তীব্র রাগ প্রকাশ করে এবং তার নাকে-মুখে আঁচড় কেটে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে চলে যায়। বালকদের খেলাও ভেঙে যায়।

১৭। তাহাই উপলব্ধি করিয়া বালকেরা এ প্রস্তাবে সম্পূর্ণ অনুমোদন করিল”-কোন্ প্রস্তাবে বালকেরা কেন অনুমোদন করেছিল? সেই প্রস্তাব কার্যকরী করার পথে কোন্ বাধা উপস্থিত হয়েছিল? ৩+২

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের উল্লিখিত অংশে নদীর ধারে পড়ে থাকা একটা প্রকাণ্ড শালকাঠের গুঁড়িকে খেলাচ্ছলে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ফটিক-প্রদত্ত প্রস্তাবের কথা বলা হয়েছে।

বালকদল তাদের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর দেওয়া প্রস্তাবকে মেনে নিয়েছিল। শালকাঠের টুকরোটি মাস্তুলে রূপান্তর করার জন্য নদীর ধারে রাখা ছিল। বালকদল ভেবেছিল, ব্যক্তি প্রয়োজনের সময় কাঠটা খুঁজে না পেয়ে বিস্মিত এবং বিরক্ত হবে, তার অসুবিধা হবে-এই উপলব্ধি থেকেই তারা ফটিকের প্রস্তাব সোৎসাহে মেনে নিয়েছিল।

সকলে যখন কোমর বেঁধে কাঠের টুকরোটি গড়ানোর কাজে মনোযোগ দিয়েছে, সেই সময় ফটিকের ছোটো ভাই মাখনলাল গম্ভীরভাবে সেই শালকাঠের গুঁড়ির ওপরে গিয়ে বসে। খেলার প্রতি মাখনের এই ঔদাসীন্য দেখে বালকের দল বিমর্ষ হয়ে যায়। কয়েকজন তাকে সামান্য ঠেললেও সে বিচলিত হয় না। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, “এই অকাল-তত্ত্বজ্ঞানী মানব সকল প্রকার ক্রীড়ার অসাড়তা সম্বন্ধে নীরবে চিন্তা” করছে। ফটিক এসে আস্ফালন করলেও এবং তাকে মারার ভয় দেখালেও মাখনলাল সেই জায়গা ছেড়ে ওঠেনি। এভাবেই বালকদের খেলার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হয়েছিল।

আরো পড়ুন : একাদশ শ্রেণি দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment