ভারত সরকারের বিভিন্ন বিভাগসমূহ (চতুর্থ অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান | Organs of the Indian Governments (4th Chapter) Question Answer Class 12 Semester IV

১। ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করো।
অথবা, ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাসমূহ বিশ্লেষণ করো।
অথবা, ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলোচনা করো।
ভূমিকা: ভারতের সংবিধানে কেন্দ্রীয় শাসন বিভাগের সর্বোচ্চ পদাধিকারী হলেন রাষ্ট্রপতি। সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি অনুসারে তিনি ভারতে নিয়মতান্ত্রিক শাসক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলি :
সংবিধানের ৫৩ (১) নং ধারায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা আছে। এগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন-
① শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা: রাষ্ট্রপতির শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতাগুলি হল-
- রাষ্ট্রপতি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ করেন এবং তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী অন্যান্য মন্ত্রীদেরও নিয়োগ করে থাকেন। পাশাপাশি হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট, নির্বাচন কমিশনার-সহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিকদের তিনি নিয়োগ করেন।
- রাষ্ট্রপতি ভারতের সামরিক বাহিনীর প্রধান। তিনি স্থল, জল এবং আকাশ বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ করেন। তিনি জাতীয় প্রতিরক্ষা কমিটির প্রধান।
② আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা: রাষ্ট্রপতি ভারতের পার্লামেন্টের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তিনি পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের অধিবেশন আহবান করেন, আবার প্রয়োজনে স্থগিত রাখেন। তিনি পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভাকে ভেঙে দিতে পারেন। আইন সংক্রান্ত ক্ষমতার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা হল-
- রাষ্ট্রপতির সম্মতি ব্যতিরেকে কোনো বিল আইনে পরিণত হতে পারে না। পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে একটি বিল গৃহীত হওয়ার পর সেটি রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য প্রেরিত হয়।
- পার্লামেন্টের অধিবেশন না থাকলে, রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন।
③ অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা: রাষ্ট্রপতির সম্মতি ছাড়া অর্থবিল লোকসভায় পেশ করা যায় না। তবে কোনো অর্থবিলকে এবং সংবিধান-সংশোধনী বিলকেও তিনি পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারেন না। তাছাড়া রাষ্ট্রপতি ৫ বছর অন্তর অর্থ কমিশন গঠন করেন।
④ বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা: রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ করেন। সংসদের সুপারিশক্রমে তিনি বিচারপতিদের পদচ্যুতও করতে পারেন। এ ছাড়াও রাষ্ট্রপতি মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ডাদেশ মকুব করতে পারেন [৭২নং ধারানুযায়ী]।
⑤ জরুরি অবস্থাকালীন ক্ষমতা: দেশে কোনোরকম জরুরি অবস্থা দেখা দিলে বা কোনো রাজ্যে সাংবিধানিক অচলাবস্থা দেখা দিলে অথবা অর্থনৈতিক সংকটের উদ্ভব ঘটলে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি তিন ধরনের জরুরি ক্ষমতা ভোগ করেন। যথা- জাতীয় জরুরি অবস্থা, শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা এবং আর্থিক জরুরি অবস্থা।
উপসংহার: রাষ্ট্রপতির প্রকৃত পদমর্যাদা এবং মন্ত্রীসভার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক প্রসঙ্গে গভীর মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে। একশ্রেণির সংবিধান বিশেষজ্ঞের মতে, রাষ্ট্রপতিই হলেন দেশের প্রকৃত শাসক। আবার বাস্তববাদী সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে রাষ্ট্রপতি হলেন নিয়মতান্ত্রিক শাসকপ্রধান। ভারতের রাষ্ট্রপতির উল্লিখিত ক্ষমতা বিশ্লেষণের পর রাষ্ট্রপতিকে প্রভৃত ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি অন্য। তিনি হলেন নামসর্বস্ব শাসক, প্রকৃত শাসক নন। তা সত্ত্বেও ভারতের রাষ্ট্রপতিকে দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং জাতীয় ঐক্যের – প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।
২। ভারতের রাষ্ট্রপতির জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতাগুলি কী লেখো।
ভূমিকা: ভারতীয় সংবিধানের অষ্টাদশ অধ্যায়ে (৩৫২, ৩৫৬ এবং ৩৬০ নং ধারা) রাষ্ট্রপতির জরুরি ক্ষমতা সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করা হয়েছে।
ভারতের রাষ্ট্রপতির জরুরি ক্ষমতার বিবরণ: ভারতের রাষ্ট্রপতির জরুরি ক্ষমতাগুলি হল-
① জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা :
সংবিধানে ৩৫২ নং ধারা রাষ্ট্রপতিকে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তিনি যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিদ্রোহ ঘটলে বা ঘটার আশঙ্কা দেখা দিলে সমগ্র ভারত বা ভারতের কোনো অংশের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন।
অনুমোদন ও মেয়াদ: জাতীয় জরুরি অবস্থা পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের মোট সদস্যের অর্ধেক এবং উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের দ্বারা অনুমোদিত হতে হয়, না হলে ঘোষণাটি বাতিল হয়ে যায়। জাতীয় জরুরি অবস্থা ৬ মাস পর্যন্ত বলবৎ থাকতে পারে। রাষ্ট্রপতি প্রয়োজন মনে করলে পার্লামেন্টের মেয়াদ আরো ৬ মাস বৃদ্ধি করতে পারে। এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি তিনবার জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করেছেন।
② রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা সংক্রান্ত ঘোষণা:
সংবিধানের ৩৫৬ নং ধারানুযায়ী কোনো অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপালের রিপোর্টের ভিত্তিতে বা অন্য কোনোভাবে রাষ্ট্রপতি যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে সেই রাজ্যের প্রশাসন সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে না তাহলে রাষ্ট্রপতি সেইসকল রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা বলবৎ করতে পারেন।
অনুমোদন ও মেয়াদ: শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ঘোষণার ২ মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে অর্থাৎ লোকসভা ও রাজ্যসভায় পৃথকভাবে এই ঘোষণাটিকে অনুমোদন করাতে হয়। যদি ঘোষণাটি অনুমোদিত না হয় তাহলে ২ মাস পরে তা অকার্যকর বলে বিবেচিত হয়। শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার ঘোষণাটি অনুমোদিত হলে এই জরুরি অবস্থা ৬ মাস পর্যন্ত বলবৎ থাকে। তবে প্রয়োজন মনে করলে পার্লামেন্টের অনুমোদন নিয়ে এর মেয়াদ ৩ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যায়। বিভিন্ন রাজ্যে ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে অনেকবারই এই জরুরি অবস্থা প্রয়োগ করা হয়েছে।
③ আর্থিক জবুরি অবস্থা ঘোষণা:
সংবিধানের ৩৬০ নং ধারায় আর্থিক জরুরি অবস্থার কথা বলা আর্থিক স্থায়িত্ব বিপন্ন হলে বা অর্থ সংক্রান্ত কোনো হয়েছে। দেশের সমস্ত অংশে বা কোনো অংশে সুনাম নষ্ট হলে, রাষ্ট্রপতি আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন।
অনুমোদন ও মেয়াদ: দু-মাসের মধ্যে এই ঘোষণা পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে অনুমোদিত হওয়া দরকার। তা যদি না হয় তাহলে এই ঘোষণা বাতিল বলে গণ্য হয়। পার্লামেন্টের অনুমোদন নিয়ে এই আর্থিক জরুরি অবস্থা অনির্দিষ্টকাল যাবৎ জারি করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ভারতে এখনও পর্যন্ত এই ঘোষণা একবারও জারি করা হয়নি।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, দেশের শাসনব্যবস্থাকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য জরুরি অবস্থা সম্পর্কিত বিধিব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
৩। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলি বিশ্লেষণ করো।
অথবা, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাজগুলির বিবরণ দাও।
ভূমিকা: ভারতীয় শাসনব্যবস্থা তথা রাজনীতির ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিপত্তির বর্তমান অবস্থাকে অধ্যাপক জোহারি প্রধানমন্ত্রী পদের রাষ্ট্রপতিকরণ বলে অভিহিত করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলি:
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এবং কার্যাবলির প্রকৃতি ও পরিধি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাকে অনুসরণ করেই নির্ধারিত হয়। নিম্নে তাঁর ক্ষমতাগুলি আলোচনা করা হল-
① মন্ত্রীসভার অন্যান্য মন্ত্রীদের মনোনীত করা: প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রীসভার নেতা। সংবিধানের ৭৫ নং ধারানুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য মন্ত্রীদের মনোনীত করেন এবং তাঁদের মধ্যে দফতর বণ্টন করেন। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভার পুনর্গঠন, দফতর পুনর্গঠন প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাছাড়া মন্ত্রীসভার সভাপতি এবং বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সমন্বয়কারী হিসেবেও প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তিনি হলেন ক্যাবিনেট তোরণের ভিত্তিস্বরূপ।
② ক্যাবিনেট সভায় সভাপতিত্ব করা: প্রধানমন্ত্রী হলেন ক্যাবিনেটের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্ব, তিনি এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। এই সভায় সরকারের যাবতীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে।
③ রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন: প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক দলের প্রতিও বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। দল যাতে প্রসারিত হয়, দলের ঐক্য এবং অখণ্ডতা যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে সেই দিকে লক্ষ রেখেই প্রধানমন্ত্রীকে দলের নীতি ও কার্যক্রম নির্ধারণ করতে হয়।
④ রাষ্ট্রপতির প্রধান পরামর্শদাতা: প্রধানমন্ত্রী হলেন রাষ্ট্রপতির প্রধান পরামর্শদাতা। প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমেই রাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রীসভার সংযোগ স্থাপিত হয়। মন্ত্রীসভার যাবতীয় সিদ্ধান্ত সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করানোর দায়িত্ব তাঁর। শাসন সংক্রান্ত কোনো বিষয় বা আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি কিছু জানতে চাইলে তিনি সেবিষয়ে তাঁকে জানিয়ে থাকেন। তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রপতি প্রশাসনের সব ক্ষমতার অধিকারী হলেও কার্যত এসব ক্ষমতা ভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে সরকারের উচ্চপদাধিকারীদের নিযুক্ত করেন।
⑤ মন্ত্রীসভা গঠন : সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার সদস্যদের নিয়োগ করেন। অর্থাৎ মন্ত্রীসভা গঠনে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা চূড়ান্ত। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নিজ দলের নেতৃত্ববর্গকে মন্ত্রীসভায় স্থান প্রদান করে থাকেন।
⑤ পার্লামেন্টের নেতা হিসেবে ভূমিকা পালন : প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। সভার সমস্ত কাজকর্ম তাঁরই নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। আইন প্রণয়ন, নীতি নির্ধারণ ইত্যাদি সরকারের যা কিছু পার্লামেন্ট কর্তৃক সম্পন্ন হয় সেগুলির সব কিছুতেই প্রধানমন্ত্রী বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, ভারতীয় সংবিধানই প্রধানমন্ত্রীর বিপুল ক্ষমতার উৎস বলে বিবেচিত হয়। ভারতে সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও প্রভাব কার্যত তাঁকে একনায়কে পরিণত করেছে।
৪। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মন্ত্রীসভার সম্পর্ক আলোচনা করো।
অথবা, মন্ত্রীপরিষদের নেতা হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা আলোচনা করো।
ভূমিকা: সংবিধানের ৭৪ নং ধারা অনুসারে প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রী পরিষদের নেতা এবং মন্ত্রীসভার মূলভিত্তি। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী পরিষদ ও ক্যাবিনেটের চরম নিয়ন্ত্রক হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকেন।
প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার সম্পর্ক: প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার সম্পর্ক নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-
① মন্ত্রীসভায় মন্ত্রীদের নিয়োগ: মন্ত্রীসভা গঠনে কার্যত প্রধানমন্ত্রীই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মন্ত্রীসভার অন্যান্য মন্ত্রীগণ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন [৭৫ (১) নং ধারা]। তবে মন্ত্রীসভার সদস্যদের নিয়োগ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী যা খুশি তাই করতে পারেন না। তাঁকে বিশেষ কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হয়, যেমন- নিজ দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা মন্ত্রীসভায় স্থান পাচ্ছেন কি না, সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি থেকে তাঁর দলের প্রতিনিধিরা মন্ত্রীত্ব করার সুযোগ পাচ্ছেন কি না প্রভৃতি।
② মন্ত্রীসভা পুনর্গঠন: মন্ত্রীসভার প্রধানরূপে মন্ত্রীদের মধ্যে দফতর বণ্টন, পুনর্বণ্টন, দফতর পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর প্রভৃত ক্ষমতা আছে। বলা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর ইচ্ছানুযায়ী মন্ত্রীসভার রদবদল ঘটাতে পারেন। তাই মন্ত্রীরা সর্বদাই প্রধানমন্ত্রীর অনুগত হয়ে থাকেন। মন্ত্রীসভার সমস্ত কাজকর্ম তাঁরই নির্দেশে পরিচালিত হয়ে থাকে।
③ মন্ত্রীসভার বিভিন্ন দফতারর মধ্যে সংযোগসাধন : প্রধানমন্ত্রী হলেন রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীপরিষদের সংযোগসাধনকারী। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভার যাবতীয় সিদ্ধান্ত একদিকে রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করেন, অন্যদিকে আবার রাষ্ট্রপতি কোনো বাণী প্রেরণ করলে তিনি তা মন্ত্রীপরিষদকে অবহিত করেন।
④ মন্ত্রীসভার সভাপতি হিসেবে ভূমিকা : প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রীসভার সভাপতি। তাঁকে বলা হয় ‘ক্যাবিনেট তোরণের ভিত্তিপ্রস্তর’। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভার বৈঠক আহবান করেন এবং ওই সভার কর্মসূচি নির্ধারণ করেন। প্রয়োজন মনে করলে তিনি তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের নিয়ে যে-কোনো দিন যে-কোনো সময় কিংবা একদিনে একাধিকবার বৈঠক ডাকতে পারেন। তাছাড়া তাঁর অনুমোদন ব্যতীত কোনো বিষয়সূচিকে ক্যাবিনেটের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।
উপসংহার: মন্ত্রীসভার পর সব সদস্যকে প্রধানমন্ত্রী সমান গুরুত্ব দেন না। এজন্য বিশেষ কয়েকজনের সঙ্গে তিনি পরামর্শ করেন। প্রধানমন্ত্রী তার একান্ত আস্থাভাজন কয়েকজনকে নিয়ে অভ্যন্তরীণ ক্যাবিনেট বা কিচেন ক্যাবিনেট গঠন করে থাকেন। বর্তমানে একে ‘কোর গ্রুপ’ বলা হয়। প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীসভার সম্পর্কের বিষয়টি বিশ্লেষণের শেষে একথা বলা যায় যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রীসভায় শুধুমাত্র সমপর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অগ্রগণ্য নন। সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর স্থান স্বতন্ত্র। ড. আম্বেদকর প্রধানমন্ত্রীকে ‘ক্যাবিনেট তোরণের প্রধান স্তম্ভ’ বলে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান শাসন কাঠামোর প্রেক্ষিতে একথা সর্বতোভাবে সত্যি।
৫। ভারতে শাসন বিভাগের স্থায়ী অংশ বা অরাজনৈতিক অংশ বা আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা ও কার্যাবলি লেখো।
ক্ষমতা ও কার্যাবলি: আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শাসন বিভাগের স্থায়ী অংশ বা আমলাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পাদন করতে হয়। আমলারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব কার্য সম্পাদন করে থাকে সেগুলি হল-
① সরকারি নীতি, সিদ্ধান্ত এ আইনকানুন বাস্তবায়ন: শাসন বিভাগের স্থায়ী অংশের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সরকারের নীতি, সিদ্ধান্ত ও আইনকানুনকে বাস্তবে রূপায়িত করা। শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশের সদস্যরা যেসব নীতি। ও সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, যেসব আইনকানুন তৈরি করে থাকেন তাকে কার্যকরী করার দায়িত্বও শাসন বিভাগের স্থায়ী কর্মীদের।
② শাসন বিভাগের কাজকর্মের ধারাবাহিকভা বজায় রাখা: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি স্বাভাবিক ঘটনা হল সরকার পরিবর্তন। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে পূর্ববর্তী সরকারের পতন ঘটলে এবং তার পরিবর্তে নির্বাচনে নতুন দল সরকার গঠন করলে, সরকারের এই যাওয়া আসার মাঝখানে শাসনকার্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। এই সময়ে শাসন বিভাগের স্থায়ী কর্মীরা প্রশাসনের কাজকর্মের ধারাবাহিকতা বা নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে থাকেন।
③ আইন প্রণয়নে সাহায্যদান: সাধারণত আইন বিভাগ বিভিন্ন বিষয়ে আইন প্রণয়ন করে থাকে। কিন্তু বাস্তবে শাসন বিভাগের স্থায়ী সরকারি কর্মীরা আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেকের মতে, বর্তমান যুগে আইনসভার অধিকাংশ বিলের প্রকৃত রচয়িতা শাসন বিভাগের স্থায়ী কর্মী বা আমলারা। রাজনৈতিক শাসকরা শুধু আইনের মূল নীতিটুকু ঠিক করেন কিন্তু তাকে পরিপূর্ণ রূপ দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন স্থায়ী কর্মীরাই। এই সব আইনকে ‘প্রশাসনিক দফতর – প্রণীত আইন’ বা ‘অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন’ বলা হয়ে থাকে।
④ জনসংযোগ রক্ষাকারী: আমলারা সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে গিয়ে জনগণের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে থাকেন। বিশেষত জেলাশাসক, ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক (BDO). মহকুমা শাসক (SDO) প্রমুখরা জনসংযোগ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। সেইসঙ্গে সরকারের নীতি, কর্মসূচি বা কার্যক্রম নিয়ে জনগণের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রীদের অবগত করেন।
⑤ পররাষ্ট্রনীতির রূপায়ণ সংক্রান্ত কাজ: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলারা পররাষ্ট্রনীতির রূপায়ণ সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি রূপায়ণে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানকারী প্রতিনিধিদের প্রয়োজনীয় তথ্য ও সংবাদ সরবরাহ করা আমলাদের দায়িত্ব। কোনো কোনো সময় আমলারা নিজেই দেশের প্রতিনিধি হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলিতে যোগদান করেন।
⑥ নীতি প্রণয়ান ভূমিকা: নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো নির্ধারিত নীতি কীভাবে প্রয়োগ করা হবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন আমলারা। বলা বাহুল্য বেশিরভাগ নীতিই আমলাদের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমলাতন্ত্র ছাড়া আইন প্রণয়ন এবং প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই আমলাদের অস্তিত্বকে বর্জন করে বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা কল্পনাই করা যায় না।
৬। শাসনব্যবস্থার অরাজনৈতিক অংশ বা আমলাতন্ত্রের ত্রুটিগুলি আলোচনা করো।
ত্রুটি: আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এটি সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। আমলাতন্ত্রের ত্রুটিগুলি নিম্নরূপ।
① উদাসীনতা: আমলাতন্ত্রের সবচেয়ে বড়ো ত্রুটি হল এটি জনস্বার্থ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। আমলারা সর্বদা নিজের স্বার্থ অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করে বলে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হয়।
② রুটিনমাফিক কার্যসম্পাদন: আমলারা সর্বদা রুটিনমাফিক কার্য সম্পাদন করে। রুটিনের বাইরে গিয়ে এদের কাজ করতে দেখা যায় না। ফলে প্রশাসনিক কাজকর্মে ধীরগতি লক্ষ করা যায়। হঠাৎ কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে তার মোকাবিলা করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এমনকি আমলাদের মধ্যে নতুন কোনো বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণের উদ্যোগও লক্ষ করা যায় না।
③ সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব : কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আমলাদের কাছে প্রেরণ করা হলে তা দীর্ঘদিন ধরে সেখানে বন্ধ অবস্থায় থেকে যায়। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে পর্যালোচনা না করে সেই সম্পর্কে আমলারা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না। ফলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব ঘটে।
④ আত্মকেন্দ্রিকতা: আমলাতন্ত্রের আরও একটি ত্রুটি হল আত্মকেন্দ্রিকতা। উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকার জন্য এদের মধ্যে সর্বদা একটি অহংবোধ থাকে। জনসাধারণের থেকে এরা নিজেদের পৃথক বলে মনে করে। ফলে জনগণের সাধারণ জীবন সম্পর্কে এরা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না।
⑤ আন্তঃবিভাগীয় প্রতিযোগিতা: আমলাতন্ত্রের অন্যতম একটি ত্রুটি হল আন্তঃবিভাগীয় প্রতিযোগিতার সৃষ্টি। আমলাতন্ত্রে সরকারের কার্যকলাপ বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বণ্টন করা হয়ে থাকে। ফলে কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য আন্তঃবিভাগীয় সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু বিভাগীয় দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সহযোগিতার পরিবর্তে আন্তঃবিভাগীয় প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। ফলস্বরূপ সরকারি কার্যকলাপে জটিলতা দেখা দেয়।
6 রক্ষণশীল মনোভাব : আমলাদের অন্যতম একটি ত্রুটি হল এদের রক্ষণশীল মনোভাব। যার ফলে সরকারের কোনো নতুন উদ্যোগকে এরা উৎসাহ প্রদান করেই না বরং বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে।
⑦ গণতন্ত্রের পরিপন্থী: সমালোচকদের মতে আমলাতন্ত্র হল গণতন্ত্রবিরোধী। আমলাতন্ত্রে আমলাদের জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থেকে কাজ করতে হয় না। কিন্তু গণতন্ত্র হল জনগণের শাসন। গণতন্ত্রে শাসক নির্বাচন, তাদের পরিবর্তন সবই জনগণের উপর নির্ভরশীল। ফলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসকদের জনগণের নিকট দায়বদ্ধ থেকে কার্য সম্পাদন করতে হয়। তাই আমলাতন্ত্রের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়াকে অনেকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিপদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় আমলাতন্ত্র ত্রুটিযুক্ত হলেও আমলাদের বাদ দিয়ে কখনোই প্রশাসনিক কার্যপরিচালনা সম্ভব হবে না। বর্তমান রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে আমলাতন্ত্রের ত্রুটিগুলি হ্রাস করা আবশ্যক হয়ে উঠেছে।
আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্ন উত্তর