বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস রচনার সময়কাল ১৮৬৫ থেকে ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত। এই বাইশ বছরের সময়পর্বে তিনি মোট চোদ্দোটি উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর উপন্যাসগুলিকে মোট চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- ইতিহাসাশ্রয়ী রোমান্সধর্মী উপন্যাস : ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘মৃণালিনী’, ‘যুগলাঙ্গুরীয়’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘রাজসিংহ’, ‘সীতারাম’।
বঙ্কিমচন্দ্র এবং তাঁর সমসাময়িক বাংলা উপন্যাস

১। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস কোল্টিন্ট ও এন্টি কোন্ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়? বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলির শ্রেণিবিভাগ করে প্রতিটি ভাগের নাম লেখো।
বঙ্কিমের প্রথম উপন্যাস: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ইংরেজিতে লেখা ‘Rajmohan’s Wife’। এটি একটি ‘ক্রাইমকাহিনি’ জাতীয় উপন্যাস। ‘Rajmohan’s Wife’ ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত হয়।
পত্রিকার নাম: ‘Indian Field’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে এই উপন্যাস প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত প্রথম বাংলা উপন্যাস হল ‘দুর্গেশনন্দিনী’।
বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের শ্রেণিবিভাগ: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস রচনার সময়কাল ১৮৬৫ থেকে ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত। এই বাইশ বছরের সময়পর্বে তিনি মোট চোদ্দোটি উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর উপন্যাসগুলিকে মোট চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- ইতিহাসাশ্রয়ী রোমান্সধর্মী উপন্যাস : ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘মৃণালিনী’, ‘যুগলাঙ্গুরীয়’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘রাজসিংহ’, ‘সীতারাম’।
সমাজ ও গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাস: ‘বিষবৃক্ষ’ ‘কৃষ্ণকান্তের উইল, ‘রজনী’।
দেশাত্মবোধক উপন্যাস: ‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরাণী’।
উপন্যাসিকা: ‘ইন্দিরা’, ‘রাধারাণী’।
২। বাংলা উপন্যাসের ধারায় বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান আলোচনা করো।
অথবা, ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান আলোচনা করো।
বাংলা কথাসাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস ইংরেজিতে লেখা Rajmohan’s Wife ১৮৬৪ সালে ‘Indian field’ নামক সাপ্তাহিক পত্রে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র মোট চোদ্দোটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। ঘটনা-বিষয়বস্তুর গুরুত্ব অনুযায়ী তাঁর রচিত উপন্যাসগুলিকে প্রধান তিনটি ধারায় বিন্যস্ত করা যায়-
ইতিহাসাশ্রয়ী রোমান্সধর্মী উপন্যাস: ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫), ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬), ‘মৃণালিনী’, ‘যুগলাঙ্গুরীয়’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘রাজসিংহ’, ‘সীতারাম’ হল বঙ্কিমের ইতিহাসাশ্রয়ী রোমান্সধর্মী উপন্যাস।
বিশুদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্র নিয়ে লেখা ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসই বঙ্কিমচন্দ্রের একমাত্র ঐতিহাসিক উপন্যাস। বঙ্কিমের অন্যান্য ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাসগুলিতে ঐতিহাসিক কাহিনি ও চরিত্র থাকলেও মানুষের কথাই প্রাধান্য লাভ করেছে।
তত্ত্বপ্রধান দেশাত্মবোধক উপন্যাস: ‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরাণী’ হল বঙ্কিমের লেখা অন্যতম দুটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
‘আনন্দমঠ’ ও দেবী চৌধুরাণী’-এই দুটি উপন্যাসের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র দেশ, সমাজ ও জীবন সম্পর্কে নতুন ধারণার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের ‘বন্দেমাতরম্’ মন্ত্র পরবর্তী সময়ে দেশপ্রেমিকের বীজমন্ত্ররূপে উচ্চারিত হয়েছিল।
সমাজ-গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাস: ‘বিষবৃক্ষ’, ‘ইন্দিরা’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘রজনী’, ‘রাধারাণী’।
বঙ্কিমের এই উপন্যাসগুলির মূলে ছিল বাঙালির পারিবারিক, সামাজিক ও গার্হস্থ্য দ্বন্দ্ব। নরনারীর আদিম সম্পর্কের জটিলতা কিংবা চিত্তসংযমের অনীহা পারিবারিক তথা সামাজিক জীবনে কতখানি শোচনীয় পরিণাম বহন করে তারই সাক্ষ্য এই শ্রেণির উপন্যাসগুলি।
৩। বঙ্কিমচন্দ্রের ইতিহাসাশ্রয়ী রোমান্সধর্মী উপন্যাসের পরিচয় দাও।
বঙ্কিমচন্দ্রের রোমান্সধমী উপনাস: স্যার ওয়াল্টার স্কটের আদর্শে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা কথাসাহিত্যে বেশ কয়েকটি রোমান্স-আশ্রয়ী ইতিহাসধর্মী উপন্যাস রচনা করেছেন। তাঁর রচিত রোমান্সধর্মী উপন্যাসগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল-
‘রাজসিংহ: বঙ্কিমচন্দ্রের যথার্থ ও সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘রাজসিংহ’। ‘রাজসিংহ’-এর কাহিনি এবং প্রধান চরিত্রের সবগুলি ইতিহাসের সুপরিচিত ব্যক্তি। রাজস্থানের চঞ্চলকুমারীকে বিবাহে ইচ্ছুক ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে রাজসিংহের সংগ্রাম এবং পরিশেষে রাজসিংহের জয়লাভ ও চঞ্চলকুমারীকে বিবাহ এই উপন্যাসের উপজীব্য।
‘দুর্গেশনন্দিনী’: বাংলার পাঠান যুগের ইতিহাসকে আশ্রয় করে রচিত বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’-তে বাংলায় পাঠান ও মোগলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রধান হয়ে উঠেছে। অনেকে এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে স্কটের ‘আইভান হো’-র প্রভাব লক্ষ করে থাকেন।
‘কপালকুন্ডলা’: ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসটিতে রোমান্সের পাশাপাশি মানবপ্রকৃতির গূঢ় রহস্য ও নিয়মতাড়িত মানুষের নিদারুণ পরিণাম এই উপন্যাসকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।
‘মৃণালিনী’: ‘মৃণালিনী’ উপন্যাস খিলজির বাংলা জয়ের পটভূমিতে রচিত হলেও এতে হেমচন্দ্র-মৃণালিনীর প্রেমকাহিনি গুরুত্ব পেয়েছে বেশি।
‘চন্দ্রশেখর’: মিরকাশিম ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বন্দ্বের পটভূমিকায় ‘চন্দ্রশেখর’ রচিত হলেও এই উপন্যাসেও বঙ্কিমচন্দ্রের প্রধান বক্তব্য প্রতাপ-শৈবলিনীর বাল্যপ্রেম ও শৈবলিনীর স্বামী চন্দ্রশেখরের চরিত্রচিত্রণ। এক্ষেত্রেও নীতিবোধের প্রাধান্য লক্ষিত হয়।
‘সীতারাম’: বঙ্কিমের সর্বশেষ ঐতিহাসিক রোমান্সধর্মী উপন্যাস ‘সীতারাম’। বাংলার বারোভুঁইয়ার একভুঁইয়া সীতারাম ঐতিহাসিক চরিত্র হলেও এই উপন্যাসে তাঁর ইতিহাসসত্তার চেয়ে সার্বিক সত্তাই প্রধান হয়ে উঠেছে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, ইতিহাসের ছায়াপটে মানবজীবনের চরিত্রচিত্রণে বঙ্কিমচন্দ্রই শ্রেষ্ঠ।
৪। সমাজ-গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাস রচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের কৃতিত্বের পরিচয় দাও।
বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজ-গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাস: সমাজ-গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাস রচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভার সম্পূর্ণ স্ফুরণ ঘটেছে। বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজ-গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাসগুলি হল- ‘বিষবৃক্ষ’, ‘ইন্দিরা’, ‘রজনী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘রাধারাণী’। এই উপন্যাসগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল-
‘বিষবৃক্ষ: বঙ্কিমচন্দ্র রচিত ‘বিষবৃক্ষ’ সমাজ-গার্হস্থ্যধর্মী প্রথম উপন্যাস। বাল্যবিধবা কুন্দনন্দিনীর প্রতি নগেন্দ্রনাথের আকর্ষণ ও পত্নী সূর্যমুখীর প্রতি উদাসীনতার ফলে সূর্যমুখীর গৃহত্যাগ এবং পরে নগেন্দ্রনাথের অনুতাপ ও সূর্যমুখীর সঙ্গে মিলন; অপরদিকে, পুরো ঘটনাটির জন্য কুন্দনন্দিনীর নিজেকে অপরাধী মনে করা ও অভিমানে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা-এই হল উপন্যাসটির উপজীব্য। এই উপন্যাসে নীতি ও নিয়তি বিষয়ে বঙ্কিমমননে কিছু দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল।
‘রজনী’: লর্ড লিটন রচিত ‘The Last days of Pompeii’-র অনুসরণে বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করলেন ‘রজনী’ উপন্যাসটি। গার্হস্থ্যধর্মী এই উপন্যাসে নারীর মনস্তত্ব বিশ্লেষণে তিনি অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন।
‘কৃষ্ণকান্তের উইল’: বঙ্কিমের সার্থক সৃষ্টি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’। স্ত্রী ভ্রমণে পরিত্যাগ করে রোহিণীর প্রতি গোবিন্দলালের রূপাসক্তি এবং পরিশেষে বিশ্বাসঘাতকতাজনিত ক্ষোভ থেকে রোহিণীর হত্যা-এই উপন্যাসের মূল কাহিনি। পরিশেষে ভ্রমরের কাছে ফিরে এলেও নারীঘাতক, ব্যভিচারী স্বামীকে পরজন্মে স্বামী হিসেবে না পাওয়ার আশা করে ভ্রমরের মৃত্যু গোবিন্দলালের মনে ঈশ্বরচিন্তার উদ্রেক ঘটায়। সামাজিক উপন্যাস রচনায়, চরিত্রের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যে পথিকৃৎ।
৫। বঙ্কিমচন্দ্রের তত্ত্বপ্রধান দেশাত্মবোধক উপন্যাস রচনার কৃতিত্ব আলোচনা করো।
তত্ত্বপ্রধান দেশাত্মবোধক উপন্যাস: ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় দেশ, সমাজ, ধর্ম ও জাতীয়তা সংক্রান্ত ভাবনায় নতুনত্বের ছোঁয়া আসে। ‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরাণী’-কে তত্ত্বপ্রধান দেশাত্মবোধক উপন্যাস বলা হয়। তাঁর রচিত এই উপন্যাসগুলি নিয়ে আলোচনা করা হল-
আনন্দমঠ’: সন্ন্যাসী বিদ্রোহের বিষয় নিয়ে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি রচিত। ভবানন্দের আদর্শচ্যুতিই এর প্রধান বিষয়। তবে মহাকাব্যিক বিস্তার উপন্যাসটিকে মহিমান্বিত করেছে। এই উপন্যাসের ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীতটি পরবর্তীকালে সমর সংগীতে পরিণত হয়েছিল। স্বাদেশিকতা, আত্মত্যাগ ও আদর্শবাদের দিক থেকে এই উপন্যাসের গুরুত্ব থাকলেও উপন্যাস হিসেবে এর মধ্যে অনেক ত্রুটি লক্ষ করা যায়। এর কাহিনিবিন্যাসের একঘেয়েমি, চরিত্রচিত্রণের দিক থেকেও শান্তি ও ভবানন্দ ভিন্ন অন্য চরিত্র সেইভাবে বিকশিত হয়নি। স্বদেশপ্রেমের উদ্দ্গাতা মন্ত্র হিসেবে উপন্যাসটির অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।
‘দেবী চৌধুরাণী’: ‘আনন্দমঠ’-এর মতো ‘দেবী চৌধুরাণী’ও বঙ্কিমের তত্ত্বপ্রধান উপন্যাস। উপন্যাসের পটভূমিকায় একটি গার্হস্থ্য কাহিনি থাকলেও এর অন্তরালে আছে গীতার নিষ্কাম তত্ত্বকথা। প্রফুল্ল নামে এক অতি সাধারণ কুলবধূ কীভাবে দেবী চৌধুরাণীতে পরিণত হল এবং পুনরায় গার্হস্থ্য জীবনে ফিরে গেল-তারই চমকপ্রদ কাহিনি এই উপন্যাসের বর্ণিত বিষয়। অবশ্য প্রফুল্লর চরিত্রে অনুশীলন ধর্ম ও নিষ্কাম কর্মের তত্ত্ব নিয়ে তর্কের অবকাশ রয়েছে। স্বামীর সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্রই মনের দিক থেকে তার সব সংযমের বাঁধ ভেঙে পড়েছে। এক্ষেত্রেও বঙ্কিমচন্দ্র নীতি, ধর্ম, সদাচার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। আসলে উপন্যাসের ভাবকল্পনায় বঙ্কিমের শিল্পীমনই জয়লাভ করেছে।
৬। বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক বাংলা উপন্যাসধারার গতিপ্রকৃতি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
ঐতিহাসিক উপন্যাস: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসের ধারাকে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই সময়পর্বের আরেকজন উল্লেখযোগ্য ঔপন্যাসিক হলেন প্রতাপচন্দ্র ঘোষ। তাঁর লেখা ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়’ গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। রমেশচন্দ্র দত্ত ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত’ এবং – ‘রাজপুত জীবন সন্ধ্যা’ নামে দুটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেছিলেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বেনের মেয়ে’, ‘কাঞ্চনমালা’ এবং স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘মিবাররাজ’ ও ‘বিদ্রোহ’ ঐতিহাসিক উপন্যাসরূপে উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া মীর মশারফ হোসেন রচিত ‘বিষাদসিন্ধু’ উপন্যাসটি তৎকালীন ঐতিহাসিক উপন্যাসরূপে মৌলিকতার দাবি রাখে।
সামাজিক উপন্যাস: সামাজিক উপন্যাস হিসেবে এই সময় পর্বের উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল-তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘স্বর্ণলতা’, শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘যুগান্তর’ এবং যোগেন্দ্রচন্দ্র বসুর ‘শ্রীরাজলক্ষ্মী’। এসময় সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা গদ্যসাহিত্যের ধারায় ভ্রমণসাহিত্যশাখাটি সৃষ্টি করেন তাঁর ‘পালামৌ’ রচনার মাধ্যমে।
ব্যঙ্গবিদ্রূপমূলক রচনা: এই সময় ব্যঙ্গবিদ্রুপমূলক কৌতুক গল্পধারাটি পুষ্ট হয়েছিল। এই ধরনের গল্পরচনার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয় ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের রচনায়। তাঁর লেখা ‘কঙ্কাবতী’, ‘ফোকলা দিগম্বর’ প্রভৃতি উপন্যাসগুলির পাশাপাশি ‘ভূত ও মানুষ’, ‘মুক্তমালা’, ‘ডমরুচরিত’ ইত্যাদি গল্পগুলি আজও পাঠকের কাছে সমানভাবে আকর্ষণীয়।
৭। ঔপন্যাসিক তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যজগতে অবদান আলোচনা করো।
তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্য জগতে পদার্পণ করার পর যে কয়েকজন লেখক তাঁর প্রভাব এড়িয়ে সাহিত্যসৃষ্টিতে সফল হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে-তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় হলেন অন্যতম। তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তার মূল উৎস ‘স্বর্ণলতা’ উপন্যাস। তিনি বিশুদ্ধ রোমান্টিকতায় আক্রান্ত হননি, বাস্তবতার নিষ্ঠুর আঘাতে আমাদের পরিণতির কথা ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর সাহিত্যে। ‘স্বর্ণলতা’ উপন্যাস সম্পর্কে ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল “This is the only true novel we have read in Bengali “।
এই উপন্যাসে তিনি একটি একান্নবর্তী পরিবারের দ্বন্দ্বময় চিত্র অঙ্কন করেছেন; দেখিয়েছেন দুই ভাইয়ের সংসারে নেমে আসা বিপর্যয়, বড়ো বউ প্রমদার চক্রান্তে ছোটো বউ সরলার জীবনের করুণ পরিণতির কথা। আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে অঙ্কিত তাঁর দূরদর্শিতার ছবি আমাদের সমাজের আনাচেকানাচে আজও বর্তমান। তারকনাথের অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘হরিষে বিষাদ’ এবং ‘অদৃষ্ট’। এইসমস্ত রচনায় লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয়েছিল।
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়: বাংলা সাহিত্যাকাশে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘কঙ্কাবতী’, ‘সেকালের কথা’, ‘ফোকলা দিগম্বর’, ‘ময়না কোথায়’ ও ‘পাপের পরিণাম’ প্রভৃতি উপন্যাস সাহিত্যের এক-একটা মাইলস্টোনে পরিণত হয়েছে। তিনি ব্যঙ্গকৌতুক রসের স্রষ্টা হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর ‘কঙ্কাবতী’ উপন্যাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “এইরূপ অদ্ভুত রূপকথা ভাল করিয়া লেখা বিশেষ ক্ষমতার কাজ।… এতদিন পরে বাঙালায় এমন লেখকের অভ্যুদয়… যাঁহার লেখা আমাদের দেশের বালক বালিকাদের এবং তাঁদের পিতামাতার মনোরঞ্জন করিতে পারিবে।” গতানুগতিক ধারা অনুসরণ না করে উদ্ভট কল্পনা ও অদ্ভুত রসকে আশ্রয় করে তিনি একান্ত ভিন্নধর্মী হয়ে উঠেছিলেন। এমন ধারার রচনা তাঁর আগে দেখা যায়নি এমনকি পরবর্তীতেও সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না।
আরও পড়ুন | Link |
নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
চার্বাক সুখবাদ প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা প্রশ্ন উত্তর | Click Here |