ক্রুসেডের পর্যায়গুলি লেখো

ক্রুসেডের পর্যায়গুলি লেখো

ক্রুসেডের পর্যায়গুলি লেখো
ক্রুসেডের পর্যায়গুলি লেখো

তিনটি পর্যায়ে ক্রুসেড সংঘটিত হয়-

  • প্রথম পর্যায়: ১০৯৫ থেকে ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে প্রথম পর্যায়।
  • দ্বিতীয় পর্যায়: দ্বিতীয় পর্যায়ের সময়কাল ১১৪৪ থেকে ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দ। এই পর্বে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্রুসেড পরিচালিত হয়।
  • তৃতীয় পর্যায়: তৃতীয় পর্যায়ের পরিধি ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৯১ খ্রিস্টাব্দ। এই সময়ে অন্যান্য ক্রুসেডগুলি হয়েছিল।

প্রথম পর্যায়

প্রথম ক্রুসেড

এই পর্যায়ে প্রথম ক্রুসেড সংঘটিত হয় (১০৯৫ থেকে ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দ)। পোপের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সন্ন্যাসী পিটার দ্য হারমিট (Peter the Hermit) ক্রুশ দণ্ড হাতে নিয়ে জার্মানি, ইটালি ও ফ্রান্সের নানা স্থানে গিয়ে ধর্মযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। পরের বছর গ্রীষ্মাবসানে সন্ন্যাসী পিটার এবং ওয়াল্টার দ্য পেনিলেস (Walter the Penniless)-এর নেতৃত্বে দলে দলে মানুষ ধর্মযুদ্ধে অংশ নেয়। ধর্মযোদ্ধারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়া পেরিয়ে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে। তবে এই দলে অধিকাংশই ছিল সমাজের নিম্নশ্রেণিভুক্ত, ধর্মান্ধ, অসংগঠিত, উচ্ছৃঙ্খল মানুষেরা। চলার পথে উন্মত্ত ধর্মযোদ্ধারা অকথ্য অত্যাচার ও লুণ্ঠন চালায়। প্রথম ক্রুসেডে যোগদানের জন্য পিটার দ্য হারমিট-এর আহ্বান

(1) যুদ্ধ

পিটার দ্য হারমিট-এর নেতৃত্বে ধর্মযোদ্ধারা জেরুজালেমের কাছে পৌঁছোলে তুর্কি বাহিনী তাদের উপর আক্রমণ করে। তুর্কিদের এই প্রতি-আক্রমণে বহু ধর্মযোদ্ধা প্রাণ হারায় পুণ্যভূমিতে পৌঁছোনোর আগেই। তবে ক্রুসেডারদের এই মর্মান্তিক পরিণতি ও লজ্জা চাপা পড়ে যায়, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সুদক্ষ শক্তিশালী ধর্মযোদ্ধাবাহিনীর আগমনের ফলে। ১০৯৭ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডাররা নিসিয়া (Nicaea), এডেসা (Edessa) এবং ১০৯৮ খ্রিস্টাব্দে অ্যান্টিওক (Antioch) শহর দখল করেন।

(2) জেরুজালেম দখল ও আধিপত্য স্থাপন

পোপের প্রতিনিধি অ্যাডহিমার (Adhemar)-এর সাংগঠনিক প্রতিভা এবং ফ্রান্সের নিম্ন লোরেন (Lower Loraine)-এর শাসক গডফ্রে (Godfrey)-এর নেতৃত্বে খ্রিস্টান বাহিনী বহু বিধর্মীকে হত্যা করে ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুন জেরুজালেম দখল করতে সক্ষম হয়। গডফ্রে জেরুজালেমের শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। এ ছাড়া এডেসা, অ্যান্টিওক, ত্রিপোলি ইত্যাদি স্থানে কয়েকটি স্বাধীন খ্রিস্টীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

দ্বিতীয় পর্যায়

দ্বিতীয় ক্রুসেড

প্রথম ধর্মযুদ্ধে খ্রিস্টানদের কাছে পরাজয়ের গ্লানি কাটিয়ে মুসলমানরা দ্রুত সংঘবদ্ধ হয়। মসুলের সেনাধ্যক্ষ ইমদাদউদ্দিন জেঙ্গি (ইমাদ অল-দিন জেঙ্গি, Imad al-Din Zengi)-র নেতৃত্বে তুর্কি বাহিনী ১১৪৪ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টানদের অধিকার থেকে এডেসা শহর কেড়ে নেয়। শঙ্কিত হয় খ্রিস্টান জগৎ। খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধারা পরবর্তী ক্রুসেডের প্রস্তুতি শুরু করেন।

(1) যুদ্ধ ঘোষণা ও যুদ্ধযাত্রা

এডেসার পতনের সংবাদে মর্মাহত পোপ তৃতীয় ইউজিন (Pope Eugene III) ১১৪৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ক্রুসেডের ডাক দেন। পোপের অনুরোধে সেন্ট বার্নার্ড (Saint Bernard) ক্রুসেডের জন্য নতুন ধর্মযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে তৎপর হন। পোপের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জার্মান সম্রাট তৃতীয় কনরাড (Conrad III) এবং ফরাসিরাজ সপ্তম লুই (Louis VII) পৃথক পৃথক পথ ধরে সামরিক অভিযান শুরু করলে দ্বিতীয় ক্রুসেডের সূচনা হয় (১১৪৭ খ্রিস্টাব্দ)। জার্মান সম্রাট এশিয়া মাইনরের দুর্গম স্থলপথে আর ফরাসিরাজ স্থল ও জলপথে জেরুজালেমের উদ্দেশে যাত্রা করেন।

(2) পরিণতি

জেরুজালেম পৌঁছোনোর পূর্বেই মুসলিম বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে কনরাড ও লুই-উভয়ই পরাজিত হন। অতঃপর দুই সম্রাট মিলিতভাবে দামাস্কাস দখলের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু দামাস্কাস অবরোধ ব্যর্থ হয়। বহু সেনাপতি ও নাইট যোদ্ধা বন্দি হন।  শেষপর্যন্ত পরাজয়ের গ্লানি বহন করে ও জেরুজালেম উদ্ধারের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে কনরাড ও লুই নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এইভাবে খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধাদের চূড়ান্ত ব্যর্থতার মাঝে শেষ হয় দ্বিতীয় ক্রুসেড।

তৃতীয় ক্রুসেড

দ্বিতীয় ক্রুসেডের ব্যর্থতা মুসলমানদের সংঘবদ্ধতা ও খ্রিস্টানদের অন্তর্দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে। ইতিমধ্যে সালাদিন (Saladin) মিশর জয় করে উত্তরমুখে তাঁর আধিপত্য কায়েম করেছিলেন। দামাস্কাস ও মিশর মুসলিম নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে খ্রিস্টান-শাসিত রাজ্যগুলি মুসলমান শক্তি দ্বারা পরিবৃত হয়ে পড়ে। হাট্টিন (Hattin)-এর যুদ্ধে সালাদিন খ্রিস্টান বাহিনীকে পরাজিত করে জেরুজালেম দখল করে নেন (১১৮৭ খ্রিস্টাব্দ)। এডেসা, অ্যান্টিওক, ত্রিপোলি থেকে খ্রিস্টানদের বিতাড়িত করা হয়। দীর্ঘ আট দশকের বেশি সময় ধরে খ্রিস্টানদের অধিকৃত পবিত্রভূমি থেকে খ্রিস্টানদের অধিকারের চিহ্নটুকুও মুছে যায়। জেরুজালেমের পতন তৃতীয় ক্রুসেডের পথ খুলে দেয়।

(1) তৃতীয় ক্রুসেডের সূচনা- যুদ্ধ ঘোষণা ও প্রস্তুতি

জেরুজালেম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মুসলমানদের বিজয়ের সংবাদে সাধারণ মানুষ প্রবলভাবে ভীতসন্ত্রস্ত ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় পোপ অষ্টম গ্রেগরি (Pope Gregory VIII) তৃতীয় ক্রুসেডের ডাক দেন। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম রিচার্ড (Richard I, যিনি তাঁর বীরত্বের জন্য Richard the Lionheart নামেও পরিচিত), ফরাসিরাজ ফিলিপ অগাস্টাস (Philip Augustus বা Philip II), পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের (জার্মানি) সম্রাট ফ্রেডরিখ বারবারোসা (Frederick Barbarossa বা Frederick ।) প্রমুখ জেরুজালেম উদ্ধারের শপথ গ্রহণ করেন। নিখুঁত পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও এই সকল মহান যোদ্ধাদের সমন্বয়ে ১১৮৯ খ্রিস্টাব্দে সূচনা হয় তৃতীয় ক্রুসেডের।

(2) যুদ্ধযাত্রা ও পরিণতি

এরপর ধর্মযোদ্ধারা জেরুজালেমের দিকে এগোতে থাকেন। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স থেকে তারা সমুদ্রপথে এবং জার্মানি থেকে স্থলপথে যাত্রা করেন। কিন্তু ভাগ্য বিরূপ। পবিত্রভূমিতে পৌঁছোনোর আগেই এশিয়া মাইনরের কাছে জাহাজডুবিতে প্রাণ হারান বারবারোসা। ফলে তাঁর অধিকাংশ সেনা দেশে ফিরে যায়।

অন্যদিকে ইংল্যান্ডরাজ ও ফরাসিরাজ জড়িয়ে পড়েন অন্তর্দ্বন্দ্বে। ফিলিপ একাই জেরুজালেম অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রিচার্ড প্যালেস্টাইনের অধীন একর (Acre) বন্দরটি দখলের চেষ্টা করেন। সালাদিন প্রবল প্রতিরোধ করলেও একর ইংল্যান্ডরাজের হস্তগত হয় (১১৯১ খ্রিস্টাব্দ) এবং রিচার্ড একাদশ শতকের সর্বোত্তম নাইট-এর স্বীকৃতি পান। কিন্তু মুক্তিপণ না পাওয়ার কারণে তিনি অসংখ্য বন্দি একরবাসীকে হত্যা করে পুনরায় ধর্মযুদ্ধকে কলঙ্কিত করেন। হতাশ ফরাসিরাজ ফিলিপ স্বদেশে ফিরে যান। শেষপর্যন্ত সালাদিনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে (১১৯২ খ্রিস্টাব্দ) তৃতীয় ক্রুসেডের ইতি টানা হয়। এই চুক্তির দ্বারা স্থির হয় যে, জেরুজালেম মুসলমানদের দখলে থাকলেও খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীরা এখানে তীর্থ করতে 3 আসতে পারবে।

তৃতীয় পর্যায়

চতুর্থ ক্রুসেড

(1) প্রেক্ষাপট

তৃতীয় ক্রুসেড ব্যর্থ হওয়ার পর ইউরোপের রাজন্যবর্গ পুণ্যভূমি জেরুজালেম উদ্ধারের ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। রিচার্ডের বিড়ম্বনা এবং ধর্মযোদ্ধাদের ব্যর্থতা এই সত্য তুলে ধরে যে, মহান পোপ ধর্মযোদ্ধাদের বিপদমুক্ত রাখতে কিংবা খ্রিস্টান জগতকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে অপারগ। ধর্মযুদ্ধে বারংবার ব্যর্থতা, ধর্মসংস্থাপনের নামে রক্তপাত ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানদের ব্যথিত ও হতোদ্যম করে তোলে। এই পরিস্থিতিতে পোপের আসনে বসেন তৃতীয় ইনোসেন্ট (Innocent III)। উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ক্ষমতাগর্বী পোপ ইনোসেন্ট জেরুজালেম উদ্ধারকে সমস্ত ল্যাটিন খ্রিস্টান জগতের উপর আপন প্রভুত্ব বিস্তারের একটি সোপান হিসেবে বেছে নেন।

(2) সূচনা

তৃতীয় ইনোসেন্টের প্রচেষ্টায় ফ্ল্যান্ডার্স (Flanders) এবং শ্যাম্পেন (Champagne)-এর শক্তিশালী ফরাসি সামন্তপ্রভু এবং ইতালীয় মার্কুইস (Marquis) চতুর্থ ক্রুসেড সংগঠনের (১২০২-১২০৪ খ্রিস্টাব্দ) দায়িত্ব নেন। ইতিপূর্বে স্থলপথে পবিত্রভূমি অভিযানের ব্যর্থতাগুলির কথা বিবেচনা করে, এবার জলপথে ক্রুসেড অভিযানের উদ্যোগ শুরু হয়। ভেনিস-এর বণিকরা অর্থের বিনিময়ে সামুদ্রিক পোত ও রসদ সরবরাহের দায়িত্ব নেন। কিন্তু মিশরের সঙ্গে ভেনিসের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। অন্যদিকে কনস্ট্যান্টিনোপল ভেনিসের সঙ্গে ব্যাবসায় অনাগ্রহী ছিল। তাই এই সুযোগে ভেনিস প্রথমে বাইজানটাইন অভিযানের উদ্যোগ নেয়। প্রচার করা হয় যে, কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করলে জেরুজালেমে অভিযান চালানো সহজ হবে। পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধা কর্তৃক আর একটি খ্রিস্টান রাজ্য আক্রমণের বিরোধিতা করেন।

(3) অভিযান ও পরিণতি

পোপের নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণ অমান্য করে তাঁরই ঝান্ডাবাহী ধর্মযোদ্ধার দল ভেনিসীয়দের নির্দেশে জারা (Zara) বন্দর জয় এবং কনস্ট্যান্টিনোপল আক্রমণ করেন। বিনা বাধায় ক্রুসেডাররা কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করে নেন (১২০৪ খ্রিস্টাব্দ)। কিন্তু এখানেও পুনরাবৃত্তি হল ধর্মযোদ্ধাদের লুণ্ঠন-লালসা। লুণ্ঠন, হত্যা, ধ্বংস, অগ্নিসংযোগের মতো নৃশংস কর্মকাণ্ড দ্বারা স্বধর্মী মানুষের রক্তে রাঙা হল খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধাদের হাত। অধরা থেকে গেল পবিত্রভূমি দখলের বাসনা। সব মিলিয়ে চতুর্থ ক্রুসেডও শেষ হল ব্যর্থতার গ্লানি দিয়ে।

পঞ্চম ক্রুসেড

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট পঞ্চম ক্রুসেড সংগঠনের উদ্যোগ নেন। তিনি ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে ল্যাটেরান ধর্মসম্মেলন (Lateran Council) আহ্বান করেন যেখানে জেরুজালেম উদ্ধারের জন্য অপর একটি ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

অভিযান ও পরিণতি

পোপের আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাঙ্গেরির শাসক অ্যানডু (Andrew II)-র নেতৃত্বে হাঙ্গেরি, জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার খ্রিস্টান জনতা জলপথে অভিযান শুরু করে (১২১৭ খ্রিস্টাব্দ)। জেরুজালেম যেহেতু তখনও পর্যন্ত মিশরীয় সুলতানের অধীনে ছিল, সেইজন্য ধর্মযোদ্ধারা প্রথমেই মিশর আক্রমণ করেন। তাঁরা অনায়াসেই মিশরের  বিখ্যাত বন্দর দামিয়েটা (Damietta) দখল করে নেয়। মিশরের সুলতান মালিক আল-কামিল (Malik al-Kamil) সমঝোতার প্রস্তাব দেন, এই বন্দর প্রত্যর্পণের বিনিময়ে জেরুজালেমের অধিকাংশ অঞ্চল খ্রিস্টানদের হাতে তুলে দিতে রাজি হন। কিন্তু ধর্মহীন ধর্মযোদ্ধার দল অকারণে অধিকৃত অঞ্চলে ধ্বংস ও হত্যাকাণ্ড চালায়। মিশরীয় বাহিনী প্রত্যাঘাত করতে বাধ্য হয় এবং ধর্মযোদ্ধারা পরাজিত হয়ে পিছু হটে। শেষপর্যন্ত মিশরের সঙ্গে ক্রুসেডারদের ৮ বছরের শান্তিচুক্তি স্থাপিত হয় (১২২১ খ্রিস্টাব্দ)।

ষষ্ঠ ক্রুসেড

পঞ্চম ক্রুসেডের ব্যর্থতা পোপ তৃতীয় হনোরিয়াস (Pope Honorius III)-কে বিক্ষুব্ধ করে। এমতাবস্থায় পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডরিখ (Frederick II)-কে তিনি পরবর্তী ক্রুসেডের দায়িত্বভার অর্পণ করেন (১২২৪ খ্রিস্টাব্দ)।

অভিযান ও ফলাফল

সম্রাট ফ্রেডরিখ-এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জেরুজালেমের ল্যাটিন খ্রিস্টান রাজ্যের উত্তরাধিকারী ব্রিয়েন (Brienne)-এর দ্বিতীয় ইসাবেলা (Isabella II)-কে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ এবং জেরুজালেমের রাজা উপাধি লাভ করা। এরপর তাঁর নেতৃত্বে ক্রুসেডাররা পবিত্র জেরুজালেম দখলের উদ্দেশ্যে ১২২৮ খ্রিস্টাব্দে অভিযান শুরু করেন। দ্বিতীয় ফ্রেডরিখ একক প্রয়াসে এবং পরম মিত্রতাসুলভ আচরণ দ্বারা মিশরের সুলতান আল-কামিলের সঙ্গে সমঝোতায় সফল হন। ফলস্বরূপ সুলতানের আমির ফকরুউদ্দিন (Fakhr al-Din)-এর সঙ্গে তাঁর জাফা সধি (১২২৯ খ্রিস্টাব্দ) স্বাক্ষরিত হয়। এই সন্ধির ফলে ১০ বছরের জন্য জেরুজালেম, নাজারিথ (Nazareth) ও বেথলেহেম (Bethlehem) খ্রিস্টানদের দখলে আসে।

কিন্তু নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জনে অভিলাষী পোপ নবম গ্রেগরি (Pope Gregory IX) এই চুক্তিকে খ্রিস্টান জগতের পক্ষে অবমাননাকর বলে নিন্দা করেন। ফলে ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমের উপর পুনরায় মুসলমানদের পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

সপ্তম ক্রুসেড

১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বাহিনী কর্তৃক জেরুজালেম দখলের সংবাদ ইউরোপে পৌঁছোনোমাত্র পোপ চতুর্থ ইনোসেন্ট (Pope Innocent IV) এবং ধর্মভীরু ফরাসিরাজ নবম লুই (Louis IX) অত্যন্ত মর্মাহত হন। এর কিছুকাল পরে (১২৪৮ খ্রিস্টাব্দ) নবম লুই [তিনি সেন্ট লুই (Saint Louis) নামে অধিক পরিচিত] বিশুদ্ধ ধর্মীয় প্রেরণা থেকে সপ্তম ক্রুসেডে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। সপ্তম ক্রুসেডে নেতৃত্বদানের জন্য এই ক্রুসেড নবম লুই-এর ক্রুসেড (Crusade of Louis IX) নামেও পরিচিত।

অভিযান ও পরিণতি

সপ্তম ক্রুসেডের জন্য কোনও বিশেষ প্রচার বা প্রস্তুতি ছিল না। ফরাসি সম্রাট নবম লুই সেনাবাহিনী-সহ জলপথে অভিযান শুরু করেন (১২৪৮ খ্রিস্টাব্দ)। ধর্মযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি দামিয়েট্টা অধিকার করেন। এরপর মিশরীয় বাহিনীর সঙ্গে ক্রুসেডারদের প্রবল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আতোয়া-র কাউন্ট রবার্ট (Robert I of Artois)-এর ভুলে মিশরীয়রা দামিয়েট্টা পুনর্দখল করে। শেষপর্যন্ত নবম লুই মুসলিম বাহিনীর কাছে পরাজিত ও বন্দি হন। জেরুজালেমের উপর মুসলিম কর্তৃত্ব বজায় থাকে।

অষ্টম ক্রুসেড

সপ্তম ক্রুসেডের ব্যর্থতার গ্লানি মুছে দেওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা থেকে নবম লুই পুনরায় ধর্মযুদ্ধ সংগঠিত করেন।

অভিযান ও ফলাফল

১২৭০ খ্রিস্টাব্দে নবম লুই আবার ফরাসি বাহিনী-সহ জলপথে অভিযান পরিচালনায় উদ্যোগী হন। এবার তিনি মিশরের বদলে টিউনিশিয়া (Tunisia) আক্রমণ করেন। কিন্তু রোগ, ব্যাধি, মরুভূমির তাপে তাঁর বাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। সম্রাট নবম লুইও টিউনিশিয়ায় অসুস্থ হয়ে মারা যান। লুইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর বাহিনীর অবশিষ্ট অংশ স্বদেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। জেরুজালেম মুসলিম অধিকারেই থেকে যায়।

অষ্টম ক্রুসেডের অবসানের পরেও দুপক্ষের মধ্যে আরও ছোটো-বড়ো বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলেছিল- ১২৯১ খ্রিস্টাব্দের পর যার অবসান ঘটে। এই সময় থেকে জেরুজালেমে খ্রিস্টানদের বা ল্যাটিন রাজ্যের অস্তিত্বের লেশমাত্র অবশিষ্ট ছিল না।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment