কুসেড বা ধর্মযুদ্ধের কারণগুলি আলোচনা করো

ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তথা কারণ বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক পি কে হিট্টি (PK Hitti) বলেছেন যে- চার্চের ক্রশ, সৈনিকের তরোয়াল এবং বণিকদের অর্থ মিলিত হয়ে ক্রুসেডের সূত্রপাত করেছিল। অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপে শুরু হওয়া ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছরব্যাপী সংঘটিত ধর্মযুদ্ধের পশ্চাদ্স্পটে কেবল ধর্মীয় নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা কারণ দায়ী ছিল।
ধর্মীয় কারণ
(1) পবিত্রভূমি উদ্ধারের আকাঙ্ক্ষা
প্যালেস্টাইনের অন্তর্ভুক্ত জেরুজালেম (Jerusalem) ছিল খ্রিস্টান, ইহুদি ও মুসলমানদের কাছে পবিত্র স্থান। জিশুখ্রিস্টের জন্মস্থান হিসেবে জেরুজালেম খ্রিস্টানদের কাছে পবিত্রভূমি। হজরত মুসা ও দাউদ-এর স্মৃতিবিজড়িত হওয়ায়। ইহুদিদের কাছেও পবিত্রভূমি। আবার হজরত মহম্মদের মিরাজ গমনের স্থান হিসেবে মুসলমানদেরও পবিত্রভূমি ছিল জেরুজালেম। সপ্তম শতকে আরবের মুসলমানরা এই পবিত্র স্থান দখল করে নেয়। তবে আরবদের অধীনে থাকলেও খ্রিস্টানদের তীর্থভ্রমণে কোনও বাধার সৃষ্টি করা হত না। একাদশ শতকের শেষদিকে সেলজুক তুর্কিরা জেরুজালেম দখল করলে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই তুর্কিরা তীর্থযাত্রী খ্রিস্টানদের নানাভাবে বিব্রত করতে থাকে। ফলে খ্রিস্টানদের তীর্থভ্রমণের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। এমতাবস্থায় প্রতিটি ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান তাদের পবিত্রভূমি উদ্ধারের জন্য আকুল হয়ে ওঠেন। এমনই পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক কিছু ঘটনা পোপ-এর নেতৃত্বে খ্রিস্টানদের জেরুজালেম উদ্ধারের লক্ষ্যে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধে নামতে প্ররোচিত করে।
(2) পোপের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা
একাদশ শতকে সংস্কার আন্দোলনের ফলে চার্চ তথা পোপের কর্তৃত্বের মনোভাব প্রবল হয়ে উঠেছিল। রোমান গির্জা ও গ্রিক গির্জার মধ্যে প্রাধান্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা পোপের কাছে অস্বস্তিকর ছিল। রোমানরা গ্রিকদের নাস্তিক ও অধার্মিক বলে ব্যঙ্গ করতেন। রোমান ধর্মগুরু পোপ সমগ্র খ্রিস্টান জগতে তাঁর প্রভুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে আগ্রহী হন। সমগ্র খ্রিস্টান জগতের উপর পোপের পার্থিব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করার প্রয়োজনে ধর্মগুরু পোপ অস্ত্র, যুদ্ধ, রক্তপাতের আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করেননি। প্রেরিত শিষ্য পিটার-এর আগ্নেয়াস্ত্র বিধর্মীর বিরুদ্ধে ঝলসে উঠুক -এমন প্রতিজ্ঞাপূরণের ইচ্ছা সমস্ত যাজক ও ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানদের ধর্মযুদ্ধে সমবেত হওয়ার উপাদান গড়ে তুলেছিল।
অর্থনৈতিক কারণ
(1) বণিকদের স্বার্থচিন্তা
ইটালির নগররাষ্ট্রগুলি অন্তর্দেশীয় ও বহির্বাণিজ্যে খুব অগ্রণী ছিল। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর স্পেন, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, আফ্রিকা, এশিয়া মহাদেশের বহু এলাকা মুসলমানদের দখলে চলে গেলে ইউরোপের ব্যাবসাবাণিজ্য খ্রিস্টানদের হস্তচ্যুত হয়। নবম শতকে পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের দুর্বলতা এবং শার্লামেনের মৃত্যুর পর ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব মুসলমানদের ভূমধ্যসাগরে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। ভূমধ্যসাগর কার্যত একটি মুসলিম হ্রদ-এ পরিণত হয়। ফলে পূর্ব ও পশ্চিম রোমের যোগাযোগ যেমন ব্যাহত হয়, তেমনি ইটালির বাণিজ্যমুখী নগররাষ্ট্রগুলির সমুদ্র বাণিজ্যেও মন্দা দেখা দেয়।
একাদশ শতকে নর্সম্যান (ন্যান) উপজাতির হাতে মুসলমানদের পরাজয় ঘটলে পশ্চিম ভূমধ্যসাগরে ইতালীয় বণিকদের ব্যাবসা পুনরায় শুরু হয়। সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত জেনোয়া, পিসা, ভেনিস প্রভৃতি ইতালীয় নগররাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। এখন ভূমধ্যসাগরকে মুসলিম কর্তৃত্বমুক্ত করতে পারলে ইটালির বাণিজ্য ইউরোপ থেকে প্রাচ্যের দেশগুলিতেও ছড়িয়ে পড়বে, এমন সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। ঠিক এই সময়ে পোপ ধর্মযুদ্ধের ডাক দিলে জেনোয়া-সহ ইটালির নগররাষ্ট্রগুলি আশার আলো দেখতে পায়। ধর্মীয় আন্দোলনের এই সুযোগে তারা বাণিজ্য বৃদ্ধির পরিকল্পনা করে এবং ধর্মযুদ্ধে যোগ দেয়। এইভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা ও বাণিজ্যিক স্বার্থ একীভূত হয়ে ক্রুসেড অনিবার্য করে তোলে।
(2) জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত চাপ
দশম শতকের শেষ দিক থেকে ইউরোপের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। বর্ধিত জনসংখ্যার অনুপাতে চাষযোগ্য জমি বাড়ানো সম্ভব হয়নি। ফলে বহু মানুষ ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হন। বিকল্প আয়েরও তেমন সুযোগ ছিল না। জীবন ও জীবিকার এই অনিশ্চয়তা বহু মানুষের মনে তীব্র অস্থিরতা ও অসন্তোষ সঞ্চারিত করে। ধর্মযুদ্ধের আহ্বান এবং মহান লক্ষ্যে দেশের বাইরে গিয়ে ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্ন তাদের মনে নতুন প্রেরণা জোগায়। এই শ্রেণির অসংখ্য মানুষ পোপের আহ্বানে ক্রুসেডে যোগ দেন।
(3) আর্থিক উন্নতির স্বপ্ন
ইউরোপের ধনী অভিজাতরা ক্রুসেডের মাধ্যমে আরও ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এ ছাড়া যুদ্ধের সময় লুঠতরাজের মাধ্যমে ম্যানর প্রভুরা তাদের আয়বৃদ্ধির সম্ভাবনার বিষয়েও আশান্বিত হন। এর ফলে পরিস্থিতি যুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়।
সামাজিক কারণ
(1) সামন্তশ্রেণির লালসা
সামন্ততন্ত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ক্রুসেডকে উৎসাহিত করেছিল। সামন্তরাজারা ক্ষমতা ও সম্পত্তি বৃদ্ধির জন্য সর্বদা একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। এখন তারা আশান্বিত হন যে ক্রুসেডের সূত্রে নতুন নতুন এলাকা তাদের দখলে আসবে। অধিকৃত অঞ্চলের লোকেদের ভূমিদাস হিসেবে জমিতে নিয়োগ করা যাবে। এইভাবে লালসাপূরণের লক্ষ্যে দলে দলে সামন্তপ্রভু ক্রুসেডের ডাকে এগিয়ে আসেন।
(2) নাইটদের উন্মাদনা
সামন্ততন্ত্রের প্রস্ফুটিত ফুল হিসেবে বন্দিত হত মধ্যযুগীয় নাইট (Knight) যোদ্ধা সম্প্রদায়। অভিজাত ও সাধারণ পরিবারের বহু যুবক নাইট নামক সুসজ্জিত, সুশিক্ষিত অস্ত্রধারী বাহিনীর সদস্য ছিলেন। এদের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও ক্ষমতা দখলের উন্মাদনা রাজ্যগুলিতে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। এই যুদ্ধপ্রিয়, লুণ্ঠন মনোবৃত্তির যোদ্ধাদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে তাদের যুদ্ধোন্মাদনা ও লুণ্ঠন-পিপাসা নিবৃত্ত করার একটা উদ্দেশ্য ক্রুসেড সংগঠনের পশ্চাদপটে সক্রিয় ছিল। ক্রিস্টোফার বুকস (Christopher Brooks) বলেছেন, পোপ দ্বিতীয় আরবানের কাছে ক্রুসেড ছিল আসলে একটি আত্মরক্ষামূলক সামরিক অভিযান, যার মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা জুড়ে দেওয়া হয়েছিল।
(3) সামাজিক চাহিদা
পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চলে প্রাইমোজেনিচার (Primogeniture) বিধান অনুসারে, পরিবারের সম্পত্তির (ফিফ) উপর কেবল জ্যেষ্ঠ পুত্রের অধিকার স্বীকৃত ছিল। পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্রদের সম্পত্তির অংশ পাওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না। সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত এই সকল ব্যক্তিদের বিকল্প জীবিকা ছিল যাজকবৃত্তি কিংবা অসৎ উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করা। এই সামাজিক সমস্যাসমাধানের অন্যতম উপায় হিসেবে পোপ এই শ্রেণির মানুষদের ক্রুসেডে অংশ নিয়ে ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্ন দেখান। ভাগ্যান্বেষণ এবং ধর্মীয় কর্তব্যপালনের দ্বৈত-প্রেরণা অসংখ্য মানুষকে ক্রুসেড জাতীয় আন্দোলনে শামিল করে।
(4) খ্রিস্টান ধর্মান্ধতা
ইউরোপে একাদশ শতক নাগাদ নরম্যান, ম্যাগিয়ার ও ভূমিদাসরা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলে একদিকে যেমন খ্রিস্টানদের সংখ্যা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে পোপ সপ্তম গ্রেগরি-র মানসিকতার প্রভাবে তারা হয়ে ওঠেন উগ্র সাম্প্রদায়িক। এই খ্রিস্টান ধর্মান্ধতাও ক্রুসেডের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কারণ হিসেবে চিহ্নিত।
(5) সাংস্কৃতিক সংঘাত
ইসলাম ধর্মগ্রহণের পর আরব জাতি এক উন্নত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারী হয়। শিল্প-স্থাপত্য, শিক্ষা-সাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের অবদান গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এতকাল রোমান ও গ্রিকরা উন্নত সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে নিজেদের আধিপত্য জাহির করতেন। এখন ইসলামের সাংস্কৃতিক গরিমা তাদের অহংকে আঘাত করে। তাই ইসলামীয় সংস্কৃতির ধ্বংস ও গ্রিকো-রোমান সংস্কৃতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তারা ক্রুসেডকে বেছে নেন।
এইভাবে ধর্ম, অর্থ, মোক্ষ এবং ক্ষমতালিপ্সা একীভূত হয়ে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের মধ্যে প্রকাশ পায়।
তাৎক্ষণিক কারণ
একাদশ শতকের সাতের দশকে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। মেঞ্জিকার্ট (Menzikert)-এর যুদ্ধে (১০৭১ খ্রিস্টাব্দ) বাইজানটাইন সম্রাট চতুর্থ রোমানোস (Romanos IV) দুর্ধর্ষ সেলজুক তুর্কি-সুলতান আলপ আর্সলান (Alp Arslan)-এর হাতে পরাজিত হন। সমস্ত আনাতোলিয়া সম্রাটের হস্তচ্যুত হয়। রুক্ষ ও অসহিষ্ণু সেলজুক তুর্কিরা জেরুজালেমে আগত খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের নানাভাবে হেনস্থা করতে থাকে। ফলে ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানদের মনে তীব্র ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়। সম্রাট আলেক্সিয়াস কমনিনাস (Alexius Comnenus, রাজত্বকাল ১০৮১-১১১৮ খ্রিস্টাব্দ) সেলজুকদের হাত থেকে খ্রিস্টান ধর্ম ও রোমের সিংহাসন বাঁচানোর তাগিদে পোপের সাহায্যপ্রার্থী হন। পোপ সপ্তম গ্রেগরি ইচ্ছা থাকলেও কিছু করতে পারেননি।
পরবর্তী পোপ দ্বিতীয় আরবান (Pope Urban II, ১০৯১ খ্রিস্টাব্দ) সম্রাটের আর্তিতে সাড়া দেন। ক্ষমতালোভী পোপের লক্ষ্য ছিল সংকটকালে ধর্মযুদ্ধের ডাক দিয়ে খ্রিস্টান জগতে পোপের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব স্থাপন করা। এমতাবস্থায় ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সের ক্লেরম বা ক্লেরমন্ট (Clermont) শহরে এক ধর্মসভা (Council of Clermont) আহ্বান করে পোপ দ্বিতীয় আরবান পবিত্র তীর্থভূমি জেরুজালেম উদ্ধারের লক্ষ্যে সকলস্তরের খ্রিস্টানদের ধর্মযুদ্ধে (ক্রুসেড) যোগদানের আহ্বান জানান। ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে হলেও নানা স্তর, নানা বৃত্তির খ্রিস্টান জনতা এই যুদ্ধে যোগ দেন। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর