ক্রুসেডের ফলাফল বা প্রভাব লেখো

ক্রুসেডের ফলাফল বা প্রভাব লেখো

ক্রুসেডের ফলাফল বা প্রভাব লেখো
ক্রুসেডের ফলাফল বা প্রভাব লেখো

আপাতবিচারে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধগুলি ছিল দীর্ঘ ব্যর্থতার ইতিবৃত্ত। ধর্মযুদ্ধের মূল লক্ষ্য অধরাই থেকে যায়। প্রায় ২০০ বছরব্যাপী ৮টি অভিযান এবং প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের আত্মবলিদান সত্ত্বেও জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করা খ্রিস্টানদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তথাপি সমকালীন সমাজ, সংস্কৃতির উপর এর প্রতিক্রিয়া ছিল সুদূরপ্রসারী।

নেতিবাচক প্রভাব

(1) সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের অবসান

ধর্ম এবং যুদ্ধ যে হাতে হাত মিলিয়ে চলতে পারে না, ইউরোপের ক্রুসেডগুলি ছিল তার জ্বলন্ত নিদর্শন। আধ্যাত্মিক লক্ষ্য পূরণের পরিবর্তে ধর্মযোদ্ধাদের লোভ, লালসা ও হিংস্রতা মধ্যপ্রাচ্যের একদা সহিষ্ণু মুসলমান শক্তিগুলির কাছে খ্রিস্টান জগতকে হিংস্রতা ও শত্রুতার প্রতীকে পরিণত করে। সমগ্র মুসলিম জগত ল্যাটিন ইউরোপকে ঘৃণা করতে শুরু করে।

(2) পূর্ব ও পশ্চিম রোমের ব্যবধান

ক্রুসেডের বিপথগামিতা পূর্ব ও পশ্চিম খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে। ধর্মযোদ্ধাগণ কর্তৃক কনস্ট্যান্টিনোপল লুণ্ঠন ও ধ্বংসের দৃষ্টান্ত পূর্ব ও পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে অবিশ্বাস, ঘৃণা ও শত্রুতার পরিমণ্ডল গড়ে তোলে।

(3) রোমান সম্রাটদের দুর্বলতার প্রকাশ

ক্রুসেড সংগঠনের তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন পোপ। কিন্তু তাকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব বর্তেছিল সম্রাট, রাজন্যবর্গ ও সামন্তদের হাতে। এই অভিযানে ধর্মযোদ্ধাদের উচ্ছৃঙ্খলতা, সেনাবাহিনীর নৃশংসতা, পরিকল্পনার ব্যর্থতা কার্যত পূর্ব ও পশ্চিম রোমান সম্রাটদের অপদার্থতাকেই প্রকট করেছিল। খ্রিস্টান জগতের মূল সঞ্চালক হিসেবে পোপের উত্থান সহজ হয়েছিল।

(4) ব্যাপক ধ্বংসলীলা ও সম্পদের অপচয়

১০১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সংঘটিত ক্রুসেডের ফলে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। ধর্মযোদ্ধা ছাড়াও বহু সাধারণ মানুষও বলি হন ক্রুসেডের। ব্যাপক হত্যাকান্ড ও ধ্বংসলীলার পাশাপাশি প্রচুর ধনসম্পত্তিরও অপচয় হয়, যা এক দুর্দশাপূর্ণ জীবনের সূচনা করে।

(5) মুসলিম জগতের পিছিয়ে পড়া

দীর্ঘকালীন ক্রুসেডে অংশগ্রহণের ফলে খ্রিস্টান ও মুসলিম-উভয় জগতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইউরোপ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়লে তারা যুদ্ধনীতি ত্যাগ করে নতুন সমাজগঠনে উদ্যোগী হয়। কিন্তু মুসলিম জগৎ এরকম উদ্যোগ গ্রহণে নিস্পৃহ হওয়ায় পরবর্তীকালে তারা খ্রিস্টানদের তুলনায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে।

ইতিবাচক প্রভাব

(1) রাজনৈতিক প্রভাব 

  1. পোপের ক্ষমতাবৃদ্ধি: পবিত্রভূমি দখলে ব্যর্থ হলেও, ক্রুসেড সংগঠনের ফলে রোমান চার্চ এবং পোপ নতুন মর্যাদা ও প্রতিপত্তির অধিকারী হন। ক্রুসেড সংগঠনের কাজে পোপ ও তাঁর প্রতিনিধিদের নেতৃত্বকারী ভূমিকা, সম্রাট, রাজন্যবর্গ ও ধর্মযোদ্ধাগণ কর্তৃক পোপের নেতৃত্বের স্বীকৃতি কার্যত পোপকেই জননায়কের মর্যাদায় ভূষিত করে। সম্রাট বা রাজার পরিবর্তে পোপই বিধর্মীদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান সমাজের সর্বোচ্চ নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হন। তবে এই ইতিবাচক সম্ভাবনা স্থায়ী হয়নি। ধর্মযুদ্ধের নামে পোপ ও যাজকগণ কর্তৃক অর্থসংগ্রহ ও আত্মসাৎ-এর ঘটনা, ‘পাপমুক্তির নামে মার্জনাপত্র (Indulgence) বিক্রয় চার্চের ব্যবসাদারী মানসিকতা প্রকাশ করে দেয়। ফলে পোপ একাদশ শতকে অর্জিত প্রতিপত্তি কিছুকালের মধ্যেই হারাতে বাধ্য হন।
  2. সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভাঙন: ক্রুসেডের একটি মহার্ঘ অবদান ছিল মধ্যযুগীয় সামন্তব্যবস্থার ভিত্তিমূলে আঘাত ও ভাঙন ত্বরান্বিত করা। ক্রুসেডে অর্থসাহায্যের জন্য বহু ভূস্বামী তাদের ভূসম্পত্তি বন্ধক রাখেন। আবার অনেকে অর্থের বিনিময়ে দাসদের মুক্তি দেন। এর ফলে প্রাচীন ভূস্বামী শ্রেণি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পরিবর্তে উত্থান ঘটে জমির অধিকারী নতুন এক শ্রেণির। অন্যদিকে দাসত্ব মুক্ত হয়ে ভূমিদাসরাও স্বাধীন মজুরে পরিণত হন। এইভাবে সামন্ততন্ত্রের দুটি প্রধান ভিত্তি ম্যানর ব্যবস্থা এবং ভূমিদাস প্রথা ভেঙে পড়লে সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপের আর্থসামাজিক চিত্র বদলে যেতে থাকে।
  3. শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উত্থান: ক্রুসেডে যোগদানকারী সামন্তপ্রভুদের অনেকেই ভূসম্পত্তি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়েছিলেন। অনেকেই ধর্মযুদ্ধে যোগ দিয়ে দূর বিদেশে মৃত্যুবরণ করেন। এইরূপে ক্রুসেড পরোক্ষভাবে সামন্ততান্ত্রিক আধিপত্যের অবসান ঘটায়। এতকাল রাজা তাঁর পদমর্যাদা ও সামরিক শক্তি নিশ্চিত করার জন্য সামন্তপ্রভুদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু সামন্তদের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি, প্রতিপত্তি ও সংখ্যা কমে গেলে রাজতন্ত্রের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ ও সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়। উত্তরাধিকারহীন সামন্তদের জমি, অর্থসম্পদ রাজার হস্তগত হয়। রাজার একক অনুচর ও সেনাশক্তি অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। এসময় সাধারণ মানুষ সামন্তদের অবর্তমানে রাজার শরণাপন্ন হন। এইভাবে রাজতন্ত্র তার হারানো মর্যাদা ফিরে পায়। শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উত্থান ঘটে।
  4. জাতীয় রাজতন্ত্রের সম্ভাবনা: ক্রুসেডে অংশ নিয়েছিল নানা দেশ, নানা জাতির মানুষ। তাদের ভাষা, জীবনধারা, আচার-বিচার ছিল পৃথক। বিদেশ-বিভুঁইয়ে এই ভিন্নতর গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে থাকতে থাকতে ধর্মযোদ্ধারা আত্মীয়-পরিজন, স্বজাতি, স্বভাষী মানুষের জন্য গভীর একাত্মতা অনুভব করতে থাকেন। এইভাবে একই দেশে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে একাত্মতার জন্ম হয়, যা পরবর্তী পর্যায়ে জাতীয়তাবোধের সম্ভাবনার বীজ বপন করে। রাজাকে কেন্দ্র করে রাজ্য গঠনের এই মানসিকতা জাতীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তৈরি করে।

(2) অর্থনৈতিক প্রভাব 

  1. শিল্পের বিকাশ : মধ্যযুগীয় ইউরোপে প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি। কিন্তু ক্রুসেডের ফলে শিল্প ও বাণিজ্যের অগ্রগতির পথ সুগম হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটে। শিল্প ও কারিগরি পেশায় নতুন নতুন বহু মানুষের নিযুক্তি ঘটতে থাকে। শিল্পের মধ্যে বস্ত্রবয়ন (সুতি, রেশম, পশম) প্রধান ছিল। দেশভেদে মখমল, মদ, রঞ্জক, সামুদ্রিক মাছ প্রক্রিয়াকরণ, চামড়ার ও ধাতব জিনিসপত্র উল্লেখযোগ্য ছিল। মুক্ত ভূমিদাসরা শিল্প ও কারিগরি পেশায় যুক্ত হলে শ্রমিকের জোগান বাড়ে। ফলে শিল্পের বিকাশ দ্রুততর হয়।
  2. প্রাচ্যে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ: ক্রুসেডের হাত ধরে প্রাচ্যের দেশগুলিতে ইউরোপীয় বাণিজ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটে। উল্লেখ্য যে, একাদশ শতকে ক্রুসেড শুরুর আগেই ভেনিস, জেনোয়া, পিসা, অ্যামালফি প্রভৃতি বন্দরগুলি থেকে বসফরাস প্রণালী ও কৃষ্ণসাগরের উপকূলবর্তী প্রাচ্যের বন্দরগুলিতে পণ্যের লেনদেন ঘটত। কিন্তু ক্রুসেডের ফলে খ্রিস্টান জনগণের সঙ্গে প্রাচ্যের প্রত্যক্ষ সংযোগ এই বাণিজ্যে নতুন গতি নিয়ে আসে। ইটালির নগররাষ্ট্র ভেনিস ক্রুসেডার এবং তাদের খাদ্যসম্ভার প্রাচ্যের দেশগুলিতে পৌঁছে দেওয়ার পর সেখানকার বিপুল পণ্য ইউরোপে আমদানি করতে থাকে। এই দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হয় অন্যান্য নগররাষ্ট্রের বণিককুল। তৈরি হয় বৃহদাকার জাহাজ। বাণিজ্যসূত্রে স্থাপিত হয় বহু নতুন নগর ও শহর। প্রাচ্যের দেশগুলিতে ইউরোপীয় শিল্পপণ্যের বাজার যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনই ইউরোপের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় প্রাচ্যের রেশম বস্ত্র, কার্পাস বস্ত্র, সুগন্ধি, খেজুর ইত্যাদি লোভনীয় পণ্যসম্ভার।
  3. নতুন শহরের পস্তুন: ক্রুসেড চলাকালীন সময়ে ইউরোপের পুরোনো শহরগুলির শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। এরপর প্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্যসূত্র স্থাপিত হলে ভেনিস, জেনোয়া, পিসা, নেপলস, মার্সেই প্রভৃতি শহর সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। গড়ে ওঠে আরও নতুন নতুন নগর ও শহর।

(3) সামাজিক প্রভাব

  1. মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব: ক্রুসেডের সূত্রে প্রাচ্যের দেশগুলিতে ইউরোপের সম্প্রসারিত বাণিজ্য ইউরোপের সমাজে এক নতুন শ্রেণির জন্ম দেয়। বাণিজ্যের হিসাবরক্ষা, সরকারি দফতর পরিচালনা, আইনকানুন চর্চা ইত্যাদি নানা বৃত্তিধারী মানুষের আবির্ভাব জন্ম দিল নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির। পরবর্তীকালে সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতির জগতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে, মধ্যযুগের অবসানে আধুনিক যুগের যে নতুন সূর্য ওঠে, তারই ধারক-বাহক হিসেবে বিশেষ অবদান ছিল এই নব্য সামাজিক শ্রেণির।
  2. বণিক ও মহাজন শ্রেণির প্রভাষ বৃদ্ধি: ইউরোপের বণিক ও মহাজন শ্রেণির থেকে ঋণগ্রহণকারী সামন্তপ্রভুরা ক্রুসেডে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলে বা নিঃস্ব হয়ে ফিরে এলে তাদের জমিগুলি বণিক ও মহাজন শ্রেণির হাতে চলে যায়। ফলে এই শ্রেণিই পরবর্তীতে ইউরোপের চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়।
  3. জামিক শ্রেণির উত্থান: পোপ দ্বিতীয় আরবানের ক্লেয়ারমন্ট ধর্মসম্মেলনে ঘোষণার প্রেক্ষিতে ক্রুসেডে যোগদানকারী ভূমিদাসরা যুদ্ধশেষে স্বাধীন নাগরিক হয়ে শহরে শিল্পী বা কারিগর কিংবা উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণির শ্রমিক বা সহযোগীতে পরিণত হয়। এভাবে সমাজে একটি নতুন সামাজিক শ্রেণি হিসেবে এই ভূমিদাসরা পরিচিত হতে থাকে।
  4. নারীসমাজের মর্যাদা বৃদ্ধি: সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মযোদ্ধারা দীর্ঘদিন ঘরের বাইরে থাকার ফলে এই সকল নাইট, সামন্তপ্রভু, অভিজাত শ্রেণির জীবন-জীবিকা, ম্যানর ও জমিদারি প্রভৃতি পরিচালনার দায়িত্বভার তাদের পরিবারের নারীদের উপর এসে পড়ে। ফলে নারীরা এই সকল কাজ পরিচালনায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে এবং সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

(4) সাংস্কৃতিক প্রভাব

  1. মননশীলতার চর্চা: প্রাক্-ক্রুসেড পর্বে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ইউরোপের তুলনায় ইসলামীয় সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় অনেক অগ্রণী ছিল। ধর্মযুদ্ধের সূত্রে অগণিত খ্রিস্টভক্তের প্রাচ্য দেশগুলিতে যাওয়া-আসার ফলে খ্রিস্টান জগৎ আঞ্চলিক সংকীর্ণতা মুক্ত হয়। নতুন নতুন দেশ, জনগোষ্ঠী, সভ্যতা-সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে ইউরোপীয় মনীষা ইসলামীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং সৃজনশীল সাহিত্য- সংস্কৃতির চর্চায় আত্মনিয়োগ করে। ক্রুসেডারদের জীবনী নিয়ে রচিত হয় বীরগাথা। সৃষ্টি হয় সাহিত্য, ইতিহাস, কাব্য। রচিত হয় মার্কো পোলো (Marco Polo)-র ভ্রমণ কাহিনির মতো চিত্তাকর্ষক পর্যটনের কাহিনি। ক্রুসেডের পর থেকেই প্রাচ্যের মধুর বিরহ-মিলনভিত্তিক গাথাগুলি ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতে থাকে।
  2. বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির প্রসার: ক্রুসেডের ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে জ্ঞানের আদানপ্রদানের সূত্রে এশিয়ার কাগজ, কম্পাস, আতস কাচ প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ইউরোপে পৌঁছোয়। ফলে সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্রুত বিস্তার ঘটে।
  3. শিক্ষাদীক্ষা ও সাহিত্য: ক্রুসেডের ফলে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগের বাতাবরণ তৈরি হয়। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক নাগাদ ইবন সিনা, ইবন রশিদ ও অন্যান্য আরব পন্ডিতগণ পশ্চিম ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অধ্যাপনা করতে থাকেন। তাঁদের আরবি ভাষায় রচনাসমূহ ইউরোপে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। ইতিপূর্বে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো, অ্যারিস্টটলের দর্শন আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। সেগুলিও ইউরোপে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতে থাকে। এ ছাড়া আরব্য রজনী, পঞ্চতন্ত্র ইত্যাদি প্রাচ্যদেশীয় সাহিত্যকর্মও ইউরোপীয় সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছিল।
  4. ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশ: ক্রুসেড চলাকালীন দীর্ঘ ২০০ বছরে বহু ধর্মযোদ্ধা স্থল ও জলপথে জেরুজালেমে আসেন। ফলে ভূপ্রকৃতি, মানুষজন সম্বন্ধে তাদের মধ্যে স্পষ্ট ধারণা জন্মায়। এসময় ভৌগোলিক জ্ঞানবিষয়ক অনেক বই লেখা হয়। পরবর্তীকালে এই ভৌগোলিক জ্ঞান সমুদ্রযাত্রা ও ভৌগোলিক আবিষ্কারের পথ নির্দেশ করে।

রেনেসাঁ(নবজাগরণ)-এর পদধ্বনি: ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের এক যুগান্তকারী ফল ছিল ইউরোপের সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ভাবনা-চিন্তার জগতে এক আমূল পরিবর্তনের পূর্বাভাস। ধর্মযুদ্ধের সূত্রে দূরবর্তী জনগোষ্ঠী এবং তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ইউরোপীয়দের মধ্যে নবচেতনার উন্মেষ ঘটায়। সংকীর্ণ ধর্মচিন্তা, পোপ-সম্রাটের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, নগররাষ্ট্র বনাম রাজশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদি গতানুগতিক ঘটনাপ্রবাহের একঘেয়েমি বর্জন করে মানুষ যুক্তিবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, মানবতাবাদ ইত্যাদি নবচেতনায় উদ্‌বুদ্ধ হতে শুরু করে। মার্কিন ঐতিহাসিক ও দার্শনিক উইল ডুরান্ট (Will Durant) এই ভাবজাগতিক পরিবর্তনকে নবজাগরণের (রেনেসাঁ) আগমনের পূর্বাভাস বলে আখ্যায়িত করেছেন।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment