ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে লেখো

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে লেখো

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে লেখো
ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে লেখো

মানবপ্রকৃতি

ম্যাকিয়াভেলি তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে যে লোকায়ত চিন্তাকে তুলে ধরেছেন, তাঁর কেন্দ্রে অবস্থিত মানুষ, তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মনস্তত্ত্ব। এক্ষেত্রে শাসক এবং শাসিত উভয়েরই চরিত্রের বিষয়টি উঠে এসেছে।

(i) মানুষ সম্পর্কে পৃথক চিন্তাধারা

ফ্লোরেন্সের বাসিন্দা ম্যাকিয়াভেলি ইটালির জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে সামন্তপ্রভু এবং রোমান ক্যাথলিক যাজকদের বিভাজনমূলক মানসিকতাকে সমর্থন করেননি। উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণির দার্শনিক প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সামন্তপ্রভুদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদ এবং যাজক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতাকে আহ্বান জানান। তাই নবযুগের প্রতিনিধি হিসেবে মানবচরিত্র সম্পর্কে ম্যাকিয়াভেলির গড়ে তোলা ধারণা ছিল প্রচলিত খ্রিস্টীয় তত্ত্বের থেকে একেবারেই আলাদা।

(ii) রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ভিত্তিতে মানবচরিত্র বিশ্লেষণ

ম্যাকিয়াভেলি ব্যক্তিগতভাবে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে নিয়ে আলোচনা করতে চাননি। তিনি মূলত মানুষের রাজনৈতিক কার্যকলাপ, তার রাজনৈতিক সাফল্য-ব্যর্থতার উপর ভিত্তি করে মানবপ্রকৃতি নিরীক্ষণ করেছেন। ম্যাকিয়াভেলি একজন রাজনৈতিক মানুষের কথা বলেছেন যার পরিচয় পাওয়া যায় তার নাগরিক গুণাবলির প্রকাশ, শাসনকৌশল, রাজনৈতিক সংগ্রাম, রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকাশের মধ্যে দিয়েই।

(iii) মানুষের মানবিক গুণের ব্যাখ্যা 

ম্যাকিয়াভেলির মতে, মানুষের সঙ্গে প্রতিবেশীর সম্পর্কের মাধ্যমে মানবিক গুণসমূহ নিরূপণ করা সম্ভব। প্রতিবেশী যদি মানুষ বা তার কল্যাণের প্রতি অমনোযোগী হয় বা তার আচরণ পক্ষপাতদুষ্ট হলে মানুষ কখনোই সদাচারী হয় না। যেহেতু মানুষ প্রকৃতিগতভাবে অসৎ ও মন্দ, পরস্পরের প্রতি সর্বদা সন্দিহান তাই রাজাকেও পাশবিক ধূর্ততার পথ অবলম্বন করতে হয়- যা ম্যাকিয়াভেলি স্বাভাবিক বলেই মনে করেছেন। তাঁর মতে, কঠোর নিয়ন্ত্রণ দ্বারা মানুষকে বাধ্য করতে না পারলে শাসক ভালো কাজ সম্পন্ন করতে পারেন না।

(iv) মানুষ সম্পর্কে ম্যাকিয়াভেলির সিদ্ধান্ত

‘The Prince’ গ্রন্থে ম্যাকিয়াভেলি উল্লিখিত মানুষ সম্পর্কে তাঁর সিদ্ধান্তগুলি হল- 

  • মানুষ অকৃতজ্ঞ, অস্থিরচিত্ত, প্রতারক, কাপুরুষ, আত্মকেন্দ্রিক, ন্যায়নীতিবোধহীন ও অর্থলিপ্স। 
  • শাসকের প্রতি শাসিতের আনুগত্যের মূল ভিত্তি হবে ভীতি। 
  • ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রে দয়ার তুলনায় নিষ্ঠুরতা বেশি মূল্যবান। 
  • ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনের থেকে পাশবিক শক্তির মূল্য অনেক। 
  • সাফল্যের প্রধান মাপকাঠিই হল সুযোগের সদ্ব্যবহার, ভাগ্য কেবল এক্ষেত্রে সহায়তা করে। 
  • দুষ্ট মানুষেরা খুব সহজেই সরল সাধারণ মানুষদের প্রবঞ্চনা করতে পারে। 
  • যে প্রবঞ্চনার পথে চলেন তার নিজেরও প্রবঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। 
  • অপরের দ্বারা নয়, বরং নিজ বিচারবুদ্ধি দ্বারা চালিত ব্যক্তিই হলেন মহৎ। 
  • বাইরের আচরণেই মানুষের প্রকাশ, বৈষয়িক বিচারবুদ্ধি এবং কামনা-বাসনা দ্বারা মানুষ পরিচালিত হয়। 
  • মানুষ পিতৃশোক ভুলতে পারলেও সম্পত্তির শোক ভুলতে পারে না। 
  • রাষ্ট্র, সরকার ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান, মানুষের প্রয়োজন থেকেই সৃষ্ট এবং মানুষেরই চাহিদা অনুসারে পরিবর্তিত ও আবর্তিত হয়। 
  • মুষ্টিমেয় লোকের ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও বেশিরভাগই চায় ব্যক্তিগত ও আর্থিক নিরাপত্তা। 
  • মানুষের বৈষয়িক চাহিদা ভালোভাবে মিটবে বলেই রাজতন্ত্রের তুলনায় প্রজাতন্ত্র কাম্য, কারণ স্বশাসিত রাষ্ট্রে সম্পদের বণ্টন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ম্যাকিয়াভেলি মনে করেন, ক্ষমতা ও অর্থলাভের জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। এইজন্য মানুষে-মানুষে বিবাদ, প্রতিযোগিতা ও সংঘর্ষ লেগেই থাকে এবং রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

(v) বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিচ্ছবি

অনেকে মনে করেন যে, ম্যাকিয়াভেলি বর্ণিত মানবপ্রকৃতি সমসাময়িক বুর্জোয়া শ্রেণিরই প্রতিচ্ছবি। এই শ্রেণি আভিজাত্যবিহীনভাবে যেরকম সংগ্রাম ও অভিযানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব জয় করেছিল, সেই আত্মকেন্দ্রিক নবজাত শ্রেণির আকাঙ্ক্ষাই উঠে এসেছে ম্যাকিয়াভেলির তত্ত্বে। অ্যান্টোনিও গ্রামসি (Antonio Gramsci)-এর মতে, ম্যাকিয়াভেলি হলেন প্রথম বুর্জোয়া শ্রেণির অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল (Organic Intellectual) |

রাষ্ট্র ও তার বৈশিষ্ট্য

রাজনৈতিক সাহিত্যে রাষ্ট্র বা State পরিভাষাটির সংযোজনকে অনেকে ম্যাকিয়াভেলির সবচেয়ে বড়ো অবদান বলে মনে করেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্র কোনও বিমূর্ত ধারণা নয়, বরং উদীয়মান সমাজের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রয়োজন রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়েছে। ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক তত্ত্বের মধ্যে থেকে রাষ্ট্রের যে যে বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে জানা যায়, তা হল- 

  • রাষ্ট্রক্ষমতা: রাষ্ট্রক্ষমতা হল ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রদর্শনের মূল বিষয়। তিনি তাঁর দ্য প্রিন্স গ্রন্থে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, সংরক্ষণ ও প্রয়োগের উপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন।
  • জীবন ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি সংরক্ষণ: ম্যাকিয়াভেলি মনে করেন যে, মানুষের জীবন ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি সংরক্ষণ হল রাষ্ট্র ও সরকারের উৎপত্তির মূল কারণ। 
  • ধর্মনিরপেক্ষতা: তাঁর মতে, রাষ্ট্রকে চার্চ ও ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। 
  • ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা : রাষ্ট্র সবসময়ই নিজ ক্ষমতাবৃদ্ধির প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকে এবং এখানে নীতিবোধের কোনও স্থান থাকে না। 
  • সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি : সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা প্রদানের মধ্য দিয়ে নিজ জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা। 
  • প্রশাসনে জনসাধারণের অংশগ্রহণ: রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল জনসাধারণ। জনসাধারণ যে রাষ্ট্রে প্রশাসনিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, ম্যাকিয়াভেলির মতে, সেই রাষ্ট্রই হল শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র। 
  • ভালো আইন ও সেনাবাহিনী: রাষ্ট্রের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ভালো আইন ও কার্যকরী সৈন্যবাহিনী গঠন করা উচিত। 
  • মানুষের ভূমিকা: মানুষ মূলত নিজের স্বার্থসিদ্ধি ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনেই রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে স্বাগত জানায়।

রাষ্ট্র ও সরকারের স্বরূপ

ম্যাকিয়াভেলির তত্ত্বে রাষ্ট্র ও সরকারের স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

(i) সরকারের শ্রেণিবিভাগ 

অ্যারিস্টটলের অনুসরণে ম্যাকিয়াভেলি যে তিন ভাগে রাষ্ট্র ও সরকারকে ভাগ করেছেন, সেগুলি হল- রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র। তবে সরকারের শ্রেণিবিভাগ করলেও ম্যাকিয়াভেলি মনে করেন, রাজতান্ত্রিক বা প্রজাতান্ত্রিক সরকার, কোনও ক্ষেত্রেই সামাজিক অগ্রগতি অব্যাহত থাকে না। তাই তাঁর মতে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং প্রজাতন্ত্র -এই তিন শাসনের মিশ্র শাসনব্যবস্থা সবচেয়ে কার্যকরী।

(ii) ভালোমন্দের ব্যাখ্যা

প্রাচীন রাষ্ট্রতাত্ত্বিক সিসেরোর প্রাকৃতিক আইনের বৈধতাকে অস্বীকার করে ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রের ভালো ও মন্দের ধারণা ব্যাখ্যা করেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত হল এই যে, রাষ্ট্র বা সমাজের স্বার্থরক্ষাকারী বিষয়সমূহ হল ভালো এবং রাষ্ট্র বা সমাজের ক্ষতিসাধনকারী বিষয়সমূহ হল মন্দ।

(iii) শাসনের রূপবদল

ম্যাকিয়াভেলি তাঁর তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে কেমন করে নতুন ঐতিহাসিক বা সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শাসনের রূপবদল ঘটে। দ্য ডিসকোর্সেস গ্রন্থে ম্যাকিয়াভেলি বর্ণনা দিয়েছেন যে কীভাবে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্র ক্রমশ স্বৈরতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র এবং জনতাতন্ত্রে পরিণত হতে পারে। বংশানুক্রমিক শাসন, শাসকের অধঃপতন, উৎপীড়নের নীতি প্রভৃতি রাজতন্ত্রকে পরিণত করে স্বৈরতন্ত্রে। আবার কিছু মহানুভব অভিজাত মানুষ যখন স্বৈরশাসনের বিলুপ্তি ঘটিয়ে, জনগণের সমর্থনে শাসনদায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন গড়ে ওঠে অভিজাততন্ত্র। কিন্তু এই ব্যবস্থায় যখন কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থ দ্বারা শাসন পরিচালিত হয়, তখন তা রূপান্তরিত হয় গোষ্ঠীতন্ত্রে। এদের অত্যাচারে অসন্তুষ্ট জনসাধারণ যখন গোষ্ঠী শাসনকে উচ্ছেদ করে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে, তখন তা হয়ে দাঁড়ায় গণতন্ত্র। ম্যাকিয়াভেলির বিচারে এটি স্বল্পস্থায়ী, কারণ অচিরেই এই শাসন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে ও উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসনে পরিণত হয়।

রাজতন্ত্র

ম্যাকিয়াভেলি তাঁর দ্য প্রিন্স গ্রন্থে কীভাবে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, কীভাবে শাসককে সফল ও সুপ্রতিষ্ঠিত করা যায় সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

(i) বংশানুক্রমিক শাসন

ম্যাকিয়াভেলির মতে, বংশানুক্রমিক শাসনে অনায়াসে রাজার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ, রাজপরিবারের প্রতি জনগণের আনুগত্য অভ্যাসে পরিণত হয়। তবে তাঁর মতে, একজন ব্যক্তি যখন বংশানুক্রমিকভাবে নয়, নিজ যোগ্যতা বা কৃতিত্বে রাজা হন, তখন সেই নবগঠিত রাজতন্ত্রকে নিয়ে সমস্যা দেখা দেয় (It is in the new monarchies the difficulties are found)। নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য অঞ্চলে আধিপত্য গড়ে তুলতে হলে রাজাকে সতর্ক হতে হবে।

এক্ষেত্রে ম্যাকিয়াভেলি নতুন রাজাকে কিছু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন, যেমন- স্থায়িত্ব ও স্থিরতা রক্ষার জন্য নিজ রাজ্যে রাজা স্বয়ং উপস্থিত থেকে সবকিছু প্রত্যক্ষ করবেন এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন; অধিকৃত এলাকায় নিজে বসবাস করতে না পারলে সেখানে রাজা নিজ রাজ্যের অধিবাসী প্রেরণ করবেন; তাছাড়া নিজের দখল করার এলাকা টিকিয়ে রাখার জন্য একদল ক্ষুদ্র শাসকগোষ্ঠীও রাজা গড়ে তুলবেন।

(ii) রাজপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার উপায়

একজন সাধারণ ব্যক্তি তিনটি উপায়ে রাজপদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন। যথা- বলপ্রয়োগ করে বা যুদ্ধ করে, ছল-চাতুরির মাধ্যমে বা দুর্বৃত্ততার সাহায্যে এবং সহ-নাগরিকদের সমর্থন ও সহযোগিতায়। ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন যে, ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, রাজা যেখানে বলপ্রয়োগের উপর নির্ভর করে এগিয়ে গেছেন, সেখানেই তিনি সফলভাবে রাজ্য শাসন করেছেন। ভাগ্য বা বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়ে নয়, নিজ শক্তি ও পরাক্রমের জোরে রাজা এলাকা দখল করলে সেখানে তাঁর শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

(iii) রাজ্যকে সুরক্ষা প্রদান

ম্যাকিয়াভেলি রাজতন্ত্রকে সাহসী, দৃঢ় ও শৌর্যবীর্যসম্পন্ন হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাজার প্রধান দায়িত্ব হল রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখা। এক্ষেত্রে তিনি যে পন্থাগুলির উল্লেখ করেছেন, তা হল- 

  • বলপ্রয়োগ করা: যে-কোনও উপায়ে রাজপদে বসার পর রাজার কাজ হবে বল প্রয়োগের মাধ্যমে রাজ্যশাসনের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করা। তিনি বলেছেন প্রজাদের প্রতি দয়া দেখানোর চেয়ে নিষ্ঠুরতা দেখানো উচিত, কারণ এতে তারা বেশি অনুগত থাকবে। 
  • ছল-চাতুরির আশ্রয় নেওয়া: ম্যাকিয়াভেলির মতে, রাজা প্রয়োজনে ছল-চাতুরি ও শঠতার আশ্রয় নেবে। তিনি অতীতের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে গ্রিসের অনেক নগররাষ্ট্র ছল-চাতুরি, শঠতা, নিষ্ঠুরতা ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করেছিল।

(iv) রাজার গুণাবলি

ম্যাকিয়াভেলির মতে, জনগণের কাছে শাসকের ভাবমূর্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজাকে বেশকিছু গুণাবলি অর্জন করতে হবে। গুণবান রাজাকে প্রজারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শ্রদ্ধা ও সম্মান করে। এই গুণাবলি হল নিম্নরূপ- 

  • রাজার সবচেয়ে বড়ো গুণ হল যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা, সামরিক সংগঠন ও শৃঙ্খলা সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা। এর ভিত্তিতেই রাজ্যের নাগরিকদের মধ্যে থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে, তাদের সুসংগঠিত করে, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও দায়িত্ব প্রদানের মধ্য দিয়ে রাজা এক সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী গড়ে তুলবেন। 
  • রাজাকে নিজের কাজকর্মের মধ্যে সাহস, দৃঢ়তা ও বীরত্ব দেখাতে হবে। ম্যাকিয়াভেলি মনে করেন যে, অস্থিরমতি, চপল, নারীসুলভ নম্রতা বা হীনমন্যতা- এ ধরনের বৈশিষ্ট্য রাজাকে প্রজাদের চোখে ছোটো করে দিতে পারে।
  • রাজাকে তাঁর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রজাদের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি করতে হবে যে তিনি একজন মহান মানুষ। যেহেতু প্রজারা যা দেখে তার ভিত্তিতেই রাজার মূল্যায়ন করে, অধিকাংশই গভীরভাবে রাজার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে না। তবে রাজা নির্দয় হলে কিংবা তার অন্তরে কপটতা থাকলেও প্রজাদের সম্মুখে রাজাকে উদার, বিশ্বস্ত, সাধু মানুষের ভান করতে হবে। 
  • রাজার কাছে নিরপেক্ষতার কোনও মূল্য থাকবে না। তিনি সক্রিয় ও সোজাসুজি ভূমিকা পালন করবেন। পরিস্থিতি অনুযায়ী রাজা মিত্রতা বা শত্রুতা যে-কোনো একটি পথ বেছে নেবেন। 
  • রাজা যখন বন্ধু হবেন তখন তিনি প্রকৃত বন্ধু হবেন। আবার যখন তিনি শত্রুতা করবেন, তাও করবেন নির্মম ও আপসহীনভাবে। 
  • রাজা, রাজ্যের প্রয়োজন অনুসারে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এবং সকল বিরোধী শক্তিকে কঠোর হস্তে দমন করবেন। এইরূপ সিদ্ধান্ত সদ্‌গুণ দ্বারা পরিচালিতও হতে পারে, আবার রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য অমানবিক ও অনৈতিকও হতে পারে। এক্ষেত্রে ম্যাকিয়াভেলি রাজাকে একইসঙ্গে সাহসী ও ধূর্ত, বীর ও কপট, দরদি ও নিষ্ঠুর ইত্যাদি পরস্পরবিরোধী গুণের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। 
  • রাজা বিনা কারণে সহৃদয় বা দয়ালু হবেন না। জনগণকে ভীত ও সন্ত্রস্ত রাখাই শাসকের আনুগত্যলাভের একমাত্র পথ।
  • রাজা প্রজাদের এমনভাবে শান্তি দেবেন যেন তা যথাযথ, যুক্তিপূর্ণ ও দৃশ্যত কারণ দ্বারা সমর্থিত হয়। ম্যাকিয়াভেলি মনে করেন যে, প্রজারা রাজাকে ভয় করলেও ঘৃণা করবে না। 
  • শাসক তাঁর প্রভুত্ব বজায় রাখার জন্য আইনের বিধান মেনে যেমন শাসন করবেন, তেমনই বলপ্রয়োগের মতো (বিশেষত অসৎ মানুষের ক্ষেত্রে) পাশবিক পন্থাও অবলম্বন করবেন। 
  • তিনি যোগ্য ব্যক্তিদের সমাদর করবেন এবং নাগরিকদের গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে উৎসাহ দেবেন। 
  • সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে সম্মান প্রদানের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন। রাজা এইসব পদ্ধতি অবলম্বন করলে শক্তিশালী হবেন এবং তিনি সীমাহীন শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠবেন।

(v) রাজার প্রতি পরামর্শ

রাজার প্রতি ম্যাকিয়াভেলির কিছু পরামর্শ আছে, যেমন- 

  • রাজা রাজকর্মচারী নিয়োগ করবেন যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততার ভিত্তিতে। 
  • রাজা রাজকর্মচারী, চাটুকারদের থেকে দূরে থাকবেন।
  • তিনি কর্মচারীদের সত্য কথনে উৎসাহ দেবেন। 
  • তিনি কখনও অযথা উপদেশ বা পরামর্শ গ্রহণ করবেন না।

প্রজাতন্ত্র

ম্যাকিয়াভেলি তাঁর দ্য ডিসকোর্সেস গ্রন্থে প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে নিজ ভাবনা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন যে, রাজতন্ত্র অপেক্ষা প্রজাতন্ত্রেই মানুষের স্বার্থ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা বেশি সুরক্ষিত থাকে।

(i) প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার শ্রেণিবিভাগ

ম্যাকিয়াভেলি দুধরনের প্রজাতন্ত্রের কথা বলেছেন। যেমন- অভিজাততান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (Aristocratic Republic) ও জনগণের প্রজাতন্ত্র (Peoples’ Republic)। তবে ম্যাকিয়াভেলির প্রজাতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে আধুনিক প্রজাতন্ত্রের ধারণা মেলে না। তাঁর মতে, রাজাই হলেন প্রজাতন্ত্রের সৃষ্টিকর্তা। 

  • অভিজাততান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র: ম্যাকিয়াভেলির মতে, রাজা যখন অভিজাতদের উপর নির্ভর করে শাসন পরিচালনা করেন, তখন তা হল অভিজাততান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র।
  • জনগণের প্রজাতন্ত্র: রাজা যখন শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা ও দায়িত্ব সাধারণ জনগণের উপর অর্পণ করেন, তখন তা হল জনগণের প্রজাতন্ত্র। এই ব্যবস্থার উদাহরণ হিসেবে তিনি প্রজাতান্ত্রিক রোমের কথা উল্লেখ করেছেন।

(ii) প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব 

তিনি জনগণের প্রজাতন্ত্রকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন এবং প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে মুক্ত রাষ্ট্র (Free States) বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হল সব ধরনের শাসনব্যবস্থার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। জনগণের কণ্ঠই হল ঈশ্বরের কণ্ঠ এই ছিল ম্যাকিয়াভেলির অভিমত।

(iii) প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার শর্ত

ম্যাকিয়াভেলি প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার শর্ত হিসেবে তুলে ধরেছেন Civic Virtue-এর প্রসঙ্গটি, যার বৈশিষ্ট্য হল সমষ্টির মঙ্গলসাধনের চেতনা বিস্তার করা। এই চেতনার প্রভাবে মানুষ, কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে নয় বরং সামগ্রিক সমাজের কল্যাণসাধনের জন্য দায়বদ্ধ থাকে। দুর্নীতি হল Civic Virtue-এর পুরোপুরি বিরোধী। ম্যাকিয়াভেলি এই Civic Virtue-এর স্বার্থে জনসাধারণের মধ্যে একরকম সমতার অবস্থান দাবি করেছেন। যোগ্য ও উৎসাহী শাসক এবং মহৎ ও উৎসাহী নাগরিকদের পারস্পরিক সহায়তা ও উদ্যোগেই সঠিকভাবে এবং সুস্থিতরূপে প্রজাতান্ত্রিক সরকার পরিচালিত হওয়া সম্ভব।

(iv) প্রজাতন্ত্রের পুনর্বিন্যাস

জনসাধারণ দুর্নীতিপরায়ণ হলে বা সমাজে বিশৃঙ্খলার দরুন যদি জনগণের অধিকার ও নাগরিক সমতা সংকটের সম্মুখীন হয়, তবে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষ সাময়িকভাবে প্রজাতন্ত্র থেকে রাজতন্ত্রের দ্বারস্থ হয়। ম্যাকিয়াভেলি দেখিয়েছেন যে কীভাবে একসময় প্রজাতন্ত্রে মানুষ সম্পদলোলুপ ও ব্যাভিচারী হয়ে পড়ে এবং সম্পদের অসম বণ্টন মানুষের মধ্যে বৈষম্য ও অভাবের সৃষ্টি করে। এই পরিবেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিজেদের আর্থিক সুবিধা ও স্বার্থরক্ষাকারী শাসককেই নির্বাচিত করতে চায়।

এর দরুন সমাজে অসৎ জনগণ ও পক্ষপাতদুষ্ট শাসকের সৃষ্টি হলে, নিপীড়িত ও বঞ্চিত প্রজারা রাষ্ট্রবিমুখ হয়ে রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়। ম্যাকিয়াভেলির মতে, এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে, যেখান থেকে প্রজাতন্ত্র পথ চলা শুরু করেছিল, সেখানেই তাকে ফিরে যেতে হবে এবং এই পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে শাসকের ভূমিকা হবে রাজতন্ত্রের রাজার অনুরূপ। তিনি ধর্মযোদ্ধার মতো একাই অভিযান চালাবেন সকল অন্যায় ও অবিচারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য যেখানে সহনশীলতা, দয়া বা তোষণের কোনও ভূমিকা থাকবে না।

ক্ষমতাতত্ত্ব

দ্য প্রিন্স ও দ্য ডিসকোর্সেস – উভয় গ্রন্থ থেকেই ম্যাকিয়াভেলির ক্ষমতাতত্ত্ব সম্পর্কিত অভিমত জানা যায়। তাঁর মতে, রাজতন্ত্র এবং প্রজাতন্ত্র উভয়ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ও শৃঙ্খলা রক্ষার প্রাথমিক শর্ত হল ক্ষমতা দখল। জনগণকে শাসন করার মাধ্যম হল ক্ষমতা। ক্ষমতা দখলের পদ্ধতি, তা বজায় রাখা, বা কী ধরনের ভ্রান্তনীতির দরুন ক্ষমতার ভিত্তি দুর্বল হয় -এসব কিছুই ম্যাকিয়াভেলি তাঁর তত্ত্বে আলোচনা করেছেন। ল্যাস্কি (Laski)-র মতে, ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রতত্ত্ব হল Grammar of Power বা ক্ষমতার ব্যাকরণ। ক্ষমতা অর্জন ও তা ধরে রাখার পদ্ধতি নিয়ে এত গভীর বিশ্লেষণের জন্য সম্ভবত ম্যাকিয়াভেলিকে রাজনীতির ক্ষমতাতত্ত্বের প্রথম ও সার্থক প্রবক্তা বলা হয়।

(i) ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পথ

ম্যাকিয়াভেলির মতে ধর্ম বা নৈতিকতা নয়, ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার প্রধান পথ হল কূটনীতি। আর এই ক্ষমতার উৎকর্ষতাকে ম্যাকিয়াভেলি বিচার করেছেন সাফল্য ও ব্যর্থতার নিরিখে, গুরুত্ব দিয়েছেন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনের উপরেই। তাঁর এই ক্ষমতাতত্ত্বে আইনের পরিবর্তে বলপ্রয়োগ বা পাশবিক পদ্মার উপরই অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

(ii) সর্বশক্তিমান আইনপ্রণেতার ধারণা

ম্যাকিয়াভেলির ক্ষমতাতত্ত্ব থেকে উঠে আসে সর্বশক্তিমান আইনপ্রণেতার (The Omnipotent Legislator) ধারণা। সর্বশক্তিমান আইনপ্রণেতা সমাজে উদ্ভূত দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা থেকে সমাজকে মুক্ত করার স্বার্থেই প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রিক আইন প্রণয়ন করবেন, যার মাধ্যমে সংকটাপন্ন রাষ্ট্রকে উদ্ধার করা সহজ হবে। এক্ষেত্রে শাসক হবেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আইনজ্ঞ।

(iii) ম্যাকিয়াভেলির ক্ষমতাতত্ত্ব একচ্ছত্রবাদের সমর্থক নয়

রাষ্ট্রতাত্ত্বিক স্যাবাইন মনে করেন যে, ম্যাকিয়াভেলির ক্ষমতাতত্ত্ব পাঠ করে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে যে তিনি সাধারণ মানুষের স্বার্থকে পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন-কিন্তু এমন ধারণা সর্বাংশে সত্য নয়। বস্তুতপক্ষে সমসাময়িক ষোড়শ শতকীয় ইটালির দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকের নেতৃত্বে ভবিষ্যতে ইটালির অধঃপতিত হওয়ার আশঙ্কায় ম্যাকিয়াভেলি আতঙ্কিত ছিলেন। তাই তিনি মনে করেছিলেন যে, ক্ষমতাশালী একক রাষ্ট্রনেতাই ইটালিতে জাতীয় চেতনা ও নাগরিক আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন। তবে এক্ষেত্রে তিনি স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র বা রাজনৈতিক একচ্ছত্রবাদের সমর্থক ছিলেন না।

তাই তাঁর দ্য ডিসকোর্সেস গ্রন্থে জনগণের রাজনৈতিক ঐক্যবদ্ধতা ও ভূমিকার ধারণা পাওয়া যায়। কোনও কোনও অসুখে স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র ওষুধের ভূমিকা পালন করলেও ম্যাকিয়াভেলির মতে আদতে তাকে বিষ হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত। তিনি আইনের শাসনের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সরকারের বেআইনি কার্যকলাপ, আধিকারিকদের ক্ষমতার অপব্যবহার, নিপীড়ন ইত্যাদি বন্ধ করার দিকে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন। তাই সবমিলিয়ে বলা যেতে পারে যে, ম্যাকিয়াভেলির ক্ষমতাতত্ত্বের মূল ভিত্তি ছিল রাষ্ট্রের সংহতি।

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার মূল্যায়ন

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রদর্শন বিষয়ক আলোচনার প্রেক্ষিতে কোনও নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সহজ বিষয় নয়। রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ও গবেষক মহলে ম্যাকিয়াভেলির প্রশংসার পাশাপাশি বিরোধিতাও হয়েছে যথেষ্ট। স্যাবাইন এর মতে, ম্যাকিয়াভেলির চরিত্র ও দর্শনের প্রকৃত অর্থ আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম বিস্ময়কর বিষয়।

ত্রুটি

(i) চিন্তায় দ্বৈতাচার

ম্যাকিয়াভেলি তাঁর দ্য প্রিন্স গ্রন্থে রাজতন্ত্রকে সমর্থন করেছেন এবং রাষ্ট্রশাসনের জন্য স্বৈরাচারী শাসন, শঠতা, নিষ্ঠুরতা ও বলপ্রয়োগের কথা বলেছেন। আবার তিনি দ্য ডিসকোর্সেস গ্রন্থে প্রজাতন্ত্রকে সমর্থন করে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নাগরিকের অধিকারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সদগুণের ক্ষেত্রে, তিনি রাজতন্ত্রে রাজার অহংবোধ ও একক শক্তিকে সদ্‌গুণ বললেও, প্রজাতন্ত্রে স্বার্থত্যাগ, দেশপ্রেম প্রভৃতিকে সদগুণ বলেছেন। এই স্ববিরোধী বক্তব্যের জন্য ম্যাকিয়াভেলি যথেষ্ট সমালোচিতও হয়েছেন। বেনেদিত্তো ক্রোচে (Benedetto Croce)-এর মতে, ম্যাকিয়াভেলির বক্তব্য হল একটি প্রহেলিকাস্বরূপ (Enigma) I

(ii) নৈতিকতায় গুরুত্ব আরোপ

ম্যাকিয়াভেলির মতবাদকে সাধারণভাবে ধূর্ততা ও অনৈতিকতার প্রকাশ বোঝানোর জন্য, সামাজিক ক্ষেত্রে সংঘটিত অনৈতিক বা শঠতার কাজকে ম্যাকিয়াভেলীয় (Machiavellian) কাজ বলে ব্যঙ্গ করা হয়। ইংল্যান্ডে এলিজাবেথীয় যুগের নাটকে তাঁকে Devil Machiavelli বলা হয়েছে। কেউ কেউ তাঁকে একজন Evil Counsellor of Princes বলে বর্ণনা করেছেন। এমনকি জার্মানিতে হিটলারের ক্ষমতাপ্রতিষ্ঠার কৌশল ও যুদ্ধে উন্মাদনার ক্ষেত্রে ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রতত্ত্বের প্রভাব আছে বলে মনে করা হয়।

(iii) মানুষের সৎগুণাবলি উপেক্ষা

ম্যাকিয়াভেলি তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় মানুষের সৎ গুণগুলিকে উপেক্ষা করেছেন। তিনি মানুষকে কয়েকটি অ-সদগুণের আধার হিসেবে ধরে নিয়েছেন। তাঁর মতে, মানুষের চরিত্র ভীতি, দুর্বলতা, মিথ্যা, সন্ত্রাস ও বীরপূজার মনোভাবের সমষ্টি। মানুষ স্বভাবগতভাবে লোভী ও স্বার্থপর। কিন্তু মানুষের মধ্যে সৎ ও অসৎ দুটি প্রবৃত্তিই কাজ করে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি হয়।

(iv) খন্ডিত জাতীয়ভাবোধ

ম্যাকিয়াভেলির মধ্যে ছিল খণ্ডিত জাতীয়তাবোধ। তিনি ইটালির জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে ফ্লোরেন্সের শক্তিবৃদ্ধির জন্য বেশি ভাবিত ছিলেন। ফ্লোরেন্সীয় দৃষ্টিতে তিনি ইটালির ভবিষ্যৎ বিচার করতে চেয়েছেন।

(v) ধর্ম ও নৈতিকতাকে উপেক্ষা

ম্যাকিয়াভেলি তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে ধর্ম ও নৈতিকতাকে যেভাবে বিসর্জন দিয়েছেন তা ঠিক নয়। কোনোকালে কোনও রাষ্ট্রই মৌলিক, সার্বজনীন ও শাশ্বত নীতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। ম্যাকিয়াভেলি শাসকের যে অনৈতিক কাজকর্মের কথা বলেছেন তাতে শাসকের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হতে পারে।

(vi) বলপ্রয়োগকে গুরুত্ব প্রদান 

জনগণের সহায়তার পরিবর্তে ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগকে অযাচিতভাবে বেশিই গুরুত্ব দিয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন।

(vii) অসমাপ্ত তথ্য 

ম্যাকিয়াভেলি তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে সার্বভৌমত্ব, রাজনৈতিক ক্ষমতা, রণকৌশল-সহ কয়েকটি তত্ত্বের কথা বলেছেন, কিন্তু এগুলি ছাড়াও রাষ্ট্র বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে যেগুলি তিনি আলোচনা করেননি। তাই অনেকে তাঁর তত্ত্বকে আংশিক ও অসমাপ্ত বলে উল্লেখ করেছেন।

(viii) যুগবিরোধী চিন্তা

ম্যাকিয়াভেলির বক্তব্যে যুগবিরোধিতা স্পষ্ট। নবজাগরণের মানবতাবাদ মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করে। মানুষ চিত্রিত হয়েছে সৃষ্টিশীল, দায়িত্ববান, উদ্যোগী, পরিশ্রমী ইত্যাদি সদগুণের অধিকারী হিসেবে। সেই মানবতা জয়যাত্রার যুগে ম্যাকিয়াভেলি মানুষকে স্বভাবগতভাবে শঠ, হিংস্র, ষড়যন্ত্রকারী, প্রবঞ্চক বলে অভিহিত করে রাজাকে কঠোর শাসন কায়েম করার পরামর্শ দিয়েছেন। মানবতাবাদের ধারণার সঙ্গে ম্যাকিয়াভেলির মূল্যায়ন একান্তই বেমানান।

(ix) ত্রুটিপূর্ণ ক্রমবিন্যাস

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তায় ত্রুটিপূর্ণ ক্রমবিন্যাসও লক্ষণীয়। ম্যাকিয়াভেলি প্রথমে রাষ্ট্র ও পরে সমাজ গঠনের কথা বলেছেন। কিন্তু পণ্ডিতগণ বলেন যে, মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে প্রথমে সমাজ ও পরে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে।

(x) শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার চিন্তা

ম্যাকিয়াভেলি জাতিস্বার্থ (ইতালীয়) রক্ষার পরিবর্তে শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার প্রতি বেশি যত্নবান ছিলেন বলে মনে করা হয়। ফ্লোরেন্সে বুর্জোয়া শ্রেণির বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য রাজনৈতিক ঐক্য, শৃঙ্খলা ও স্থিতি প্রয়োজন। ম্যাকিয়াভেলি বুঝেছিলেন যে, সর্বশক্তিমান রাজতান্ত্রিক শাসনে প্রতিষ্ঠিত বুর্জোয়া শ্রেণির বাণিজ্যিক স্বার্থ নিরাপদ থাকবে। তাই তিনি এক শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত রাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন।

(xi) অগভীর রাষ্ট্রচিন্তা

অনেকসময় ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তাকে খুবই অগভীর এবং নির্দিষ্ট কাঠামোবিহীন হিসেবে সমালোচনা করা হয়ে থাকে।

গুরুত্ব

ম্যাকিয়াভেলির বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে ত্রুটিমুক্ত, এমন দাবি হয়ত করা যায় না। মানুষের সহজাত দুর্বলতা তাঁর ক্ষেত্রেও থাকা স্বাভাবিক। তবুও ম্যাকিয়াভেলির অভিমত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পথ চলা শুরুর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। জন প্লামেনাজের ভাষায়- “… Nevertheless, it is with Machiavelli that modern social and political theory really begins.” আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় তাঁর অবদানগুলি হল-

(i) ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক চিন্তার প্রবক্তা 

ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক চিন্তার একজন সার্থক প্রবক্তা। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিচালনায় ঈশ্বরের বিধান বা ধর্মীয় নির্দেশের কোনও ভূমিকা নেই।

(ii) ব্যক্তির নৈতিকতা ও রাষ্ট্রের নৈতিকতার পার্থক্যনির্দেশ 

ম্যাকিয়াভেলির আলোচনায় ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের নৈতিকতার মধ্যেকার পার্থক্য উঠে এসেছে। অবশ্য ইশায়া বার্লিন (Isaiah Berlin) মনে করেন যে, তিনি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের নৈতিকতার তফাত বোঝানোর উদ্দেশ্যেই যে বক্তব্য রেখেছেন, তা নয়। আসলে তিনি নৈতিকতার দুটি অবস্থানের মধ্যেকার বিরোধকে উপস্থাপিত করেছেন। ম্যাকিয়াভেলির মতে, ব্যক্তির সদ্‌গুণ রাষ্ট্রের জন্য সদ্‌গুণ নাও হতে পারে। আবার রাষ্ট্রের কোনও কাজ কোনও ব্যক্তি অনৈতিক বলে মনে করলেও, তা ব্যক্তির শান্তি ও নিরাপত্তার কারণ হতে পারে।

(iii) আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পথিকৃৎ

ম্যাকিয়াভেলি প্রথম ব্যক্তি যিনি অতীত ঐতিহ্যের সমস্ত প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে রাজনীতিকে এক সম্পূর্ণ নতুন চরিত্র প্রদান করেন। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ, নৈতিকতামুক্ত ও বস্তুনিষ্ঠ জীবনধারার প্রবর্তন করে রাজনৈতিক চিন্তায় আধুনিকতার সূত্রপাত করেন। তাঁর রাষ্ট্রধারণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইন, সার্বভৌমিকতা, শৃঙ্খলা ও স্বাধীনতা। ম্যাকিয়াভেলির চিন্তাধারায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান আধুনিক হয়ে ওঠে বলে তাঁকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পথিকৃৎ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

(iv) ক্ষমতা সংক্রান্ত তত্ত্ব

ম্যাকিয়াভেলি প্রথম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ যিনি ক্ষমতাকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু বলে গণ্য করেছিলেন। এক্ষেত্রে ম্যাকিয়াভেলি অভিনবত্বের পরিচয় দেন। পরবর্তীকালে বিশ শতকে যেসকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্ষমতাতত্ত্বকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হিসেবে গণ্য করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই ম্যাকিয়াভেলির কাছে ঋণী।

(v) সমসাময়িক ইটালির পরিস্থিতি উপলব্ধি

সমসাময়িক ইটালিতে যে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল তা দূর করার জন্যই ম্যাকিয়াভেলি শক্তিশালী জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন।

(vi) বুর্জোয়া শ্রেণির গুরুত্ব উপলব্ধি

ম্যাকিয়াভেলি উদীয়মান বুর্জোয়াসমাজের অফুরন্ত সম্ভাবনার কথা প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন।

(vii) অভিজ্ঞতার উপর গুরুত্ব আরোপ

বাস্তব অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রতাত্ত্বিক হিসেবে, ম্যাকিয়াভেলি কোনোকিছুকে চূড়ান্ত বলে মেনে নেননি। সবকিছুকেই বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিরীক্ষণ করে নেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। ফ্লোরেন্সের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অনেকে তাঁর তত্ত্বকে বাস্তবমুখী রাষ্ট্রতত্ত্ব বলে থাকেন।

প্রকৃতপক্ষে ম্যাকিয়াভেলি এক সুসংগঠিত, সুনিয়ন্ত্রিত ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন। এই রাষ্ট্র প্লেটো কল্পিত গ্রিক রাষ্ট্র নয়, বরং এতে রোমক রাষ্ট্রব্যবস্থার মিল বেশি। তিনিই সর্বপ্রথম মানুষের আচরণকে ভিত্তি করে রাজনীতির ব্যাখ্যা করে এবং মানুষের সমস্যা ও ভাবনাকে রাজনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ম্যাকিয়াভেলির কৃতিত্বের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডানিং (Dunning) তাঁর ‘A History of Political Theories’ গ্রন্থে বলেছেন যে, ‘ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন প্রথম আধুনিক চিন্তাবিদ যিনি মধ্যযুগীয় সময়কালের অন্তিমলগ্ন ঘোষণা এবং আধুনিক সময়কালের সূচনা করেছিলেন।’ তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই “A child of his times.” তাই সবমিলিয়ে বলাই যায় যে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির নাম চিরস্মরণীয়।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment