টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০২৪ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০২৪ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০২৪ - মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০২৪ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক মানের খেলাধুলোর মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে সর্বক্ষণের উপভোগ্য এই খেলা। স্বল্প সময়ে সীমিত ওভারের (২০ ওভার) রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ ক্রিকেট ভক্তদের আবেগ-আনন্দ জোয়ারে ভাসায়। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতাটি নিয়ন্ত্রণ করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল বা আইসিসি। প্রতিযোগিতায় ২০টি দল অংশগ্রহণ করে। ২০০৫-এ প্রথম পূর্ণ আন্তর্জাতিক টি টোয়েন্টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।

সর্বাধিক জনপ্রিয় টি-২০ বিশ্বকাপ ২০২৪-এর এবারের আসর বসেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে ২ জুন থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত। এই বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী ২০টি দলের মধ্যে ৫৫টি ম্যাচ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ডালাস গ্রান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে টি-টোয়েন্টি ২০২৪-এর প্রথম উদ্বোধনী ম্যাচ হয়। অংশগ্রহণকারী ২০টি দলকে চারটি বিভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। ভারত ছিল গ্রুপ-‘এ’-তে। এই গ্রুপের বাকি চারটি দল-পাকিস্তান, কানাডা, আমেরিকা এবং আয়ার্ল্যান্ড। ৫ জুন আয়ার্ল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ৯ জুন পাকিস্তান, ১২ জুন আমেরিকা, ১৫ জুন কানাডার বিরুদ্ধে খেলেছিল ভারত।

চারটি গ্রুপ থেকে দুটি করে দল সুপার ৮ পর্বে উন্নীত হয়েছিল। সেখানে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয় দলগুলিকে। সেখান থেকে সেমিফাইনালে উঠেছিল চারটি দল-ভারত, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, আফগানিস্তান। দুটি গ্রুপের এক ও দুই নম্বরে থাকা দল খেলছিল সেমিফাইনালে। আর সুপার ৮ পর্বের দুটি গ্রুপে শীর্ষে থাকা দলগুলি অন্য গ্রুপের দ্বিতীয় স্থানে থাকা দলের বিরুদ্ধে। ২৭ জুন সেমিফাইনালে দুটি ম্যাচ ভারতীয় সময় সকাল ৬টায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা ৮ ওভার, ৫ বলে ১ উইকেট হারিয়ে জয়ের জন্য ৬০ রান তুলে নেয়।

অন্যদিকে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২০ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে ১৭১ রান করেছিল ভারত। ইংল্যান্ড ১৬ ওভার ৪ বলে সব উইকেট হারিয়ে ১০৩ রান করে অর্থাৎ ৬৮ রানে জয়ী হয় ভারত। ফাইনাল খেলাটি অনুষ্ঠিত হয় ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে কেনসিংটন ওভাল, ব্রিজটাউন, বার্বাডোস, ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্টেডিয়ামে। টি-টোয়েন্টি ২০২৪ খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল বিশ্ব জনমানসে ছেলে-বুড়ো সকলের মধ্যে এক অপূর্ব উন্মাদনা। বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টি কে পাবে?-এ নিয়ে ক্রিকেট ভক্তদের উৎকণ্ঠা ছিল।  অবশেষে সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটে ২৯ জুন। ভারতের কপালে দ্বিতীয় বার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের সৌভাগ্য হয়। আপামর ভারতবাসী বিশ্বজয়ের আনন্দে উল্লসিত হয়ে ওঠে।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২৪-এ রোহিত শর্মার অধিনায়কত্বে ভারত দ্বিতীয় বার চ্যাম্পিয়ন দল হয়। এর পূর্বে ভারত মহেন্দ্র সিং ধোনির অধিনায়কত্বে ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল। দুই বছর অন্তর টি-২০ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হলেও দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও সংগ্রামের পর ভারত বিশ্বক্রিকেটের ইতিহাসে স্বমহিমায় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পেল। এই টি-২০-২০২৪-এ রানার্স আপ দল হয় এইডেন মার্করামের অধিনায়কত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা।

চ্যাম্পিয়ন দল পুরস্কার পায় ট্রফি ও ২.৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং রানার্স আপ দল পায় ট্রফি ও ১.২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফাইনাল ম্যাচে ৭৬ রান ও অসাধারণ ব্যাটিংয়ের জন্য বিরাট কোহলি-কে ম্যান অব দ্যা ফাইনাল সম্মান দেওয়া হয় এবং অসাধারণ বোলিং দক্ষতার জন্য ম্যান অব দ্যা টুর্নামেন্ট সম্মান দেওয়া হয় যশপ্রীত বুমরা-কে। তিনি মোট ১৫টি উইকেট নিয়েছেন এই বিশ্বকাপে। তবে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি আফগানিস্তানের ফজলহক ফারুকি ও ভারতের আর্শদীপ সিং। এই দুই বোলার বিশ্বকাপে ১৭টি উইকেট সংগ্রহ করেন।

বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক আফগানিস্তানের রামানুল্লাহ গুরবাজ। তাঁর মোট সংগৃহীত রান ২৮১। সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ রান আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২১৮। সর্বনিম্ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে উগান্ডার ৩৯ রান। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর ৯৮ ওয়েস্ট ইন্ডিজের নিকোলাস পুরানের। টি-টোয়েন্টি ২০২৪ বিশ্বকাপের ইতিহাসে টানা দুই ম্যাচে হ্যাট্রিকের রেকর্ড করেন অস্ট্রেলিয়ার প্যাট কামিল। ফ্রিস জর্ডন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১ বার হ্যাট্রিক করেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে এক ম্যাচে ৪ ওভার মেডেন ও মেডেন ওভারগুলোতে নিউজিল্যান্ডের লেকি ফার্গুসন সংগ্রহ করেন তিন উইকেট। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে একমাত্র বোলার হিসেবে সাকিব আল হাসান ৫০ উইকেট শিকারের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন। নবম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে উদ্বোধনী ম্যাচসহ আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেছেন শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ।

ওয়েস্ট ইন্ডিজে বার্বাডোস স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল নবম টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত খেলা। এই খেলায় ভারতীয় ক্রিকেট দলের বহু কাঙ্ক্ষিত জয় বা স্বপ্নপূরণ হয় অবশেষে। টি-টোয়েন্টি ২০২৪-এ ভারতীয় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা, সহ-অধিনায়ক হার্দিক পান্ডে। এ ছাড়াও দলের হয়ে বিশ্বকাপ ময়দানে মোকাবিলা করেছেন যশস্বী জয়সওয়াল, বিরাট কোহলি, সূর্যকুমার যাদব, ঋষভ পন্থ, সঞ্জু সামসন, শিভব দুবে, রবীন্দ্র জাদেজা, কুলদীপ যাদব, আর্শদীপ সিং, জশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ সিরাজ প্রমুখরা। ভারতীয় এই ক্রিকেট দলের কোচ ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়।

ভারতীয় ক্রিকেট দলের সব ক্রিকেটারদের আত্মত্যাগ ও ক্রীড়াকৌশলে ভারতের কপালে দ্বিতীয় বার টি-টোয়েন্টি ২০২৪-এ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ওঠে। বিশ্ব ক্রিকেটে জয়ের উচ্ছ্বাসে ক্রিকেটার থেকে সব ভারতীয় দর্শক সমর্থক উচ্ছ্বসিত হয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে বহু বছরের প্রতীক্ষার পর হয় কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নপূরণ। ‘INDIA’ প্রতিধ্বনি-তে মুখরিত হয় টি-টোয়েন্টি ২০২৪-এর ময়দান। সারা ভারতজুড়ে বিচিত্র রংমশাল ও আনন্দসুরে প্লাবিত হয় ২৯ জুন। বিশ্বজয়ের মাঠে বিশ্বজয়ীদের বরণ বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে স্মরণীয় মুহূর্ত। রোহিত শর্মার হাতে বিশ্বজয়ের ট্রফি, সমর্থকদের হাতে পতাকা আর সকলের আনন্দ উচ্ছ্বাস হয়ে উঠেছিল গগনচুম্বী। ‘চ্যাম্পিয়ান। চ্যাম্পিয়ান আই সি সি টি-টোয়েন্টি ২০২৪ ইন্ডিয়া।’

এরপর বিশ্বজয়ীদের দেশের মাটিতে পদার্পণ ভারতীয় টি-টোয়েন্টি ২০২৪ ক্রিকেট দলের। মাস্টার ব্লাস্টার শচীন প্রশংসায় ভরিয়ে দেয় টিম ইন্ডিয়াকে। গত কয়েক বছর ধরে বিরাট কোহলির নেতৃত্বে নানা ইতিহাস গড়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট দল। আইসিসি ট্রফির আক্ষেপ মিটছিল না। রোহিত শর্মা দায়িত্ব নেওয়ার পরও তেমনই টানাপোড়েন চলছিল। একের পর এক পরাজয়ের গ্লানি ও হতাশা কাটিয়ে অবশেষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২৪-এ এল বিশ্বজয়ের সীমাহীন আনন্দ। দেশের মাটিতে বিমান অবতরণের সাথে সাথে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে স্বাগত জানায় আপামর দেশবাসী।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিল্লির বাসভবনে বিশ্বজয়ীদের অভ্যর্থনা জানান। বিসিসিআই-এর পক্ষ থেকে ভারতীয় দলকে ‘নমো’ লেখা ক্রিকেট টিমের এক নম্বর জার্সি উপহার দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে ভারতীয়দের টি-টোয়েন্টি ২০২৪-এ বিশ্বজয় অনেকটা ক্ষত পূরণ করে বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০২৩ অস্ট্রেলিয়ার কাছে অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের। সম্প্রতিকালে আইসিসির র‍্যাঙ্কে ভারত আবার শীর্ষে পৌঁছানোয় ভারত হৃতগৌরব ফিরে পেয়েছে।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment