
বংশগতি বলতে জিনের মাধ্যমে বাবা-মার থেকে সন্তানদের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যগুলি স্থানান্তরিত হয়, তাকে বোঝানো হয়। বংশগতির প্রভাব শুরু হয় শিশুর জন্মের আগে থেকেই এবং এটি শারীরিক বৈশিষ্ট্য, বুদ্ধিমত্তা এবং কিছু মানসিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিকাশের ক্ষেত্রে বংশগতি ও পরিবেশের ভূমিকা
মানুষের বিকাশ একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। এটি বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। এই প্রক্রিয়াটি মূলত দুটি প্রধান উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়- বংশগতি এবং পরিবেশ। উভয় উপাদানই মানুষের ব্যক্তিত্ব, আচরণ, বুদ্ধিমত্তা এবং সামগ্রিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(1) বংশগতি:
বংশগতি বলতে জিনের মাধ্যমে বাবা-মার থেকে সন্তানদের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যগুলি স্থানান্তরিত হয়, তাকে বোঝানো হয়। বংশগতির প্রভাব শুরু হয় শিশুর জন্মের আগে থেকেই এবং এটি শারীরিক বৈশিষ্ট্য, বুদ্ধিমত্তা এবং কিছু মানসিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বংশগতির প্রভাবগুলি হল-
- শারীরিক বৈশিষ্ট্য: উচ্চতা, ওজন, চুলের রং, চোখের রং ইত্যাদি বংশগতির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাবা-মা লম্বা হলে, সন্তানেরও লম্বা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হয়।
- বুদ্ধিমত্তা: গবেষণায় দেখা গেছে যে, বুদ্ধিমত্তার একটি বড়ো অংশ জিনের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়। যমজ শিশুদের উপর করা গবেষণায় এ তথ্য প্রমাণিত হয়েছে।
- স্বাস্থ্য: কিছু রোগ এবং স্বাস্থ্যের অবস্থা, যেমন-ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং কিছু মানসিক রোগ বংশগতির মাধ্যমে প্রভাবিত হয়।
(2) পরিবেশ:
পরিবেশ বলতে শিশুর জন্মের পর থেকে যে সমস্ত বাহ্যিক উপাদানগুলি তার বিকাশে প্রভাব ফেলে, তাকে বোঝানো হয়। এতে পারিবারিক পরিবেশ, শিক্ষা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং অর্থনৈতিক অবস্থা অন্তর্ভুক্ত। পরিবেশের প্রভাবগুলি হল-
- পারিবারিক পরিবেশ: শিশু তার পরিবারের কাছ থেকে সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা, আচরণগত নিদর্শন শেখে। একটি ভালো পারিবারিক পরিবেশ শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
- শিক্ষা: একটি ভালো শিক্ষাব্যবস্থা শিশুর জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা উন্নত করতে সাহায্য করে। শিক্ষকদের সাথে মিথস্ক্রিয়া এবং শিক্ষামূলক উপকরণ শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সামাজিক মিথস্ক্রিয়া: বন্ধু, প্রতিবেশী এবং অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ক শিশুর সামাজিক দক্ষতা, আচরণ এবং মানসিক স্থিতিশীলতা উন্নত করতে সাহায্য করে।
- সাংস্কৃতিক প্রভাব: সংস্কৃতি শিশুর বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং আচরণের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, একটি সাম্প্রদায়িক সমাজে বড়ো হওয়া শিশু তার সংস্কৃতির মূল্যবোধ এবং সামাজিক আচরণগুলি গ্রহণ করে।
- অর্থনৈতিক অবস্থা: একটি পরিবারের আর্থিক অবস্থা শিশুর শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক বিকাশে বড়ো [ ভূমিকা পালন করে। আর্থিক স্বচ্ছলতা শিশুর শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য সুবিধা প্রদান করে।
বিকাশের উপর বংশগতি ও পরিবেশ উভয়েরই গভীর প্রভাব রয়েছে। বংশগতি শিশুর মৌলিক শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। কিন্তু পরিবেশ সেই বৈশিষ্ট্যগুলিকে পরিপূর্ণ করে এবং তাদের উন্নতিতে সহায়তা করে। একটি শিশু তার জিনগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়। কিন্তু তার চূড়ান্ত বিকাশে পরিবেশের ভূমিকা অপরিহার্য। বংশগতি ও পরিবেশ একসাথে মিলে শিশুর সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখে, যা তার ভবিষ্যতের ব্যক্তিত্ব এবং জীবনপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বংশগতি ও পরিবেশের উপর শিক্ষার প্রভাব বা ভূমিকা [Role of Education on Heredity and Environment]
শিক্ষা, বংশগতি এবং পরিবেশের পারস্পরিক ক্রিয়া বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এই তিনটি উপাদানই একজন ব্যক্তির সামগ্রিক বিকাশকে প্রভাবিত করে। শিক্ষার ভূমিকা বংশগতি এবং পরিবেশের প্রভাবগুলিকে পরিপূরক এবং সমন্বিত করতে সহায়ক হয়।
বংশগতির উপর শিক্ষার ভূমিকা
বংশগতি বলতে, সেই জিনগত বৈশিষ্ট্যগুলিকে বোঝায় যা আমরা আমাদের পিতামাতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাই। এইসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে শারীরিক বৈশিষ্ট্য, বুদ্ধিমত্তা এবং কিছু মানসিক বৈশিষ্ট্য। শিক্ষার মাধ্যমে বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলিকে কার্যকরভাবে উন্নত করা যায়। নীচে বংশগতির উপর শিক্ষার প্রভাবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হল-
(1) বুদ্ধিমত্তার বিকাশ:
কিছু মানুষ বংশগতভাবে উচ্চবুদ্ধিমত্তা নিয়ে জন্মায়। শিক্ষা এই বুদ্ধিমত্তা বা মেধাকে বিকশিত হতে সাহায্য করে। উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে তারা তাদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা তাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে উন্নতি করতে সাহায্য করে।
(2) প্রতিভা ও দক্ষতার বিকাশ:
শিল্প, সংগীত, বিজ্ঞান বা ক্রীড়ার মতো ক্ষেত্রগুলিতে বংশগত প্রতিভা থাকলে শিক্ষা সেই প্রতিভাকে সঠিকভাবে বিকশিত করতে পারে। সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই প্রতিভাগুলি উন্নত করা যায় এবং সর্বোচ্চস্তরে নিয়ে যাওয়া যায়।
(3) স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জ্ঞান বৃদ্ধি:
বংশগত কারণে কিছু মানুষ নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যার প্রবণতা নিয়ে জন্মায়। শিক্ষা এই স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং তাদের প্রতিরোধ ও পরিচালনার উপায় শেখায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি কারো পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকে, তবে শিক্ষা তাকে এই রোগের ঝুঁকি কমাতে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে সহায়তা করে।
(4) মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন:
মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কিছু সমস্যাও বংশগত হতে পারে। শিক্ষা মানসিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার উপায় শেখায়। এটি মানসিক সমস্যাগুলি চিহ্নিত করতে এবং সময় মতো চিকিৎসা গ্রহণ করতে সাহায্য করে।
(5) পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ণ:
শিক্ষা মানুষকে তাদের বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে সাহায্য করে। এটি ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারকে বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বোঝার সুযোগ দেয় এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করতে সহায়ক হয়।
মোট কথা, শিক্ষার মাধ্যমে বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলির যথাযথ ব্যবহার এবং উন্নতি সম্ভব।
পরিবেশের উপর শিক্ষার ভূমিকা
পরিবেশ বলতে সেইসব বাহ্যিক কারণকে বোঝায় যা একজন ব্যক্তির বিকাশকে প্রভাবিত করে। এসব কারণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পারিবারিক পরিবেশ, সামাজিক সম্পর্ক, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক অবস্থা। শিক্ষা পরিবেশের এই প্রভাবগুলিকে ইতিবাচকভাবে রূপান্তর করতে এবং ব্যক্তির সামগ্রিক বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এখানে পরিবেশের ওপর শিক্ষার কিছু মূল ভূমিকা আলোচনা করা হল-
(1) পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি:
শিক্ষা মানুষকে পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলোতে পরিবেশ বিষয়ে পড়াশোনার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান, যেমন-বায়ু, জল, মাটি ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। এই জ্ঞান তাদের পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়তা করে।
(2) সমস্যা সমাধানের উপায় শেখায়:
শিক্ষা পরিবেশের সমস্যা সমাধানের উপায় শেখায়। বিভিন্ন গবেষণা এবং প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পরিবেশের সমস্যাগুলি চিহ্নিত করতে এবং সেগুলির উপায় খুঁজে পেতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিক্ষার্থীরা পুনর্ব্যবহার, কম্পোস্টিং এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্ব শিখতে পারে।
(3) পরিবশেবান্ধব আচরণ গড়ে তোলা:
শিক্ষা পরিবেশবান্ধব আচরণ গড়ে তোলে। স্কুলের পাঠ্যক্রমে পরিবেশবান্ধব অভ্যাস, যেমন-গাছ লাগানো, জ্বালানি সাশ্রয় এবং প্লাস্টিক ব্যবহার কমানোর বিষয়ে শিক্ষাদান করা হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করতে শেখে।
(4) বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান:
পরিবেশ সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং তত্ত্ব শেখার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পরিবেশের বিভিন্ন প্রক্রিয়া এবং পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে গভীরভাবে বুঝতে পারে।
(5) সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সহায়তা:
শিক্ষিত ব্যক্তিরা সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়তা করতে পারে। যেমন- বনায়ন, জল সংরক্ষণ প্রকল্প এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ।
এইভাবে শিক্ষা পরিবেশ সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে আমরা এটি স্থিতিশীল এবং সবুজ পৃথিবী গড়ে তুলতে পারি।
আরও পড়ুন | Link |
নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
চার্বাক সুখবাদ প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা প্রশ্ন উত্তর | Click Here |