আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা করো

আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা করো

আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা করো
আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা করো

আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক

আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক (Relationship between Law and Liberty) নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। অনেকে মনে করেন, আইন ছাড়া স্বাধীনতার কথা কল্পনা করা যায় না। আবার অনেকে মনে করেন, আইন ও স্বাধীনতা দুটি পরস্পরবিরোধী ধারণামাত্র।

(1) স্বাধীনতা ও আইনের পরস্পরবিরোধী সম্পর্ক

অ্যাডাম স্মিথ, বেথাম, হারবার্ট স্পেনসার, জেমস্ মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল-এর মতো উদার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী তাত্ত্বিকরা এবং বাকুনিন (Bakunin), গডউইন (Godwin) এবং ক্রপোটকিন (Kropotkin)-এর মতো নৈরাজ্যবাদীরা আইন ও স্বাধীনতাকে পরস্পরবিরোধী ধারণা বলে প্রচার করেছিলেন। এ ছাড়াও অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith), ডেভিড রিকার্ডো (David Ricardo), অ্যালফ্রেড মার্শাল (Alfred Marshall) এবং হামবোল্ড (Humboldt)-ও একই মতের অনুসারী। সাধারণভাবে স্বাধীনতা বলতে বোঝায়, ব্যক্তির খেয়ালখুশিমতো আচরণ করার ক্ষমতা। অন্যদিকে, আইন হল ব্যক্তির বাহ্যিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সার্বভৌম শক্তির দ্বারা স্বীকৃত ও প্রযুক্ত নিয়মাবলি। সুতরাং, আপাতদৃষ্টিতে আইন ও স্বাধীনতা হল পরস্পরবিরোধী ধারণা।

এঁদের বক্তব্য, স্বাধীনতার উপর কোনোরূপ হস্তক্ষেপই অবাঞ্ছনীয়। কর্তৃত্বহীন ও নিয়ন্ত্রণহীন সমাজই একমাত্র ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য উপযুক্ত ও প্রকৃত পরিবেশ তৈরি করে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী তাত্ত্বিকরা উদীয়মান বুর্জোয়া তথা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবাধ ব্যাবসা-বাণিজ্যের পথে কোনোরূপ রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণকে অন্যায় বলে মনে করেছেন এবং তাঁদের মতে, আইন ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব উভয়ই ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। তাঁরা আরও বলেন যে, ব্যক্তিগত ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রণের অধিকার রাষ্ট্রের হাতে থাকা উচিত নয়, তাহলেই ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব হবে। নৈরাজ্যবাদীরা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন তাই তাঁরা যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিলোপসাধনের কথা বলেন।

বাকুনিন বলেছিলেন, রাষ্ট্র সকলের স্বার্থ ও কল্যাণের নামে ব্যক্তির স্বাধীনতাকে নাকচ করে। উদারবাদী জে এস মিল বলেছিলেন, ব্যক্তির আত্মকেন্দ্রিক বা Self-Regarding ক্রিয়াকলাপে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ একেবারেই কাম্য নয়। অ্যাডাম স্মিথ ব্যক্তির অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে রাষ্ট্রের তদারকিকে স্বীকার করেননি। বেত্থাম ব্যক্তির উপযোগিতা বা হিতের দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্র ও আইন ব্যবস্থার সংস্কার চেয়েছিলেন। হারবার্ট স্পেনসার-এর মতানুযায়ী, আইনের পরিমান যত বাড়বে, মানুষের দুঃখের বোঝাও তত বৃদ্ধি পাবে। লর্ড ব্রাইস মনে করতেন, আইন এবং স্বাধীনতার মধ্যে যে-কোনো একটিকে প্রাধান্য দিলে অন্যটি সংকুচিত হতে পারে।

উক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, উদার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা এবং নৈরাজ্যবাদীরা সম্পূর্ণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ককে আলোচনা করেছেন।

(2) আইন ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক

ল্যাস্কি, বার্কার, হবহাউস, রিচি-র মতো তাত্ত্বিকরা আইন ও স্বাধীনতার নিবিঢ় সম্পর্কের কথা বলেছিলেন। এই তাত্ত্বিকরা আইন ও স্বাধীনতা পরস্পরবিরোধী এই ধারণাকে খণ্ডন করেন। ভাববাদী বা আদর্শবাদীদের মতে, রাষ্ট্র ও আইনের অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতা ভোগ করা কখনোই সম্ভব নয়। টমাস হিল গ্রিন- এর মতে, স্বাধীনতা হল ব্যক্তির সৃষ্টিশীল চেতনার এক মহৎ প্রকাশ। রাষ্ট্র বা আইনের কাজ হল এই স্বাধীনতার প্রসারে সহায়তা করা। গ্রিন-এর চোখে আইনের কাজ হল ‘removal of all obstructions to the free development of English Citizens’.

রুশো তাঁর ‘সামাজিক চুক্তি’ গ্রন্থে এমন রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা কল্পনা করেছিলেন, যেখানে আইন ও স্বাধীনতা একে অপরের পরিপূরকরূপে কাজ করে। তাঁর মতে, প্রাকৃতিক স্বাধীনতা থেকে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ ও আইনের জন্ম এবং আইন থেকেই রাজনৈতিক স্বাধীনতার উদ্ভব হয়। অধ্যাপক ল্যাস্কি-র মতে, স্বাধীনতার প্রকৃতির মধ্যেই নিয়ন্ত্রণের শর্ত বিদ্যমান।

বার্কার বলেছেন, স্বাধীনতা হল রাষ্ট্র কর্তৃক আইনগতভাবে স্বীকৃত অধিকারভোগের ক্ষমতা। এই অর্থেই বলা যায়, রাষ্ট্রীয় আইনের মধ্যেই স্বাধীনতার অস্তিত্ব বিদ্যমান। বার্কার আরও বলেন, স্বাধীনতার উৎস হল আইন। তাই স্বাধীনতা কখনো চূড়ান্ত বা নিঃশর্ত হতে পারে না। কাজেই আইন কখনো  স্বাধীনতাকে খর্ব করে না, বরং স্বাধীনতার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে।

হবহাউস-এর মতে, আইন না থাকলে ক্ষমতাবান মুষ্টিমেয় ব্যক্তি কেবলমাত্র স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকারী হবে, অন্যান্যরা বঞ্চিত হবে। সুতরাং স্বাধীনতার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আইনের প্রয়োজন।

এই তাত্ত্বিকদের বক্তব্য হল, অবাধ নিয়ন্ত্রণবিহীন স্বাধীনতা হল আসলে স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। স্বাধীনতাভোগে কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ব্যক্তির উচ্ছৃঙ্খলতা প্রকাশ পাবে। অবাধ স্বাধীনতা প্রদান করলে দুর্বলের উপর সবলের আধিপত্য বৃদ্ধি পাবে। ফলস্বরূপ দুর্বলের স্বাধীনতা লুপ্ত হবে। শুধু তাই নয়, অবাধ স্বাধীনতা স্বীকৃত হলে সমাজে কেবল কতিপয় ক্ষমতাবান ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাহীন দুর্বল সাধারণ মানুষ স্বাধীনতা ভোগ থেকে বঞ্চিত হবে। যেমন বলা যায়, প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ স্বাধীনতা রয়েছে, তা বলে একে অপরের বিরুদ্ধে মিথ্যা রটনা বা কুৎসা রচনা করলে রাষ্ট্র তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে। তাই কেবল রাষ্ট্রীয় আইনই পারে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সকলের জন্য সমস্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করতে। এজন্য রাষ্ট্র সকলের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার বিনিময়ে নাগরিকদের থেকে আনুগত্যও দাবি করতে পারে।

  • অহিনের সাহায্যে ব্যক্তিস্বাধীনতার সংরক্ষণ: আইনের সহায়তায় রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সংরক্ষিত করে। যথা-
  1. আইন আছে বলেই সবলের হাত থেকে দুর্বলরা রক্ষা পায়। নতুবা মুষ্টিমেয় সবল ব্যক্তি গায়ের জোরে অন্যায়ভাবে দুর্বলদের স্বাধীনতা কেড়ে নিত। কিন্তু আইনের উপস্থিতির ফলে বলপূর্বক অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তির স্বাধীনতাকে কেড়ে নেওয়া যায় না। আইন দুর্বলদের স্বাধীনতার রক্ষাকর্তা বা Protector-এর ভূমিকা পালন করে।
  2. আইন, শাসকশ্রেণির স্বৈরাচারিতার হাত থেকেও নাগরিকদের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত ও সুনিশ্চিত করে, যাতে শাসকশ্রেণি নাগরিকদের স্বাধীনতা খর্ব করতে না পারে অথবা কোনোভাবে স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করলে যাতে তার প্রতিকার লাভ করতে পারে আইন তা-ও সুনিশ্চিত করে।
  3. অনেকে মনে করেন, আইন যে শুধুমাত্র স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করে তা-ই নয়, স্বাধীনতার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গঠনেও আইন সাহায্য করে। নাগরিকদের অন্তর্নিহিত সত্তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশের নাম স্বাধীনতা। আইনের দ্বারা তার যথার্থ উন্মেষ ঘটে। এই প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রিচি বলেছেন, স্বাধীনতা বলতে যদি ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধাকে বোঝায়, তবে অবশ্যই তা আইন দ্বারা সৃষ্ট।

আধুনিক জনকল্যাণকর রাষ্ট্র নাগরিকদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য আইনের মাধ্যমে উপযুক্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, শান্তিপূর্ণ সামাজিক পরিবেশের সুরক্ষা ইত্যাদি ব্যবস্থা করে থাকে। নাগরিকদের আত্মবিকাশের উপযোগী সুযোগসুবিধাকে যদি স্বাধীনতা বলা হয়, তাহলে তা অবশ্যই আইনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিরা আইনসভায় আইন প্রণয়নের কাজ সম্পাদন করেন। তাই আইনের প্রতি জনগণের স্বাভাবিক আনুগত্য থাকে। এই কারণে রুশো আইনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকে স্বাধীনতা বলে অভিহিত করেছেন।

  • স্বাধীনতার শর্ত হল আইন: আইন ও স্বাধীনতাকে পরস্পরের পরিপূরক ভেবেই বলা হয়েছে, ‘Law is the Condition of liberty’, ‘Liberty lies within restrains’, ‘Liberty is a positive thing’। এ প্রসঙ্গে বার্কার-এর কথা উল্লেখ করে বলা যায়, আইন ও স্বাধীনতার ধারণা – কখনোই বিরোধময় নয়, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য সংখ্যালঘুর উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হওয়া আবশ্যক। এই অর্থে, ‘প্রত্যেকের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা অন্য সকলের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ’ (“The need of liberty for each is necessarily qualified and conditioned by the need of liberty for all.”)।

সমাজবিজ্ঞানী বার্কার স্বাধীনতাকে আপেক্ষিক বলে বর্ণনা করেছেন। একজনের স্বাধীনতা অপরজনের স্বাধীনতাভোগের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। – কাজেই নিয়ন্ত্রণ ছাড়া স্বাধীনতার কোনো অর্থ হয় না। ল্যাস্কি-র মতে, – স্বাধীনতার শর্ত প্রকৃতির মধ্যেই নিহিত রয়েছে। সমাজের প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনতা সংরক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্র এই দায়িত্ব পালন করে থাকে। আইন ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপন্থী নয়, আইন ও স্বাধীনতা একে অপরের পরিপূরক। এই কারণে বলা হয় স্বাধীনতার প্রধানতম শর্ত হল আইন।

(3) মার্কসবাদীদের বক্তব্য

মার্কসবাদীরা মনে করেন, ধনবৈষম্যমূলক সমাজে রাষ্ট্রীয় আইন বৈষম্যমূলক। রাষ্ট্র এখানে আপামর জনগণের স্বার্থরক্ষা করে না, মুষ্টিমেয় বিত্তবান শ্রেণির স্বার্থ ও স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় এমনভাবেই আইন প্রণীত হয়, যাতে করে উৎপাদনের উপকরণগুলির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা যায় এবং সংখ্যালঘু মালিকশ্রেণির ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধি করা যায়। এরকম বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থায় সাধারণ শ্রমিকশ্রেণি কোনো স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। বিশেষত, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ থেকে তারা বঞ্চিত হয়। আর মার্কসবাদীদের মতে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ব্যতিরেকে অন্য কোনো স্বাধীনতা যথা সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করা যায় না।

তাঁদের মতে, একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজে আইনের মাধ্যমে আপামর জনগণের স্বাধীনতার সংরক্ষণ সম্ভব। কারণ এই সমাজে কোনো শ্রেণিবিভাজন থাকে না, ফলে আইনকে অস্ত্র করে শাসন-শোষণের প্রয়োজন থাকে না। আইন সেখানে স্বাধীনতার প্রকৃত শর্তরূপে কাজ করে। কারণ, সমাজতান্ত্রিক সমাজে স্বাধীনতার রক্ষাকারী আইন ভক্ষকের ভূমিকা পালন করে না। ফলে এই সমাজে যে আইন প্রণীত হয়, তার দ্বারা সকলে প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। তাই মার্কসীয় মত অনুযায়ী, সমাজতান্ত্রিক সমাজের আইন ও স্বাধীনতা একে অপরের পরিপূরকরূপে কাজ করে।

আরও পড়ুন – ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা

Leave a Comment