ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা

ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা

ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা
ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা

ষোড়শ শতকে জার্মানি তথা সমগ্র ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে যিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তিনি হলেন মার্টিন লুথার (Martin Luther, ১৪৮৩-১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দ)। পবিত্র গ্রন্থ বাইবেল বর্ণিত ‘সদ্ধর্ম’ থেকে রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিচ্যুতি, পোপ ও যাজকদের বিলাসবৈভব ও অনৈতিক জীবনধারার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ ওয়াইক্লিফ, জন হাস প্রমুখ করেছিলেন, তাকেই লুথার এক বৃহত্তর সফল আন্দোলনে পরিণত করেন।

লুখারের প্রথম জীবন

মার্টিন লুথার ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর জার্মানির স্যাক্সনি প্রদেশের ইসালিবেন গ্রামে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এরফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের পর তিনি উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। ইতিপূর্বে ১৫০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি খ্রিস্ট ধর্মের অগাস্টিয়ান সন্ন্যাসী সংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

আন্দোলনের সূচনা

১৫১০ খ্রিস্টাব্দে লুথার ক্যাথলিক ধর্মের কেন্দ্রস্থল ও পোপের অধিষ্ঠানক্ষেত্র রোম পরিদর্শনে যান। এখানে ক্যাথলিক চার্চ ও যাজকদের দুর্নীতি ও অনাচার সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়। এই দুর্নীতি দূর করার জন্য তিনি পোপের শরণাপন্ন হন। কিন্তু ক্ষমতালোভী এবং অনৈতিকতার পৃষ্ঠপোষক স্বয়ং পোপ লুথারের অভিযোগ অগ্রাহ্য করেন। মর্মাহত লুথার ক্যাথলিক ধর্মের প্রতিপালকদের মিথ্যাচার জনসাধারণের সামনে আনার সংকল্প নেন। পোপ ও যাজকদের অনৈতিক আচরণ এবং বাইবেলে বর্ণিত খ্রিস্ট ধর্মের মর্মবাণীর ভুল বা মিথ্যা ব্যাখ্যা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার কাজ শুরু করেন। মার্টিন লুথারের এই প্রয়াস দ্রুত খ্রিস্টান সমাজে জনপ্রিয়তা পায়। লুথারের এই আন্দোলন ধর্মসংস্কার আন্দোলন বা প্রতিবাদী ধর্মসংস্কার আন্দোলন (Protestant Movement) নামে পরিচিত হয়।

মার্জনাপত্র বিক্রয় সংক্রান্ত বিরোধ 

রৈামান ক্যাথলিক মতে, মৃত্যুর পর মানুষ যাজকের আশীর্বাদে ছোটোখাটো পাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে কিংবা সাময়িক যন্ত্রণা ভোগ করে সম্পূর্ণ পাপমুক্ত হতে পারে। যাজকের এই আশীর্বাদ লাভের জন্য সাধারণ মানুষকে অর্থের বিনিময়ে মার্জনাপত্র ক্রয় করতে হত। একে বলা হত Indulgence, রোমের সেন্ট পিটারস চার্চ সংস্কারের জন্য যেহেতু প্রভূত অর্থের প্রয়োজন ছিল, তাই এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থসংগ্রহ করতে ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে পোপ দশম লিওর অনুমোদনক্রমে ডোমিনিকান সন্ন্যাসী জোহান টেটজেল মার্জনাপত্র বিক্রয়ের জন্য উইটেনবার্গে এলে মার্টিন লুথার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।

৯৫ দফা প্রতিবেদন বা নাইনটি ফাইভ থিসিস

 মার্টিন লুথার বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের পাপপুণ্যের বিচার এবং তা থেকে মুক্তিদানের কাজে যাজকদের কোনও বিশেষ ক্ষমতা থাকতে পারে না। একজন যাজক ও একজন গৃহী মানুষ তাদের কৃতকর্মের জন্য একইভাবে ঈশ্বরের কাছে দায়বদ্ধ। একজন প্রকৃত খ্রিস্টানের প্রধান পরিচয় হল প্রকাশিত সত্যকে অনুধাবন (Revealed Truth)। একমাত্র ‘বিশ্বাস’ দ্বারাই প্রকাশিত সত্যকে অনুধাবন করা সম্ভব। মার্জনাপত্র কখনোই বিশ্বাসের স্থান নিতে পারে না। তিনি এই মার্জনাপত্র বিক্রয়কে মানুষের সঙ্গে প্রবঞ্চনা এবং চার্চ ও যাজকদের ধর্মের অজুহাতে সম্পদ সংগ্রহের অপচেষ্টা বলে প্রচার করেন।

‘মার্জনাপত্র’ নামক মিথ্যাচারের প্রকৃত ছবি উদ্‌ঘাটনের জন্য লুথার এক দীর্ঘ প্রশ্নমালা তৈরি করেন। এটি ৯৫ দফা প্রতিবেদন বা নাইনটি ফাইভ থিসিস (Ninety-five Theses) নামে খ্যাত। এই ঘোষণাপত্রটি তিনি ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর তারিখে All Saints Day-র প্রাক্কালে উইটেনবার্গ ক্যাসল চার্চের দরজায় ঝুলিয়ে দেন। ঘোষণাপত্রের অসংখ্য মুদ্রিত অনুলিপিও কয়েক মাসের মধ্যেই ইউরোপের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

Anti Theses প্রচার ও লুখারের তর্কযুদ্ধে যোগদান

লুথারের এই ৯৫টি প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে টেটজেল ১০৬টি প্রতিপ্রশ্ন (Anti Theses) ছাপিয়ে প্রচার করেন। ছাত্রসমাজ এসময় প্রতিপ্রশ্নগুলিকে পুড়িয়ে লুথারের পাশে এসে দাঁড়ায়। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুন লাইপজিগে (Leipzig) জোহান বা জোহানেস এক্ (Johann Eck) নামে জনৈক রক্ষণশীল ধর্মযাজকের সাথে লুথার এক তর্কযুদ্ধে অংশ নেন এবং যুক্তি-তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেন যে, পোপতন্ত্র ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়।

লুথারের প্রচারপুস্তিকা

লুথার মনে করতেন, ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য কোনও মধ্যবর্তীর প্রয়োজন নেই। দরকার নেই মার্জনাপত্র কিনে মুক্তির সন্ধান করারও। লুথার পোপতন্ত্রের মিথ্যাচারের প্রতিবাদে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে, ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে তিনটি প্রচারপুস্তিকা প্রকাশ করেন-

  • Address to the Christian Nobility of the German Nation (অথবা An Appeal to the Christian Nobility of the German Nation)) শীর্ষক পুস্তিকায় তিনি সম্রাট পঞ্চম চার্লস (Charles V) ও জার্মানির রাজন্যবর্গকে আবেদন জানান যে, তাঁরা যেন জাগতিক বিষয়ে (রাজনীতি, প্রশাসন) পোপের আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বের দাবির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। চার্চের অভ্যন্তরে সদ্ধর্ম প্রতিষ্ঠাকে রাজশক্তির অন্যতম কর্তব্য বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
  • A Prelude Concerning the Babylonian Captivity of the Church শীর্ষক পুস্তিকাটিতে লুথার ক্যাথলিকদের সঙ্গে সম্পর্কিত সাতটি অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহের (Sacraments) সংখ্যা কমিয়ে তিনটি করেন। যথা- খ্রিস্ট ধর্মের আনুষ্ঠানিক দীক্ষা বা Baptism, জিশুর শেষ ভোজনের স্মৃতি উপলক্ষ্যে পালনীয় একটি বিশেষ প্রতীকী অনুষ্ঠান বা Eucharist; যেখানে প্রভুর উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত রুটি ও মদ খাদ্য হিসেবে ভাগাভাগি করে গ্রহণ করতে হয় এবং Penance বা কোনও খ্রিস্টধর্মাবলম্বী কৃত পাপ যাজকদের কাছে স্বীকার এবং যাজক কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে উক্ত পাপীকে ক্ষমা প্রদর্শন।
  • A Treaties on Christian Liberty বা On the Freedom of a Christian শীর্ষক পুস্তিকায় লুথার সদ্ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের অবস্থান সূচিত করেন। তিনি বলেন, ঈশ্বরের বাণীই ধর্মতত্ত্ব। একজন খ্রিস্টান স্বাধীনভাবেই ধর্মপালন করতে পারেন। পাশাপাশি একজন যাজক ও চার্চের প্রশাসন বা শিক্ষাদানে অংশ নিতে পারেন, কিন্তু তাঁরা অন্যান্য মানুষের থেকে কখনই বেশি মর্যাদার অধিকারী হতে পারেন না। বলাবাহুল্য, লুথারের এই পুস্তিকাগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনা জাগ্রত করে। জার্মানির প্রভাবশালী শাসকগণ থেকে সাধারণ দরিদ্র কৃষক -সকলেই লুথারের সমর্থনে এগিয়ে আসেন।

পোপের প্রতিক্রিয়া

লুথারের বক্তব্য পোপের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। অবশ্য ইতিপূর্বেই একবার পোপের তরফ থেকে লুথারকে রোমে আহ্বান করা হয়েছিল (১৫১৮ খ্রিস্টাব্দ)। কিন্তু তখন স্পেনের সম্রাটপদকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে পোপের পক্ষে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এরপর পরিস্থিতি আরও জটিল হতে শুর করে। ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে পোপ দশম লিও (Leo X) এক আদেশনামা (Papal Bull) জারি করে লুথারের সমস্ত রচনা আগুনে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। ৬০ দিনের মধ্যে অনুতাপ প্রকাশ করে ক্ষমাপ্রার্থনা না করলে লুথার সমাজচ্যুত হবেন বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়। এই সময় স্যাক্সনির ইলেকটর ফ্রেডরিক (Frederick III) লুথারকে ওয়ার্টবার্গ দুর্গে গোপনে আশ্রয়দান করেছিলেন। 

লুথারের প্রতিক্রিয়া

পৌপের Bull-এর প্রতিবাদে লুথার আরও একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে জানিয়ে দেন যে, পোপের নির্দেশনামা নীতিহীনতা, অজ্ঞানতা ও অসত্যের প্রতীক এবং এর বক্তব্য খ্রিস্ট ধর্মবিরোধী (anti-christ)। গোটা জার্মানি জুড়ে লুথারের সমর্থনে এবং পোপের আদেশনামার বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ দেখা দেয়। আদেশনামার কাগজ এবং ধর্মীয় আইনগ্রন্থ (Canon Law) পুড়িয়ে লুথারপন্থীরা প্রতিবাদ জানান। লুথারকে সমাজচ্যুত ঘোষণা ও ওয়ার্মস-এর ধর্মসভা আহ্বান: এমত পরিস্থিতিতে লুথারকে সমাজচ্যুত করা হয় (২৮ জানুয়ারি, ১৫২১ খ্রিস্টাব্দ) এবং কিছুদিনের মধ্যেই ওয়ার্মস-এর এক সভা (Diet of Worms) আহ্বান করে লুথারকে উপস্থিত হতে ও বক্তব্য পেশ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

কিন্তু জার্মানির রাজন্যবর্গ ও লুথারের অনুগামীদের ইচ্ছানুযায়ী তিনি রোমে গিয়ে জবাবদিহি করতে অস্বীকৃত হন। শেষপর্যন্ত উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে অগসবার্গে বিচারসভা আহ্বান করা হয়। লুথার এখানে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, বাইবেলের বিধান (Scripture) এবং যুক্তির বিচারে (Right Reason) ভুল প্রমাণিত না হলে তিনি নিজ সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্যুত হবেন না। এমতাবস্থায় সম্রাট পঞ্চম চার্লস নিজেকে ধর্মের রক্ষক এবং চার্চের রক্ষক দাবী করে মার্টিন লুথারকে ওয়ার্মস-এর অনুশাসনের ভিত্তিতে ধর্মদ্রোহী এবং আইন বহির্ভূত ব্যক্তি (Outlaw) হিসেবে ঘোষণা করেন। সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে তাঁর অবাধ যাতায়াতের অধিকারের উপরেও নামে নিষেধাজ্ঞা। এমনকি ডিক্রি জারি করে তাঁকে প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হয়। এইভাবে ক্যাথলিক চার্চ এবং ধর্মের সঙ্গে লুথার ও তাঁর অনুগামীদের বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয়।

ওয়ার্মস এর ডিক্রির ব্যর্থতা ও লুথারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি

অবশ্য শেষপর্যন্ত ওয়ার্মস-এর ডিক্রি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। কারণ, সম্রাট পঞ্চম চার্লস সেসময় ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় তিনি লুথারবাদের প্রসার রোধ করতে পারেননি। আর যেহেতু জার্মানির রাজারা প্রত্যেকে লুথারবাদ দমনের প্রশ্নে সহমত ছিলেন না, তাই লুথারের কার্যকলাপকে অঙ্কুরে বিনাশ করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া পোপের সঙ্গে চার্লসের বিরোধও ছিল লুথার পরিচালিত আন্দোলন শক্তিশালী হওয়ার একটি কারণ।

অন্যদিকে লুথার ও লুথারপন্থীরাও এই সময় নিষ্ক্রিয় ছিলেন না। ওয়ার্টবার্গ দুর্গে আত্মগোপনকালে লুথার জার্মান ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন, যা দ্বিতীয় বাইবেল নামে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। রচনা করেন প্রবন্ধও। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথার Evangelical Hymn বা সমবেত প্রার্থনা সংগীত রচনা করেছিলেন।

লুথারের মতবাদ সমগ্র জার্মানিতে প্রসারিত হলে একদিকে যেমন মঠগুলিকে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, তেমনই পূজার্চনার পদ্ধতিকেও করা হয়েছিল সহজসরল। প্রার্থনা সভাগুলিতে সেসময় ল্যাটিনের বদলে রাষ্ট্রীয় ভাষা ব্যবহৃত হত। ১৫২১ থেকে ৩১ -এই এক দশকে স্যাক্সনি থেকে অন্যান্য জার্মান রাজ্যগুলিতে লুথারের মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে। জার্মানির স্ট্রাসবার্গ, উম, অগসবার্গ, হ্যামবার্গ, ব্রিমেন, নুরেমবার্গ ও ল্যুবেক শহরের বাসিন্দারা লুথার কথিত ধর্মের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বেশকিছু জার্মান প্রদেশের শাসকও লুথারের মতবাদ গ্রহণ করেছিলেন।

রাজশক্তির সুদৃঢ়করণ

লুথার রাজশক্তির সমর্থনলাভের জন্য এসময় ঘোষণা করেন যে, পোপ বা যাজক নন বরং রাজশক্তি ও তার অনুগামীরাই হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। Doctrine of Two Kingdom ধারণা দ্বারা মার্টিন লুথার ধর্মজীবন ও রাষ্ট্রজীবনের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজনরেখা টেনেছেন। আবার Doctrine of Non-resistance তত্ত্ব দ্বারা ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দের পর লুথার মেনে নেন যে, কোনও অবস্থাতেই প্রজাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অধিকার নেই। লুথার ১৫২৪-১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত জার্মানির কৃষক বিদ্রোহে কৃষকদের বিদ্রোহ থেকে বিরত হতে বলেছিলেন।

স্পিয়ারের ধর্মসভা

পূর্বে ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার দরুন চার্লস ওয়ার্মসের ডিক্রি বলবৎ করতে না পারলেও ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস (Francis I) যখন পাভিয়ার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মাদ্রিদ চুক্তি (Treaty of Madrid, ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ) স্বাক্ষর করেন, তখন তিনি পুনরায় ডিক্রি জারির সুযোগ লাভ করেন। কিন্তু অচিরেই ফ্রান্সিসের সঙ্গে পোপের সুসম্পর্ক স্থাপন পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আবারও ডিক্রি জারির উপর নামে নিষেধাজ্ঞা। এই পরিস্থিতিতেই ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে আয়োজিত হয় স্পিয়ারের ধর্মসভা (Diet of Speyer)। ফ্রান্স ও অটোমান তুর্কিদের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত থাকার কারণে এতে সম্রাট পঞ্চম চার্লস ও তাঁর ভ্রাতা ফার্দিনান্দ (Ferdinand) অনুপস্থিত থাকেন। এই ধর্মসভায় ঘোষিত হয় যে, প্রত্যেক রাষ্ট্র নিজেদের মতো ধর্মাচরণ করবে এবং কেবলমাত্র ঈশ্বর ও সম্রাটের কাছেই জবাবদিহি করবে।

  • দ্বিতীয় স্পিয়ারের ধর্মসভা আহ্বান: এমত পরিস্থিতিতে পঞ্চম চার্লস পোপ ও ফ্রান্সিস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেন এবং তাঁদের ক্যাম্বে চুক্তি (Treaty of Cambrai, ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দ) মেনে নিতে বাধ্য করেন। অন্যদিকে ওই বছরেই চার্লস দ্বিতীয়বার স্পিয়ারের ধর্মসভা (মার্চ, ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দ) আহ্বান করে পূর্বের ধর্মসভার সিদ্ধান্তগুলিকে বাতিল করেন। ধর্মসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্যাথলিকরাও সমস্ত জার্মানবাসীদের লুথারের মতবাদকে পরিত্যাগ করার কথা বলেন, যার বিরুদ্ধে লুথারের সমর্থকেরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। এর কিছুদিন পরে (১৯ এপ্রিল) সংখ্যালঘু জার্মান শাসকগণ ও বিভিন্ন শহর আনুষ্ঠানিকভাবে লুথারবাদের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘোষণা করেন এবং বলেন যে, কোনোভাবেই তারা ঈশ্বরের ইচ্ছা ও বাণীর বিরুদ্ধাচরণ করবেন না। এরপর যারা যারা ক্যাথলিক চার্চ পরিত্যাগ করে চলে গেলেন, তারাই পরিচিত হতে থাকলেন প্রোটেস্ট্যান্ট নামে।

ক্যাথলিকবাদ ও প্রোটেস্ট্যান্টবাদ

মার্টিন লুথারের ধর্মসংস্কার ‘আন্দোলনের ফলে খ্রিস্টান সম্প্রদায় দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। লুথারকে অনুসরণ করে যাঁরা পোপতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করেন, অর্থাৎ প্রতিবাদ করেন, তাঁরা প্রোটেস্ট্যান্ট (Protestant) নামে পরিচিত হন। এঁদের ধর্মীয় বিশ্বাস প্রোটেস্ট্যান্টবাদ (Protestantism) নামে বিখ্যাত হয়। অন্যদিকে যাঁরা আগের মতোই পোপতন্ত্রকে সমর্থন জানান, তাঁরা পরিচিত হন রোমান ক্যাথলিক (Roman Catholic) নামে। এঁদের মতাদর্শ ক্যাথলিকবাদ (Catholicism) নামে সুবিদিত হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জার্মানি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে ধর্মসংস্কারে লুথারের প্রভাব ছিল বেশি। তাই এইসব স্থানের প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ ‘লুথারবাদ’ নামেও অভিহিত হয়। তবে ইংল্যান্ড, পোল্যান্ড, সুইটজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, বোহেমিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনগুলিতে প্রকৃতিগত প্রভেদ ছিল।

গৃহযুদ্ধ

পবিত্র রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লস অতঃপর লুথারবাদকে ধ্বংস করতে প্রোটেস্ট্যান্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। প্রোটেস্ট্যান্টপন্থীরাও সম্মিলিত হয়ে গঠন করেন Schmalkaldic League। এই যুদ্ধ স্কমালক্যালডিক যুদ্ধ (Schmalkaldic War) নামে পরিচিত। এই সংঘর্ষে পঞ্চম চার্লসের প্রতিপক্ষ ছিল লুথারবাদী রাজন্যদের মৈত্রীজোট বা স্কমালক্যালডিক লিগ। জার্মানিতে ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই গৃহযুদ্ধ চলে। এই সময় ১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের মৃত্যু হয়। অবশেষে ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে অগসবার্গের সন্ধি (Peace of Augsburg) দ্বারা উভয়পক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয় এবং প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ তথা ধর্ম আইনসংগত স্বীকৃতি লাভ করে। এরপর থেকে ব্যাভেরিয়া, রাইন ও অস্ট্রিয়া অঞ্চলে যেমন ক্যাথলিক মতবাদ বজায় থাকে, অন্যদিকে স্যাক্সনি, ব্রান্ডেনবার্গ, লুক্সেমবার্গ প্রভৃতি প্রদেশগুলিতে লুথারবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment