সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা করো

সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা করো

সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা করো
সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা করো

সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক

সাম্য ও স্বাধীনতার সংজ্ঞা

সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শ দুটির অস্তিত্ব বহু যুগ ধরে সমাজে বিদ্যমান থাকলেও উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। একপক্ষ মনে করেন এই দুই ধারণা একে অপরের বিরোধী, আবার অন্যপক্ষ মনে করেন এই দুই ধারণা পরস্পরের পরিপূরক। এই দুই ধারণার মধ্যে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, বর্তমানেও তার সমাপ্তি ঘটেনি। তবে উভয়ের সম্পর্ক আলোচনা করার পূর্বে সংক্ষেপে উভয়ের সংজ্ঞা আলোচনা করা প্রয়োজন। সাম্য বলতে সাধারণ অর্থে বোঝায় সব মানুষের সমতাকে।

কিন্তু ‘সাম্য’ বা ‘Equality’ কথাটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে সাম্য বলতে সব মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী যাবতীয় সুযোগসুবিধার সমতাকে বোঝায়। অন্যদিকে, স্বাধীনতা বলতে এমন একটি বিশেষ পরিবেশের সযত্ন সংরক্ষণকে বোঝায়, যেখানে মানুষ তার ব্যক্তিসত্তাকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করার সুযোগ পায়। ল্যাস্কি-র মতে, নিয়ন্ত্রণবিহীন স্বাধীনতা কখানোই প্রকৃত স্বাধীনতা বলে বিবেচিত হতে পারে না। বার্কার-ও মনে করেন, স্বাধীনতা সর্বদা সকলের জন্য শর্তসাপেক্ষ। মার্কসবাদীদের মতে, স্বাধীনতা হল মানুষের সামর্থ্য ও যোগ্যতার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ।

সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক বিষয়ে লর্ড অ্যাক্টন-এর মতে, সমতার আবেগ স্বাধীনতার দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করে। সাম্য উদ্যোগকে নষ্ট করে, সভ্যতার অধঃপতন ডেকে আনে। আবার এবিষয়ে অধ্যাপক ল্যাস্কি-র অভিমত সম্পূর্ণ ভিন্ন, তাঁর মতে, সাম্য ছাড়া স্বাধীনতার কল্পনা করাই অসম্ভব। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, স্বাধীনতা ও সাম্যের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রশ্নে রাষ্ট্রচিন্তাবিদেরা দ্বিধাবিভক্ত। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্ককে অস্বীকার করেন। আবার, সমাজবাদীরা স্বাধীনতা অপেক্ষা সাম্যের গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

(1) সাম্য অপেক্ষা স্বাধীনতার গুরুত্ব

সুদীর্ঘকাল থেকে সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বলে ব্যাখ্যা করা হলেও ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সাম্যের বহু আগে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি ওঠে। প্রাচীন গ্রিসে এবং রোমে যখন দাস ব্যবস্থার প্রচলন ছিল তখন সব মানুষকে সমান ভাবা হত না। সেই সময় সাম্য অপেক্ষা স্বাধীনতার স্থান ছিল অনেক উপরে। দাস প্রথার বিধিবদ্ধতাকে অগ্রাহ্য করে গ্রিসে ইউরিপিডিস, অ্যালসিডামাস প্রমুখ দার্শনিক এবং স্টোয়িক চিন্তাবিদরা স্বাভাবিক সাম্যের ধারণা প্রচার করলেও তা সমকালীন সমাজে গ্রাহ্য হয়নি। প্রাচীন গ্রিসে অ্যারিস্টট্ল ক্রীতদাস প্রথাকে সমর্থন করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি ব্যক্তি সাম্যকে স্বীকার করেননি।

আবার রোমান সাম্রাজ্যে সম্ভ্রান্ত অভিজাত তথা প্যাট্রিশিয়ানরা আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যাবতীয় সুবিধা ভোগ করত। অন্যদিকে প্লেবিয়ান তথা সাধারণ মানুষের বিশেষ কোনো অধিকার ভোগের সুযোগ ছিল না, বিত্তবানরাই আইনসভায় প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পেত। মধ্যযুগেও উভয় ধারণার মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। খ্রিস্টধর্ম প্রচারকরাও যে সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন তার কোনো রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, মধ্যযুগ পর্যন্ত সাম্যের আদর্শ উপেক্ষিত ছিল।

পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী (Utopian Socialists)-রা বৈষম্যহীন সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। যেমন টমাস ম্যুর, চার্লস ফুরিয়ার, রবার্ট ওয়েন প্রমুখ কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীরা সাম্যভিত্তিক সমাজ স্থাপনের উপর জোর দিয়েছিলেন, তাঁদের তত্ত্বে সাম্য ও স্বাধীনতার সমন্বয়ের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। যেমন-সাঁ সিমোঁ মানুষের উপর অন্য মানুষের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাকে স্বাধীনতাবিরোধী বলে মনে করতেন। যদিও তাঁরা সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শের কোনো সমন্বয় চিন্তা করেননি।

(2) সাম্য ও স্বাধীনতার সমন্বয়

স্বাধীনতা ও সাম্যের পারস্পরিকতার প্রশ্নে রুশোর অবদান অসামান্য। রুশো তাঁর ‘Discourse on the Origin of Inequality’ গ্রন্থে তিনি দেখান মানবসমাজের অস্তিত্বের প্রথম পর্বে মানুষের মধ্যে সুখ, স্বাধীনতা, সমতার অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে অন্যায়, অসাম্য, দাসত্বের সৃষ্টি হল যা মানুষের স্বাধীনতা, সাম্যকে কেড়ে নিল। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Social Contract (১৭৬২ খ্রি.)-এ তিনি এমন এক সমাজ গঠনের কথা পরিকল্পনা করেছিলেন যে সমাজে মানুষ তথা মানব সভ্যতার প্রথম পর্বের মতো সাম্য ও স্বাধীনতা ফিরে পায়। এ প্রসঙ্গে তিনি সাধারণ ইচ্ছার ধারণার অবতারণা করেছিলেন।

যাই হোক, তাঁর সমতার দর্শনের প্রধান কথা ছিল ‘রাষ্ট্রের মালিকানা থাকবে সর্বোচ্চ আর নাগরিকের সম্পত্তি হবে ক্ষুদ্র ও নগণ্য’। রুশো মনে করেন, বৈষম্য দূর না হলে, গণতান্ত্রিক শাসন ও আইনের প্রসার না ঘটলে, মানুষের মধ্যে সমাজবোধ ও সহযোগিতার সম্পর্ক সৃষ্টি না হলে স্বাধীনতা ও সমতার সংগতি আসবে না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “Liberty cannot exist without equality”। তিনি মনে করতেন সাম্যের  অস্তিত্ব ছাড়া স্বাধীনতা ভোগ করা যায় না।

বস্তুতপক্ষে, ফরাসি বিপ্লব এবং ফ্রান্সের ব্যক্তি ও নাগরিকদের অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণায় (১৭৮৯ খ্রি.) সর্বপ্রথম সাম্য ও স্বাধীনতার সমন্বয় চিন্তা বাস্তব রূপ লাভ করে। ফ্রান্সের জাতীয় সংসদে ঘোষণা করা হয় মানুষ জন্ম থেকেই স্বাধীন এবং সমানাধিকারসম্পন্ন।

পরবর্তীকালে উনবিংশ শতাব্দীর চিন্তাবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরের পরিপূরক বলে বর্ণনা করেন। তিনি সমাজের মঙ্গল ও কল্যাণের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীনতার ধারণাকে বিশ্লেষণ করেছিলেন। এইরূপ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সর্বাগ্রে অর্থনৈতিক সমতা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেছিলেন। আধুনিককালে বিংশ শতাব্দীর বহু চিন্তাবিদরা যেমন-হবহাউস, ল্যাস্কি, বার্কার, পোলার্ড, মেইটল্যান্ড, গডউইন প্রমুখ সাম্য ও স্বাধীনতার ধারণাকে একে অপরের পরিপূরক বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

হবহাউস-এর মতে, সাম্য ছাড়া স্বাধীনতার ধারণা নিছক ‘বাগাড়ম্বর’ মাত্র (Liberty without equality is a high sounding phrase with squalied results)। আর এইচ টনি বলেন, সাম্য কখনো স্বাধীনতার পরিপন্থী হতে পারে না। বরং, স্বাধীনতার জন্যই সাম্যের প্রয়োজন। তাঁর মতে, মানবতার নিরবচ্ছিন্ন প্রসার যদি স্বাধীনতা হয় তাহলে তা সাম্যভিত্তিক সমাজ ছাড়া পাওয়া যাবে না। পোলার্ড-এর অভিমত হল, স্বাধীনতা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানসূত্রের নাম সাম্য। বার্কার স্বাধীনতা ও সাম্যের সমন্বয়সাধনের উপর গুরুত্ব দেন।

তাঁর ভাষায় এর অর্থ হল, “সাম্য কোনো বিচ্ছিন্ন নীতি নয়। এ হল এমন এক নীতি, যা স্বাধীনতা ও সৌভ্রাতৃত্বের উপরে দাঁড়িয়ে আছে” (Equality is not an isolated principle. It stands by the principle of liberty and fraternity.) IF সুতরাং উক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, উভয় ধারণা পরস্পরবিরোধী নয়, বরং সমন্বয়মূলক ধারণা। এ বিষয়ে ল্যাস্কি-র মত হল, স্বাধীনতার মূল কথা হল সাহস। এই সাহস যে গতিপথ (Channel)- এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেগুলিই সাম্যের ধারণার দিকে প্রবাহিত।

(3) অর্থনৈতিক সাম্যের গুরুত্ব

অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কি তাঁর ‘A Grammar of Politics’ গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, অর্থনৈতিক সাম্য না থাকলে রাজনৈতিক সাম্যের কোনো মূল্য নেই। তাই দুটি ধারণা কখনোই পরস্পরের বিরোধী নয়। বরং এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘They are different facets of the same ideal’। মার্কসবাদীরাও এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, ধনবৈষম্যমূলক সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য না থাকায় রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা নিতান্তই মূল্যহীন হয়ে দাঁড়ায়। এরূপ সমাজে আইন যেহেতু কতিপয় ব্যক্তির স্বার্থরক্ষার যন্ত্র হিসেবে কাজ করে, সেহেতু এই আইন শ্রমজীবী মানুষদের আর্থিক স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করতে পারে না। তাই, মার্কসীয় তত্ত্বে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্তরূপে অর্থনৈতিক সাম্যের কথা বলা হয়। তাই মার্কসবাদীদের মতে, শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজেই সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরকরূপে কাজ করতে পারবে।

(4) রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতবিরোধ

সাম্যের সঙ্গে স্বাধীনতার সম্পর্ক নির্ণয় করতে গিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেননি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আর্থিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ব্যক্তির অবাধ স্বাধীনতার তত্ত্ব প্রচার করেন। এর পাশাপাশি তাঁরা ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণাকেও প্রচার করেন, যা সাম্যের তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত। লর্ড অ্যাক্টন, স্পেনসার, টকভিল, বেজহট, লেকি প্রমুখ চিন্তাবিদরা স্বাধীনতা বলতে ব্যক্তির ধনসম্পদ ভোগের অবাধ স্বাধীনতাকে বুঝিয়েছিলেন। ফলে তাঁদের দৃষ্টিতে সাম্য ও স্বাধীনতা ছিল সম্পূর্ণ বিরোধী ধারণা।

লেকি তাঁর, ‘Democracy and Liberty’ শীর্ষক গ্রন্থে গণতন্ত্রের অবস্থাকে স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধী বলে বর্ণনা করেছিলেন (‘Direct opposite of liberty’) কারণ, গণতন্ত্র শ্রেণিগুলির মধ্যে ভারসাম্য বিনাশ করে দেয়। এখানে লেকি গণতন্ত্র বলতে রাজনৈতিক ক্ষমতার সাম্য তথা Equality of political power-কে বুঝিয়েছিলেন। আবার লর্ড অ্যাক্টন-এর মতে, সাম্য প্রতিষ্ঠার আগ্রহ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে ধ্বংস করে দেয়। তিনি ব্যক্তির অসীম সম্পত্তি ভোগের অধিকারকেই স্বাধীনতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এক্ষেত্রে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে ধনী শ্রেণির স্বাধীনতায় সীমাবদ্ধতা আরোপিত হবে যা, তাদের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ বা খর্ব করবে। এজন্যই তিনি সাম্যের নীতিকে স্বাধীনতার বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, সাম্য ও স্বাধীনতা-দুটিই হল আইনগত ধারণা। রাষ্ট্র আইনের সহায়তায় স্বাধীনতা ও সাম্যের ধারণাকে বাস্তবায়িত করে। উভয় ধারণাই ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তার বিকাশের সঙ্গে জড়িত। স্বাধীনতা বলতে একটি সামাজিক পরিবেশের সযত্নে সংরক্ষণকে বোঝায়। বলাই বাহুল্য, এই সামাজিক পরিবেশ আসলে সাম্যের পরিবেশকেই বোঝায়। সুতরাং, সাম্য ও স্বাধীনতার ধারণা কার্যত পরস্পরের পরিপূরক। কারণ, সাম্য ও স্বাধীনতা উভয়েই মানুষের আত্মবিকাশে সহায়তা করে। তাই সাম্য ও স্বাধীনতা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কযুক্ত।

আরও পড়ুন – ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা

Leave a Comment