আন্তর্জাতিক আইনের অর্থ, সংজ্ঞা ও প্রকৃতি আলোচনা করো

আন্তর্জাতিক আইনের অর্থ, সংজ্ঞা ও প্রকৃতি আলোচনা করো

আন্তর্জাতিক আইনের অর্থ, সংজ্ঞা ও প্রকৃতি আলোচনা করো
আন্তর্জাতিক আইনের অর্থ, সংজ্ঞা ও প্রকৃতি আলোচনা করো

আন্তর্জাতিক আইন

(1) অর্থ

বর্তমান পৃথিবীতে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল জাতীয় রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করা যায় না। আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্র অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক-সহ সকল ক্ষেত্রে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। কতকগুলি নিয়মকানুনের মাধ্যমে এই পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। এই নিয়মকানুনগুলিকে আন্তর্জাতিক আইন বলে অভিহিত করা হয়। লরেন্স-এর মতে, সাধারণভাবে যেসব নিয়মকানুনের দ্বারা সভ্য রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক আচার-ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হয়, সেগুলিকে আন্তর্জাতিক আইন বলে। অনুরূপ মত পোষণ করে ওপেনহেইম বলেন, আন্তর্জাতিক আইন হল প্রথাগত ও চিরাচরিত নিয়মকানুনের এমন এক সমষ্টি, যার আইনগত বাধ্যবাধকতাকে সভ্য রাষ্ট্রগুলি তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মেনে চলে। (“International law is a body of customs and observances in a imperfectly organised society, which have not fully acquired the character of law, but which are on the way to become law.”) ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আন্তর্জাতিক সমাজে আন্তর্জাতিক – আইনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। অধ্যাপক ল্যাস্কি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, বর্তমান বিশ্ব একে অপরের প্রতি এত বেশি নির্ভরশীল যে, কোনো একটি রাষ্ট্রের অবাধ ইচ্ছা অপর রাষ্ট্রের শান্তির পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এজন্য আন্তর্জাতিক ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’-এর প্রচ্ছদ শান্তি-শৃঙ্খলা, ঐক্য-সংহতি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা প্রয়োজন। সেই সূত্রেই আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োজনীয়তা উদ্ভূত হয়েছে।

(2) উৎস

১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে জেরেমি ব্যোম সর্বপ্রথম ‘আন্তর্জাতিক আইন’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করেন। যদিও তাঁর পূর্বে হুগো গ্রোটিয়াস কর্তৃক লিখিত ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত De Jure Belli ac Pacis (On the Law of War and Peace) গ্রন্থটি আন্তর্জাতিক আইনের একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এই গ্রন্থে তিনি যুদ্ধের আইন সম্পর্কে কিছু নীতি বা সূত্র আলোচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে যুদ্ধের ন্যায্যতা (Just War) সম্পর্কেও মত প্রকাশ করেছিলেন। এ ছাড়া, সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাস (St. Thomas Acquinas) এবং পুফেনডর্ফ (Pufendorf)-এর ধারণাতেও আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে আলোচনা পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের সংবিধি (Statute of the International court of Justice)-র ৩৮ নং ধারায় আন্তর্জাতিক আইনের উৎসগুলির সম্পর্কে বলা হয়েছে। সেগুলি হল-

  1. বিশেষ আন্তর্জাতিক সন্ধি দ্বারা সৃষ্ট নিয়মাবলি, যা বিবাদমান রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকারযোগ্য;
  2. বিধিবদ্ধ আইনের মতো স্বীকৃত আন্তর্জাতিক প্রথাসমূহ;
  3. সভ্য রাষ্ট্রগুলির দ্বারা স্বীকৃত আইনের সাধারণ নিয়মকানুন;
  4. প্রখ্যাত আইনজ্ঞ কর্তৃক প্রকাশিত রচনাসমূহ এবং বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত।

(3) সংজ্ঞা

আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আইনবিদদের মধ্যে কোনোরূপ ঐক্যমত গড়ে ওঠেনি। আন্তর্জাতিক আইনবিদদের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে সংজ্ঞাগুলিকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা নিম্নরূপ-

  • সাবেকি সংজ্ঞা: ওপেনহাইম, লরেন্স প্রমুখরা আন্তর্জাতিক আইনের সাবেকি সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাঁদের মতে, যেসকল আন্তর্জাতিক নিয়ম, প্রথা, রীতিনীতি একত্রিতভাবে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির ব্যবহার, আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে ও পরিচালনা করে, সেই সকল সংজ্ঞাকে আন্তর্জাতিক আইনের সাবেকি সংজ্ঞা বলে। লরেন্স-এর অভিমত অনুযায়ী, সভ্য দেশগুলির পারস্পরিক আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মকানুনই হল আন্তর্জাতিক আইন। আবার আন্তর্জাতিক আইনবিদ ওপেনহাইম-এর মতে, সভ্য রাষ্ট্রগুলি নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যেসকল নিয়ম ও প্রথাগুলি স্বীকার করে নেয় সেই সকল নিয়মনীতি, প্রথার সমষ্টিকে আন্তর্জাতিক আইন বলে। চার্লস ফেনউইক (Charles Fenwick) নামক এক আইনজ্ঞ তাঁর ‘আন্তর্জাতিক আইন’ নামক গ্রন্থে আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নীতি এবং তার অনুশীলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করেছেন। তিনিও উপরোক্ত দুই তাত্ত্বিকের সমরূপ ভাবনা পোষণ করেন। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক আইন সেই সকল সাধারণ নীতি ও নির্দিষ্ট নিয়মের সমষ্টি যেগুলি আন্তর্জাতিক সমাজের সদস্যরা নিজেদের আন্তঃসম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। এছাড়াও ব্রিয়ারলি (Brierly), জিসাপ (Jeessup) প্রমুখও আন্তর্জাতিক আইনের অনুরূপ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
  • আধুনিক সংজ্ঞা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক  রাজনীতিতে এক ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। এই সময় স্টার্ক (J G Starke), সি সি হাইড (CC Hide)-সহ প্রমুখ তাত্ত্বিকরা নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তর্জাতিক আইনকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। জাতিপুঞ্জের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা আন্তর্জাতিক আইনের পরিধিকে সম্প্রসারিত করেছিল। শুধু তাই নয়, জার্মানির ন্যুরেমবার্গে বিজয়ী মিত্রশক্তি দ্বারা অনুষ্ঠিত বিচার প্রক্রিয়া (১৯৪৫-১৯৪৬) এবং জাপানের টোকিও-তে অনুষ্ঠিত বিচার প্রক্রিয়ার রায়-তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি প্রদানের কথা ঘোষণা করে। ফলে আন্তর্জাতিক আইন কেবল রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না, তা আরও প্রসারিত হয়ে ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ককেও তুলে ধরল। এই প্রেক্ষিতেই স্টার্ক আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক আইন হল সেই সকল নিয়ম ও আচরণের সমষ্টি, যেগুলি রাষ্ট্রসমূহ পারস্পরিক সম্পর্ক পরিচালনার ক্ষেত্রে মেনে চলতে বাধ্য থাকে।

শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির কার্যাবলি, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং রাষ্ট্র ও ব্যক্তির সম্পর্ক সংক্রান্ত আইনের অনুশাসন বা Rule of Law এবং বৈশ্বয়িক স্তরে ব্যক্তি ও বিভিন্ন অরাষ্ট্রীয় কারক (Non-State Actor)-গুলির অধিকার, কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনাকে অন্তর্ভুক্ত করে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণকারী সাবেকি সংজ্ঞা-তে Natural Law বা স্বাভাবিক আইনের উপরই গুরুত্ব আরোপিত হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক সংজ্ঞা প্রদানকারীরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনকে আইনিভাবে বাধ্যতামূলক প্রকৃতির (Legally Binding in Nature) বলে অভিহিত করেছেন। এ ছাড়া আধুনিক সংজ্ঞা প্রদানকারীরা অরাষ্ট্রীয় কারকগুলিকে আন্তর্জাতিক আইনভুক্ত করায় আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতি আরও প্রসারিত হয়েছে।

  • মার্কসবাদী সংজ্ঞা: রাষ্ট্রীয় আইনের মতো আন্তর্জাতিক আইনকেও 2 মার্কসবাদীরা নেতিবাচকভাবে বর্ণনা করেছিলেন। তাঁদের মতে, আন্তর্জাতিক আইনেও শ্রেণি চরিত্র বর্তমান। আন্তর্জাতিক আইন ধনী, উদার পুঁজিপতি দেশগুলির অনুকূলে পরিচালিত হয়, যা উন্নয়নকামী দরিদ্র দেশগুলিকে শোষণের যে পথ, তাকে সুগম করে। ১৯১৭ সালে বলশোভিক বিপ্লবের পর পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের Academy of Sciences দ্বারা প্রকাশিত আন্তর্জাতিক আইনের পাঠ্যবই অনুসারে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির নিজেদের মধ্যে এবং সমাজতান্ত্রিক ও অসমাজতান্ত্রিক উদার দেশগুলির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান (Peaceful Co-existance), পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা সম্পর্কিত নীতি (Principle of Mutual Co- operation) ও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিবাদ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা সংক্রান্ত নিয়মের সমষ্টিকে আন্তর্জাতিক আইন বলা হয়। আবার, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সোভিয়েত প্রতিষ্ঠান বা Soviet Institute of International Relations আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে উল্লেখ করে, বিশ্বশান্তি ও শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র প্রসার ও প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক পরিচালনার উদ্দেশ্যে প্রণীত আইনই হল আন্তর্জাতিক আইন।

(4) আন্তর্জাতিক আইনের শ্রেণিবিভাজন

আন্তর্জাতিক আইনের প্রধান দুটি ভাগ রয়েছে। এগুলি হল- সরকারি আন্তর্জাতিক আইন (Public International Law) ও বেসরকারি আন্তর্জাতিক আইন (Private International Law)। সরকারি আন্তর্জাতিক আইন বলতে সেই আইনকে বোঝায় যা আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কাজকর্ম ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সেই সঙ্গে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রভৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সরকারি আন্তর্জাতিক আইন তিন ধরনের হয়। এগুলি হল শান্তি সম্পর্কিত আইন (Laws of Peace)- যেসব আন্তর্জাতিক আইন শান্তির সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে শান্তি সম্পর্কিত আইন বলে। যেমন, বন্দি অর্পণ (Extradition) বা সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতিদান (Recognition of States) প্রভৃতি।

যুদ্ধ সম্পর্কিত আইন (Laws of War)-যুদ্ধের সময়ে যুদ্ধরত দেশগুলি যেসব আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে, সেগুলিকে যুদ্ধ সম্পর্কিত – আইন বলা হয়। যেমন, যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিতকরণ (Warcrime), শত্রু – চিহ্নিতকরণ, জল, স্থল ও বিমান যুদ্ধ ইত্যাদি এবং নিরপেক্ষতা সম্পর্কিত আইন (Laws of Neutrality)। আবার যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলির বাইরে যেসব নিরপেক্ষ রাষ্ট্র রয়েছে, তারা নিজেদের মধ্যে বা তাদের সঙ্গে যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলির সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে যেসব আইন মেনে চলে, সেগুলিকে নিরপেক্ষতা সম্পর্কিত আইন বলে। দৃষ্টান্ত হিসেবে অর্থনৈতিক অবরোধ (Blockade), যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলিতে পণ্য সরবরাহ নিষিদ্ধকরণ (Contraband) প্রভৃতি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা যায়।

অন্যদিকে, বেসরকারি আন্তর্জাতিক আইন বলতে সেই আইনকে বোঝায়, যে আইনের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির অধিকার বা স্বার্থকে কেন্দ্র করে দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধের নিষ্পত্তি হয়। যেমন বিবাহ বিচ্ছেদ, অবৈধ সন্তানের অধিকার, সম্পত্তি-সংক্রান্ত বিরোধ ইত্যাদি। যদিও এই আইনগুলি রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণে সহায়তা করে না বলে অনেক আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ এগুলিকে আইনি স্বীকৃতি দিতে রাজি হন নি।

(5) আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতি

আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতি নির্ণয়ের প্রশ্নে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে, যেগুলিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একদিকে অস্টিন, হল্যান্ড প্রমুখ আইনবিদরা আন্তর্জাতিক আইনকে আইন পদবাচ্য বলে স্বীকার করেননি। অন্যদিকে, হেনরি মেইন, স্যাভিনি প্রমুখ আন্তর্জাতিক আইনকে আইনের পদবাচ্য হিসেবে মনে করেন।

অনেকে আবার আন্তর্জাতিক আইনকে শ্রেণিগত প্রকৃতির দিক থেকে আলোচনা করেছিলেন।

  • বিপক্ষে মতামত: হক্স, অস্টিন, হল্যান্ড প্রমুখ আইনবিদরা আন্তর্জাতিক আইনকে আইনের মর্যাদা প্রদান করতে চাননি। এর পশ্চাতে তাঁরা কতকগুলি কারণ উল্লেখ করেছেন। যথা-
  1. সার্বভৌমের আদেশ নয়: সাধারণ অর্থে, সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট আদেশ হল আইন। কিন্তু, আন্তর্জাতিক স্তরে কোনোরূপ সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের উপস্থিতি নেই ফলে, আন্তর্জাতিক আইনকে কোনো সার্বভৌমের আদেশ বলা যায় না।
  2. আইনসভার অস্তিত্বহীনতা: প্রত্যেক দেশে আইন প্রণয়ন করার জন্য একটি জাতীয় আইনসভার অস্তিত্ব থাকে। এই আইনসভাই সমগ্র দেশের জন্য সাধারণ নিয়মকানুন প্রস্তুত করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন করার জন্য কোনো আন্তর্জাতিক আইনসভার অস্তিত্ব নেই।
  3. শাসন বিভাগের অস্তিত্বহীনতা: জাতীয় আইন দেশের শাসন বিভাগ দ্বারা বলবৎযোগ্য। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনকে বাস্তবায়িত করার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে কোনো শাসন বিভাগের অস্তিত্ব দেখা যায় না।
  4. বাধ্যতামূলক নয়: রাষ্ট্রে বসবাসকারী সকল ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংগঠনকে রাষ্ট্রীয় আইন আবশ্যিকভাবে মেনে চলতে হয়। কেউ যদি রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য বা ভঙ্গ করে, রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করতে পারে বা তাকে শাস্তি প্রদান করতে পারে। অপরপক্ষে, আন্তর্জাতিক আইন মান্য করা রাষ্ট্রগুলির কাছে আবশ্যিক নয় বরং তা স্বেচ্ছামূলক। কোনো রাষ্ট্রের ইচ্ছা হলে আন্তর্জাতিক আইন মান্য করবে নতুবা মান্য করবে না। এক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে আন্তর্জাতিক আইন রাষ্ট্রের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। আবার, কোনো রাষ্ট্র যদি আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্তরে কেবল রাষ্ট্রের নিন্দা করা যায় কিন্তু, কোনোরূপ শাস্তি প্রদান করা যায় না। যেমন-গণহত্যা প্রতিরোধ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন থাকলেও বহু দেশেই সংখ্যালঘু গণহত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়। সম্প্রতি ২০১৬-১৭ সালে মায়ানমার সরকার কর্তৃক সংখ্যালঘু মুসলমান রোহিঙ্গাদের গণহত্যার কথা বলা যায়।
  5. বিচারালয়ের অনুপস্থিতি: দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানকে ভঙ্গ করলে আইন অমান্যকারীকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত শাস্তি প্রদান করতে পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের এরূপ শাস্তি প্রদানের কোনো এক্তিয়ার নেই।
  6. আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের ক্ষমতাহীনতা: জাতীয় আইনে কোনোরূপ অস্পষ্টতা থাকলে, সেই আইনের স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এমনকি সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে দেশের আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনে কোনোরূপ অস্পষ্টতা তৈরি হলে জাতিপুঞ্জের অন্যতম প্রধান অঙ্গ আন্তর্জাতিক বিচারালয়, দেশীয় আদালতের অনুরূপ ক্ষমতা ভোগ করতে পারে না। এমনকি বিচারসংক্রান্ত সিদ্ধান্তকেও কার্যকর করতে পারে না। এ কারণে বিভিন্ন মামলার রায় অকার্যকরী থেকে গেছে।
  7. বিধিবদ্ধ আইনের অনুপস্থিতি: জাতীয় আইন সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকে বলে জাতীয় আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করা সহজ। ফলে জাতীয় আইন প্রকৃতিগতভাবে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট এবং এই আইনানুযায়ী শাস্তি প্রদান করা যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন সুনির্দিষ্ট আকারে লিপিবদ্ধ হয়নি। ফলে আইনের ব্যাখ্যা করে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী রাষ্ট্রকে আইনভঙ্গের অপরাধে শাস্তি দেওয়া যায় না। বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক আইনগুলি লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস উদ্যোগ দেখা দিলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন চুক্তি, সন্ধি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার ফলে তা একত্রিত করে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি।
  8. ত্রুটিপূর্ণ আইন: আন্তর্জাতিক আইনে বিভিন্ন ত্রুটিপূর্ণ ধারা রয়েছে, যেগুলির সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রগুলি নিজেদের খেয়ালখুশি মতো কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ জাতিপুঞ্জের সনদের ২(৭) নং ধারার কথা বলা যায়। এই ধারানুযায়ী, জাতিপুঞ্জ কোনো সদস্যরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। এই ধারার সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রগুলি যাবতীয় ক্রিয়াকলাপকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে ঘোষণা করে, ফলস্বরূপ জাতিপুঞ্জ হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

এই লেখকদের আরও যুক্তি হল যে, আন্তর্জাতিক আইনের কোনো সুনির্দিষ্ট উৎস বা সর্বসম্মত রূপ নেই। হল্যান্ড-এর মতে, ‘International Law is the vanishing point of Jurisprudence.’ লর্ড সলসবেরি (Lord Salisbury)-র মতে, যে অর্থে আইন কথাটি প্রযুক্ত হয়, সেই অর্থে আন্তর্জাতিক আইনের কোনো অস্তিত্ব দেখা যায় না। অধ্যাপক ল্যাস্কি-র বক্তব্য হল, আন্তর্জাতিক আইনের বৈধতা আংশিক এবং অসম্পূর্ণ, কারণ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সম্মতির উপর এটি নির্ভরশীল। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা থাকার জন্য রাষ্ট্রের আইনের উপরে আন্তর্জাতিক আইনকে আরোপ করা যায় না (International Law is only valid for a given state to the degree that it is prepared to accept its substance.)।

  • সপক্ষে  মতামত: ওপেনহেইম পোলক, কেলসন, হল, ফেনউইক- এর মতো আন্তর্জাতিক আইনবিদরা এবং হেনরি মেইন, স্যাভিনি-র মতো লেখকরা আন্তর্জাতিক আইনকে আইনের স্বীকৃতি দিয়ে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁরা যে যুক্তিগুলির কথা তুলে ধরেছেন সেগুলি হল-
  1. সাধারণ স্বীকৃতি: সাধারণ স্বীকৃতির উপর ভিত্তি করে যেভাবে জাতীয় আইন দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনই আন্তর্জাতিক আইনেরও ভিত্তি সাধারণ স্বীকৃতি। রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে একে মেনে চলে। পারস্পরিক বিরোধ মীমাংসা যুদ্ধ প্রতিরোধ প্রভৃতি সমস্যা আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে সমাধান করা হয়। রাষ্ট্রগুলি উপলব্ধি করে, আন্তর্জাতিক আইনের উপস্থিতি না থাকলে বিশ্বে যুদ্ধ পরিস্থিতি, পারস্পরিক বিরোধের সমাধান করে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করা সম্ভব হবে না। ফলে রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োজন।
  2. অভিন্ন উৎস: জাতীয় আইন ও আন্তর্জাতিক আইনের উৎসগুলি অভিন্ন। আন্তর্জাতিক আইনেরও ক্রমবিবর্তন দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, প্রথা, আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে রায়, আন্তর্জাতিক সন্ধি দ্বারা সৃষ্ট এবং বিবাদমান রাষ্ট্রগুলি কর্তৃক স্বীকৃত নিয়মাবলি, বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সাধারণ নিয়মাবলি, বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ পণ্ডিতদের আইনি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আন্তর্জাতিক আইনের প্রধান উৎস, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় আইনের মতো আন্তর্জাতিক আইনেরও অসংখ্য উৎস রয়েছে। ফলে আইন যে কেবলমাত্র সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের নির্দেশ তা কখনোই সঠিক নয়।
  3. সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা: আন্তর্জাতিক আইনকে কোনো রাষ্ট্র অস্বীকার করতে পারে না। এমনকি আন্তর্জাতিক আইন বলবৎযোগ্য নয়, একথাও বলা যায় না। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এই বিষয়ে অবিরত কাজ করে চলেছে। নিরাপত্তা পরিষদ অতীতে ও বর্তমানে এ ধরনের বহু উদ্যোগ বাস্তবে কার্যকরী করেছে। তাছাড়া কোনো রাষ্ট্র প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক আইনকে অমান্য করার কথা ঘোষণা করতে পারে না। এই আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা ও আনুগত্যহীনতার পরিচয় কোনো রাষ্ট্র দিতে চায় না। এমনকি জাতিপুঞ্জের অন্যতম প্রধান অঙ্গ নিরাপত্তা পরিষদ আন্তর্জাতিক আইনকে বাস্তবায়িত করার ভূমিকা পালন করে।
  4. মর্যাদাসম্পন্ন: আন্তর্জাতিক আইনকে ভঙ্গ করা হয় বলে তা আইন নয়-এ যুক্তিও ঠিক নয় বলে এই লেখকরা অভিমত প্রকাশ করেন। সাম্রাজ্যবাদী ও যুদ্ধপ্রিয় রাষ্ট্র কোনো ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনকে ভঙ্গ করলে এর গুরুত্ব হ্রাস পায় না। কারণ আন্তর্জাতিক আইনের মতো জাতীয় আইনও কিছু সমাজবিরোধী ব্যক্তি ভঙ্গ করে থাকে। তা সত্ত্বেও যদি জাতীয় আইনকে আইন বলে গণ্য করা হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক আইনও আইনের পদবাচ্য হওয়া উচিত।
  5. বিশ্ববিবেক ও বিশ্বজনমতের সমর্থন: আন্তর্জাতিক আইনের পশ্চাতে বিশ্ববিবেক ও বিশ্বজনমত সদাজাগ্রত, সেক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্র এর গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারে না। জাতীয় আইন যে সবসময় শাস্তির ভয়ে মানা হয় তা কিন্তু ঠিক নয়, এর পিছনে জনমত ও জনচেতনা কাজ করে। একথা ঠিক যে, রাষ্ট্রীয় আইনের মতো আন্তর্জাতিক আইনকে বলপ্রয়োগ করে মানতে বাধ্য করা যায় না। আবার, বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন করেও আইনকে দীর্ঘকাল ধরে বলবৎ রাখা যায় না। ফলে কোনো আইনকে দীর্ঘমেয়াদি হতে হলে জনসমর্থন একটি আবশ্যক উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। হেনরি মেইন স্যাভিনি-র মতে, সমাজে কিছু সংখ্যালঘু মানুষ শাস্তির ভয়ে আইনকে মান্য করে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই অবচেতনভাবে ও অভ্যাসের বলে আইন মান্য করে চলে। আন্তর্জাতিক আইন অনুপস্থিত থাকলে বিশ্বব্যাপী বিশৃঙ্খলা, যুদ্ধ, পারস্পরিক বিরোধকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসা করা সম্ভবপর হত না বা পারস্পরিক সহযোগিতা গড়ে তোলা সম্ভব হত না।
  6. আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের উপস্থিতি: কোনো রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করছে কি না বা ভঙ্গ করছে কি না তা নজর রাখার দায়িত্ব অনেকাংশে আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের উপর বর্তায়। এমনকি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন সংক্রান্ত কোনো বিরোধ রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে উপস্থিত হলে আন্তর্জাতিক বিচারালয় তার নিষ্পত্তি করতে পারে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিচারালয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চুক্তি, সন্ধির ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে, আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে, প্রয়োজন মনে করলে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গকারীদেশকে ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দান করতে পারে।
  7. লিপিবদ্ধ ও সুনির্দিষ্ট: আন্তর্জাতিক আইন অলিপিবদ্ধ ও অস্পষ্ট এ কথা সঠিক নয়। কারণ বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক আইনকে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। জাতিপুঞ্জের বিভিন্ন উদ্যোগ, চুক্তিগুলিকে দলিল আকারে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র’, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ‘প্যারিস ঘোষণা’ ১৮৯৯, ১৯০৭ ও ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ‘হেগ সম্মেলন’ ইত্যাদি প্রমাণ হিসেবে পাওয়া যায়। তাছাড়া, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ নভেম্বর সাধারণ সভা কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক আইন কমিশন’ গঠনকে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়।
  • সমন্বয়বাদী মত: আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতি সম্পর্কে যে পরস্পরবিরোধী মতের অস্তিত্ব রয়েছে, সেই মতগুলিকে সমন্বিত করে এই মত গড়ে উঠেছে। তাঁদের মতে, রাষ্ট্রীয় আইন এবং আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে বিবিধ পার্থক্য থাকলেও, আন্তর্জাতিক আইনই সাধারণভাবে আইন হিসেবে গ্রহণীয়। তাঁরা আইনের তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেছেন। এগুলি হল- আবশ্যিকভাবে কতকগুলি নিয়মনীতির উপস্থিতি, সমাজের অস্তিত্ব এবং আইনকে কার্যকর করার জন্য উপযুক্ত সংস্থার উপস্থিতি। এই দিক থেকে বিচার করলে বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক আইন কোনো সার্বভৌমের নির্দেশ না হলেও উক্ত তিনটি বৈশিষ্ট্যই আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে বর্তমান। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের আন্তঃসম্পর্ক স্থাপন ও পরিচালনার জন্য বিবিধ নিয়মকানুনের অস্তিত্ব রয়েছে। সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি জাতিরাষ্ট্রকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সমাজ গড়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক আইনকে বলবৎ করার জন্য ও বাস্তবায়িত করার জন্য উপযুক্ত সংস্থা ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়াও বিশ্বজনীন সম্মতি ও জনমত আন্তর্জাতিক আইনকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করেছে।

জার্মান আইনবিদ হেফটার (Hefter) বলেছেন, যে-কোনো সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আইন আবশ্যক। বর্তমানে সকল জাতিরাষ্ট্রসমূহকে নিয়ে যেহেতু বিশ্বসমাজ গড়ে উঠেছে, সেহেতু বিশ্বসমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কতকগুলি আইন থাকা প্রয়োজন। এই আইনগুলির নিয়ন্ত্রণকারী হল জনগণের মতামত। যেহেতু বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে সব রাষ্ট্রই পরস্পর নির্ভরশীল, ফলে কোনো রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় এবং একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও থাকতে পারে না। তাই আয়তনে ও শক্তিতে ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকল রাষ্ট্রকেই তার চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতার কিছু অংশ ছেড়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক আইন মান্য করতে হয়।

অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে, বিশ্বের অসংখ্য ক্ষুদ্র, দুর্বল রাষ্ট্রগুলির অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োজন। তাই বলা যায়, আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় আইনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক আইনকে অস্বীকার করা যায় না। লেভিন (Levin)-এর মতো তাত্ত্বিকদের মতে, সার্বভৌমত্ব আন্তর্জাতিক আইনের অস্তিত্বহীনতা প্রকাশ করে না, বরং তার বিশেষ প্রকৃতি এবং জাতীয় আইনের সঙ্গে বৈসাদৃশ্যকে প্রকাশ করে।

(6) উপসংহার

উক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, আন্তর্জাতিক আইনের পশ্চাতে কোনোরূপ সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের উপস্থিতি না থাকলেও এই আইন মূলত ন্যায়-নৈতিকতা এবং জাতিরাষ্ট্রগুলির স্ব-সম্মতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। ওপেনহেইম এবং হল-এর মতো বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা আন্তর্জাতিক আইনের অনুকূলে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের অধীনে আন্তর্জাতিক আইন প্রকৃত আইনের সমস্ত বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। অধ্যাপক গিলক্রিস্ট-এর মতে, আন্তর্জাতিক আইন হল ‘আধা-আইন-আধা-নৈতিকতা’ (International law is half law, half morality)।

আবার পোলক-এর অভিমত বিশ্লেষণ করে বলা যায়, আন্তর্জাতিক আইন হল অসম্পূর্ণভাবে সংগঠিত এক সমাজের জন্য এমন কতকগুলি প্রথার সমষ্টি, যা এখনও পুরোপুরি আইনের স্বরূপ অর্জন করতে পারেনি, তবে পূর্ণাঙ্গ আইনরূপে পরিগণিত হওয়ার পথে অগ্রসর হয়ে চলেছে (“International law is a body of customs and observances in a imperfectly organised society, which have not fully acquired the character of law, but which are on the way to become law”)। যাই হোক পরিশেষে বলা যায়, আন্তর্জাতিক আইনের নানাবিধ সীমাবদ্ধতা, ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও বর্তমানে একে আইনের পর্যায়ভুক্ত বলে চিহ্নিত করা যায়।

আরও পড়ুন – ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা

Leave a Comment