কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরার সমন্বয়কারী বহুল পরিচিত ট্রেন। এই ট্রেনটি মূলত ভারতের পূর্ব রেলওয়ে দ্বারা পরিচালিত হয়। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে হিমালয় পর্বতমালার অপরূপ দৃশ্য কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গের নামে ট্রেনটি নামাঙ্কিত করা হয়েছে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ট্রেনটি শিয়ালদহ থেকে নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত চালু হয়েছিল। বর্তমানে ট্রেনটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শিয়ালদহ এবং অসম রাজ্যের শিলচর এবং ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা আসা-যাওয়া করে থাকে। সমস্ত পথের মধ্যে শিয়ালদহ থেকে বদরপুর পর্যন্ত দৈনিক যাতায়াত করে, তারপর সপ্তাহে ৪ দিন আগরতলা ও ৩ দিন শিলচর যায়। এটি ত্রি-সাপ্তাহিক ভিত্তিতে ১৩১৭৫/১৩১৭৬ ট্রেন সংখ্যার সাথে পরিচালিত হচ্ছে।
ট্রেনটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ১১০ কিলোমিটারের সাথে রয়েছে আইসিএফ রেক। ট্রেনে মোট ২১টি কোচ রয়েছে। ১৭ জুন, ২০২৪ সোমবার ঈদুল আযাহার আনন্দে আপ্লুত মানুষজন। বাংলার কোনো প্রান্তে মুশলধারায় বৃষ্টি আর কোথাও ঝিরঝিরে বৃষ্টি। হঠাৎ আকাশ বিদীর্ণ হওয়া বিকট আওয়াজ নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ১০ কিমি দূরে নির্মলজোত নামক স্থানে। ঘড়ির কাঁটা তখন টিকটিক করে ছুঁয়েছে ঠিক সকাল সোয়া ৮.৫৫ মিনিটে। চারিদিকে আর্তনাদের সুর। স্তব্ধতা ভেঙে এক মুহূর্তে কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠেছিল দুর্ঘটনাস্থল। কাঞ্চনজঙ্ঘার পিছনে মালগাড়ির ধাক্কায় বিপর্যস্ত যাত্রীরা। ১টি এসি ২টিয়ার, ৪টি এসি ৩ টিয়ার, ৫টি সংরক্ষিত আসন, ৭টি শয়ন যান, ৪টি সাধারণ/অনারক্ষিত, ২টি বসারসহ লাগেজ রেক এবং গার্ড। উভয় ট্রেনটি বর্ধমান (ডব্লিউডিএম ৩এ) ডিজেল ইঞ্জিন দ্বারা শিয়ালদহ থেকে মালদা টাউন চালিত হয়। ট্রেনটি মালদা টাউন লোকোশেড ভিত্তিক (ডব্লিউডিএম ৩এ) ডিজেল ইঞ্জিনটি মালদা টাউন থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত যায় এবং এর বিপরীত দিকে আসে। ট্রেনটি শিলিগুড়ি (ডব্লিউডিপি-৪) ডিজেল ইঞ্জিনটি গুয়াহাটি থেকে শিলচর পর্যন্ত যায় এর বিপরীত দিকে আসে। ২ বার মোট অভিমুখ পরিবর্তন করে ট্রেনটি লামডিং জংশন, বদরপুর জংশন।
২০২৩ সালের ২ জুন ওড়িশার বালেশ্বরের বাহানগায় করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় ২৯৫ জনের মৃত্যু, ১২০০ জন যাত্রী আহতর মর্মান্তিক ছবি জ্বলজ্বল করছে সবার মনের অ্যালবামে। মাত্র এক বছর পনেরো দিনের মাথায় স্মৃতি ফিরল সোমবার উত্তরবঙ্গের রাঙাপানি স্টেশন সংলগ্ন নির্মলজোত গ্রামে। একইরকম দুর্ঘটনা এবার কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে ঘটল। আগরতলা থেকে শিয়ালদহের দিকে আসছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। সিগন্যাল লাল থাকায় নিজবাড়ি এবং রাঙাপানি স্টেশনের মাঝে নির্মলজোত এলাকায় দাঁড়িয়েছিল ট্রেনটি। তখন সেই লাইনেই সিগন্যাল না মেনেই ঢুকে পড়েছিল মালগাড়ি। সজোরে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে ধাক্কা মারে সেটি। খেলনা গাড়ির মতো মালগাড়ির উপরে উঠে পড়েছিল এক্সপ্রেসের পিছনের একাধিক বগি। লাইনচ্যুত হয় মালগাড়ি। ঘটনাস্থলে আগেই প্রাণ হারান মালগাড়ির চালক, অনিল কুমার, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের গার্ড আশিস দে, পার্সেল ভ্যানের কর্মী শঙ্কর মোহন দাস। এ ছাড়াও, ওইদিন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৯/১০ জন মানুষ ও আহত হন কয়েকশো মানুষ।
২০২৩-এ ঘটেছে অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার ও ওড়িশায় ভয়ংকর ট্রেন দুর্ঘটনা। বারংবার ঘটে যাওয়া ট্রেন দুর্ঘটনার মর্মান্তিক ছবির পুনঃপ্রকাশ ঘটল উত্তরবঙ্গের রাঙাপানি স্টেশন সংলগ্ন নির্মলজোত এলাকায়। দুর্ঘটনা ঘটে আর তদন্তে নামে সিবিআই। উঠে আসে রেলকর্মীর কর্তব্যে গাফিলতি এবং সিগন্যাল বিভ্রাটের কথা কিংবা যান্ত্রিক গোলযোগের কথা। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার নেপথ্যে সিগন্যাল বিভ্রাট দায়ী বলে রেল কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক অনুমান। রাঙাপানি থেকে চটের হাট, এই অংশের অটোমেটিক সিগন্যালিং সিস্টেম সোমবার ভোর পৌনে ৬টা থেকে (১৭ জুন) বিকল থাকায় তৈরি হয়েছিল সমস্যার জট। রবিবার (১৬ জুন) সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে আগরতলা থেকে নির্ধারিত সময়ে ছেড়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। সোমবার সকালে পৌঁছায় এনজেপিতে। সেখান থেকে শিয়ালদহের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল সকাল ৮টা ৩ মিনিটে। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মাঝে ট্রেনটি রাঙাপানি স্টেশন হয়ে নিজবাড়ি স্টেশনের দিকে খুব ধীর গতিতে এগোচ্ছিল। সিগন্যালিং সমস্যার কারণে নির্মলজোত এলাকায় সেটি থেমেছিল।
সেই কারণেই বোধহয় সিগন্যাল দেখতে পাননি মালগাড়ির চালক। যার ফলে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে থাকা লাইন বরাবর মালগাড়ি ঢুকে পড়েছিল। সাধারণত যে লাইনে এক্সপ্রেস ট্রেন চলে, সেই লাইনে মালগাড়ি চালানো হয় না। মালগাড়ি দাঁড় করিয়ে পাস করান এক্সপ্রেস। এক্ষেত্রে কাঞ্চনজঙ্ঘার এক্সপ্রেসের পিছনেই ছিল মালগাড়িটি। একই লাইনেই দুটি ট্রেন পাস করানোর পরিকল্পনা ছিল রেলের। তবে আগে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে শিয়ালদহের উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দিয়ে তারপর মালগাড়ি পাস করানোর কথা। সেই কারণেই মালগাড়িকে লাল সিগন্যাল দেওয়া হয়েছিল। রেল কর্তৃপক্ষের অনুমান মালগাড়ির চালক ওই সিগন্যাল দেখতে পাননি বা দেখেননি। ফলে একই লাইনে এসে পড়েছিল মালগাড়িটি। সজোরে ৮০ কিমি গতিতে ধাক্কা মারে সোজা লাইন বরাবর কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে। এক্ষেত্রে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন প্রকাশ্যে উঠে এসেছে-বর্তমানে যে-কোনো রেলইঞ্জিনে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা থাকে। ইঞ্জিনের সামনে নির্দিষ্ট কোনো দূরত্বে যদি কোনো ট্রেন বা অন্য কিছু থাকে তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই
ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়বে একে ‘কবজ’ বলা হয়। অনেকে মনে করছেন রবিবার মধ্যরাত থেকে রাঙাপানি চটের হাট মধ্যবর্তী অংশ স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থা বিকল ছিল। এই ধরনের পরিস্থিতিতে ‘ব্লক সেকশন’ এর মধ্যে ম্যানুয়াল সিগন্যালের মাধ্যমে ট্রেন চলাচল করানো হয়। এর পোশাকি নাম – (পি.এল.সি) পেপার লাইন ক্লিয়ার। নিয়ম অনুযায়ী ‘ব্লক সেকশনে’ একটি – ট্রেন থাকলে অন্য কোনো ট্রেনকে ওই লাইনে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। কিন্তু সেদিন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস রাঙাপানিতে পিএলসি পেয়ে খানিক এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘণ্টায় ৮০ কিমি বেগে চলতে থাকা মালগাড়ি এসে ধাক্কা মারে। কেউ কেউ মনে করেন সবুজ সংকেত পেয়ে মালগাড়ির চালক এগিয়েছেন। রেলের অন্য একটি সূত্র থেকে জানা যায় স্টেশন মাস্টার যে লিখিত ছাড়পত্রটি এ-৯১২ কাঞ্চনজঙ্ঘার চালককে দিয়েছিলেন সেই একই ছাড়পত্র মালগাড়ির চালককেও দেওয়া হয়েছিল। শুধু সিগন্যাল ত্রুটি নয়, স্টেশন ম্যানেজারের কর্তব্যে গাফিলতির কথা অস্বীকার করার নেই।
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনাস্থল নির্মলজোত এলাকা। ঈদুল আযাহারের নামাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিল তালেব ফজলু, আফজারা। হঠাৎ উচ্চস্বরে বিকট শব্দে কুরবানিকে কুরবান করেই ছুট লাগিয়েছিল ওরা। মালগাড়ির ইঞ্জিনের ওপর ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে দাঁড়িয়ে পড়েছে ট্রেনের পিছনের কামরা। চাক্ষুষ করে যেন সিনেমার কোনো ভয়ংকর দৃশ্য। সাতপাঁচ না ভেবে উদ্ধার কাজে প্রথমেই নেমে পড়ে ফজলুরা। ছুটে আসে আরও স্থানীয় মানুষেরা। খবর ছড়িয়ে পড়তেই ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল অ্যাম্বুলেন্স ও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা। কাঁধে কাঁধ এবং হাতে হাত রেখে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্থানীয়রা। ট্রেনের জানালা ভেঙে ভিতর থেকে উদ্ধার করে যাত্রী ও রেলকর্মীদের। খবর পেয়ে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের অফিসার ও কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছিলেন। রাজ্য পুলিশের পাশাপাশি আরপিএফ, এনডিআরএফ, বিএসএফ জওয়ানদের নামানো হয়েছিল দ্রুত উদ্ধারকাজ সম্পাদনের জন্য। আহতদের চিকিৎসার জন্য উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়। রেলের তরফ থেকে আহত ও নিহতদের অনুসন্ধান সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার জন্য হেল্পলাইন খোলা হয়েছিল।
দুর্ঘটনার খবরে মর্মাহত নিহত ও আহত পরিবারের প্রতি সমবেদনার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী, রেলমন্ত্রী আর্থিক ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করেছিলেন। ওইদিনই দুর্ঘটনাস্থলে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস, রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈয়ব, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মৃতদের পরিবার পিছু ২ লক্ষ টাকা, আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। রেল দফতর মৃতদের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। ত্রিপুরা সরকারও মৃতদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করেছিল। আকস্মিক দুর্ঘটনা হৃদয় বিদারক। বারংবার ঘটে যাওয়া ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান বহু মানুষ। প্রমাণিত হয় সিগন্যাল, গার্ড, স্টেশন ম্যানেজারের, চালকের গাফিলতির জন্যই ট্রেন দুর্ঘটনার কথা। কখনো-বা যান্ত্রিক গোলযোগের কারণেই শিরোনামে উঠে আসে ট্রেন দুর্ঘটনার কথা। শত শত মানুষের জীবনের যাত্রাপথ বিপদমুক্ত করতে প্রয়োজন রেলকর্তৃপক্ষের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং রেলকর্মীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো। তাহলেই হয়তো এমন সব ভয়ংকর দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হবে না মানুষজনকে। মর্মান্তিক পরিস্থিতির মাঝে দাঁড়িয়ে স্বজন হারানোর বেদনায় বিহ্বল হতে হবে না। যাত্রাপথ শুভ হবে। রেলকর্তৃপক্ষের প্রতি ভরসা বাড়বে জনতার।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর