চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার পরিচয় দাও

চিনের ম্যান্ডারিন
সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে বিচার করলে চিন কেবল প্রাচীনই নয়, বৃহৎ-ও বটে। চিন নামটির উদ্ভব ঘটেছে চৌ বংশের এক করদ রাজ্য চিন থেকে। এই রাজ্য গঠিত ছিল কান-সু এবং সেন-সি জেলা নিয়ে। চিন-কুয়ো নামে পরিচিত এই রাজ্য ক্রমে আশপাশের বিভিন্ন রাজ্য জয় করে সমগ্র দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে। বাইরের যেসকল দেশের সঙ্গে চিন- কুয়ো-র যোগাযোগ ছিল তারা প্রত্যেকেই চিন-কুয়ো-কে সমগ্র চিনদেশ বলে ভাবতে শুরু করে। চিন রাজবংশের সময়কালেই চিন নাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভারত, গ্রিস, রোম চিন নামটির সঙ্গে পরিচিত হয়।
চিনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজবংশগুলির স্থান ছিল বেশ উঁচুতে। এখানে সম্রাটের ঐশ্বরিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করা হত। চিনে রাজাকে বলা হত স্বর্গপুত্র বা Son of Heaven. প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সম্রাট এবং গ্রাম বা শহরের শাসনব্যবস্থায় আঞ্চলিক শাসকদের মধ্যবর্তী স্থানে এক ধরনের সরকারি কর্মচারী শ্রেণির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়- এদের বলা হত ম্যান্ডারিন (Mandarin)। জানা যায়, বিংশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত চিনে ম্যান্ডারিনদের অস্তিত্ব ছিল।
ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার সূচনা
এক সুপ্রাচীন আদর্শের প্রকৃত পরিণতি হিসেবে চিনের বিভিন্ন বিভাগের শাসকের পদগুলিতে সুশিক্ষিত পণ্ডিতগণ বা ম্যান্ডারিনদের নিয়োগের প্রথাটি গড়ে উঠেছিল চৌ বংশের (খ্রিস্টপূর্ব ১১২২ ২৫৫ অব্দ) রাজাদের রাজত্বকালে। পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজবংশের আমলে এর মধ্যে কিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। যেমন- তাং বংশের (৬১৮ – ৯০৭ খ্রিস্টাব্দ) আমলে চিনের পদস্থ সরকারি কর্মচারীদের কাঠামোগত বিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। এই আমলে ইতিপূর্বে প্রচলিত Nine Rank System বা নয় স্তরীয় ব্যবস্থা বাতিল করে নতুন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা গঠন করা হয়। বলাবাহুল্য, এই ব্যবস্থায় ম্যান্ডারিন পদটি যথার্থ রূপ লাভ করে। চিনে মাঞ্জু রাজবংশের (১৬৪৪ ১৯১১/১৯১২ খ্রিস্টাব্দ) শাসনকালে প্রদেশ থেকে জেলাস্তর পর্যন্ত প্রশাসনিক বিভাগগুলিতে ম্যান্ডারিন নামক আমলাতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী প্রশাসনিক ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল।
ম্যান্ডারিন শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ
ম্যান্ডারিন হল বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পন্ডিত। ইংরেজি ম্যান্ডারিন (Mandarin) শব্দটি এসেছে পোর্তুগিজ ম্যান্ডারিম (Mandarim) শব্দটি থেকে। এই শব্দটি পোর্তুগিজরা মালয়ীদের (মালয়েশিয়ার অধিবাসী) কাছ থেকে গ্রহণ করেছিল বলে অনেকে মনে করেন। তাছাড়া এও মনে করা হয় যে, মন্ত্রিণ শব্দ থেকে মালয়ীরা এই শব্দটি গ্রহণ করেছিল। বিশিষ্ট মালয়েশিয়ান অধ্যাপক উংকু আবদুল আজিজ (Ungku Abdul Aziz)-এর মতানুসারে, মালাক্কায় বসবাসকারী পোর্তুগিজগণ চিনের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে দেখা করার সময় তাদের মেন্তেরিন (Menterin) বলে অভিহিত করত।
ম্যান্ডারিনদের যোগ্যতা
চিনের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারি কর্মচারী অর্থাৎ ম্যান্ডারিনদের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুতপক্ষে একজন ম্যান্ডারিনের শাসনতান্ত্রিক বিষয় সম্পর্কে যত না জানতে হত, তার থেকে বেশি ধ্রুপদি চিনা ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞানলাভ ছিল আবশ্যিক। চিনের প্রতিভাধর ও সুদক্ষ কর্মচারী অর্থাৎ ম্যান্ডারিনদের বিশেষ কিছু যোগ্যতা থাকতে হত। যেমন-
(1) শিক্ষাগত যোগ্যতা
জন্ম, বংশপরিচয় ও সম্পত্তির পরিবর্তে ম্যান্ডারিন হতে গেলে থাকতে হত উচ্চমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা। কনফুসীয় আদর্শ সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের পাশাপাশি সাহিত্য, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়েও জ্ঞান থাকা ছিল আবশ্যিক।
(2) প্রশাসনিক দক্ষতা
ম্যান্ডারিনদের প্রশাসনিক কাজে দক্ষ হতে হত। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে এই সকল দক্ষতা যাচাইয়ের ব্যবস্থা ছিল। কারণ- তাদের দক্ষতার উপরেই নির্ভর করত সরকারের স্থায়িত্ব ও খ্যাতি।
(3) চিনা ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা
ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীদের চিনের অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান থাকতে হত। তারা চিনা ঐতিহ্যের বিভিন্ন বিষয়ে পণ্ডিত হতেন।
(4) রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা
ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীর অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতাকে প্রাধান্য দেওয়া হত। যাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থাকত তারা বিশেষ গুরুত্ব পেতেন। চিনের ম্যান্ডারিনদের বিশেষজ্ঞ হওয়ার পরিবর্তে একজন পন্ডিত ব্যক্তি হওয়াই ছিল কাম্য। সমাজে রাজার পরবর্তী স্তরে তাদের বিশেষ মর্যাদা ছিল। সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে তারাও সম্রাটের সঙ্গে স্বর্গীয় অনুশাসন (তিয়েন মিং) লাভের অংশীদার ছিলেন।
ম্যান্ডারিনদের নির্বাচন ও নিয়োগ
শিক্ষিত ও চরিত্রবান ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে ম্যান্ডারিন নির্বাচন করা হত। প্রথমদিকে চিনা সম্রাটদের আত্মীয়-পরিচিতরা রাজকর্মচারী পদে নিযুক্ত হতেন। পরবর্তী পর্যায়ে কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার সূচনা হয়। পরীক্ষার্থীদের কনফুসীয় নীতিধর্মের আদর্শ সম্পর্কিত জ্ঞান যাচাইয়ের পাশাপাশি রাজা-প্রজার সম্বন্ধ, সামাজিক ও পারিবারিক সদাচার, চিরাচরিত ধর্মানুষ্ঠান বিষয়ে জ্ঞান ও রাজকার্য সম্পাদনের দক্ষতাও নিরূপণ করা হত। পরিশেষে পরীক্ষায় উপযুক্ত গুণসম্পন্ন প্রার্থীদের তাদের গুণগতমান অনুযায়ী কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক বা স্থানীয় অঞ্চলে নিয়োগ করা হত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তাং রাজবংশের সময়কালে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। এই বিদ্যালয়গুলি থেকে মেধাবী ছাত্ররা লেখাপড়া করে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন সরকারি চাকুরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারতেন। সং আমল থেকে সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা বেশ উৎকর্ষতা লাভ করতে থাকে। পরবর্তীতে মিং রাজবংশের আমলে ম্যান্ডারিন ব্যবস্থা তার পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং এসময় থেকে ম্যান্ডারিনদের নিয়োগের পরীক্ষা তিনটি পর্যায়ে সম্পন্ন হতে থাকে।
ম্যান্ডারিনদের সামাজিক সম্মান
ম্যান্ডারিনদের জীবনযাত্রার মান ছিল সর্বসাধারণের ঊর্ধ্বে। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল পরিবারের লক্ষ্য ছিল তাদের পরিবারের সন্তানদের ম্যান্ডারিনরূপে সরকারি পদে প্রতিষ্ঠিত করা। আসলে ম্যান্ডারিনগণ ছিলেন আধুনিককালের কর্মচারী সম্প্রদায় বা আমলাতন্ত্রের (Bureaucracy) মতো। প্রসঙ্গত বলা যায়, চিনা সমাজে উচ্চস্তরের ম্যান্ডারিনরা যথেষ্ট সামাজিক সম্মানের অধিকারী ছিলেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, চিনের চিৎ বংশের (Qing Dynasty, ১৬৪৪-১৯১১/১৯১২ খ্রি.) আমলে রাজপরিবার এবং প্রধানমন্ত্রীর পরেই ছিল এদের স্থান।
ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার বিভিন্ন বিভাগ
চৌ বংশের সূচনাকালে চৌ লি (Zhou Li) নামে একটি গ্রন্থ রচিত হয়। অনেকে বলেন এই গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন চৌ-কুং, তবে অবশ্যই বিষয়টি বিতর্কিত। উক্ত গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, চৌ রাজাদের রাজত্বকালে সমগ্র প্রশাসনিক ক্ষেত্র ছয়টি ম্যান্ডারিন বা পণ্ডিত পরিচালিত বিভাগ বা বোর্ড (Six Boards) -এ বিভক্ত ছিল। এগুলি হল-
(1) স্বর্গ বিভাগ (Mandarin of Heaven)
এই বিভাগের কাজ ছিল সম্রাটের খাদ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ-সহ প্রশাসনসমূহের তত্ত্বাবধান করা।
(2) পৃথিবী বিভাগ (Mandarin of Earth)
জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম পরিচালিত হত পৃথিবী বিভাগে। এই দফতরের অপর একটি কাজ ছিল অবিবাহিত যুবক-যুবতীদের বিবাহের ব্যবস্থা করা।
(3) বসন্ত বিভাগ (Mandarin of Spring)
এই বিভাগের উপর ধর্মানুষ্ঠানের ভার ছিল। তারা বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন পূজাপার্বণের বিষয়ে দায়িত্ব পালন করতেন।
(4) গ্রীষ্ম বিভাগ (Mandarin of Summer)
এটি ছিল প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধ বিষয়ক বোর্ড। এদের কাজ ছিল সৈন্য সংগ্রহ করা, যুদ্ধের সাজসজ্জা, অস্ত্রশস্ত্রের জোগান দেওয়া ইত্যাদি।
(5) শরৎ বিভাগ (Mandarin of Autumn)
ন্যায়বিচার ও দন্ডের বিধান করাই ছিল এই বিভাগের অন্যতম কাজ।
(6) শীত বিভাগ (Mandarin of Winter)
শীত বিভাগের কাজ ছিল বিভিন্ন রাস্তা ও সেতু নির্মাণের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিসাধন করা। চিনের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ম্যান্ডারিনদের বিভিন্ন বিভাগের নাম ও কার্যাবলির প্রতি দৃষ্টি রাখলে সহজেই চিনা সংস্কৃতির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। বিভিন্ন ঋতু, পৃথিবী, স্বর্গ- এইসকল নানান প্রাকৃতিক বন্ধু ও অবস্থার সঙ্গে মানুষের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং মানুষকে প্রকৃতির বিধান মেনে চলতে হয় বলে চিনারা বিশ্বাস করতেন।
ম্যান্ডারিনদের পদমর্যাদার স্তর ও পোশাক-পরিচ্ছদ
চিনের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পদমর্যাদা অনুসারে ম্যান্ডারিনদের দুটি স্তর ছিল। যথা-
(1) উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিন
চিনের সম্রাটের প্রধানমন্ত্রীর সমগোত্রীয়রা ছিলেন সর্বোচ্চ স্তরের ম্যান্ডারিন। বিভিন্ন প্রদেশের শাসক ও গভর্নর পদেও ম্যান্ডারিনরা নিযুক্ত হতেন।
(2) সাধারণ ম্যান্ডারিন
পরবর্তী পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন স্তরে ম্যান্ডারিনগণ নিযুক্ত হতেন। তারা উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিনদের অধীনে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতেন।
ম্যান্ডারিনদের পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, তারা গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা কোর্টজাতীয় পোশাক পরিধান করতেন, যা সম্ভবত সিল্ক দিয়ে তৈরি হত। তারা বহু মূল্যবান অলংকার সংবলিত পোশাক পরতেন। উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিনগণ পদ্মরাগমণিযুক্ত টুপি পরতেন। প্রথম শ্রেণির ম্যান্ডারিনদের পোশাকে সারস পাখির প্রতিকৃতি আঁকা থাকত। অন্যদিকে, দ্বিতীয় শ্রেণির ম্যান্ডারিনদের পোশাকে সোনালি লেজঝোলা পাখির চিহ্ন লক্ষণীয়। এ ছাড়া পরবর্তী স্তরভুক্ত ম্যান্ডারিনগণের পোশাকে আঁকা থাকত বিভিন্ন পশুপাখির প্রতিকৃতি। একেবারে সাধারণ ও নিম্নশ্রেণিভুক্ত ম্যান্ডারিনরা সোনা, রূপো, প্রবাল প্রভৃতি দ্বারা নির্মিত টুপি ব্যবহার করতেন। ম্যান্ডারিনদের পদমর্যাদা প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়- তারা এক বিশেষ ধরনের পালকিতে যাতায়াত করতেন এবং পালকি- বাহকদের সংখ্যা তাদের মর্যাদার ক্রম অনুসারে কম বা বেশি হত।
ম্যান্ডারিনদের পদচ্যুতি
ম্যান্ডারিনদের দীর্ঘকাল একই স্থানে না রেখে অন্যত্র বদলিও করা হত। বস্তুতপক্ষে ম্যান্ডারিনদের মধ্যে যাতে কোনোরূপ আঞ্চলিক স্বার্থ গড়ে উঠতে না পারে তার জন্য আইনের দ্বারা তাদের অনেকসময়ই নিজেদের এলাকার বাইরে নিয়োগ করা হত। ফলস্বরূপ, সাম্রাজ্যের স্বার্থবিরোধী কোনোরকম কার্যকলাপে তারা লিপ্ত হতে পারতেন না। তাছাড়া সম্রাটের বিরাগভাজন হলে বা কর্তব্যকর্মে অবহেলা করলে অথবা নীতিবিরুদ্ধ কোনও কাজে লিপ্ত হলে সম্রাট ম্যান্ডারিনদের পদচ্যুত করার অধিকারী ছিলেন।
ম্যান্ডারিনদের কার্যাবলি
চিনের কেন্দ্রীয় সরকারের মুখ্য সচিবালয়ের অধীনে থাকা ম্যান্ডারিনদের একাধিক কাজকর্ম সম্পাদন করতে হত, যেমন-
(1) প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন
প্রশাসনের যাবতীয় দায়িত্ব, এমনকি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যাবতীয় নির্দেশ ম্যান্ডারিনদের বেশ সতর্কতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হত। বিভিন্ন স্তরে বিন্যস্ত ম্যান্ডারিনগণ আঞ্চলিক প্রশাসনে যুক্ত থেকে কর আদায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার আয়োজন করা, বাণিজ্যিক শুল্ক আদায়ের মতো নানাবিধ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করত।
(2) রাজাকে সহায়তা দান: সর্বোচ্চ স্তরভুক্ত ম্যান্ডারিনরা রাজার প্রধানমন্ত্রীর সমগোত্রীয় হওয়ায় প্রত্যক্ষভাবে তারা রাজাকে বিভিন্ন কাজে সহায়তা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করতে পারতেন। ম্যান্ডারিনদের পরামর্শ ও সাহায্য নিয়েই সাধারণত সম্রাট দেশশাসন করতেন। অবশ্য এই পরামর্শ মানা বা না মানা ছিল সম্পূর্ণ রাজার ইচ্ছাধীন।
(3) যোগসূত্র স্থাপন
ম্যান্ডারিনগণ চিনের সর্বোচ্চ শাসক ও আঞ্চলিক প্রশাসনের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন। তাদের মাধ্যমেই সর্বোচ্চ শাসক বা রাজার নির্দেশ, শাসনবিষয়ক যে-কোনো ঘোষণা ক্রমান্বয়ে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত পৌঁছোেত।
(4) শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষা
মধ্য ও নিম্নপদস্থ ম্যান্ডারিনরা প্রদেশ বা স্থানীয় অঞ্চলগুলির শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকতেন। এর পাশাপাশি তারা সেনাবাহিনীর সাহায্যে দেশের নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের ক্ষেত্রেও ম্যান্ডারিনদের ভূমিকা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
(5) রাজস্ব সংগ্রহ
ম্যান্ডারিনদের অন্যতম কাজ ছিল রাজস্ব সংগ্রহের তদারকি করা। চৌ রাজাদের আমলে গ্রামের সমাহার বা সিয়েন (Hsien)-এর ম্যান্ডারিন শাসক কৌশল এবং অনুরোধ-উপরোধের মাধ্যমেই রাজস্ব আদায় করতেন। সেখানে বলপ্রয়োগের কোনও নিয়ম ছিল না।
(6) অন্যান্য কাজ
এ ছাড়াও ম্যান্ডারিনরা দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ে তদারকি করতেন। বৈদেশিক সম্পর্ক, আইন, বিচার ইত্যাদি বিষয়গুলির ক্ষেত্রেও ম্যান্ডারিনরা যুক্ত থাকতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভালো কাজের জন্য ম্যান্ডারিনদের পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল।
ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতি
চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার নানান ভালো দিক থাকলেও এর বেশকিছু ত্রুটিবিচ্যুতিও পরিলক্ষিত হয়।
(1) প্রশাসনিক অগ্রগতি ব্যাহত
অনেকেই মনে করেন যে, চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থা পরবর্তীকালে তার গতি হারিয়ে ফেলেছিল- ফলস্বরূপ প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এক স্থবিরতার সৃষ্টি হয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রশাসনিক সংস্কার সাধিত হয়নি।
(2) রাজার সঙ্গে সংঘাত
ম্যান্ডারিনদের ক্ষমতাবৃদ্ধির বিষয়টি চিনা সম্রাটের সঙ্গে তাদের সংঘাত ও সন্দেহের এক বাতাবরণ তৈরি করেছিল। এই পণ্ডিত রাজকর্মচারীগণ রাজার স্বৈরাচারী আচরণের ভয়ে ভীত থাকতেন। অন্যদিকে আবার সম্রাটও সদাই ম্যান্ডারিনদের ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা করতেন এবং তাদের ক্ষমতা খর্ব করতে সচেষ্ট হতেন। এই সংঘাত-সন্দেহের বিষয়টিই প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলেছিল।
(3) গ্রামের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা
ম্যান্ডারিনরা শিক্ষাদীক্ষা ও সামাজিক সম্মানে সমাজের উচ্চস্থানে অবস্থান করতেন। ফলে তাদের সঙ্গে গ্রামের মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এইভাবে সাধারণ মানুষের চাহিদা এবং অভাব-অভিযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পূরণ হয়নি।
(4) নিয়োগ ব্যবস্থার ত্রুটি
ম্যান্ডারিন নিয়োগের ব্যবস্থাও ছিল যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ। চিনা সমাজের এক বৃহৎ অংশের মানুষ ম্যান্ডারিনরূপে নিযুক্ত হওয়া থেকে বঞ্চিত ছিল।
ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার গুরুত্ব
তবে সমালোচনা বা ত্রুটিবিচ্যুতি যাই থাকুক না কেন ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার গুরুত্বকে কোনোভাবে অস্বীকার করা যায় না।
(1) যোগসূত্র রক্ষাকারী
চিনা সম্রাটের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসকদের যোগসূত্র রক্ষাকারীরূপে ম্যান্ডারিনদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মাধ্যমে সম্রাটের নির্দেশ ও ঘোষণা দ্রুত জনগণের কাছে পৌঁছে যেত। সর্বোপরি প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত এক ধারাবাহিকতা বজায় ছিল।
(2) সুদক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা
ম্যান্ডারিনদের কঠোর পরিশ্রম, পাণ্ডিত্য ও দক্ষতার ফলে চিনে এক উন্নত গতিশীল প্রশাসনিক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। বস্তুতপক্ষে ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার মাধ্যমে চিনে যে আমলাশ্রেণির সৃষ্টি হয়েছিল, তাদের কর্মপ্রচেষ্টায় চিনা রাজবংশ প্রায় ১৩০০ বছর অস্তিত্ব বজায় রাখতে সমর্থ হয়।
শাসন পরিচালনার দায়িত্বপালনের পাশাপাশি ম্যান্ডারিনগণ দেশের নিরাপত্তা, ব্যাবসাবাণিজ্য ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম করায় প্রশাসনে উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়।
(3) নিরাপত্তা প্রদান
ম্যান্ডারিনরা প্রদেশগুলির শাসনভার গ্রহণ করে এবং একাধিক বৈদেশিক আক্রমণকে প্রতিহত করে চিনকে সুরক্ষা প্রদান করেছিলেন।
(4) জেন্ট্রি সম্প্রদায়ের উত্থানে সহায়তা
ম্যান্ডারিনরা চিনে বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। ম্যান্ডারিনদের সামাজিক পদমর্যাদা ও বংশগত আভিজাত্য থেকে পরবর্তীকালে চিনে জেন্ডি (Gentry) নামে এক নতুন সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল।
ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার অবসান
চিনে বিভিন্ন রাজবংশ ও সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ঘটলেও সুশিক্ষিত ও পণ্ডিত রাজকর্মচারী অর্থাৎ ম্যান্ডারিনদের নিয়ে গঠিত আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব টিকেছিল সুদীর্ঘকাল ধরে। ক্রমশ এই ব্যবস্থার অবসান ঘটে।
(1) গ্র্যান্ড কাউন্সিল গঠন ও ম্যান্ডারিনদের ক্ষমতা হ্রাস
১৩৮০ খ্রিস্টাব্দে চিনের জনৈক মিং সম্রাট প্রধানমন্ত্রীর দফতর তুলে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সচিবালয় বা নেই-কো। ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই সচিবালয় ছিল চিন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। অবশ্য চিং সম্রাট কাং-শির আমলে সচিবালয়ের রাজনৈতিক গুরুত্ব খানিকটা কমে গিয়েছিল। এই সময়কালেই (১৭২৯ খ্রি.) Grand Council বা মহাপরিষদ গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সচিবালয়ের গুরুত্ব একেবারে হ্রাস পায়। এমনকি এসময় ম্যান্ডারিনদের দায়দায়িত্ব ও ক্ষমতাও অনেকাংশে হ্রাস পেতে থাকে।
(2) জেন্ট্রি সম্প্রদায়ের উদ্ভব
চিনের বিশিষ্ট সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত ম্যান্ডারিনদের মধ্য থেকে পরবর্তীকালে চিনে জেস্ট্রি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল। এই জেস্ট্রিরাই ছিলেন প্রকৃত অর্থে চিনের শাসকশ্রেণি।
(3) ম্যান্ডারিন ব্যবস্থায় দুর্নীতি বৃদ্ধি ও জনগণের অসন্তোষ
চিনে দুর্বল মাঞ্জু (চিং বা কিং) বংশের রাজাদের আমলে ম্যান্ডারিন ব্যবস্থায় দুর্নীতি প্রবল আকার ধারণ করে। ম্যান্ডারিনদের অনেকেই স্থানীয় শাসক বা ভূস্বামী হয়ে জমি ভোগদখল, কেউবা আবার রাজস্ব আদায়ে কারচুপি করে অর্থ আত্মসাৎ করত। এমনকি এসময় ম্যান্ডারিনদের শোষণ ও অত্যাচারের জন্য জনগণ তাদের ঘৃণা করত ও তাদের ভয়ে ভীত থাকত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেসময় চিনে বিশেষত দক্ষিণ চিনে একটি প্রবাদ খুব প্রচলিত ছিল, তা হল-জনগণ ম্যান্ডারিনদের ভয়ে সন্ত্রস্ত, ম্যান্ডারিনরা বিদেশি শয়তানের ভয়ে সন্ত্রস্ত, আবার বিদেশি শয়তানরা জনগণের ভয়ে সন্ত্রস্ত।
(4) আধুনিক আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা ও ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার অবসান
চিনে উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় প্রভাবে আধুনিক আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা হয়। ইতিমধ্যে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাধারার প্রভাবে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে চিনে ম্যান্ডারিনদের নিয়োগ সংক্রান্ত পরীক্ষাব্যবস্থার অবসান সূচিত হয়। অতঃপর ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে চিনে মাঞ্জু রাজবংশের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ম্যান্ডারিন ব্যবস্থারও অবসান ঘটে এবং গড়ে ওঠে আধুনিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর