ভারতের দেশপ্রেমের ঐতিহ্য – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

বঙ্কিমচন্দ্র একবার ‘বঙ্গদর্শন’-এর পাতায় লিখেছিলেন দেশ কেবল ‘মৃন্ময়’ মূর্তি নয়, দেশ হল ‘চিন্ময়’ মূর্তি। নিজের দেশ সম্পর্কে এর চেয়ে – খাঁটি সত্য-উপলব্ধি বোধহয় আর কিছুই হয় না।
এ দেশে সাংস্কৃতিক সংঘর্ষ ও সমন্বয়ের ধারাটি অনেক প্রাচীন। -আর্য-অনার্য-শক-হুন-পাঠান কিংবা মুঘল কোনো জাতিই এখানকার মাটির স্পর্শে এসে তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারেনি। কবির ভাষায় বলা যায়, ‘দেবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’। তাই এখানকার আলো-বাতাস আর মাটির মধ্যেই এমন এক জাদুস্পর্শ আছে, যা এদেশের সন্তান কিংবা অতিথিকেও পরম মমতায় আকৃষ্ট করে। এই অদৃশ্য সুতোর মায়াডোরে বাঁধা পড়ে সবাই। তাকেই আমরা বলি দেশপ্রেম।
দেশপ্রেমের সংহত ও সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছিল পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্বে। গানে-গল্পে-কবিতায় স্বাদেশিকতা ও স্বাজাত্যবোধের বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছিল এ সময়ে। স্বদেশমাতার মুক্তির স্বপ্নে প্রাণিত হয়ে শতসহস্র তরুণ-তরুণী আত্মদানে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। তাঁদের দেশপ্রেমের সাহস-নিষ্ঠা ও আদর্শে ভর করেই একদিন পরাধীন ভারত মুক্ত হয়েছিল। আর স্বাধীন ভারত তার সমন্বয়ী চরিত্রকে অটুট রেখে; সমগ্র বিশ্বের কাছে স্বাধীনতা-মৈত্রী এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সুদৃঢ় চরিত্রটিকেই মেলে ধরেছে।
দেশপ্রেম শুধু ভারতপ্রেমকেই চিহ্নিত করে না, বরং বৃহত্তর অর্থে সমগ্র মানবসমাজকে আপন করে নেওয়ার কথা বলে। যার মূলমন্ত্র ‘বসুবৈধ কুটুম্বকম’। দেশপ্রেমের মধ্যে যেখানে নিহিত আছে বিশ্বমৈত্রীর চিরন্তন বাণী।
মরু-নদী-পাহাড়-অরণ্য বেষ্টিত এই ভূভাগের মানুষের বিচিত্র সাংস্কৃতিক পরম্পরার স্মৃতি-ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের যে অনুভূতিকে আমরা হৃদয়ে ধারণ করি; তাই আমাদের দেশ ভারত। যাকে দেখে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/তোমার এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী’, বা দ্বিজেন্দ্রলালের সুরমূর্ছনায়, ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ/স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো’ কিংবা বিবেকানন্দের পৌরুষদৃপ্ত বিশ্বাসে, ‘হে ভারত ভুলিও না; দরিদ্র ভারতবাসী, মূর্খ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী তোমার ভাই।’
কাকে বলি আমরা দেশ? আমার পাড়া, এলাকা নাকি আমার রাজ্য কিংবা বৃহত্তর ভারত ভূখন্ড; কোন্টাকে দেশ বলে বিশ্বাস করি আমরা! আসলে দেশ কোনো ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ ভূভাগ মাত্র নয়। কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ, নদনদী, বনভূমি, সেখানকার মানুষজন, তাদের ভাষা-সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস সব কিছু নিয়েই দেশের সামগ্রিক ধারণাটি গড়ে ওঠে। তাই প্রতিটি ভারতবাসী তার স্বদেশপ্রেমের গভীরে এই স্বাতন্ত্র্য ঐতিহ্যকেই ধারণ ও বহন করে চলে।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর