ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা ব্যাখ্যা করো

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা ব্যাখ্যা করো

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা ব্যাখ্যা করো
ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা ব্যাখ্যা করো

ইউরোপে যখন নবজাগরণের ঢেউ আছড়ে পড়ে, সেই সময় যেসকল চিন্তাবিদদের হাত ধরে রাষ্ট্রচিন্তার জগতে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে, তাঁদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন কূটনীতিজ্ঞ, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ তথা বিশিষ্ট দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি। মধ্যযুগীয় ভাবনাচিন্তা ও ধর্মান্ধতাকে পরিহার করে তিনি আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার সূত্রপাত ঘটান। প্রাচীন রাষ্ট্রতাত্ত্বিক প্লেটো, অ্যারিস্টটল, পলিবিয়াস প্রমুখের মতবাদ ও সমকালীন ইটালির রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাকিয়াভেলি তাঁর রাষ্ট্রদর্শন গড়ে তোলেন। তিনি ‘আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক’, ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নিউটন’ প্রভৃতি নামেও সুপরিচিত। 

সংক্ষিপ্ত পরিচয়

ইটালির ফ্লোরেন্স শহরে ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নিকোলো ডি বার্নার্ডো ডেই ম্যাকিয়াভেলি (Niccolo di Bernardo dei Machiavelli)। তাঁর পিতা ছিলেন একজন অ্যাটর্নি। তিনি তাঁর পুত্রের জন্য যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শিক্ষা শেষে ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাকিয়াভেলি সরকারি চাকুরিতে নিযুক্ত হন এবং অল্পকালের মধ্যেই নিজ দক্ষতায় সচিব পদ লাভ করেন। ইতিমধ্যে ইটালির রাজনীতিতে আসে পরিবর্তন। ১৪২৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ফ্লোরেন্সে মেডিচি পরিবারের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চললেও, ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে এই বংশের শাসক পিয়েরো দ্য মেডিচি (Piero de’ Medici) ক্ষমতাচ্যুত হন। তখন সাভোনারোলা (Savonarola) ফ্লোরেন্সে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন, যা ১৫১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকে থাকে।

এই কালপর্বে ম্যাকিয়াভেলির দায়িত্ব যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। তিনি বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং সেই সকল দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষণ করে সেই পরিস্থিতিকে ফ্লোরেন্সের স্বার্থে কাজে লাগাতে প্রয়াসী হন। কিন্তু ১৫১২ খ্রিস্টাব্দে মেডিচি পরিবার পুনরায় ক্ষমতা দখল করলে ফ্লোরেন্সে প্রজাতান্ত্রিক সরকারের পতন হয়। সেই সময় ফ্লোরেন্স শহর থেকে ম্যাকিয়াভেলিকে নির্বাসিত করা হয় ও তিনি কারাবন্দি জীবন কাটাতে বাধ্য হন। তবে এই নির্বাসন তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। বাধ্যতামূলক রাজনৈতিক অবসর ম্যাকিয়াভেলিকে রাজনৈতিক সাহিত্যচর্চায় অনুপ্রাণিত করে তোলে।

ম্যাকিয়াভেলি রচিত গ্রন্থ

সাহিত্যিক হিসেবে ম্যাকিয়াভেলির বিভিন্ন রচনার কথা জানা যায়, যেমন- বেলফ্যাগর আর্চিদিয়াভোলো (Belfagor Arcidiavolo), দ্য ম্যানড্রেক বা ম্যানড্রাগোলা (Mandragola), ডিসকোর্স অন পিসা (Discourse on Pisa), দি আর্ট অফ ওয়ার (The Art of war), দ্য প্রিন্স (The Prince), ফ্লোরেনটাইন হিস্টোরিজ (Florentine Histories), দ্য ডিসকোর্সেস অন দ্য ফার্স্ট টেন বুকস অফ টাইটাস লিভিয়াস (The Discourses on the First Ten Books of Titus Livius, যা সংক্ষেপে দ্য ডিসকোর্সেস নামে পরিচিত) প্রভৃতি। তবে ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক ধারণা সম্পর্কে জানা যায় মূলত দ্য প্রিন্স ও দ্য ডিসকোর্সেস -এই দুটি গ্রন্থ থেকেই।

দ্য প্রিন্স ও দ্য ডিসাকার্সেস গ্রন্থ দুটির বৈশিষ্ট্য

  • ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রভাবনা সংবলিত দ্য প্রিন্স গ্রন্থের বিষয় নবীন রাজতন্ত্র। এক্ষেত্রে তিনি শাসকের শক্তি, স্বৈরাচার ও কঠোর নিয়ন্ত্রণের উপর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। অন্যদিকে দ্য ডিসকোর্সেস গ্রন্থের প্রধান আলোচ্য বিষয় প্রজাতান্ত্রিক সরকার। এক্ষেত্রে সরকারের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের পাশাপাশি নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য এবং সক্রিয় সহযোগিতাকে প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করার জন্য গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 
  • কোনও কোনও ব্যক্তি গ্রন্থ দুটির মধ্যে অসামঞ্জস্য ও বৈপরীত্য লক্ষ করলেও, গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে গ্রন্থ দুটি একে অপরের পরিপূরক। 
  • অনেকে মনে করেন যে, ম্যাকিয়াভেলি রাজপদ লাভের আশায় ‘দ্য প্রিন্স’ গ্রন্থটি লিখেছিলেন- যার বিষয়বস্তু হল রাষ্ট্রের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পর্কে শাসককে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান। কিন্তু শেষপর্যন্ত রাজপদ লাভ করতে না পারার ব্যর্থতা থেকে তিনি লেখেন ‘দ্য ডিসকোর্সেস’। এই গ্রন্থে তিনি রোমান প্রজাতন্ত্রকে আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে তুলে ধরেন এবং বলেন যে প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ইটালির সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব। 
  • আপাতদৃষ্টিতে গ্রন্থ দুটির বিষয়বস্তু পৃথক, কিন্তু উভয়ক্ষেত্রেই ম্যাকিয়াভেলি মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চালিত হয়েছিলেন। নবজাগরণ- প্রসূত শিক্ষা থেকেই তিনি ভরসা রেখেছিলেন মানুষের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা ও সামর্থ্যের উপর।

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তায় ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রভাব

মধ্যযুগ থেকে ইউরোপের আধুনিক যুগে রূপান্তরেরর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ইউরোপের নবজাগরণ-যার প্রাণকেন্দ্র ছিল ফ্লোরেন্স। আর এই ফ্লোরেন্সের মাটিতেই জন্ম নেন দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মননশীলতার বাস্তব উপাদান ছিল রেনেসাঁ-প্রসূত শিক্ষা। নবজাগরণকালে ইটালির সমৃদ্ধির প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন ম্যাকিয়াভেলি। সেই সময় নবজাগরণের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এবং শাসক লরেঞ্জো দ্য মেডিচির শাসনদক্ষতা ম্যাকিয়াভেলির মনে গড়ে তুলেছিল একক শাসনব্যবস্থার উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যের ধারণা, যার প্রভাব পড়েছিল তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বেও। তাছাড়া নবজাগরণের চিন্তাধারার দুটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য- যুক্তিবাদী চিন্তা এবং মানবতাবাদ -এই দুইয়েরই প্রতিফলন ঘটেছে ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তায়। আবার ধর্মীয় নীতি বা প্রবণতা থেকে মুক্ত হয়ে সাফল্যের উদ্দেশ্যে সচেষ্ট দৃঢ়চেতা মানুষের ক্ষমতাকে ম্যাকিয়াভেলি তাঁর তত্ত্বে যেভাবে তুলে ধরেছেন-তাও আদতে নবজাগরণেরই প্রত্যয়। কাজেই ম্যাকিয়াভেলি যে নবজাগরণের সন্তান ছিলেন, তা এককথায় অনস্বীকার্য।

ম্যাকিয়াভেলির আলোচনা পদ্ধতি

কঠোর বাস্তববোধ

ম্যাকিয়াভেলি তাঁর আলোচনায় সমসাময়িক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তদানীন্তন সমস্যাগুলির সমাধান নির্ণয়ে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে বিমূর্ত ভাববাদ নয়, কঠোর বাস্তববোধকে কাজে লাগানো হয়েছিল। ম্যাকিয়াভেলি মনে করেন যা হওয়া উচিত তার চেয়ে যা ঘটেছে তা বেশি মূল্যবান। তাঁর জীবনদর্শনেও ঈশ্বর ও ভাগ্যের মতো অধরা বিষয় স্থান পায়নি, তিনি মানুষের কার্যকলাপের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি

ম্যাকিয়াভেলি তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন।

ইতিহাস নির্ভরতা

ইতিহাসকে আশ্রয় করে ম্যাকিয়াভেলি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর রাষ্ট্রদর্শন। দ্য প্রিন্স গ্রন্থে তিনি রাষ্ট্রের শাসকদের ইতিহাসপাঠের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন প্রত্যেক শাসকের উচিত তাদের অতীতের বিখ্যাত শাসকদের কর্মপদ্ধতি, রণকৌশল, সফলতার কাহিনি ইত্যাদি জেনে রাষ্ট্র শাসন করা।

অ্যারিস্টটলের আরোহমূলক পদ্ধতির প্রভাব

গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের আরোহমূলক পদ্ধতিরও (বিশেষ থেকে সাধারণে পৌঁছোনোর পরিকল্পনা) প্রতিফলন ঘটেছে ম্যাকিয়াভেলির সিদ্ধান্ত ও সাধারণীকরণের রীতিতে। অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ম্যাকিয়াভেলি রাজনৈতিক প্রশ্ন ও সমস্যার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রাজনীতির প্রধান প্রয়োজন তথা উদ্দেশ্যবাদ এবং মূল লক্ষ্যকে বিচার করেছেন।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment