জাঁ বোদাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বের মূল্যায়ন করো

ত্রুটি
রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে বোঁদার অবদান বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। পল জ্যানেট (Paul Janet), গিয়াক প্রমুখ পণ্ডিতগণ রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে বোদার রক্ষণশীল মনোভাব, অস্পষ্ট ব্যাখ্যা, চিন্তার অসংগতি, বিভ্রান্তি ও সামঞ্জস্যহীনতা প্রভৃতি ত্রুটির উল্লেখ করেছেন।
(i) মধ্যযুগীয় মানসিকতা
বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তা ছিল মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার বেড়াজালে আবদ্ধ। তিনি রাজতন্ত্রকে আদর্শ ব্যবস্থা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি অ্যারিস্টটলের অনুকরণে তিন ভাগে সরকারের শ্রেণি বিভাজন করেছেন। এসব ক্ষেত্রে বোদাঁ কোনও মৌলিকত্বের পরিচয় দিতে পারেননি। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ স্যাবাইন (George Holland Sabine) ও ম্যাক্সি (Chester C Maxey) দুজনেই বোদার চিন্তাধারায় মধ্যপন্থী মানসিকতা লক্ষ করেছেন। নতুন ও পুরাতনের সংমিশ্রণ, অধিবিদ্যা ও বিজ্ঞানের সহাবস্থান, কঠোরতা ও উদারতার সহযোগ – এসবই ছিল তাঁর মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার প্রতিফলন।
(ii) স্ববিরোধী বক্তব্য
বোদাঁর বক্তব্যে স্ববিরোধিতার ছাপ স্পষ্ট। যেমন- তিনি অসাম্য ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। আবার তিনি বলেছেন সম্পত্তির সমানাধিকার রাষ্ট্রের পক্ষে ক্ষতিকারক। অন্যদিকে বোদাঁ গণতন্ত্রের প্রশংসা করলেও, রাজতন্ত্রকে আদর্শ ব্যবস্থা বলে উল্লেখ করেছেন, যাকে অনেকেই পরস্পরবিরোধী মন্তব্য বলেই মনে করেন।
(iii) সার্বভৌম ক্ষমতা ও সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধ
বোদাঁর রাষ্ট্রতত্ত্ব অনুযায়ী, সার্বভৌম ক্ষমতাই হল চূড়ান্ত ক্ষমতা। অথচ তিনিই আবার বলেছেন যে, সম্পত্তির অধিকার হল একপ্রকার পবিত্র অধিকার যাকে সার্বভৌম ক্ষমতাও স্পর্শ করতে পারে না।
(iv) ব্যক্তির ভূমিকা স্বীকৃত নয়
বোদাঁ তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে পরিবারের গুরুত্বকে তুলে ধরলেও ব্যক্তির ভূমিকাকে স্বীকার করেননি।
(v) সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে অস্পষ্টতা
সার্বভৌমিকতা সম্পর্কেও বোদাঁর তত্ত্বে অসংগতি দেখা যায়। তিনি একদিকে সার্বভৌম শক্তিকে আইনের উৎস হিসেবে অভিহিত করেছেন। আবার অন্যদিকে বলেছেন যে, কিছু কিছু আইন আছে যা পরিবর্তন করার ক্ষমতা সার্বভৌম শক্তির (রাজার) নেই।
গুরুত্ব
বোদাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় কিছু ত্রুটি থাকলেও ডানিং, গেটেল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে তাঁর অবদানকে অমূল্য সম্পদ বলে মনে করেন। ঐতিহাসিক গেটেলের মতে, বোদাঁর চিন্তাধারা সমকালীন ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের চিন্তাদর্শনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল।
(i) সার্বভৌমত্বের আদর্শ
বোদাঁ রাষ্ট্রের চূড়ান্ত সার্বভৌমত্বের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে আধুনিক সার্বভৌমত্বের ভিত্তি গড়ে তোলেন। তিনি সার্বভৌম ক্ষমতাকে রাষ্ট্রের চরম, চূড়ান্ত ও অপ্রতিহত ক্ষমতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে এটি ছিল এক নতুন সংযোজন। তাই ড. মুরে বোদাঁকে সার্বভৌমেত্বের ধারণার জনক বলে অভিহিত করেছেন। ম্যাক্সির মতে, “Bodin was the first to define it (Sovereignty) clearly and embody it in a Philosophy of Politics.”
(ii) ধর্মনিরপেক্ষতা
বোদাঁ তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভিত্তি রচনা করেন। তিনি মধ্যযুগীয় চিন্তার বেড়াজালে আবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ধর্মনিরপেক্ষ রাজশক্তি সৃষ্টির কথা বলেছেন।
(iii) আধুনিক ভাবধারা
বোদাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় আধুনিক ভাবধারার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। অ্যারিস্টটলের পর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা পদ্ধতি ও প্রকৃতিকে বোদাই সর্বপ্রথম বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির সাহায্যে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেন। গেটেল বলেছেন যে, বোদাঁ অনুশীলন ও পর্যবেক্ষণের সাহায্যে সমাজ এবং রাষ্ট্র সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন।
(iv) রাষ্ট্রচিন্তার দিকনির্দেশ
বোদাঁ তাঁর তত্ত্বে রাষ্ট্রচিন্তার পদ্ধতি বিষয়ে এক দিকনির্দেশ করেছেন। তিনি ছিলেন প্রথম রাষ্ট্রতাত্ত্বিক, যিনি ঐতিহাসিক পদ্ধতি এবং আইনি পদ্ধতির উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। ঐতিহাসিক পদ্ধতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, ইতিহাস শুধুমাত্র কোনও ব্যক্তি বা ঘটনার বর্ণনা নয়, ইতিহাস হল সমগ্র সমাজের ইতিহাস, যা কিনা ভৌগোলিক বা জলবায়ুর বিবরণও বিস্তারিতভাবে দেয়। এক্ষেত্রে কেউ কেউ মনে করেন, জাঁ বোদাঁ হলেন কার্ল মার্কসের (Karl Marx) পূর্বসূরি।
বস্তুতপক্ষে, অ্যারিস্টটলের পরে জাঁ বোদাঁই ছিলেন প্রথম, যিনি সমাজের বিভিন্ন বিষয়, যেমন- পরিবার, সরকারের শ্রেণিবিভাগ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, সাম্য, নাগরিকত্ব ইত্যাদিকে একত্রিত করে এক রাষ্ট্রতত্ত্ব নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছিলেন। বিশিষ্ট মার্কিন ঐতিহাসিক ডব্লু এ ডানিং (WA Dunning)-এর মতে, অ্যারিস্টটলের পরে যে রাষ্ট্রতত্ত্ব হারিয়ে গিয়েছিল, তাকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেন বোদা। তাই সবমিলিয়ে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে বোদাঁর রাষ্ট্রদর্শনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর