লেখাপড়ার অবসরে খেলা আর গল্পের বই – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

ছাত্রছাত্রীদের কাছে ‘লেখাপড়া’ হল এক বিশেষ সাধনার ব্যাপার। তাদের মন দিয়ে লেখাপড়া করতেই হয়।
লেখাপড়াই শিক্ষার্থীদের ধর্ম। ছাত্রদের হল ‘অধ্যয়নং তপঃ’। সাধকরা যেমন তপস্যা করেন ইষ্টলাভের আশায়, তেমনি ছাত্ররা তাদের অধীত বিদ্যাকে আয়ত্ত করতে তপস্যা করবে, এটাই কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু জিজ্ঞাসা হল, ছাত্রছাত্রীরা কি দিনরাত্তির কেবল পড়াশোনাতেই ডুবে থাকবে? তারা শুধু পড়াশোনার সাধনায় শরীরপাত করবে? এটি কি ঠিক?
আধুনিক শিক্ষাবিদরা কিন্তু এই মত পোষণ করেন না। তাঁরা মনে করেন, লেখাপড়া করে ছাত্ররা জ্ঞান অর্জন করে থাকে বটে, কিন্তু ছাত্রদের চারিত্রিক এবং শারীরিক বিকাশের জন্য শুধুমাত্র লেখাপড়া করাই যথেষ্ট নয়। শরীর ও মন যথাযথভাবে গঠিত না-হলে লেখাপড়ার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। তাই শরীর ও মনের ব্যায়াম দরকার।
লেখাপড়ার অবসরে শরীরচর্চা খুবই জরুরি। আর শরীরচর্চার জন্য দরকার খেলাধুলা। আমাদের শাস্ত্রেও আছে, ‘শরীরং আদ্যং খলু ধর্ম সাধনং’। খেলাধুলার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে শরীর। এইজন্য স্বামী বিবেকানন্দ ফুটবল খেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তা শুধু ফুটবল কেন, এইসঙ্গে ক্রিকেট, ভলিবল, হকি, টেনিস এবং ব্যাডমিন্টন ইত্যাদিও খেলা যেতে পারে। সাঁতার কাটার মধ্য দিয়েও শরীর তৈরি হয়। সুতরাং, লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত সাঁতারও কাটা যেতে পারে। শরীরকে সুস্থ রাখতে হলে এগুলি খুবই দরকার।
আমাদের শরীর গঠনের জন্য যেমন খেলাধুলা আবশ্যিক, তেমনি মানসিক বৃত্তিগুলির উৎকর্ষসাধনের জন্য গল্পের বই হল বিশেষ এবং উৎকৃষ্ট একটি উপাদান। তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছে গল্পের বইয়ের বিশেষ আকর্ষণ থাকা খুবই স্বাভাবিক। ওই বয়সে গল্পের বই পড়তে কে না ভালোবাসে? গল্পের বইয়ের মাধ্যমে পরিচিত হওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে। জানা যায়, মানুষে মানুষে সম্পর্ক এবং প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বিষয়গুলি। চেনা যায় আমাদের স্বদেশকে। জানা যায়, কাকে বলে কর্তব্যবোধ। সামাজিক প্রেক্ষিতে ভাই-বোন, মা-বাবা ইত্যাদি আপনজনকে আপন করে গভীরভাবে দেখতে পাওয়া যায় গল্পের বই পাঠ করলে।
মনের প্রসারে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর প্রমুখের গল্পগুলি প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যায়। এই গল্পগুলি আমাদের মনকে কেবল মোহিত করে না; গ্রামবাংলার বৃহত্তর জনসমাজ, গ্রামবাংলার প্রকৃতি, জনপদ, নদীলালিত পল্লিগ্রামকে চোখের সামনে মেলে ধরে। আমাদের মনের গভীরে এইসব দৃশ্য বিশেষভাবে আলোড়নের সৃষ্টি করে এবং সূক্ষ্ম মানসিক বৃত্তিগুলিকে জাগিয়ে তোলে এবং সমৃদ্ধ করে। বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’ আমাদের তরুণ মনে অ্যাডভেঞ্চারের ক্ষুধা জাগিয়ে উদ্বোধিত করে। অপরিচয়ের সঙ্গে পরিচয়ের, অজানার সঙ্গে জানার ও দূরের সঙ্গে নিকটের মেলবন্ধন তৈরি করে নানা ধরনের এবং নানা বিষয়ের গল্পের বই। তাই সবসময় কেবলমাত্র পাঠ্যসূচির লেখাপড়ার মধ্যে ডুবে থাকা ছাত্রসমাজের পক্ষে কখনোই কাম্য নয়।
লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে এবং অবসর সময়ে আমাদের অবশ্যই খেলাধুলোয় অংশগ্রহণ করে শরীরকে মজবুত করতে হবে, ভবিষ্যৎ জীবনে লড়াইয়ের উপযুক্ত করতে হবে এবং সেইসঙ্গে মানসিক বৃত্তিগুলিকে শক্তপোক্ত করার জন্য পড়তে হবে নানা ধরনের গল্পের বই। নতুবা শুধুই পড়াশোনা আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে পূর্ণ করে তুলতে পারবে না।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর