শহর ও গ্রামে পাঠাগার – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

“গ্রন্থের আগার ‘গ্রন্থাগার’, জ্ঞানভাণ্ডার যারে কয়,
দেশ-বিদেশের জ্ঞানসম্পদ, চুপিসারে কথা কয়।”
‘লাইব্রেরি’ বা গ্রন্থাগার শিক্ষিত মানুষের বিশেষ করে জ্ঞানপিপাসু মানুষের আশ্রয়স্থল। গ্রন্থাগার সভ্যতার দিকচিহ্ন, অতীত ও বর্তমানের সংগমস্থল। মানুষের জ্ঞানরাশি স্থান পায় গ্রন্থে। সেইসকল গ্রন্থ সঞ্চিত হয়ে গড়ে ওঠে গ্রন্থাগার।
প্রাচীন যুগের তক্ষশীলা, নালন্দা, মথুরা, বিক্রমশীলা, বারাণসী প্রভৃতি বিদ্যাকেন্দ্রে গড়ে উঠেছিল এক-একটি পুথির সংগ্রহশালা। প্রাচীন ভারতে যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে পুথি সংগ্রহ করে রাখা হত, তাকে বলা হত ‘গ্রন্থকুঠি’। সে যুগের গ্রন্থাগার নানা নামে পরিচিত ছিল। যেমন, ‘ধর্মগঞ্জ’, ‘জ্ঞানভাণ্ডার’, ‘সরস্বতী ভান্ডার’। দক্ষিণ ভারতের তাঞ্জোরে এখনও আছে ‘সরস্বতী মহল’।
আধুনিক যুগে বিদ্যাশিক্ষার প্রসার ঘটেছে। এখন ছাপাখানার কল্যাণে বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেইসব গ্রন্থ ব্যক্তিগত ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা গ্রন্থাগারে সংকলিত ও সংগৃহীত হয়। সেইসব অমূল্য সংগ্রহ মানুষের জ্ঞান ও বিদ্যাচর্চার প্রধান অবলম্বন।
গ্রন্থাগারের বিস্ময়কর ভূমিকাটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া-পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাদেশের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।” সত্যই, যুগ যুগ ধরে জ্ঞান বন্দি হয়ে আছে, চিন্তা আবদ্ধ হয়ে আছে এই গ্রন্থাগারে। যুগ-যুগান্তরের মানুষের কথা পুথির পাতায় নিঃশব্দ নীরবতার মধ্যে বাঁধা পড়ে আছে।
একালের শিক্ষার্থী ও গবেষকদের কাছে পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা কতখানি, তা এরপর আর নতুন করে ব্যাখ্যা করবার দরকার হয় না। ছোটো হলেও আমাদের প্রতিটি বিদ্যালয়ে রয়েছে ছোট্ট এক-একটি পাঠাগার। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নতমানের পাঠাগার একান্তভাবেই আবশ্যক। ইদানীং সরকারি উদ্যোগে প্রতিটি জেলা-শহর ও প্রধান প্রধান নগরগুলিতে বড়ো বড়ো লাইব্রেরি তৈরি করা হচ্ছে। এদিকে প্রাচীন গ্রন্থাগার হিসেবে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ ও ‘জাতীয় গ্রন্থাগার’-এর তুলনা মেলা ভার। দিল্লির ‘মহাফেজখানা’-য় প্রচুর প্রাচীন দলিল ও কাগজপত্র রক্ষিত রয়েছে। এগুলি আমাদের দেশের ইতিহাস লেখার কাজে খুবই জরুরি।
মনীষীদের নিজের নিজের সংগৃহীত গ্রন্থ থেকে অনেকসময় তাঁদের ব্যক্তিগত পাঠাগার তৈরি হয়ে থাকে। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিসংগ্রহ থেকেই গড়ে উঠেছে একটি পাঠাগার। বিদ্যাসাগর এবং আশুতোষের ব্যক্তিগত পাঠাগার জমা রয়েছে জাতীয় গ্রন্থাগারে। এইভাবে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ অনেক ব্যক্তিসংগ্রহ নিজের পরিষদ ভবনে ধরে রেখেছে। সব বই সকলের পক্ষে কেনা বা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। গ্রন্থাগার সেখানে ‘মুশকিল আসান’, জ্ঞানতৃষ্ণা মেটানোর নির্ভরযোগ্য স্থান। তাই এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। পরিশেষে বলতে হয়, পাঠাগার হল মানবসভ্যতার এক অত্যাশ্চর্য নির্মাণ। এমন জ্ঞানভান্ডার আর কোথাও নেই। পাঠকদের কাছে টানবার জন্য সে হাত বাড়িয়ে আছে। আমাদের শুধু যাওয়ার অপেক্ষা। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, “আমাদের দেশে হাসপাতালের চেয়ে পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। পাঠাগার মনকে জ্ঞানের আকারে আলোকিত করে সুস্থ করে তোলে। মানুষকে মানুষ করে তোলে।” তাই মানবজীবনে পাঠাগারের গুরুত্ব অপরিসীম।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর