টমাস হবসের রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো

টমাস হবসের রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো

টমাস হবসের রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো
টমাস হবসের রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো

সপ্তদশ শতকের একজন বিখ্যাত রাষ্ট্রদার্শনিক ছিলেন টমাস হবস (Thomas Hobbes, ১৫৮৮ ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দ)। ইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে ম্যাকিয়াভেলি, বোদা প্রমুখ মনীষীগণ যে নতুন নতুন চিন্তাধারার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে টমাস হবসের চিন্তাধারায় তা বিকশিত হয়েছিল। তিনি আধুনিক বৃহদায়তন রাষ্ট্রের বস্তুতান্ত্রিক ভিত্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। 

সংক্ষিপ্ত পরিচয়

১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের ম্যালমেসবেরি (Malmesbury) নামক স্থানে এক যাজক পরিবারে টমাস হবস জন্মগ্রহণ করেন। ছোটোবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। অধ্যয়ন করেন গ্রিক ও রোমান সাহিত্যও। ম্যালমেসবেরিতে প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ সম্পন্ন করার পর ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ২০ বছর বয়সে হবস অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। ওই বছরই উইলিয়ম ক্যাভেনডিস (2nd Earl of Devonshire)-এর গৃহশিক্ষক হিসেবে ইংল্যান্ডের ক্যাভেনডিস পরিবারে যোগদান করেন তিনি।

পরবর্তীকালে এই পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও শিক্ষক হিসেবে হবস নিযুক্ত হন ও আজীবন এই পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। ইটালি, ফ্রান্সের মতো নানা দেশে ভ্রমণের সময় তিনি ফ্রান্সিস বেকন (Francis Bacon), দেকার্তে (Rene Decartes), গ্যাসেন্ডি (Pierre Gassendi), গ্যালিলিও (Galileo Galilei) প্রমুখ বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদের সংস্পর্শে আসেন, যা তাঁর চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৬৪৭ থেকে ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে হবস ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ রাজা দ্বিতীয় চার্লসকে (Charles II) অঙ্কশাস্ত্র শেখান। জীবনের শেষ দিনগুলি অবশ্য তিনি চ্যাটসওয়ার্থ হাউস এস্টেটে ক্যাভেনডিস পরিবারেরই সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে ৯১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।

হবসের রাষ্ট্রচিন্তার ঐতিহাসিক পটভূমি

(i) স্পেনীয় আর্মাডার অভিযান

১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে টমাস হবস যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন ইংল্যান্ডের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। ওই বছর স্পেনের বিশাল নৌবাহিনী স্পেনীয় আর্মাডা ইংল্যান্ডে অভিযান করে এবং পরবর্তীকালে ভয়াবহ যুদ্ধের পর এই রণতরী ইংরেজদের হাতে পরাস্ত হয়। হবসের জীবনীকার জোনস এ প্রসঙ্গে হবসের একটি উক্তির উল্লেখ করেছেন। হবস বলতেন, ‘আর্মাডার অভিযানের সময় আমার মা যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন আমাকে এবং ভয়কে’ (“In the year of Armada my mother gave birth to twins: myself and fear.”)।

(ii) পিউরিটান বিপ্লব ও ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ

১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন রাজা প্রথম চার্লস (Charles I), যিনি তাঁর পূর্বতন শাসকের মতোই (প্রথম জেমস) স্বৈরাচারী ছিলেন। ইতিপূর্বে সেদেশের স্টুয়ার্ট বংশীয় রোমান ক্যাথলিক রাজারা, সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রোটেস্ট্যান্ট প্রজাদের উপর রোমান ক্যাথলিক মতবাদ চাপাতে চাইলে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট ও তার নিম্নকক্ষের পিউরিটান মতাবলম্বী প্রোটেস্ট্যান্টরা তা মানতে অস্বীকার করেন। সুতরাং পিউরিটানদের সাংবিধানিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার প্রচেষ্টায় পার্লামেন্ট ও রাজশক্তির মধ্যে বাধে বিরোধ।

প্রথম চার্লসের আমলে এই বিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে এবং শুরু হয় ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ। শেষপর্যন্ত সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে প্রথম চার্লসকে ক্ষমতাচ্যুত ও শিরশ্ছেদ করা হয়। ইংল্যান্ডের এমন এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে রাজপরিবারের গৃহশিক্ষক হিসেবে হবসকেও প্যারিসে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। এই চূড়ান্ত অরাজক, ভীতিপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় পরবর্তীকালে হবসের রাষ্ট্রচিন্তায় নিরাপত্তা, সংহতি, শৃঙ্খলার মতো বিষয়গুলি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে।

(iii) ক্রমওয়েলের প্রজাতন্ত্র

ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের সময় পার্লামেন্টের পক্ষে ও রাজার বিরোধীপক্ষের নেতা ছিলেন অলিভার ক্রমওয়েল (Oliver Cromwell)। রাজা প্রথম চার্লসের শিরশ্ছেদের পর তাঁর নেতৃত্বেই ইংল্যান্ডে গড়ে ওঠে প্রজাতান্ত্রিক সরকার। এক্ষেত্রে রাজা না হলেও অলিভার ক্রমওয়েলই ছিলেন প্রশাসনিক কর্তৃত্বের সর্বেসর্বা। এই প্রজাতান্ত্রিক সরকারের কার্যকলাপ পরবর্তীকালে টমাস হবসের রাষ্ট্রচিন্তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল।

(iv) বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও চিন্তাধারা

হবসের রাষ্ট্রদর্শন গড়ে ওঠার পিছনে সেই সময়ের নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও চিন্তাধারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। গ্যালিলিও, কেপলার বা দেকার্তের বৈজ্ঞানিক গবেষণা; বেকনের যুক্তিবাদ ও প্রয়োগকৌশল; কোপারনিকাসের আবিষ্কার এবং এর পাশাপাশি জ্যামিতি ও পদার্থবিদ্যার মতো বৈজ্ঞানিক বিষয়সমূহের প্রভাব পড়েছিল হবসের চিন্তাধারায়।

হবস রচিত গ্রন্থ

টমাস হবস যেসব গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- লেভিয়াথান (Leviathan), ডি কর্পোর (De Corpore), ডি হোমিনি (De Homine), বেহেমোথ (Behemoth), হিস্টোরিয়া একলেসিয়াস্টিকা (Historia Ecclesiastica) প্রভৃতি। এই গ্রন্থগুলির মধ্যে ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘লেভিয়াথান’ গ্রন্থটি তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। হবস তৎকালীন পরিস্থিতি অনুযায়ী ইংল্যান্ডে শক্তিশালী শাসকের প্রয়োজনীয়তার কথা এই লেভিয়াথান গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এইজন্য কেউ কেউ গ্রন্থটিকে স্বৈরাচারী শাসনের ব্যাকরণ বলেও অভিহিত করেন। যদিও অনেকে একে রাজনৈতিক সাধারণতত্ত্ব সম্পর্কে লিখিত গ্রন্থ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment