সাম্যের প্রকৃতি আলোচনা করো

সাম্যের প্রকৃতি আলোচনা করো

সাম্যের প্রকৃতি আলোচনা করো
সাম্যের প্রকৃতি আলোচনা করো

সাম্যের প্রকৃতি

অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কি সাম্যের দুটি মূল বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরেছিলেন। যথা- সাম্য হল বিশেষ সুযোগসুবিধার অনুপস্থিতি এবং সাম্য হল সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা দান। এই বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে সাম্যের প্রকৃতিকে দুটি দিক থেকে আলোচনা করা যায়। যথা- নেতিবাচক প্রকৃতি এবং ইতিবাচক প্রকৃতি। বিশেষ সুযোগসুবিধার অনুপস্থিতি হল নেতিবাচক প্রকৃতি। অন্যদিকে, সকলকে পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা দান করা হল সাম্যের ইতিবাচক প্রকৃতি।

(1) নেতিবাচক প্রকৃতি

বস্তুত দৈহিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিগত শক্তি- সামর্থ্যের নিরিখে সব মানুষ কখনই সমান হতে পারে না। মানুষের মধ্যে প্রকৃতিগত সহজাত বৈষম্য বিদ্যমান। সব মানুষের ক্ষমতা, চাহিদা ও প্রয়োজন একই রকমের নয়। ল্যাস্কি-র বক্তব্য হল, যতদিন মানুষের অভাব, যোগ্যতা ও প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তারতম্য থাকবে, ততদিন সবার জন্য সমান সুযোগসুবিধা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তবে ব্যক্তিদের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তিকে কোনো বিশেষ সুযোগসুবিধা প্রদান করে পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করবে না। রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো বিশেষ সুবিধা প্রদানের অর্থ হল ব্যক্তির সুপ্ত প্রতিভার বিকাশের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা। তাই জন্য এটি নেতিবাচক অর্থে গৃহীত হয়। যথা-আইনের চোখে সাম্য।

(2) ইতিবাচক প্রকৃতি

সাম্যের ইতিবাচক প্রকৃতি বলতে বোঝায়, সব মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের উপযোগী পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করা, যেহেতু ব্যক্তি মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক অসাম্য বর্তমান, সেহেতু প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মবিকাশের জন্য পৃথক পৃথক পরিবেশ ও সুযোগসুবিধা প্রয়োজন হয়। এই পৃথক সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করাই হল ইতিবাচক সাম্য। এই প্রসঙ্গে বেন ও পিটার্সের (SI Benn and RS Peters) মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। তাঁদের মতে, ইতিবাচক সাম্য হল প্রত্যেক ব্যক্তির স্ববিকাশের জন্য যথাযথ (Appropriate) সুযোগসুবিধা প্রদান করা।

বার্কারও সাম্য বলতে সম আচার-আচরণকে বোঝাননি। এক্ষেত্রে তিনি একটি সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বলেন, দৌড় প্রতিযোগিতা শুরুর পূর্বে যেমন সকল প্রতিযোগীকে একই সরলরেখায় দাঁড়াতে হয়, রাষ্ট্রকেও তেমনই ব্যক্তির সম্ভাব্য বিকাশের জন্য সমসুযোগ প্রদান করতে হবে। সুতরাং প্রারম্ভেই সাম্যের প্রয়োজন। কিন্তু, সমস্ত নাগরিককে সমান সুযোগসুবিধা দিলে সবাই যে সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে সমানভাবে ব্যক্তিত্বের উন্নতি ঘটাতে পারবে, তা কিন্তু নয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে প্রত্যেকে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে পারে।

(3) মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সাম্য

মার্কসবাদীরা সম্পূর্ণ পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্যকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁরা সাম্য বলতে সমাজ থেকে শ্রেণিবৈষম্যের বিলুপ্তির কথা বলেছিলেন। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, ধনবৈষম্যমূলক ও শ্রেণিবিভক্ত সমাজে প্রকৃত সাম্যের অস্তিত্ব কখনোই সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ না ঘটলে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এ প্রসঙ্গেই বলা যায় মার্কস পাঁচ ধরনের সমাজব্যবস্থা কথা উল্লেখ করেছেন। যথা- আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা, দাস সমাজব্যবস্থা, সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। মার্কসের মতে, এই পাঁচ ধরনের সমাজব্যবস্থায় সাম্যের প্রকৃতিও ভিন্ন। কারণ সকল সমাজব্যবস্থায় সাম্যের প্রকৃতি সমান নয়। বরং সাম্যের প্রকৃতি সমাজব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সংক্ষেপে তা আলোচনা করা হল-

  1. আদিম সাম্যবাদী সমাজ: মার্কসের মতে যে-কোনো সমাজে সাম্যের প্রকৃতি সেই সমাজের আর্থিক ব্যবস্থা দ্বারা নির্ধারিত হয়। আদিম সাম্যবাদী সমাজেও সাম্য অর্থনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। এই সমাজে ব্যক্তির কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। ফলে সমাজস্থ সকল সম্পদ সকলে একত্রে সমভাগে ভোগ করত। এরূপ সমাজব্যবস্থায় কোনো শ্রেণিবৈষম্য, শ্রেণিশোষণের স্থান ছিল না। ফলে এই সমাজব্যবস্থায় প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠিত ছিল।
  2. দাস সমাজ: রাষ্ট্র বিবর্তনের এক পর্যায়ে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের উত্থান হয়। দাস সমাজ হল প্রথম শ্রেণিবিভক্ত সমাজ, যে ব্যবস্থায় প্রথম ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব হয়। এই ব্যবস্থায় দাস মালিকদের হাতে যাবতীয় সম্পত্তির মালিকানা কেন্দ্রীভূত হয়। ফলে দাসরা সকলপ্রকার বৈষম্যের শিকার হয়।
  3. সামন্ত সমাজ : সামন্ত সমাজব্যবস্থায় সমগ্র সমাজ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা-সামন্তপ্রভু ও কৃষক। এই সমাজ পরিচালিত হত সামন্তপ্রভুদের দ্বারা। তাদের হাতেই যাবতীয় সম্পত্তি কেন্দ্রীভূত ছিল এবং এই সমাজে যাবতীয় আইন সামন্তপ্রভুদের স্বার্থরক্ষায় প্রণীত ও পরিচালিত হত। ফলত কৃষকশ্রেণি ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হত।
  4. ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজ: এরপর পুঁজিবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরূপ সমাজব্যবস্থাও দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা-পুঁজিপতি মালিকশ্রেণি এবং সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণি। এই সমাজেও শ্রমিকশ্রেণিই যাবতীয় শোষণ-বৈষম্যের শিকার হত কারণ মালিকশ্রেণির হাতেই যাবতীয় ক্ষমতা ও সম্পদ কেন্দ্রীভূত ছিল। যদিও এইরূপ সমাজব্যবস্থায় আইনের চোখে সমতা, সকলের রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা স্বীকৃতি দেওয়া হয়, এবং সকল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এখানে বৈষম্যমূলক যাবতীয় ব্যবস্থায় অবসান ঘটানোর উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। বলা যায় এরূপ সমাজে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমতাকে স্বীকার করা হলেও অর্থনৈতিক সাম্যকে পৃথকভাবে স্বীকার করা হয়নি। পরিবর্তে মনে করা হয় সামাজিক ও রাজনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠিত হলেই অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

সমাজতান্ত্রিক সমাজ: এই সমাজে সাম্যের ধারণা পুঁজিবাদী সমাজের সম্পূর্ণ বিপরীত। মার্কসের মতে এই সমাজব্যবস্থায় কোনোরূপ শ্রেণিবৈষম্য থাকবে না, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্ব থাকবে না। এই সমাজ ব্যবস্থায় সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সম্পত্তির সামাজিক মালিকানার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ফলে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। মার্কসের মতে, অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলেই সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এ প্রসঙ্গে লেনিন-এর মতে, এক শ্রেণির দ্বারা অন্য শ্রেণির শোষণের সমস্ত রকম সম্ভাবনা যতক্ষণ না পর্যন্ত বিনষ্ট হচ্ছে, ততক্ষণ কোনো প্রকৃত বা বিশুদ্ধ সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না (“…there can be no real, actual equality untill all possibilities of exploitation of one class by another has been totally destroyed.”)।

তাঁদের মতে, পুঁজিপতিশ্রেণির বিলোপের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণি আর্থিক মুক্তি লাভ করবে। উৎপাদনের উপকরণের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা বিলুপ্ত করে সামাজিক  ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপসাধন ঘটবে, মালিকানা স্থাপন করলে প্রত্যেক মানুষ সমাজে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে ও সেই অনুযায়ী মজুরি পাবে এবং সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করা প্রত্যেকের কর্তব্য। তারা সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে ও সম্পদ ভোগ করবে প্রয়োজন অনুযায়ী, কখনোই অতিরিক্ত নয়। তবেই সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

আরও পড়ুন – ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা

Leave a Comment