ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো

ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো

ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো
ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো

দিল্লি সুলতানির শাসনকালের গোটা পর্বে (১২০৬-১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ) ইক্তা ব্যবস্থার স্বরূপ একরকম ছিল না। বিভিন্ন সুলতানের আমলে পরিস্থিতির চাহিদা অনুসারে ইক্কার শর্তাবলি সংশোধন করা হয়েছিল।

(1) ইলতুৎমিস-এর আমল

  1. ইলতুৎমিসের আমলে ভারতে প্রথম খালিসা জমি সংরক্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়। দিল্লির পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চল এবং দোয়াবের কিছু অংশ খালিসার অন্তর্ভুক্ত ছিল। 
  2. ইলতুৎমিস এই জমির রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব তুর্কি সেনাপতিদের হাতে অর্পণ করেন।
  3. এই ভূখণ্ডের রাজস্বকে সেনাবাহিনীর ভরণ-পোষণ ও সেনানায়কদের বেতন হিসেবে গণ্য করা হত। 
  4. এই ব্যবস্থাকে ভারতে ইক্তা প্রথার আদিপর্ব বলা যায়। এই সময় জমির প্রাপকের কাছে কোনও রাজস্ব অর্থ দিল্লি দাবি করত না। 
  5. ইক্তা ব্যবস্থা ছিল প্রায় সামন্তব্যবস্থার অনুরূপ। ইক্তার প্রাপকদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের প্রবণতা এবং সুলতানের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই ইলতুৎমিস মুক্তিদের অধীন ইক্তা জমি বদলি করার নীতি নেন।

(2) গিয়াসউদ্দিন বলবন-এর আমল

ইলতুৎমিসের মৃত্যু এবং গিয়াসউদ্দিন বলবনের সিংহাসনে বসার মধ্যবর্তীকালে (১২৩৬-১২৬৬ খ্রিস্টাব্দ) ইক্তা ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। দুর্বল সুলতানদের আমলে মুক্তিরা প্রায় স্বাধীন হয়ে ওঠেন। বলবন কঠোর হাতে ইক্তা ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা পুনঃপ্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। এজন্য তিনি

  1. রাষ্ট্রের অধীনে জমি ও ভাতা ভোগ করা সত্ত্বেও যেসকল মুকৃতি প্রয়োজনে সুলতানকে সামরিক সাহায্য প্রদান করত না, তাদের তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে মৃত এবং বৃদ্ধ মুক্তিদের বরাদ্দ করা ইক্তা কেড়ে নেন। যদিও শেষপর্যন্ত বৃদ্ধদের ইক্তা বহাল রাখা হয়। বলবন মূলত শারীরিকভাবে সক্ষম ও উপযুক্ত ব্যক্তিদেরই রাজস্ব ভোগের অধিকার দেন। মুকৃতির কাছ থেকে ইক্তার উদ্‌বৃত্ত রাজস্ব দিল্লিতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
  2. ইক্তার রাজস্বের আয়ব্যয়ের সঠিক হিসাব পরীক্ষার জন্য খোয়াজা নামক কর্মচারী নিয়োগ করেন। ইক্তাদার যেন নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্য রাখেন ও এই ব্যবস্থা যেন বংশানুক্রমিক না হয়ে পড়ে সেদিকে বলবন কড়া নজর রাখতেন।

(3) আলাউদ্দিন খলজি-র আমল

আলাউদ্দিন খলজির সাম্রাজ্যবাদী নীতির দরুন সুলতানি সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটে যথেষ্ট। এসময় তিনি ইক্তা ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার করেন। 

  1. দিল্লির নিকটবর্তী অঞ্চলগুলিকে খালিসা জমি হিসেবে অধিগ্রহণ করেন। এর দরুন সরকারি রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
  2.  আলাউদ্দিন অশ্বারোহী বাহিনীকে (হাসম) বেতন হিসেবে ইক্তা প্রদান বন্ধ করেন এবং তাদের নগদে বেতন দানের ব্যবস্থা করেন। সেনানায়কদের বেতনের পরিবর্তে ইক্তা বরাদ্দ করা হয়। 
  3. স্থির হয় যে, দেওয়ান-ই-উজিরৎ বিভাগ মুক্তিদের দেওয়া ইক্কার মোট রাজস্ব স্থির করবেন। 
  4. ইক্তার ভূখণ্ডকে দুভাগে ভাগ করে একভাগ থেকে সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ ও সেনাদের বেতন প্রদান এবং দ্বিতীয় ভাগ থেকে মুক্তির প্রশাসনিক অর্থ ব্যয় নির্দিষ্ট করা হয়। 
  5. সেনাবাহিনীর ব্যয় এবং মুক্তির ও ইক্তার ব্যয়সংকুলানের পর উদ্বৃত্ত রাজস্ব সুলতানের দফতরে জমা দিতে বলা হয়। 
  6. প্রতিটি ইক্তার নিয়মিত বার্ষিক আয়ব্যয় পরীক্ষার উপর জোর দেওয়া হয় এবং হিসাবে কারচুপি কিংবা উদ্বৃত্ত রাজস্ব দিল্লিতে জমা দেওয়ার কাজে গাফিলতি ধরা পড়লে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়। 
  7. জনৈক কর্মচারী শরাফ কোই দক্ষতা ও কঠোরতার সঙ্গে ইতা প্রশাসন পরিচালনা করেন, এতে কেন্দ্রীয় কোশাগারের আয় বৃদ্ধি পায়।

(4) গিয়াসউদ্দিন তুঘলক-এর আমল

উদারপন্থী শাসক গিয়াসউদ্দিন ইক্তা প্রশাসনে কেন্দ্রের কঠোরতা কিছুটা শিথিল করে দেন। 

  1. এই সময় ইক্তার রাজস্ব বৃদ্ধির হার প্রচলিত হারের ১/১০ বা ১/১১ শতাংশের মধ্যে রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 
  2. মুক্তিরা তাদের অধীনস্থ কর্মচারীদের প্রাপ্য বেতনের এক শতাংশও কম দিতে পারবেন না। 
  3. উভয় ক্ষেত্রে অপরাধ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়। 
  4. সেনাবাহিনীর ব্যয়বাবদ নির্দিষ্ট ইক্তার রাজস্বের কোনও অংশ মুক্তি নিতে পারবেন না। 
  5. মুক্তির অধীনস্থ কর্মচারীরা প্রাপ্য বেতনের অতিরিক্ত অর্থ বা এক শতাংশ অতিরিক্ত সংগ্রহ করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হবে না।

(5) মহম্মদ বিন তুঘলক-এর আমল

মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে ইক্তা ব্যবস্থায় কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। মাসালিক অল অবসর গ্রন্থ থেকে এই সময়কার ইক্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়।

  1. এসময় রাজস্ব আদায় এবং সেনা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পৃথক করে দেওয়া হয়।
  2. রাজস্ব আদায়ের ভার নিলাম ডেকে সর্বোচ্চ নিলামদারকে ইজারা (Contract) দেওয়া হয়। ইজারাদারকে সেনাবাহিনী পোষণের দায়িত্ব পালন করতে হত না।
  3. সর্বনিম্নে সিপাহশালার থেকে ঊর্ধ্বক্রমে খান পদমর্যাদার সেনানায়করা বেতন বাবদ ‘ইক্তা’ বরাদ্দ পেতেন। সাধারণ সেনাদের নগদ টাকায় বেতন দেওয়া হত।
  4. মুক্তির হাতে কেবল ইক্তা শাসন ও নিজেদের খরচের জন্য অর্থ দেওয়া হত।
  5. মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে অভিজাতদের কাছ থেকে প্রশাসনিক দায়িত্ব সরিয়ে নেওয়া হলে অভিজাতরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বলা হয়, দাক্ষিণাত্যের সদাহ্-আমিরদের (আমিরান-ই-সদাহ) বিদ্রোহের অন্যতম কারণই ছিল এই বিষয়টি।

(6) ফিরোজ শাহ তুঘলক এর আমল

ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন প্রচণ্ড ধর্মভীরু ও তোষামুদে শাসক। তাঁর আমলে ইক্কা প্রশাসনে এমন কিছু পরিবর্তন আনা হয়, যা ইক্তা ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামো ভেঙে দেয়।

  1. তিনি অভিজাতদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা প্রচুর বৃদ্ধি করলে তার প্রভাব পড়ে ইক্তা ব্যবস্থাতেও। যেমন- খান পদমর্যাদার একজন অভিজাতের বার্ষিক বেতন ২ লক্ষ তঙ্কা থেকে বেড়ে হয় ৪ থেকে ৮ লক্ষ তঙ্কা।
  2. ঐতিহাসিক সামস-ই-সিরাজ আফিফের রচনা থেকে জানা যায় ফিরোজ শাহ প্রায় সমস্ত জমি ইক্তা হিসেবে বণ্টন করে দেন।
  3. সেনাবাহিনীর সকল সদস্যকে নগদ অর্থের বদলে বেতন খাতে ইক্তা বরাদ্দ করা হয়।
  4. গ্রামাঞ্চলে সেনারা জমির খাজনা আদায় করে নিজেদের বেতন সংগ্রহের অধিকার পায়। একে বলা হত ওয়াঝ বা মোয়াজব (অর্থাৎ বেতনের বিকল্প)।
  5. ফিরোজ সরকারিভাবে ইক্তার উপর মুক্তির বংশানুক্রমিক অধিকার মেনে নেন।
  6. মুক্তির মৃত্যুর বা অবসরের পর তার পুত্র, কন্যা বা জামাতা ইক্কার অধিকারী গণ্য হতেন। পুত্র-কন্যার অবর্তমানে মুক্তির ক্রীতদাসকেও ইক্তার প্রাপকের মর্যাদা দেওয়া হয়।
  7. ইক্কার আয় বার্ষিকভাবে নির্ধারণের পরিবর্তে সমগ্র শাসনকালের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এসময় ইক্তার আয় নির্ধারিত হয়েছিল প্রায় ৬ কোটি ৮৫ লক্ষ তঙ্কা। এতে মুক্তিরা বাড়তি রাজস্ব প্রদান না করায় সরকারি আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
  8. আফিফের রচনা থেকে অনেকে মনে করেন যে, ইক্তাতে মুক্তির ব্যক্তিগত বেতন ও সৈন্যদের বেতনের জন্য এলাকা ভাগ করা ছিল, কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলকের সময় এই বিভাজন ঠিকমতো মেনে চলা হত না।

(7) লোদি বংশের শাসনকাল

ফিরোজ শাহ তুঘলক যেভাবে ইক্তার উপর সুলতানের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেছিলেন তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। লোদি বংশের শাসনকালে (১৪৫১-১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ) ইক্তা ব্যবস্থার নতুন কোনও পরিবর্তন ঘটেনি।

  1. তবে এই সময় ইক্তা-র পরিবর্তে ‘সরকার’ নাম ব্যবহার করা হয়। কয়েকটি পরগনা নিয়ে একটি সরকার গড়ে উঠত।
  2. মূলত অনুমানের ভিত্তিতে এসময় প্রত্যেক ‘সরকার’-এর মোট রাজস্ব (জমা) দিল্লির দফতর স্থির করে দিত। এই জমা সরকার হিসেবে বিশিষ্ট অভিজাতদের বন্দোবস্ত দেওয়া হত এবং এরই ভিত্তিতে গ্রহীতার দায়িত্ব ও কর্তব্য স্থির করা হত। সরকারের প্রাপক তাঁর প্রাপ্ত ভূখণ্ড ছোটো ছোটো অংশে ভাগ করে ইজারা বন্দোবস্ত দিতে পারতেন।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment