মনসবদারি ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো

মনসবদারি ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো

মনসবদারি ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো
মনসবদারি ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো

(1) নিয়োগরীতি

বংশানুক্রমিক বা উত্তরাধিকারসূত্রে মনসবদার নিযুক্ত হতেন না। মনসবদার নিয়োগের অধিকারী ছিলেন একমাত্র সম্রাট। সম্রাট নিজ ইচ্ছানুযায়ী যে-কোনো ব্যক্তিকে এই পদে নিয়োগ করতে পারতেন। তবে এক্ষেত্রে সম্রাট উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও শাহজাদাদের পরামর্শকেও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতেন। সাধারণভাবে মিরবশি সম্ভাব্য পদপ্রার্থীদের একটি তালিকা সম্রাটের কাছে পেশ করতেন। অতঃপর সম্রাট মনসবদারদের নাম পছন্দ করতেন। পাশাপাশি তিনি ব্যক্তিগতভাবেও প্রার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। এরপর সম্রাট অনুমোদিত প্রার্থীদের নাম দেওয়ান ও মিরবশির দফতরে নথিভুক্ত করা হত। তারপর উজির নির্বাচিতদের মনসব প্রদান করতেন।

সম্রাটের ইচ্ছানুযায়ী মনসবদারদের পদমর্যাদা স্থির করা হত। তিনি চাইলে কোনও ব্যক্তিকে প্রথমেই পাঁচ হাজার বা তারও বেশি উচ্চ মর্যাদার মনসবদারি দিতে পারতেন। তবে বদায়ুনি বলেছেন যে, নীতিগত দিক থেকে মনসবদারদের নীচু থেকে উপরের স্তরে পাঠানোর বিষয়টিতেই গুরুত্ব আরোপ করা হত। তবে পদমর্যাদা অনুসারে কর্তব্যপালনে ব্যর্থ হলে সম্রাট তার পদের অবনতি ঘটাতে পারতেন। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকেই এই পদ প্রদান করা হত।

(2) স্তরবিন্যাস

মনসবদারি ব্যবস্থায় একাধিক স্তরের মনসবদার নিয়োগ করা হত। আবুল ফজল মনসবদারদের তেত্রিশটি স্তরের বিবরণ দিয়েছেন। সর্বনিম্ন মনসবদারের অধীনে ১০জন এবং সর্বোচ্চ মনসবদারের অধীনে পাঁচ হাজার সৈন্য থাকত। ৬ থেকে ১০ হাজারি মনসবদার পদে রাজপরিবারের সন্তান বা সম্রাটের অতিবিশ্বস্ত ব্যক্তি নিয়োগ করা হত। যেমন- মানসিংহ, আবুল ফজল, টোডরমল প্রমুখ উচ্চপদে নিয়োজিত হয়েছিলেন। ক্রমোচ্চ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সম্রাটের ইচ্ছাই ছিল যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি।

এই ব্যবস্থায় ১ হাজারি ও তার উচ্চস্তরের মনসবদারেরা পরিচিত হতেন ওমরাহ নামে। বার্নিয়ের মতে, ওমরাহরা ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের স্তম্ভস্বরূপ। সামরিক কার্যাবলি, প্রাদেশিক শাসন, মুঘল দরবার-সবেতেই এদের সাহায্য নিতেন সম্রাট। বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে ওমরাহরা সম্রাটের কাছে উপহার পাঠাতেন ও নিয়মিত তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। তবে অনেকসময় দেখা যেত যে, পদমর্যাদা অনুযায়ী পরিমাণমতো সেনাবাহিনী ওমরাহরা পোষণ করতেন না।

(3) দায়িত্ব ও কর্তব্য

মনসবদারদের মূল কাজ ছিল সম্রাটের প্রতি অনুগত থাকা এবং সম্রাটের প্রয়োজন অনুসারে তাঁকে সাহায্য করা। এক্ষেত্রে পদমর্যাদার তারতম্য বিচার্য ছিল না। সামরিক ও অসামরিক উভয় কাজেই মনসবদারদের সেবা (Service) রাষ্ট্র দাবি করতে পারত। সাধারণভাবে মনসবদার সম্রাটের নির্দেশ অনুসারে নির্দিষ্ট সংখ্যক সেনা ও যুদ্ধের অশ্ব রাখতে দায়বদ্ধ ছিলেন। অধ্যাপক কুরেশী (S M Quareshi)-এর মতে, ‘সকল মনসবদারই সামরিক পদমর্যাদা (Rank) পেতেন। তবে সবার জন্য সামরিক কর্তব্য বাধ্যতামূলক ছিল না।’

(4) জাট ও সওয়ার পদ

একজন মনসবদার দুটি পদের অধিকারী হতেন- জাট (Zat) ও সওয়ার (Sawar)। এই দুটি পদের সূচনা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মতভেদ আছে।

  • দুটি পদের সূচনা: 
  1. ঐতিহাসিক মোরল্যান্ড (W M Moreland) ও আবদুল আজিজ-এর মতে, মনসবপ্রথা শুরুর সময় একটিমাত্র সংখ্যানুভিত্তিক পদ (জাট) চালু ছিল। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনসবদার তার জন্য নির্ধারিত সংখ্যা অনুযায়ী ঘোড়সওয়ার পোষণ করতেন না। এই কারচুপি বন্ধ করার জন্য সম্রাট আকবর তাঁর রাজত্বের একাদশ বর্ষে সওয়ার পদ চালু করেন। এতে মনসবদার পোষিত প্রকৃত ঘোড়সওয়ারের সংখ্যা বিজ্ঞাপিত হত। 
  2. অন্যদিকে জে এ ক্যায়সর, শিরিন মুসভি মনে করেন, আকবরের রাজত্বের অষ্টাদশ বর্ষে (১৫৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দ) জাট ও সওয়ার পদদুটিকে মনসব ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। 
  3. আবার ড. অনিল ব্যানার্জীর মতে, মনসবদারি ব্যবস্থা চালুর প্রথম ২০ বছর কেবল ‘জাট’ পদের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু মনসবদাররা নির্দিষ্ট সংখ্যক সেনা পোষণ না করে সংখ্যার কারচুপি করতেন। তাই ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ (আকবরের শাসনের চল্লিশতম বর্ষ) আকবর সওয়ার পদ চালু করেন। স্থির হয়, জাট পদ অনুযায়ী সেনাবাহিনী পোষণ বাধ্যতামূলক হবে না এবং মনসবদারকে সেনা পোষণ করতে হবে সওয়ার পদ অনুযায়ী। এজন্য তাকে অতিরিক্ত অর্থ প্রদানও করা হবে।
  • জাট ও সওয়ার পদের বৈশিষ্ট্য: জাট ও সওয়ার পদের বৈশিষ্ট্য বা কর্তব্য সম্পর্কেও মতভেদ আছে। 
  1. ব্লখম্যান (Blochmann)-এর মতে, একজন মনসবদারের অধীনে অনুমোদিত সৈন্যসংখ্যার সূচক ছিল জাট পদ এবং তিনি প্রকৃতপক্ষে যত সৈন্য রাখতেন তার সূচক ছিল সওয়ার পদ।
  2. আবার ইতিহাসবিদ ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, ‘জাট’ ছিল মনসবদারের ব্যক্তিগত পদমর্যাদার সূচক এবং ‘সওয়ার’ ছিল তার অধীনে রক্ষিত অতিরিক্ত সেনাবাহিনীর সূচক। 
  3. অন্যদিকে আর পি ত্রিপাঠী মনে করেন, ‘সওয়ার’ ছিল মনসবদারের অতিরিক্ত সেনার সূচক। এজন্য মনসবদার অতিরিক্ত অর্থ দাবি করতে পারতেন। ‘সওয়ার’ রাখার ক্ষেত্রে কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। 
  4. তবে সাধারণত মনে করা হয় যে, ‘জাট’ ছিল পদাতিক বাহিনীর সূচক এবং ‘সওয়ার’ ছিল অশ্বারোহী বাহিনীর সূচক। অর্থাৎ, নিজ পদমর্যাদা অনুসারে মনসবদারেরা নির্দিষ্ট সংখ্যক পদাতিক ও অশ্বারোহী সেনা রাখতেন ও প্রয়োজনে তা সম্রাটকে সরবরাহ করতেন।

(5) শ্রেণিবিভাগ

  1. জাট ও সওয়ার পদের সংখ্যার অনুপাতের ভিত্তিতে মনসবদারদের তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যথা- প্রথম শ্রেণির মনসবদার ছিলেন তারা, যাদের জাট ও সওয়ারের সংখ্যা সমান হত। 
  2. যেসকল মনসবদারদের সওয়ারের সংখ্যা জাট সংখ্যার অর্ধেক ছিল, তারা ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির মনসবদার। 
  3. কারোর সওয়ারের সংখ্যা জাট সংখ্যার অর্ধেকেরও কম হলে, তারা তৃতীয় শ্রেণির মনসবদার হতেন। এ ছাড়া সৈনিকের অধীনস্থ ঘোড়ার সংখ্যার ভিত্তিতেও মনসবদারদের ভাগ করা যেত। যে সওয়ারের অধীনে ৩টি ঘোড়া থাকত, তাকে শি-আস্পা (Seh-aspa), যার অধীনে ২টি ঘোড়া থাকত তাকে দুহ-আস্থা (Do-aspa) এবং ১টি ঘোড়া থাকলে তাকে বলা হত ইয়াক-আস্পা (Ek-aspa)। আবার অনেকসময় দুজন সৈনিকের ১টি ঘোড়া থাকত, এদের বলা হত নিম-আস্থা (Nim-aspa) I

(6) দাগ ও হুলিয়া প্রথা

মনসবদারি ব্যবস্থায় বহু মনসবদার নির্দিষ্ট সংখ্যক সেনা পোষণ করতেন না। ভাড়াটে সেনা দেখিয়ে সরকারি পরিদর্শককে সন্তুষ্ট করে দিতেন। এই ত্রুটি উপলব্ধি করে আকবর দাগ এবং চেহরা বা হুলিয়া প্রথা চালু করেন। দাগ (Branding) হল, প্রতিটি ঘোড়ার গায়ে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা এবং চেহরা (Descriptive Roll) হল, প্রতিটি সৈনিকের ব্যক্তিগত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দাগ ও হুলিয়া প্রথার উদ্ভাবক ছিলেন দিল্লির সুলতানি শাসক আলাউদ্দিন খলজি।

(7) বেতন 

মনসবদারি প্রথায় মূলত জাট পদ অনুযায়ী মনসবদারের ব্যক্তিগত বেতন এবং সওয়ার পদ অনুসারে সম্রাটকে সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে পোষণ করা অশ্বারোহী বাহিনীর ব্যয়ভার মেটানোর খরচ নির্দিষ্ট করা হত। ‘জাট’ ও ‘সওয়ার’ -এই দুটি পদের জন্য মঞ্জুর হওয়া অর্থের পরিমাণের ভিত্তিতে মনসবদারের বেতনকাঠামো (তলব) নির্দিষ্ট করা হত। বন্দোবস্তের মাধ্যমে। মনসবদারের বেতন দুভাবে দেওয়া হত- নগদ অর্থে এবং জমি

  • নগদ অর্থ বেতন প্রদান: নগদ অর্থে বেতন গ্রহণকারী মনসবদারের সংখ্যা ছিল খুব কম। এদের বলা হত মনসবদার-ই-নগদী।
  • জমি বন্দোবস্তের মাধ্যমে বেতন প্রদান: অধিকাংশ মনসবদার বেতন বাবদ ভূমিরাজস্ব ভোগের অধিকারী হতেন। সম্রাট খালিসা জমির বাইরে থাকা ভূখণ্ড পদমর্যাদা অনুযায়ী মনসবদারদের জায়গির দিতেন। উক্ত জমির রাজস্ব মনসবদার তার বেতন ও সেনাবাহিনী পোষণের খরচ বাবদ ভোগ করতেন। তবে জমির উপর মনসবদারের কোনও অধিকার স্বীকৃত ছিল না। এরা ‘জায়গির’ ভোগদখলের কারণে জায়গিরদার নামেও অভিহিত হতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মনসবদারদের বেতনের সমপরিমাণ ভূমিরাজস্ব সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট জমি জায়গির হিসেবে দেওয়া হলে, তাকে বলা হত তনখা জায়গির। অন্যদিকে বংশানুক্রমিকভাবে প্রাপ্ত জায়গিরকে বলা হত ওয়াতন জায়গির।

(8) অধিকার

মনসবদারের পদ, মর্যাদা, জায়গির সবকিছুই ছিল একান্তভাবে সম্রাটের ইচ্ছানির্ভর। মনসবদার পদে বংশানুক্রমিক অধিকার ছিল না। একজন মনসবদারের অপসারণ বা মৃত্যুর পরে তার অধীনস্থ মনসব, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সম্রাটের হস্তগত হত। বার্নিয়ের মতে, ফরাসি অভিজাতদের অনুরূপ হিন্দুস্থানের মনসবদাররা কোনোদিনই ভূমি ও রাজস্বের মালিক ছিলেন না। কোনও মনসবদারের মৃত্যু হলে তার সম্পত্তির মালিক হতেন স্বয়ং সম্রাট। মৃত মনসবদারের পুত্র-কন্যাকে ভিক্ষাবৃত্তি কিংবা অতি সাধারণ কোনও চাকুরি গ্রহণ করতে হত। অবশ্য হকিন্স (W Hawkins) লিখেছেন যে, প্রচলিত নিয়মমাফিক সম্রাট সকল সম্পত্তির অধিকারী হলেও তিনি সাধারণত মৃত মনসবদারের যোগ্য উত্তরাধিকারীকে নতুন ‘মনসব’ দিয়ে রক্ষা করতেন। এক্ষেত্রে বিশেষ করে জ্যেষ্ঠপুত্র মৃত মনসবদারের অধিকার ও মর্যাদা ভোগ করার জন্য সম্রাটের অনুগ্রহ লাভ করতেন। ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্রের মতে, আইন থাকলেও কার্যত সম্রাট মনসবদারের ব্যক্তিগত সম্পদ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতেন না।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment