রুশোর রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আলোচনা করো

প্রকৃতির রাজ্য
রুশো তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে প্রাক্-রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রকৃতির রাজ্যের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, প্রকৃতির রাজ্য ছিল মর্তের স্বর্গ। প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত এবং তাদের মধ্যে কোনোরকম হিংসার পরিবেশ ছিল না। এখানে মানুষ ছিল সৎ, সহানুভূতিশীল ও স্বাধীন। তারা সকলে সমান সুযোগসুবিধা ভোগ করতে পারত।
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা
প্রকৃতির কোলে লালিত মানুষই একসময় গড়ে তোলে রাষ্ট্র। কিন্তু মানুষ কেন প্রকৃতির রাজ্য ছেড়ে রাষ্ট্র গঠন করল? এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে মূলত তিনটি কারণের কথা জানা যায়- জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব এবং বুদ্ধি ও যুক্তির উন্মেষ।
- জনসংখ্যা বৃদ্ধি: জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলস্বরূপ সীমিত প্রাকৃতিক সামগ্রীর অধিকার নিয়ে মানুষে মানুষে তীব্র সংঘাত দেখা দেয়। মানুষের নিজেদের প্রয়োজন পূরণ না হওয়ায় প্রকৃতির রাজ্যে শুরু হয় চরম অশান্তি।
- ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব: ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। এর ফলে সুখশান্তি, সাম্য সব বিনষ্ট হয়। শুরু হয় ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সংঘাত, হত্যা ও যুদ্ধবিগ্রহ। এর ফলে স্বর্গের মতো প্রকৃতির রাজ্য পরিণত হয় নরকে।
- শুভবুদ্ধি ও যুক্তির উন্মেষ: একদিকে প্রকৃতির রাজ্যের স্বর্গসুখ দূর হয়ে অশান্তি নেমে আসে এবং অপরদিকে শুভবুদ্ধি ও যুক্তির উন্মেষের ফলে আদিম মানুষ নতুন বিকল্প সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়। এভাবেই মানুষ সামাজিক চুক্তির জন্য প্রেরণা লাভ করে।
- রাষ্ট্র সৃষ্টি: প্রকৃতির রাজ্যের দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের প্রেরণা থেকে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করেই ব্যক্তিজীবন নিরাপদ হয় এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা পূর্ণতা লাভ করে।
সামাজিক চুক্তি
রুশো তাঁর The Social Contract গ্রন্থে যে সামাজিক চুক্তির কথা বলেছেন, সেখানে তাঁর চিন্তার স্বকীয়তা প্রকাশিত হয়েছে। বুশোর মতে, প্রকৃতির রাজ্যে বসবাসকারী মানুষ পরস্পরের মধ্যে চুক্তি করে তাদের সমস্ত অধিকার কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে অর্পণ করেনি, তারা সমস্ত অধিকার অর্পণ করেছিল সমগ্র সমাজের কাছে। বুশো একেই সামাজিক চুক্তি বলেছেন। এই সামাজিক চুক্তির ফলাফলগুলি হল-
(i) স্বাধীনতা
সামাজিক চুক্তির মধ্য দিয়ে জোটবদ্ধ হওয়ার ফলে মানুষ কারোর অধীন হয়নি। প্রত্যেকে নিজ সত্তা ও ক্ষমতা অন্যদের সঙ্গে মিলে সমগ্র সমাজের কাছে অর্পণ করায়, সেই সমগ্রের অঙ্গ হিসেবে প্রত্যেকে যথাযোগ্য অবস্থান অর্জন করে। ফলে আগের মতোই তাদের স্বাধীনতা অব্যাহত থাকে।
(ii) যৌথশক্তির প্রকাশ
ব্যক্তির শক্তির চেয়ে যৌথশক্তি অনেক বেশি শক্তিশালী। যৌথশক্তিতে রাষ্ট্র গড়ে ওঠে এবং রাষ্ট্রের কাছে মানুষ বিনা দ্বিধায় আত্মসমর্পণ করে।
(iii) জনগণের অধিকার রক্ষা
রুশোর মতে, চুক্তির ফলেই রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে। চুক্তিকারী কর্তৃপক্ষ বা জনগণ সরকারের হাতে চরম ক্ষমতা দেয়নি। সরকারের সমালোচনা করা বা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার জনগণের আছে। জনগণই হল সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস। জনগণ প্রয়োজনে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে।
(iv) সম্পত্তির মালিকানা
রুশোর মতে, সামাজিক চুক্তির ফলে জনগণ অনেক লাভবান হয়েছে। মানুষ স্বাধীনতার পাশাপাশি সম্পত্তির মালিকানাও অর্জন করেছে।
(v) নৈতিকতা
বুশোর মতে, মানুষের স্বেচ্ছায় নিজের সৃষ্টি করা নিয়মের অধীন হওয়াই প্রকৃত স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা নৈতিকও (Moral Liberty) বটে। প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ প্রবৃত্তির তাড়নায় পরিচালিত হত বলে তার নৈতিকতা ছিল না। নৈতিক বোধ লাভের মাধ্যমে ব্যক্তি বুঝতে পারে যে, কোনও মানুষই স্বতন্ত্রভাবে সাধারণ ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণ করতে পারে না।
সাধারণ ইচ্ছা বা General Will
বুশোর বিখ্যাত তত্ত্ব হল সাধারণ ইচ্ছা (General Will)-র তত্ত্ব। রুশোর মতে, আদিম মানুষ সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে যে সম্মিলিত শক্তি গড়ে তুলেছিল তাই হল সাধারণ ইচ্ছা। প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ যে স্বাধীনতা ও ক্ষমতা ভোগ করত তা সমস্ত সমর্পণ করে সকলের সম্মিলিত শক্তির কাছে। তাই সব কিছু সমর্পণ করেও মানুষ কিছুই হারায় না। আসলে সে ব্যক্তি হিসেবে যা হারাল, সমগ্রের অংশীদার হিসেবে তার সবটাই ফিরে পেল। ফলে সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছার অধীন হয়েও প্রত্যেক মানুষ স্বাধীন থেকে গেল। রুশো বলেছেন, প্রত্যেক মানুষের দুই ধরনের ইচ্ছা থাকে- প্রকৃত ইচ্ছা (Real Will) এবং বাস্তব ইচ্ছা (Actual Will) |
- প্রকৃত ইচ্ছা: প্রকৃত ইচ্ছা হল সকল মানুষের মৌলিক, বিশুদ্ধ ও স্বভাবগত ইচ্ছা, যা সব মানুষের ক্ষেত্রে এক। এই ইচ্ছা সকল মানুষের মঙ্গল করার ইচ্ছা বা Common Good.
- বাস্তব ইচ্ছা: বাস্তব ইচ্ছা হল প্রতিটি মানুষের নিজের নিজের স্বার্থপূরণ করার ইচ্ছা।
রুশোর মতে, সামাজিক চুক্তিজাত সাধারণ ইচ্ছা হল সকল মানুষের Common Good নির্দেশিত প্রকৃত ইচ্ছার গুণফল। ক্ষুদ্র স্বার্থে পরিচালিত ব্যক্তি সাধারণ ইচ্ছার নির্দেশ অমান্য করলে তাকে বলপ্রয়োগ করে সাধারণ ইচ্ছা মান্য করতে বাধ্য করা হবে।
সার্বভৌমিকতা
বুশো মনে করতেন, সাধারণ ইচ্ছা ও সার্বভৌমের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। তিনি বলতেন সাধারণ ইচ্ছা সমন্বিত সমাজই হল সার্বভৌম। রুশোর সার্বভৌম কোনও ব্যক্তির মধ্যে আবদ্ধ নয়। তাঁর মতে, কোনও ব্যক্তি বা সরকার সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না।
সার্বভৌম বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত। বৈধ এই কারণে যে মানুষ নিজের ইচ্ছায় তাদের সমস্ত ক্ষমতা সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছার কাছে হস্তান্তরিত করেছিল। অপরদিকে ন্যায়সঙ্গত এই কারণে যে সাধারণ ইচ্ছার মধ্যে সকলের মঙ্গলকামী ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে। সকলের মঙ্গলকামী ইচ্ছার সমষ্টি বলেই সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছার নির্দেশ ন্যায়সঙ্গত।
বৈশিষ্ট্য
রুশো তাঁর দ্য সোশ্যাল কনট্রাক্ট গ্রন্থে সার্বভৌমিকতার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন—
- অ-হস্তান্তরযোগ্য: রুশোর মতে, সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তরযোগ্য নয়। কারণ- শুধুমাত্র সাধারণ ইচ্ছা রাষ্ট্রকে পরিচালনা করতে পারে, অন্য কেউ নয়। এর কোনও প্রতিনিধি থাকতে পারে না।
- সাধারণভাব বা সামান্যধর্মিতা: সাধারণ ইচ্ছা এমন একপ্রকার ইচ্ছা যা পরিপূর্ণ অর্থে সাধারণ, কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা ইচ্ছাকে নির্দেশ করে না। সমষ্টিগত স্বার্থ ছাড়া কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থের সঙ্গে এই ইচ্ছার সম্পর্ক থাকবে না।
- অবিভাজ্যতা: সার্বভৌম ক্ষমতা অবিভাজ্য, সার্বভৌম ক্ষমতাকে বিভক্ত করা যায় না। তিনি সার্বভৌম ক্ষমতাকে জীবদেহের প্রাণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। একে ভাগ করার অর্থ একে শক্তিহীন করা। রুশো এই বক্তব্যের মাধ্যমে লক ও মন্তেঞ্জুর ক্ষমতা বিভাজন নীতির প্রতি কটাক্ষ করেছেন।
- চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতা: রুশোর রাষ্ট্রচিন্তায় সার্বভৌম ক্ষমতা চরম ও চূড়ান্ত। সকলেই তার নির্দেশ মানতে বাধ্য। যদি কেউ সাধারণ ইচ্ছাকে অমান্য করে এবং বিপথগামী হয় তবে তাকে সাধারণ ইচ্ছা মানতে বাধ্য করা হবে।
- অভ্রান্ততা: সার্বভৌমিকতার একটি বৈশিষ্ট্য হল অভ্রান্ততা। রুশোর মতে সাধারণ ইচ্ছা সবসময় সঠিক এবং জনকল্যাণকারী কাজ করে। কারণ সাধারণ ইচ্ছা গড়ে উঠেছে সকলের মঙ্গলকারী প্রকৃত ইচ্ছার সমন্বয়ে।
আইন এবং আইনপ্রণেতা
- আইন: সর্বসাধারণের ইচ্ছাকেই বুশো আইন বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, যখন সাধারণের উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে সকলের ইচ্ছা, সকল ব্যক্তির উপরেই আদেশ হিসেবে জারি হয়, তখন তাকে আইন বলে। এ প্রসঙ্গে রুশো উল্লেখ করেছেন, যে রাষ্ট্র আইনের দ্বারা পরিচালিত সেই রাষ্ট্রই প্রজাতন্ত্র (Republic), কারণ- এক্ষেত্রে প্রজাদের সম্মতি নিয়ে, প্রজারা যেমন চায় তেমনভাবেই শাসন পরিচালিত হয়।
- আইনপ্রণেতা : রুশো মনে করেন, যে প্রজারা আইনের আনুগত্য মেনে নেয়, তাদেরই আইনপ্রণেতা হওয়া উচিত। তাঁর মতে, আইনপ্রণেতা এমন এক বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি শাসকের থেকেও মূল্যবান। আইনপ্রণেতা ব্যক্তির বুদ্ধিকে পরিমার্জিত করে শুধরে নিতে ও জনগণকে কিসে তার মঙ্গল হবে তা বুঝে নিতে সাহায্য করেন। এ ছাড়া ব্যক্তির ইচ্ছা ও বুদ্ধির সঙ্গে সমাজের ইচ্ছাকে যুক্ত করে এবং ব্যক্তির শক্তিকে সমাজের শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সমাজদেহকে অপরাজেয় করে তোলেন আইনপ্রণেতাই। তবে আইন প্রণয়নের পাশাপাশি তা জনগণের কাছে বোধগম্য করে তোলাও আইনপ্রণেতার কাজ। তিনি যদি জনগণের পক্ষে বোঝার উপযুক্ত করে তৈরি করতে না পারেন, তবে আইনের কোনও মূল্য থাকবে না। সেইসঙ্গে মানুষকে নৈতিকবোধে শিক্ষিত করে তোলাও আইনপ্রণেতার অন্যতম দায়িত্ব।
শাসনব্যবস্থা বা সরকার
শাসনব্যবস্থা প্রসঙ্গে রুশো বলেছেন যে, রাষ্ট্রদেহে দুটি পৃথক ক্ষমতার অস্তিত্ব বিদ্যমান- আইন-প্রণয়নী ক্ষমতা বা সার্বভৌম ক্ষমতা এবং শাসনবিভাগীয় ক্ষমতা। জনগণের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকলেও সেই আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতা থাকা উচিত নয়। কারণ- আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শক্তির পিছনে থাকে নানা বিধিনিষেধ এবং তা ব্যক্তি ও স্থান বিশেষে প্রযুক্ত হয়, যা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা শাসক বা জনগণ কারোরই নেই। এই ক্ষমতা থাকবে সার্বভৌমের নিজস্ব শক্তি অর্থাৎ সরকারের হাতে, যে শাসক ও প্রজাদের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করবে। সরকারের দায়িত্ব হল আইনের প্রয়োগ ও প্রজাদের স্বাধীনতা রক্ষা করা। শাসনব্যবস্থার আলোচনায় রুশো তিন ধরনের সরকারের কথা বলেছেন, যথা-
- গণতন্ত্র: এই শাসনব্যবস্থায় সরকার গঠন এবং সরকারি কার্যকলাপে নাগরিকরা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। সরকার ও শাসনতন্ত্রকে সমালোচনা করার সুযোগও থাকে এই ব্যবস্থায়। রুশোর মতে ক্ষুদ্র এবং গরিব রাষ্ট্রের পক্ষে এই ব্যবস্থা উপযুক্ত।
- অভিজাততন্ত্র: এই ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে সার্বভৌম কর্তৃক শাসনভার অর্পিত হয়। যেসকল রাষ্ট্র অতি বৃহৎ বা ক্ষুদ্র নয় এবং সম্পদও পরিমিত, সেক্ষেত্রে অভিজাততন্ত্রই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী।
- রাজতন্ত্র: এই ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তির হাতে সার্বভৌম সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করে, অর্থাৎ একজনের শক্তিতেই সরকার শক্তিশালী। বৃহদাকার রাষ্ট্রের পক্ষে রাজতন্ত্রই সবচেয়ে উপযুক্ত শাসনব্যবস্থা।
এ ছাড়া রুশো মিশ্র সরকারের কথাও বলেছেন, যেখানে সবরকম সরকারেরই সদস্যসংখ্যার পরিমাণ কম বেশি হতে পারে। রুশো মনে করেন, যে সরকার ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা, শাসকদের সুযোগ-সুবিধা প্রভৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে শুধুমাত্র গণ-ইচ্ছার প্রতি সংবেদনশীল হয়ে কাজ করে, সেই সরকারই শ্রেষ্ঠ সরকার।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর