জাঁ বোদাঁর রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো

জাঁ বোদাঁর রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো

জাঁ বোদাঁর রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো
জাঁ বোদাঁর রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো

রাষ্ট্রের সংজ্ঞা

দার্শনিক জাঁ বোদা মনে করেন যে, ‘সংজ্ঞার মাধ্যমে যে সমস্যা বিবেচনা করা হচ্ছে তার সমাধান করা সম্ভব এবং সংজ্ঞা যদি সুনির্মিত না হয় তাহলে তার উপর ভিত্তি করে যা গড়ে তোলা হয় তা সত্বর ভেঙে পড়ে।’ তাই নিজের তত্ত্বে বোদা রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে উদ্যত হয়েছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্র হল কয়েকটি পরিবার ও তাদের যৌথ সম্পত্তির সমন্বয়ে গঠিত একটি আইনসম্মত সরকার, যা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী (The State is a lawful government, with sovereign power, of different households and their common affairs)।

রাষ্ট্রের উদ্ভব

রাষ্ট্রের উদ্ভব প্রসঙ্গে বোদাঁর অভিমত হল এই যে, মানুষের সামাজিক অনুভূতি বা আবেগের পরিণতি হল পরিবার এবং অন্যান্য ধর্মীয় বা অর্থনৈতিক সংগঠন। প্রাকৃতিক কারণেই একটি পরিবার থেকে একাধিক পরিবার গড়ে ওঠে। নিজেদের অস্তিত্ব ও স্বার্থরক্ষার তাগিদে পরিবারগুলি নিজেদের বসতি গড়ে তুলতে শুরু করে। এর জন্য স্থান দখল করাকে কেন্দ্র করে পরিবারগুলি একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধে পরাজিতরা ক্রীতদাস হিসেবে বিজয়ী শ্রেণির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে বাধ্য হয়। আর এভাবেই বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে সমাজে বিকশিত হয় সার্বভৌম শক্তি এবং সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন সর্বোচ্চ সংগঠন হিসেবে উদ্ভব ঘটে রাষ্ট্রের।

রাষ্ট্র ও পরিবার

পরিবারের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বোদাঁ রোমান আইন দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁর মতে, পরিবার হল পিতার নিয়ন্ত্রণাধীন কতিপয় ব্যক্তির সমষ্টি। পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, গৃহভৃত্য ও তাদের যৌথ সম্পত্তির সমবায়ে তৈরি পরিবারকে বোদাঁ স্বাভাবিক লোকসমাজ (Natural Community) বলে অভিহিত করেছেন। এই পরিবার থেকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি বলে তিনি মনে করেন। এরই পাশাপাশি তিনি পরিবারের সঙ্গে রাষ্ট্রের নানা সাদৃশ্যও লক্ষ করেছেন। যেমন- 

  • সংগঠন প্রধানের নির্বাচন: পরিবারের প্রধানকে যেমন অন্যান্য সদস্য দ্বারা নির্বাচিত হতে হয় না, তেমনি রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজাকেও জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হতে হয় না। 
  • বৈষম্য সৃষ্টি: পরিবারে স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি পিতার আধিপত্য যেমন বৈষম্য সৃষ্টি করে, একইভাবে রাষ্ট্রও সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয়। 
  • সম্পত্তির অধিকার: পরিবার তার সমৃদ্ধির জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর নির্ভরশীল। আবার একইভাবে রাষ্ট্রও সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে। পারিবারিক সম্পত্তির উপর রাষ্ট্রিক কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের চূড়ান্ত বিরোধী ছিলেন বোদা। 
  • আধিপত্য: পরিবারের সকল সদস্যকে পরিবারের কর্তার অনুগত হয়ে থাকতে হয়। একইভাবে, রাষ্ট্রের চরম আধিপত্যের অধীনেই থাকতে হয় রাষ্ট্রের সকল সদস্যকে। বোদাঁর মতে, চরম আধিপত্য হল রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

জনকল্যাণ ও সুবিচার

বোদার মতে, সুসংগঠিত একটি রাষ্ট্র প্রথমেই সুবিচার ও প্রতিরক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করবে। তারপর রাষ্ট্র তার সদস্যদের কল্যাণসাধনের জন্য কাজ করবে।

সার্বভৌমিকতা ও আইনের ধারণা

(i) সার্বভৌমিকতা 

বোদাঁ রাষ্ট্রের চরম আধিপত্যকে সার্বভৌমিকতা (Sovereignty) বলে অভিহিত করেছেন। তিনি সার্বভৌমতার একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর মতে ‘সার্বভৌমিকতা হল রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ ও বিরামহীন ক্ষমতা যার দ্বারা আধিপত্যের অবাধ ক্ষমতা সূচিত হয়।’ F₁ বিষয়টিকে আরও সহজভাবে দেখিয়ে বোদা বলেছেন যে, ‘সার্বভৌমিকতা হল নাগরিক ও প্রজাদের উপর রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা, যা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।’ F2 তাঁর মতে সার্বভৌমিকতাই হল রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য, যা তাকে অন্যান্য সংগঠন থেকে পৃথক করেছে।

সার্বভৌম শক্তি শুধুমাত্র ঈশ্বরের কাছেই দায়বদ্ধ থাকে, তাকে কেবলমাত্র প্রাকৃতিক আইনই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবে বোদা এই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার রাষ্ট্র এবং শাসককেই দিয়েছেন, কোনও বিশেষ শাসক বা রাজা বা গোষ্ঠীকে নয়। বোদাঁর মতে, শাসক হলেন সার্বভৌম ক্ষমতার অছি (Trustee) বা অভিভাবক (Custodian)। কোনও নির্দিষ্ট শাসককে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হলে, পরবর্তী অপর একজন শাসক সেই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী ও রক্ষক হবেন।

(ii) আইনের ধারণা

আইন সম্পর্কে বোদাঁর চিন্তাধারা বস্তুতপক্ষে সার্বভৌমিকতার ধারণাটিরই প্রসারিত এবং পরিবর্ধিত রূপ। চূড়ান্ত সার্বভৌমিকতার ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে তিনি সার্বভৌমিকতার সঙ্গে আইনের সম্পর্ক তুলে ধরেন। তাঁর মতে, সার্বভৌমই আইনের স্রষ্টা এবং আইন সার্বভৌমের ইচ্ছা বা আদেশ। এর মধ্যে দিয়ে বোদাঁ মূলত রাষ্ট্র এবং সরকার (রাজতন্ত্র)-কেই আইনের উৎস হিসেবে অভিহিত করতে চেয়েছেন। সার্বভৌমের প্রধান কাজ হল আইন প্রণয়ন করা।

(iii) সার্বভৌম ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা

বোদাঁ অবশ্য সার্বভৌম ক্ষমতার কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও উল্লেখ করেছেন। যেমন- ঐশ্বরিক বিধানের অংশ হিসেবে সার্বভৌম কর্তৃত্ব স্বাভাবিক আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মানবীয় আইনের ঊর্ধ্বে তিনি ঐশ্বরিক বিধানকে স্থান দিয়েছেন। তিনি রাজাকেও এই আইনের অধীনস্থ রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। অপরদিকে রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য সৃষ্ট আইন তথা সাংবিধানিক আইনকে বোদা গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। এমনকি রাজাকেও তিনি এই আইন মান্য করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপরেও হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তাছাড়া প্রতিটি রাষ্ট্রেই কিছু সুপ্রতিষ্ঠিত প্রাকৃতিক নিয়ম আছে, যা সার্বভৌম শক্তি পরিবর্তন করতে পারে না।

রাষ্ট্র এবং সরকার

অ্যারিস্টটলকে অনুসরণ করে বোদাঁ রাষ্ট্র ও সরকারকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন- রাজতান্ত্রিক, অভিজাততান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক। বোদাঁর মতে, সার্বভৌম ক্ষমতা একজনের হাতে থাকলে তা রাজতান্ত্রিক, কয়েকজনের হাতে থাকলে তা অভিজাততান্ত্রিক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের হাতে থাকলে তা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে চিহ্নিত হয়। তবে তিনি মনে করেছেন যে, একের বেশি শ্রেণি বা এই তিনটি শ্রেণির মিশ্রিত রাষ্ট্র কোনোদিনই কাম্য নয়, কারণ তা আদতে নৈরাজ্যেরই জন্ম দেয়।

রাজতন্ত্র

বোদাঁর মতে, তাত্ত্বিকভাবে রাজতন্ত্র বা অভিজাততন্ত্র অপেক্ষা গণতন্ত্র বেশি ভালো হলেও, তার কার্যকারিতা বাকি দুটি ব্যবস্থার তুলনায় কম। অন্যদিকে অভিজাততান্ত্রিক ব্যবস্থায় আধিপত্য ও আনুগত্যের নীতি শিথিল হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। তাই বোদার মতে, রাজতন্ত্রই হল সর্বাপেক্ষা কার্যকরী শাসনব্যবস্থা, যেখানে একক কর্তৃত্বের মাধ্যমে সংকটের অবসান এবং ঐক্যবদ্ধ পরিবেশ গড়ে তোলা সহজ হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বোদাঁ তিন ধরনের রাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, যথা- 

  • স্বৈরতান্ত্রিক শাসন: যে রাজতন্ত্রে dominitus বা আধিপত্য প্রবল এবং যেখানে রাজা তাঁর প্রজাদেরকে ক্রীতদাসের মতো শাসন করে, সেটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন নামে পরিচিত। 
  • বংশানুক্রমিক রাজতান্ত্রিক শাসন: বোদাঁর মতে, এটি রাজতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ রূপ। এতে প্রজাদের অধিকার ও সম্পত্তি সুরক্ষিত, ঐশ্বরিক ও প্রাকৃতিক আইনের প্রতি রাজা অনুগত এবং রাজার সৃষ্ট আইনের মর্যাদা ও পবিত্রতা স্বীকৃত। 
  • স্বেচ্ছাচারী রাজতান্ত্রিক শাসন: এই প্রকার শাসনব্যবস্থায় রাজা নিজ খেয়ালখুশি মতো প্রজাদের শাসন করেন এবং ঈশ্বরের আইন ও প্রাকৃতিক আইনকে লঙ্ঘন করেন।

বিপ্লব

বোদাঁর রাষ্ট্রচিন্তার একটি মৌলিক চিন্তাধারা হল রাষ্ট্রের পরিবর্তন বা বিপ্লব সংক্রান্ত চিন্তাধারা। বোদাঁর মতে, জীবদেহের মতো রাষ্ট্রের জন্ম, বৃদ্ধি ও ধ্বংস হয়। আর এই পথ ধরেই রাষ্ট্রের উন্নতি ও প্রগতির ধারা অব্যাহত থাকে। রাষ্ট্রের মৃত্যু অর্থাৎ অবক্ষয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রের পরিবর্তন ঘটে এবং এক কর্তৃপক্ষের হাত থেকে অন্য কর্তৃপক্ষের হাতে স্থানান্তরিত হয় সার্বভৌম ক্ষমতা। সুতরাং, রাষ্ট্রের পরিবর্তন বা রাষ্ট্রবিপ্লব একটি স্বাভাবিক ঘটনা। বোদার মতে রাষ্ট্রবিপ্লব দুধরনের হতে পারে-

  • Alteratio অর্থাৎ রাষ্ট্রবিপ্লবের ফলে আইন ও অন্য প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন ঘটলেও সার্বভৌমিকতা অপরিবর্তিত থাকে এবং
  • Conversio অর্থাৎ এক্ষেত্রে বিপ্লবের কঠোর প্রয়োগের ফলে সার্বভৌমিকতার পরিবর্তন ঘটে। বোদাঁর মতে, তিনটি কারণে বিপ্লব হতে পারে- ঐশ্বরিক, প্রাকৃতিক ও মানবিক। এর মধ্যে ঐশ্বরিক কারণগুলি হল অদৃশ্য ও অজ্ঞাত। অন্যদিকে প্রাকৃতিক কারণগুলি চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবাধীন, যা জ্যোতিষবিদ্যার সহায়তায় মানুষ উপলব্ধি করতে সক্ষম। আর বিপ্লবের মানবিক কারণগুলি বিশ্লেষণ করে বোদা শাসককে অসাম্য প্রশমিত করা, নাগরিকদের অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের সুযোগ না দেওয়া প্রভৃতি পরামর্শ দিয়েছেন।

সাম্য ও অসাম্য

অ্যারিস্টটলের মতো বোদাঁও তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে বিপ্লব-বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধান করেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে, যারা অসাম্যের শিকার তারা সাম্যের দাবিতে বিদ্রোহ করে। আর যারা সাম্য ভোগ করে তারা অন্যের চেয়ে বেশি সুযোগসুবিধা পাওয়ার জন্য বা উপরে ওঠার জন্য বিপ্লবে শামিল হয়। একইভাবে বোদা বলেছেন, রাষ্ট্রদ্রোহিতার বড়ো কারণ হল অসাম্য। যখন কিছু মানুষ অত্যধিক ধনী হয়ে ওঠে এবং অন্যেরা অত্যন্ত গরীব থাকে তখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার পরিবেশ তৈরি হয়। তবে আশ্চর্যের বিষয় বোদা ছিলেন অসাম্যের উগ্র সমর্থক। তিনি বলেছেন, সম্পত্তির সমানাধিকার রাষ্ট্রের পক্ষে চরম ক্ষতিকারক। এক্ষেত্রে বোঁদার বক্তব্য ছিল স্ববিরোধী।

যুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ

বোদাঁর মতে, রাষ্ট্র যুক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী। যুক্তির দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র হল আইনসম্মত ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। স্বাভাবিক আইন বা নৈতিক আইনকে তিনি যুক্তির অনুশাসন বলেই মনে করেন।

নাগরিকতা

বোদাঁর মতে, সমাজের প্রাথমিক ধাপ হল পরিবার, আর এই পরিবারেই নাগরিক বিকশিত হয়। নাগরিক বলতে তিনি অবশ্য ক্রীতদাস, নারী বা শিশুদের বোঝাতে চাননি, মূলত পরিবারের প্রধানকে বা পিতাকে (Pater Familias) বোঝাতে চেয়েছেন। বোদা মনে করেন যে, পরিবারের প্রধান যখন পরিবারের কর্তৃত্বের সীমানা ছাড়িয়ে অন্যান্য পরিবারের প্রধানদের সঙ্গে মিলিত হন এবং নিজের কর্তৃত্ব ছেড়ে অপর পরিবার প্রধানদের সঙ্গে একত্রিতভাবে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের অধীনস্থ হন, তখন এই পরিবার প্রধানরা নাগরিক সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত হন। 

উদারবাদ

বোদাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে উদারবাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লক্ষণীয়। বিশেষত পলিটিকিউজ গোষ্ঠীর উদারবাদী ভাবধারা তাঁর চিন্তাধারাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment