সাম্যের বিভিন্ন রূপ আলোচনা করো

সাম্যের বিভিন্ন রূপ আলোচনা করো

সাম্যের বিভিন্ন রূপ আলোচনা করো
সাম্যের বিভিন্ন রূপ আলোচনা করো

সাম্যের বিভিন্ন রূপ

সাম্য একটি বহুমাত্রিক ধারণা। সুতরাং, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রকার সাম্যের ধারণার উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

সামাজিক সাম্য, রাজনৈতিক সাম্য, আইনগত সাম্য, অর্থনৈতিক সাম্য, সাংস্কৃতিক সাম্য, লিঙ্গ সাম্য, স্বাভাবিক সাম্য এবং আন্তর্জাতিক সাম্য।

(1) সামাজিক সাম্য

সামাজিক সাম্য (Social Equality) হল একটি বাস্তবতা (‘…Social or civil equality is an actuality’)। সাধারণ অর্থে সামাজিক সাম্য বলতে বোঝায়, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বংশমর্যাদা স্ত্রী-পুরুষ ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সব মানুষের সামাজিক ক্ষেত্রে সমমর্যাদা। এককথায় বলা যায়, সমাজে যখন মানুষে মানুষে কোনোরূপ ভেদাভেদ করা হয় না, তখন তাকে সামাজিক সাম্য বলে অভিহিত করা হয়। বার্কার সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠাকে সামাজিক সাম্য হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, দাস সমাজ ও সামন্ত সমাজে সামাজিক সাম্যের কোনো অস্তিত্ব ছিল না।

পরবর্তীকালে উদার গণতান্ত্রিক সমাজে আইনের অনুশাসন (Rule of Law)-এর প্রসার লাভের ফলে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বলা যায়, সাম্যের প্রকৃত অর্থ সামাজিক সাম্যের দ্বারাই মূর্ত হয়ে ওঠে। সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলেই সমাজের সকলে সমান অধিকার ও স্বাধীনতা লাভ করবে, তবেই প্রত্যেকে তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সমর্থ হবে।

তবে, বিশ্বের কোনো দেশেই সামগ্রিকভাবে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অন্য ভাষায় বলা যায়, বর্তমানেও বিশ্বের সকল দেশেই সামাজিক অসাম্য বিদ্যমান। দৃষ্টান্ত হিসেবে ভারতীয় সমাজে জাতিভেদ প্রথা অস্পৃশ্যতার উপস্থিতির কথা বলা যায়। মার্কসবাদীদের মতে, কেবল সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সকলের সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

(2) রাজনৈতিক সাম্য

রাজনৈতিক সাম্য (Political Equality) বলতে বোঝায় স্ত্রী-পুরুষ জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকারভোগের সমতা। রাজনৈতিক সাম্য গণতন্ত্র ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। কারণ, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকার গঠন ও পরিচালনার দায়িত্ব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনগণের উপর নির্ভর করে। এজন্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সকল ব্যক্তির সমান অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করাই হল রাজনৈতিক সাম্য। রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ভোট দেওয়ার অধিকার ভোটে বা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কার্যে অংশগ্রহণ করার অধিকার সরকারের সমালোচনা করার অধিকার প্রভৃতি। উদারনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনৈতিক সাম্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

তবে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যক্তির রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। মার্কসবাদীদের মতে, শ্রেণিবৈষম্যমূলক সমাজে কখনোই সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। কেবল শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজেই মানুষের রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব।

(3) আইনগত সাম্য

উদারবাদী দর্শনে আইনগত সাম্য (Legal Equality) প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আইনি সাম্যের অধীনে প্রধান দুটি বিষয় হল- আইনের দৃষ্টিতে সমতা (Equality Before Law), ও আইন কর্তৃক সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার (Right to Equal Protection of Law)। এই দুই অধিকারকে একত্রে আইনগত সাম্য (Legal Equality) বলে অভিহিত করা হয়। আইনের দৃষ্টিতে সমতার অর্থ হল ধনী-দরিদ্র, শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্বিশেষে সব নাগরিক – আইনের চোখে সমান। ক্ষমতা, পদমর্যাদা নির্বিশেষে কোনো ব্যক্তিই আইনের  ঊর্ধ্বে নয়। এর অর্থ সমান দোষ এবং অপরাধে সমান শাস্তি ভোগ, অর্থাৎ একজন সাধারণ ব্যক্তি কোনো অপরাধে যে শাস্তি পাবে, রাষ্ট্রপতিও সেই অপরাধে অনুরূপ শাস্তিই ভোগ করবেন।

আইনের দৃষ্টিতে সাম্য নেতিবাচক সাম্যের ধারণা হিসেবে পরিচিত কারণ, রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তির সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করে না। অন্যদিকে, আইন কর্তৃক সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অর্থ হল আইনের মাধ্যমে সকল নাগরিকের সমান সুরক্ষা। এটি ইতিবাচক সাম্য হিসেবে পরিচিত। কারণ এর দ্বারা ব্যক্তি রাষ্ট্রের কাছ থেকে ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রত্যাশা করে।

(4) অর্থনৈতিক সাম্য

অর্থনৈতিক সাম্য (Economic Equality) বলতে বোঝায়, দেশের সকল নাগরিকের আর্থিক সুযোগসুবিধা ভোগের সমতা। বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের মতে, আয় ও সম্পত্তির অধিকারের সমতাই হল অর্থনৈতিক সাম্য। যদিও এই ধরনের অধিকার সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে না, বরং বৈষম্যকেই বাড়িয়ে তোলে। তাই ল্যাস্কি সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ন্যূনতম সম্পত্তি রাখার ব্যবস্থাকে সুনিশ্চিত করার কথা বলেন। অর্থনৈতিক সমতা প্রসঙ্গে ল্যাস্কি-র মত হল, অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া রাজনৈতিক সাম্যের কোনো মূল্য থাকে না। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক সাম্য হল সকলের জন্য পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা প্রদান করা। তিনি আরও বলেন, জীবনযাপনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় বস্তুগুলির উপর সকলের সমানাধিকার থাকা উচিত, নতুবা গণতন্ত্র তত্ত্বসর্বস্বতায় পরিণত হবে।

কারণ, অর্থনৈতিক অসাম্যের কারণে রাজনৈতিক ক্ষমতা বিত্তবান শ্রেণির হস্তে কুক্ষিগত হয়ে পড়ার সম্ভবনা থাকে। তাঁর ভাষায়, রাষ্ট্র কতিপয় ধনী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র মানুষে বিভক্ত হয়ে পড়লে ধনীদের দ্বারা প্রভাবিত যে সরকার গঠিত হয়, তা সর্বদা ধনীদের সম্পদ ও সুযোগসুবিধা সংরক্ষণের কাজ করে (“State divided into a small number of rich and a large number of poor will always develop a government manipulated by the rich to protect the amenities represented by their property.”)। বার্কার-এর মতানুসারে, অর্থনৈতিক সাম্য আইনগত সাম্যের আপেক্ষিক। অর্থাৎ বলা যায়, এ হল সর্বোত্তম মূল্যবোধের প্রকাশ। এই মূল্যবোধ মানুষের সম্ভাবনাগুলি বিকাশের মধ্যেই নিহিত।

(5) সাংস্কৃতিক সাম্য

সাংস্কৃতিক সমতা (Cultural Equality) হল এমন একধরনের সমতা যেখানে বহুত্ববাদী সমাজে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংস্কৃতিগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সমাজে তাদের সঙ্গে কোনো বৈষম্য করা হয় না। এককথায় বলা যায়, সাংস্কৃতিক পার্থক্য নির্বিশেষে সকলকে তার নিজ সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের সমসুযোগ প্রদান করাই হল সাংস্কৃতিক সাম্য। যদিও বাস্তবে উন্নত, উন্নয়নশীল দেশ নির্বিশেষে সংস্কৃতিগত অসাম্য পরিলক্ষিত হয়। ফলে সংখ্যালঘু সংস্কৃতিগুলির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে।

(6) লিঙ্গ সাম্য

অক্সফোর্ড অভিধান অনুসারে লিঙ্গ সাম্য বলতে, লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে নারী ও পুরুষের প্রতি সমআচরণ ও সমসুযোগের ধারণাকে বোঝায়। এককথায় লিঙ্গ সমতা (Gender Equality) হল। হল জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র যথা-অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারী- পুরুষের সমান সুযোগ ও অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করা। নারীবাদী (Feminist)-রা লিঙ্গ সমতাকে মৌলিক মানবাধিকার বলে ঘোষণা করেছেন।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, বেশিরভাগ সমাজই ছিল পুরুষতান্ত্রিক। পুরুষেরা ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পূর্ণ অধিকার ভোগ করত। এর ফলে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা কোনো সুযোগ পায়নি। যুগের পর যুগ ধরে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারীকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। গত শতাব্দীতে নারীবাদী আন্দোলনের ফলে আইনি সংস্কারের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে নারীর ভোটাধিকার ও অন্যান্য অধিকার-সহ লিঙ্গ সমতার বিষয়টিকে বাস্তবায়িত করার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতের রাজনীতিতে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থায় এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। সম্প্রতি ১০৬তম সংবিধান-সংশোধনীর মাধ্যমে লোকসভাতেও মহিলাদের জন্য ১/৩ অংশ আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সাম্য অর্জিত হলেও অর্থনৈতিক সমতা অর্জিত হয়নি। আজও বহু দেশে নারী-পুরুষের মধ্যে সমমজুরি ব্যবস্থা স্বীকৃত হয়নি। গার্হস্থ্য হিংসা, যৌন নির্যাতন এবং পাচার-সহ লিঙ্গভিত্তিক হিংসাকে এখনো নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হয়নি। এজন্য প্রয়োজন কঠোর আইনি পদক্ষেপ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (UNO) সুস্থায়ী বা স্থিতিশীল উন্নয়ন মাত্রার (Sustainable Development Goal) অধীনে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যপী লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়েছে।

আরও পড়ুন – ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা

Leave a Comment