আন্তর্জাতিক আইন ও জাতীয় আইনের পার্থক্য নির্ণয় করো

আন্তর্জাতিক আইন ও জাতীয় আইন
আন্তর্জাতিক আইন ও জাতীয় আইনের মধ্যে কতকগুলি মৌলিক ও প্রকৃতিগত পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
(1) সংজ্ঞাগত পার্থক্য
জাতীয় আইন বলতে বোঝায় সেই আইন, যা রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট ও স্বীকৃত। জাতীয় আইনকে রাষ্ট্রীয় আইনও বলা হয়। এই আইন রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের মধ্যে প্রযোজ্য। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। আন্তর্জাতিক আইন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের জন্য প্রযোজ্য। জাতীয় আইন যেভাবে ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, আন্তর্জাতিক আইন সেভাবে রাষ্ট্রগুলির উপর প্রয়োগের চেষ্টা করা হয়।
(2) প্রকৃতিগত পার্থক্য
সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ জাতীয় আইন বলবৎ করে বলে জাতীয় আইনের একটি সুনির্দিষ্ট প্রকৃতি লক্ষ করা যায়। কিন্তু, আন্তর্জাতিক আইন সুনির্দিষ্ট নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ নেই। এই কারণে আন্তর্জাতিক আইনের আদেশ প্রদানকারী চরিত্র (Imperative Character) লক্ষ করা যায় না।
(3) উৎপত্তিগত ও উৎসগত পার্থক্য
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ট্রাইপেন, অ্যাঞ্জিলোত্তি এবং ওপেনহাইম-এর অভিমত হল, জাতীয় আইনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনের উৎপত্তি বা উৎসগত মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। জাতীয় আইনের উৎস হল জাতীয় রাষ্ট্র বা জাতীয় রাষ্ট্রের আইনসভা। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনো আন্তর্জাতিক আইনসভা দেখা যায় না। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণসভা ও নিরাপত্তা পরিষদের গৃহীত সিদ্ধান্ত, আন্তর্জাতিক সন্ধি ও চুক্তি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পন্ডিতদের রচনা, আন্তর্জাতিক আদালতের রায় প্রভৃতি হল আন্তর্জাতিক আইনের মূল উৎস।
(4) বৈধতাজনিত পার্থক্য
জাতীয় আইনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনের বৈধতাজনিত পার্থক্য রয়েছে। জাতীয় আইন রাষ্ট্রের ভিতরে বলবৎ হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকে না। রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে জাতীয় আইনকে বলবৎ করার জন্য আলাদা কোনো আইনের প্রয়োজন পড়ে না। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক আইন সরাসরি বলবৎ হয় না। আন্তর্জাতিক আইনকে বলবৎ করার জন্য রাষ্ট্রগুলিকে আলাদা করে রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন করতে হয়।
(5) সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের অবস্থানজনিত পার্থক্য
সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের অবস্থানজনিত বিষয়ে জাতীয় আইনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। জাতীয় আইন জাতীয় রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ হিসেবে বলবৎ হয়। জাতীয় আইনের যথাযথ প্রয়োগের জন্য সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। জাতীয় আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের হাতে রয়েছে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে কোনো সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। আন্তর্জাতিক আইন কোনো সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সৃষ্ট বা প্রযুক্ত নয়।
(6) আইনভঙ্গকারীকে শাস্তিপ্রদানজনিত পার্থক্য
জাতীয় আইনের ক্ষেত্রে আইনভঙ্গকারীকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে। রাষ্ট্র আইনভঙ্গকারীকে সংশ্লিষ্ট বিধি অনুসারে শাস্তি দিয়ে থাকে। এই কারণে জাতীয় আইন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা প্রতিটি নাগরিক উপলব্ধি করে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার ব্যাপারে রাষ্ট্রগুলির কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আন্তর্জাতিক আইনভঙ্গকারীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য কোনো সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ নেই।
(7) দ্বন্দ্ব বা বিরোধজনিত পার্থক্য
জাতীয় আইনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনের কোনো দ্বন্দ্ব বা বিরোধ দেখা দিলে আন্তর্জাতিক আইন কার্যকরী হয় না। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার কারণে রাষ্ট্রীয় আইনের উপরে আন্তর্জাতিক আইনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। অর্থাৎ, এইরূপ বিরোধজনিত পরিস্থিতিতে একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক আইনের মর্যাদা হ্রাস পায়, অন্যদিকে তেমনই জাতীয় আইনের অপ্রতিহত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত দুটি উপায়ে এই বিরোধ উপস্থিত হতে পারে-
- আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান না করে রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন করলে, আন্তর্জাতিক আইনকে বাস্তবায়িত করা যায় না। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করলে বিরোধ ঘটে।
- রাষ্ট্র যদি তার নাগরিকদের এমন কার্যসম্পাদন করার অনুমতি দেয়, যা আন্তর্জাতিক চুক্তি, সন্ধি বা আইনানুযায়ী স্বীকৃত বা বৈধ নয়, তখন বিরোধ উপস্থিত হয়।
(8) আইনি অস্পষ্টতাজনিত পার্থক্য
দেশের সর্বোচ্চ আদালত জাতীয় আইনকে ব্যাখ্যা করতে পারে। ফলত জাতীয় আইনে অস্পষ্টতা দেখা দিলে, তা ব্যাখ্যার জন্য বিচারবিভাগ থাকে। এক্ষেত্রে বিচারালয়ের ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। অপরপক্ষে, আন্তর্জাতিক আইনের কোনোরূপ অস্পষ্টতাজনিত সমস্যা দেখা দিলে তাকে ব্যাখ্যা করার জন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা নেই।
(9) আনুগত্য প্রদর্শনে পার্থক্য
জাতীয় আইনের প্রতি সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিক আনুগত্য প্রদর্শনে বাধ্য থাকে। চাইলেও তারা জাতীয় আইনকে উপেক্ষা করতে পারে না। কিন্তু, আন্তর্জাতিক আইনকে মান্য করাকে একজন ব্যক্তি তার কর্তব্য বলে মনে নাও করতে পারে, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে আনুগত্য প্রদর্শন নাও করতে পারে।
উপসংহার
আন্তর্জাতিক আইন ও জাতীয় আইনের মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে একথা অনস্বীকার্য। আইনের বিশ্লেষণমূলক তত্ত্বের প্রবক্তা জন অস্টিন, হল্যান্ড প্রমুখ আন্তর্জাতিক আইনকে আইন হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি হননি। অস্টিনের মতে, আন্তর্জাতিক আইন হল সৌজন্যমূলক আইন (‘International law is regarded as the law of courtesy’)। লর্ড সলসবেরি প্রায় অনুরূপ অভিমত প্রকাশ করে বলেছেন, সাধারণভাবে আইন যে অর্থে ব্যবহৃত হয়, সেই অর্থে আন্তর্জাতিক আইনের কোনো অস্তিত্ব নেই (International law has not any existence in the sense in which the “law usually used”)।
আধুনিক সভ্য দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক আইন ও জাতীয় আইন পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। অধ্যাপক জোহারির মতে, জাতীয় আইন ও আন্তর্জাতিক আইনের সম্পর্ক পারস্পরিক নির্ভরশীল। আইনের উদ্দেশ্য হল ভুল কাজের সংশোধন করা। যখন এই কাজ কোনো ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা সম্পাদিত হয়, তখন তা জাতীয় আইন এবং যখন তা কোনো রাষ্ট্রের দ্বারা সম্পাদিত হয়, তখন আন্তর্জাতিক আইন এই ভূমিকা পালন করে।
আরও পড়ুন – ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা