ছোটোগল্প সংক্রান্ত প্রশ্ন ও উত্তর Class 11 | Choto Golpo Question Answer

ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্য: 
ছোটোগল্পের শুরু যেমন আকস্মিকভাবে-মাঝখান থেকে তেমনই তার সমাপ্তি ও মাঝপথে, একান্ত নাটকীয়ভাবে, অতৃপ্তিতে।
ছোটোগল্পে জীবনের খণ্ডচিত্র বর্ণিত হয়, এবং সেই খণ্ডচিত্রের মধ্যেই পাঠক উপলব্ধি করেন সমগ্রের ব্যঞ্জনা।
স্বল্প আয়তনে ছোটোগল্পের আয়োজন বাহুল্যবর্জিত।
ছোটোগল্পের ভাষা ব্যঞ্জনাধর্মী, সংকেতময়, শিল্পিত ও সংক্ষিপ্ত। 
ছোটোগল্প হল একমুখী-তার একটিমাত্র সামগ্রিক বক্তব্য।

সূচিপত্র

ছোটোগল্প সংক্রান্ত প্রশ্ন ও উত্তর

১। ছোটোগল্প কাকে বলে? ছোটোগল্পকে মোট ক-টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় ও এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লেখো।

সংজ্ঞা: স্বপ্নায়তন ক্ষুদ্র পরিসরে যে-কোনো ঘটনার আকস্মিক বিবরণে ছোটোগল্পের শুরু এবং বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের অসামান্য অভিজ্ঞতায় তার চকিত পরিসমাপ্তি।

স্বল্প চরিত্র, একমুখী ঘটনাবিন্যাস, খণ্ড জীবনচিত্র, একটিমাত্র ক্লাইম্যাক্স (Climax) এসব দিয়েই নির্মিত ছোটোগল্পের আঙ্গিক।

ছোটোগল্পের শ্রেণি বিভাজন: ‘সাহিত্য সন্দর্শন’ রচয়িতা শ্রীশচন্দ্র দাশ বিষয়ানুযায়ী ছোটোগল্পকে মোট পনেরোটি বিভাগে ভাগ করেছেন। যথা- প্রণয়মূলক, সামাজিক, হাস্যরসাত্মক, উদ্ভট, বিজ্ঞাননির্ভর, গার্হস্থ্য/পারিবারিক জীবনমূলক, মনুষ্যেতর, বাস্তবনিষ্ঠ, প্রকৃতি ও মানুষ, সাংকেতিক/প্রতীকধর্মী, গোয়েন্দা গল্প, অতিপ্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, মনস্তাত্ত্বিক, বিদেশি পটভূমিকাযুক্ত।

ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্য: 

  • ছোটোগল্পে জীবনের খণ্ডচিত্র বর্ণিত হয়, এবং সেই খণ্ডচিত্রের মধ্যেই পাঠক উপলব্ধি করেন সমগ্রের ব্যঞ্জনা।
  • স্বল্প আয়তনে ছোটোগল্পের আয়োজন বাহুল্যবর্জিত।
  • ছোটোগল্পের ভাষা ব্যঞ্জনাধর্মী, সংকেতময়, শিল্পিত ও সংক্ষিপ্ত। 
  • ছোটোগল্প হল একমুখী-তার একটিমাত্র সামগ্রিক বক্তব্য। 
  • ছোটোগল্পের শুরু যেমন আকস্মিকভাবে-মাঝখান থেকে তেমনই তার সমাপ্তি ও মাঝপথে, একান্ত নাটকীয়ভাবে, অতৃপ্তিতে।

২। ছোটোগল্পের কাহিনিবৃত্ত ও এর ভাষাবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

কাহিনিবৃত্ত: ছোটোগল্প যেহেতু স্বল্প পরিসরে সমগ্র কাহিনি অংশকে ধারণ করে, তাই এই সংরূপের কাহিনিভাগের বৃত্তগঠনে বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের বিষয়টিই প্রধান অবলম্বন। সেই কারণে একেবারে শুরু থেকেই ছোটোগল্প দ্রুত ছুটে চলে সমাপ্তির দিকে। কোনো গল্পে সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে উত্তরণ, কোনো গল্পে হঠাৎই ক্লাইম্যাক্সে (Climax) পৌঁছোনো তারপর ধীরে ধীরে পরিণতি লক্ষ করা যায়। তবে শীর্ষবিন্দু বা Climax-এর বিস্তারের উপরই ছোটোগল্পের গঠনবিন্যাস নির্ভর করে। এ ছাড়াও কাহিনিবৃত্তে কখনও প্রাধান্য পায় ঘটনা, কখনও কাহিনি হয় চরিত্রকেন্দ্রিক, কখনও বা মুখ্য হয়ে ওঠে ব্যঞ্জনা। এভাবেই নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা, অনুসন্ধান এবং রূপ- রূপান্তরের মধ্য দিয়ে ছোটোগল্প প্রতিমুহূর্তেই নতুন পথের সন্ধানে ধাবমান।

ভাষাবৈশিষ্ট্য: সৃজনশীল গদ্যের ভাষারীতিতে মূলত তিনটি রীতি লক্ষ করা যায়। যথা-বর্ণনামূলক, নাটকীয় এবং কাব্যিক। ছোটোগল্পের ভাষাতেও – এই রীতিই প্রযোজ্য। তবে, মূলত ভাষারীতির বিষয়টি কাহিনি পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার্য-তা একান্তই গল্পকারের লেখনীনির্ভর। তাই কোনো গল্পে লেখক যেমন নির্দিষ্ট একটি ভাষারীতিকে অবলম্বন করেন, কোথাও দেখা যায় – একাধিক রীতির মিশ্রণ। আবার রুক্ষ সময়ের ছাপ মেলে কোনো গল্পের – ভাষায়। অন্যদিকে, সমাজ, মানুষ, বৃত্তি এসব কিছুর প্রেক্ষিতেও ছোটোগল্পের আখ্যান বর্ণনা বা চরিত্রের সংলাপে ভাষাবৈচিত্র্য দেখা যায়। এইভাবে আবহমান কাল ধরে বাংলা ছোটোগল্প ভাষা ও রূপরীতিতে নানান ভাঙাগড়া আজও ঘটিয়ে চলেছে।

৩। বাংলা ছোটোগল্পের উদ্ভব ও ক্রমপরিণতি আলোচনা করো।

উদ্ভব : “খোকা মাকে শুধায় ডেকে—

‘এলেম আমি কোথা থেকে, 

কোনখানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে’।”

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আধুনিক বাংলা ছোটোগল্প বা short story উনিশ শতকের সন্তান হলেও এ কথা বলা বাহুল্য যে, মানুষের গল্প শোনার ইচ্ছেটা কিন্তু মানব ইতিহাসের সমবয়সি। তাই বাংলা ছোটোগল্পের শিকড় সন্ধানে আমাদের পৌঁছোতেই হবে নীতিকথা, উপকথা, রূপকথাদের কাছে। তবে প্রকরণ হিসেবে যথার্থ আধুনিক বাংলা ছোটোগল্পের সূচনা বাঙালির মুদ্রণযন্ত্র এবং পত্রপত্রিকার হাত ধরেই। প্রথমে পত্রপত্রিকায় সংকলিত হতে শুরু হয়েছিল টুকরো টুকরো কাহিনি, যাদের নাম দেওয়া যায় চূর্ণক। এ ছাড়া হিতোপদেশ, পঞ্চতন্ত্রের ন্যায় আরেকটি প্রকার ছিল, যার নাম আখ্যানক। উনিশ শতকে বহুলজনপ্রিয় নকশা জাতীয় কাহিনিতেও ছিল ছোটোগল্পের আভাস। আর ইংরেজি বা ফরাসির মতো বাংলাতেও ছোটোগল্পের প্রস্তুতিপর্বে ছোটো ছোটো উপন্যাস বা ‘নভেলা’-র প্রচলন ছিল। কিন্তু পরিশেষে পাঠকচিত্তে এমন এক আখ্যান পাঠের প্রত্যাশা জন্মাল, যা উপন্যাসের সমগোত্রীয় অথচ দীর্ঘদেহী নয়। বাংলা সাময়িকপত্রই সেই প্রত্যাশা মেটাতে ধাপে ধাপে ত্বরান্বিত করল বাংলা ছোটোগল্পের ক্রমপরিণতিকে।

ক্রমপরিণতি: ‘বঙ্গদর্শন’-এ প্রকাশিত সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ইন্দিরা’-কেই মনে করা হয় বাংলা সাহিত্যে ছোটোগল্প রচনা পরীক্ষার প্রথম ফলাফল, এ ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের দুই ভ্রাতা পূর্ণচন্দ্র এবং সঞ্জীবচন্দ্রেরও দুটি গল্প যথাক্রমে ‘মধুমতী’ এবং ‘দামিনী’ প্রকাশিত হয়। মহিলা গল্পকার হিসেবে নজর কাড়লেন ‘ভারতী’-র সম্পাদিকা স্বর্ণকুমারী দেবী। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, আলালী গদ্য এবং হুতোমের নকশার কৌতুকের ধারাটিকে ফুটিয়ে তুললেন তাঁর ব্যঙ্গবিদ্রূপাত্মক কৌতুক গল্পসমূহে, যেমন- ‘ভূত ও মানুষ’, ‘ডমরু-চরিত’ প্রভৃতি। আধুনিক বাংলা ছোটোগল্পের অনন্য রূপকার তিনি। তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন আরও একজন। কেবল ছোটোগল্প নয়-বলা বাহুল্য, বাংলা কথাসাহিত্য তার অগভীর গতানুগতিকতা থেকে মুক্তি পেল যাঁর হাত ধরে, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি আলোকবর্তিকার ন্যায় আজও পথ দেখাচ্ছেন তাঁর উত্তরসূরিদের।

৪। বাংলা ছোটোগল্পের ধারায় কৌতুকরসের সঞ্চারে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা করো।

অবদান: “…এতদিন পরে বাঙ্গালায় এমন এক লেখকের অভ্যুদয় হইতেছে যাহার লেখা আমাদের দেশের বালক-বালিকাদের এবং তাদের পিতামাতার মনোরঞ্জন করিতে পারিবে।” বাংলা কথাসাহিত্যকে অনাবিল হাস্যরসের ধারায় সিক্ত করেছিলেন যিনি, সেই ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে পূর্বোক্ত মন্তব্যটি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। মানুষ-পশু-ভূতপ্রেত সবাই একসঙ্গে বাসা বেঁধেছে তাঁর গল্পে। বহির্বিশ্বের বিস্তর টানাপোড়েনের মাঝে তিনি শোনালেন রূপকথার ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমিদের কথা। ‘ভূত ও মানুষ’ গল্পগ্রন্থে তাঁর চরিত্ররা ঘোরাফেরা করছে অদ্ভুতের জগতে। এই গল্পগ্রন্থের মোট চারটি গল্প যথা ‘বাঙ্গাল নিধিরাম’, ‘বীরবালা’, ‘লুলু’, ‘নয়ন চাঁদের ব্যবসা’ প্রকাশিত হয় ‘জন্মভূমি’ পত্রিকায়। ‘ডমরু-চরিত’-এ • তিনি পাঠককুলকে নিয়ে গিয়েছেন যমরাজের রাজসভায়। ডমরুধর কেবল • ত্রৈলোক্য-সাহিত্যের নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কমিক ৪ চরিত্র। ‘ডমরু-চরিত’-এ মোট সাতটি গল্প সংকলিত হয়েছে। এই গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত উল্লেখযোগ্য গল্পগুলি হল, ‘স্বদেশি কোম্পানী’, ‘ভিকু ডাক্তার’, ‘চঞ্চলার গাইগরু’ প্রভৃতি। এইসব গল্প ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার বিভিন্ন পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এ ছাড়াও তাঁর অন্যান্য ব্যঙ্গাত্মক গল্পগ্রন্থের অন্যতম ‘মজার গল্প’ (১৯০৬) গ্রন্থের মোট আটটি গল্প প্রকাশ পায় ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকায়। ‘মুক্তা-মালা’ (১৯০১) গ্রন্থের এগারোটি গল্প সাপ্তাহিক ‘বঙ্গবাসী’-তে প্রকাশ পায়। যদিও ‘রূপসী হিরন্ময়ী’ এবং ‘আমার সেই অমূল্য মণি’ গল্প দুটি গ্রন্থভুক্ত হয়নি। এগুলি প্রকাশিত হয় ‘জন্মভূমি’ পত্রিকায়। শতাধিক বছর পেরিয়ে এসেও বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত বাংলা ছোটোগল্পে আজও তিনি সমান জনপ্রিয়, আর তাঁর সৃষ্টি কালজয়ী।

৫। বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাসে স্বর্ণকুমারী দেবীর অবদান আলোচনা করো।

অবদান: বাংলা শিল্প-সাহিত্যসংস্কৃতির ইতিহাসে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি যুগ যুগ ধরে যেন এক পথপ্রদর্শকের ন্যায় অবতীর্ণ। সেই বাড়িরই সুযোগ্য কন্যা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা ভগিনী স্বর্ণকুমারী দেবী উনিশ – শতকের বাঙালি সমাজে নারীজাগরণের প্রতীকরূপে প্রতিভাত। কাব্য- – কবিতা-গান-উপন্যাস-শিল্প-সাহিত্যের সর্বত্র তাঁর গৌরবময় পদচারণা। • স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখনী যেমন আনাগোনা করেছে নারীমনের অন্দরমহলে তেমনই মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার ও সমাজকে নিপুণভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন তিনি। তাঁর সমস্ত রচনায় সর্বপ্রধান রচনাগুণ হল সুরুচি এবং আভিজাত্য। উপন্যাসের পাশাপাশি বাংলা ছোটোগল্প রচনার প্রাথমিক পর্বে তাঁর রচিত কয়েকটি ছোটোগল্পেরও নিদর্শন পাওয়া যায়। নতুন এই সাহিত্য সংরূপকে চিহ্নিত করতেই যেন ‘ভারতী’ আর ‘বালক’ পত্রিকায় স্বর্ণকুমারীর ‘নবকাহিনী’ নামাঙ্কিত গল্পগ্রন্থের গল্পগুলি একের পর এক প্রকাশ পেতে থাকে। এই গল্পগ্রন্থের প্রথম তিনটি গল্পই ঐতিহাসিক উপাদাননির্ভর।

‘নবকাহিনী’-র মধ্যে সংকলিত ‘কেন’, ‘যমুনা’, ‘চাবিচুরি’ গল্পগুলিতে প্লটের দুর্বলতা প্রকাশ পেলেও, ‘আমার জীবন’ ও ‘গহনা’ গল্পদ্বয় কিন্তু তাঁর প্রতিভার অব্যর্থ নিদর্শন।

এ ছাড়া ‘পেনে প্রীতি’, ‘অমরগুচ্ছ’, ‘মালতী ও গল্পগুচ্ছ’ সংকলনের ‘মিউটিনি’ তাঁর স্মরণীয় রচনা।

কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই যে, বাংলা সাহিত্যের এই নবীন শিল্পসংরূপ ছোটোগল্পকে, শুরুর সেই দিনে যাঁরা স্বাগত জানিয়ে গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদেরই একজন স্বর্ণকুমারী দেবী-আজ এক অনালোচিত ইতিহাস মাত্র। অথচ বাংলা ছোটোগল্পের বহমান স্রোত আজও, বিস্মৃতির আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা এই পুরোধা স্থানীয়দের সৃজনীগুণের কাছে ঋণগ্রস্ত।

৬। ছোটোগল্প ও একাঙ্ক নাটকের তুলনা করো।

উদ্ভব: একদা একসময় প্রাচীন সেই নগরে এক যে ছিল রাজা, এক যে ছিল রানি-সময়ের গলিপথ ধরে এইসব গল্প চলে আসছে মানব ইতিহাসের শুরুর সেই দিন থেকেই। কিন্তু আধুনিক ছোটোগল্প স্বতন্ত্র সংরূপ হিসেবে একেবারেই উনিশ শতকের মধ্যভাগের ফসল। অন্যদিকে, এই শতকেরই অন্তিমলগ্নে নাট্যশিল্পের আধুনিক সংরূপ হিসেবে আবির্ভাব ঘটে একাঙ্ক নাটকের। বয়সের বিচারে যেমন এরা সমবয়সি, চেহারাতেও উভয়ের বহুক্ষেত্রেই সাদৃশ্য লক্ষণীয়। যেমন-

আয়তন: ছোটোগল্প এবং একাঙ্ক নাটক উভয়ই স্বল্পায়তনবিশিষ্ট। একমুখী: ছোটোগল্পের ন্যায় একাঙ্ক নাটকও একটিমাত্র দৃশ্যপটে একটিই ঘটনা সূত্রকে আশ্রয় করে সংক্ষিপ্ত অথচ আকস্মিকভাবেই ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছোয়।

ব্যক্তি: একাঙ্ক নাটক-নামেই একটি অঙ্কের আভাস। সেই একটি অঙ্কে কিন্তু সুসংবদ্ধ পরিসরে ক্ষুদ্রায়তন এই নাট্যসংরূপের ভাবগত ও শৈলীগত যাবতীয় সমাবেশ হঠাৎই পরিণতিতে পৌঁছোয় তেমনই ছোটোগল্পও স্থান ও কালের স্বল্প, সীমিত পরিসরে কাহিনির আকস্মিক পরিসমাপ্তি টানে।

চরিত্র: ছোটোগল্পের ন্যায় একাঙ্ক নাটকে চরিত্রসংখ্যাও স্বল্প।

বৈসাদৃশ্য: একাঙ্ক নাটক যেহেতু নাটক, তাই কাহিনি উপস্থাপনায় অভিনয়, মঞ্চসজ্জা, আলোকসম্পাত, আবহসংগীত, সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে, ছোটোগল্প পাঠ্যবিষয়। যদিও ছোটোগল্পের কাহিনির ফাঁকে ফাঁকে চরিত্রদের এক-আধটা সংলাপ-কথোপকথন থাকে। আবার ছোটোগল্পেও মিলতে পারে একাঙ্ক নাটকের স্বাদ; যেমন রহস্য-রোমাঞ্চে ভরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে বা বনফুলের অনুগল্পগুলিতে পাই।

তবে সামগ্রিক বিচারে, বাংলা সাহিত্যে এই বয়ঃকনিষ্ঠ প্রকরণ দুটি যে সহোদরের ন্যায় বিরাজমান-এ কথা বলা বাহুল্য।

৭। ছোটোগল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটোগল্পগুলির আলোচনা ও মূল্যায়ন করো।

আলোচনা: উনিশ শতকের পৃথিবীতে চার জন প্রধান ছোটো গল্পকার এসেছিলেন, পাশ্চাত্যের গী-দ্য-মপাসাঁ, আন্তন চেকভ, এডগার অ্যালান পো আর বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মপাসাঁর রচনায় রয়েছে সমাজ সময়ের এক গ্লানিময় দশা, অথবা পো-র রচনায় সামাজিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংকটের দ্বিবিধ যন্ত্রণা বর্তমান। সেই সূত্র ও বাস্তব প্রেক্ষিতেই রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা ছোটোগল্পের উদ্ভব ও যথার্থ বিকাশ।

বাংলা সাহিত্যে ছোটোগল্পের প্রথম সার্থক স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘ভিখারিনী’ (১২৮৪ বঙ্গাব্দ) গল্পের মাধ্যমে তাঁর ছোটোগল্প রচনার সূত্রপাত। কালানুক্রম অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পগুলিকে তিনটি পর্বে বিভক্ত করা যায়। প্রথম পর্বটিকে বলা হয় ‘হিতবাদী-সাধনা-ভারতী’-র যুগ (১২৯৮-১৩১৮বঙ্গাব্দ)। দ্বিতীয় পর্বটি হল- ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার যুগ এবং তৃতীয় পর্বটি হল অন্তিম যুগ (১৩২৫-১৩৪৭ বঙ্গাব্দ)।

বিষয় বা মূলভাব অনুসারে রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পগুলি হল-

সমাজসমস্যামূলক: সামাজিক জীবনযন্ত্রণা, প্রথা, ভালোবাসা ও স্নেহের ক্ষুদ্র অথচ আন্তরিক বিষয়গুলি লেখক পরম মমতায় এঁকেছেন- ‘দেনাপাওনা’ ‘রামাকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘বিচারক’, ‘নষ্টনীড়’ গল্পে।

পারিবারিক: পারিবারিক সনাতন স্নেহ-মমতায় দেশকাল এক হয়ে চিরন্তন রূপ পরিগ্রহণ করেছে-‘শাস্তি’, ‘দর্পহরণ’, ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে।

জীবন ও প্রকৃতি নির্ভর: রবীন্দ্রনাথ জীবনকে দার্শনিক দৃষ্টিতে দেখেছেন আবার প্রেমের স্বর্গীয় মাধুর্য ধারণ করেছেন করপুটে।

সেই বাণীই প্রকাশ পেয়েছে ‘পোস্টমাস্টার’, ‘অতিথি’, ‘একরাত্রি’, ‘ছুটি’ প্রভৃতি গল্পে।

প্রেমবৈচিত্র্যমূলক: মানুষের জীবনের সুপ্ত অথবা ব্যক্ত প্রেমের বিচিত্র প্রকাশ ‘মণিহারা’, ‘দুরাশা’, ‘দালিয়া’, ও ‘জয়-পরাজয়’ গল্পে।

রাজনীতি বিষয়ক: গল্পকার রাজনীতির আলো-ছায়ার মধ্যেও জীবনের সূর্যালোকের দ্বার রুদ্ধ করেননি ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘দুবুদ্ধি’ ও ‘রাজটীকা’ গল্পে।

অতিপ্রাকৃত: ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘কঙ্কাল’, ‘গুপ্তধন’ গল্পগুলিতে অতিলৌকিক আখ্যান অপেক্ষা মানবমনের রহস্যময়তারই প্রাধান্য। পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রভাবে গল্পগুলিতে সৃষ্টি হয়েছে এক বিচিত্র আবহ।

হাস্যরসাত্মক: সুরসিক রবীন্দ্রনাথের রসিক স্বভাবটি ফুটে উঠেছে যে সমস্ত গল্পে সেগুলি হল- ‘ইঁদুরের ভোজ’, ‘ইচ্ছাপূরণ’, ‘বিজ্ঞানী’, ‘আব্দুল মাঝির গল্প’ প্রভৃতি।

মূল্যায়ন: বাংলা সাহিত্যে প্রথম ও সার্থক ছোটোগল্পের ভগীরথ রবীন্দ্রনাথ। বলা বাহুল্য, তিনি বাংলা ছোটোগল্পের উদ্ভাবক, প্রবর্তক ও সিদ্ধিদাতা গণেশ। শাসনে শাসনে তিনি বাংলা ছোটোগল্পকে নির্মম বেত্রখণ্ডে পরিণত করেছেন, অথচ তা হয়ে উঠেছে বাঙালির একান্ত প্রাণের নিভৃতচারী।

৮। বাংলা ছোটোগল্পের ধারায় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা করো।

অবদান: সূর্য (রবীন্দ্রনাথ) ও চন্দ্র (শরৎচন্দ্র)-দীপ্ত বাংলা সাহিত্য- ভুবনে প্রভাত (প্রভাতকুমার) এসেছিল অচিরেই। এসেছিল ‘চিরপথিকের’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, বুনে দিয়ে গিয়েছিল ভাসমান জীবনের বাস্তবনিষ্ঠ আখ্যান। বিংশ শতাব্দীর কথাসাহিত্যে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় উদার মানবতাবোধের কথাকার, অন্যদিকে কৌতুকশিল্পী। বিশুদ্ধ কৌতুকরসের ধারা, রবীন্দ্রনাথ, ত্রৈলোক্যনাথের হাত ধরে প্রভাতকুমারের গল্পেই যথাযথ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।

কান্না-হাসিতে দোলায়িত মানবজীবন তাঁর গল্পে অনবদ্য রূপ লাভ করেছে। তাঁর ‘কাশিবাসিনী’ গল্পে বিধবা নারীর জীবনযন্ত্রণার পাশাপাশি বর্ণিত হয়েছে সন্তান বাৎসল্যের রূপটি। আবার, ‘বলবান জামাতা’ গল্পে অনাবিল হাস্যরসের সঞ্চার ঘটেছে। ‘বিবাহের বিজ্ঞাপন’ গল্পটিও অতীব কৌতুকপূর্ণ।

সমাজসমস্যা, নানাবিধ সংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রকাশ পেয়েছে প্রভাতকুমারের ‘ধর্মের কল’, ‘স্বর্ণসিংহ’, ‘প্রতিজ্ঞাপূরণ’, ‘বাস্তুসাপ’ প্রভৃতি গল্পে।

মানব ও মানবেতর সম্পর্কের কাহিনি, যা বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদে পরিণত হয়েছে-তা প্রভাতকুমারের ‘আদরিণী’। ‘আদরিণী’ নামে একটি হাতিকে কেন্দ্র করেই আলোচ্য গল্পটির আবর্তন। এ ছাড়া স্বদেশি আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত হয় ‘দেশী ও বিলাতী’, ‘উকিলের বুদ্ধি’।

সমকালীন জীবন ও সমাজসমস্যার রূপায়ণে, চরিত্রচিত্রণের নৈপুণ্যে, নির্ভেজাল হাস্যরসের সঞ্চারে, পরিস্থিতি রচনার দক্ষতায় রবীন্দ্র- সমকালেও বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথাকার হয়ে উঠেছিলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।

৯। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক কালে বাংলা ছোটোগল্পের গতিপ্রকৃতি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

গতিপ্রকৃতি: বাংলা ছোটোগল্পের পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাসে বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুক গল্পের যে ধারা, তা প্রতিষ্ঠা পায় ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের রচনায়। কিন্তু তা চরম সার্থকতা লাভ করেছিল প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের হাতে। ‘দেবী’, ‘আদরিণী’-র মতো অসাধারণ ভাবগম্ভীর গল্প; আবার বিপরীতে ‘বলবান জামাতা’, ‘মাস্টার মহাশয়’, ‘রসময়ীর রসিকতা’ ইত্যাদি হাস্যরসাত্মক গল্প তাঁর লেখনীর সৃষ্টি। এই ধারার ক্রমবিকাশের পথে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি কৌতুক-ব্যঙ্গের সমাহারে বিচিত্র সব গল্প লিখলেন। একই পথ অনুসরণ করলেন সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, দেবেন্দ্রনাথ বসু। অন্যদিকে, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক রচনা অনুসৃত পথের ছায়াপাত লক্ষ করা গেল প্রমথ চৌধুরীর গল্পগুলির মধ্যে। এঁদের উত্তরাধিকার বহন করেই পরবর্তীকালের ছোটোগল্পের প্রাঙ্গণে জোয়ার আসে।

১০। গল্পকার শরৎচন্দ্রের সাহিত্যপ্রতিভার মূল্যায়ন করো।

সূচনা: ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো গল্পকার শরৎচন্দ্রও গ্রামবাংলার পটভূমিতে পারিবারিক স্নেহ-প্রীতি-বাৎসল্যের সুরটি বারংবার ধ্বনিত করেছেন। তিনি নারী হৃদয়ের আর্তিকে সহানুভূতির সঙ্গে বাণীরূপ দিয়েছেন তাঁর ছোটোগল্পে।

গল্পসমূহ: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য গল্পগুলি হল- ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘রামের সুমতি’, ‘মেজদিদি’, ‘বড়দিদি’, ‘মামলার ফল’, ‘হরিলক্ষ্মী’, ‘পরেশ’, ‘মন্দির’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘অনুপমার প্রেম’, ‘কাশীনাথ’, ‘স্বামী’, ‘নববিধান’, ‘সতী’, ‘মহেশ’, ‘অভাগীর স্বর্গ’, ‘লালু’, ‘একাদশী বৈরাগী’ ইত্যাদি।

পারিবারিক গল্প: ‘বিন্দুর ছেলে’ গল্পে পালিত পুত্র অমূল্যধনের প্রতি বিন্দুর বাৎসল্য এবং স্নেহ বিরোধের পটভূমি সৃষ্টি করেছে। ‘রামের সুমতি’ গল্পে দুরন্ত রামের প্রতি বৌদি নারায়ণীর অপত্যস্নেহ সংসারে অশান্তির বীজ বপন করেছে।

সমাজ বিষয়ক গল্প: ‘মন্দির’ গল্পের মধ্য দিয়ে শরৎচন্দ্রের সাহিত্যক্ষেত্রে প্রবেশ এবং ‘কুন্তলীন’ পুরস্কারপ্রাপ্তি তাঁর লেখনীর শক্তি সম্পর্কে আমাদের নিঃসন্দিহান করে। গল্পটিতে জমিদারকন্যা অপর্ণা বাল্যবিধবা। বিগ্রহসেবা করতে এসে পূজারি শক্তিনাথের প্রতি তার হৃদয়দৌর্বল্য মানব মনস্তত্ত্বকে প্রকাশ করে। শরৎচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ‘মহেশ’ গল্পটিতে জমিদারি শোষণ, জাতিভেদপ্রথা ও সমাজের ধনী-দরিদ্রের বিভাজনের ছবি প্রকাশিত। মানুষ ও পশুর নিবিড় আত্মিকতা গল্পটিতে অন্য মাত্রা সংযোজিত করে। ‘অভাগীর স্বর্গ’ ও ‘একাদশী বৈরাগী’ শরৎচন্দ্রের অপর সার্থক সৃষ্টির অন্যতম।

কথাকার শরৎচন্দ্রের মধ্যে একজন দার্শনিক ব্যক্তি প্রচ্ছন্ন ছিলেন, তিনি অতীন্দ্রিয় ভাবরসের মানুষ। সহজ কথায় তিনি নারীর ইচ্ছাশক্তির প্রাবল্য, সেবা করার প্রচণ্ড জেদ ও স্বাধীনতার ছবিকে তুলে ধরেছিলেন বলেই আপামর বাঙালি পাঠকের কাছের লেখক হয়ে উঠেছিলেন।

১১। ছোটোগল্প রচনায় বিভূতিভূষণের অবদান আলোচনা করো।

গল্পসমূহ: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত অবহেলিত ও পরিত্যক্ত পল্লির দরিদ্র মানুষের দরদি কথাশিল্পী। তাঁর গল্পসংকলনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য-‘মেঘমল্লার’, ‘মৌরীফুল’, ‘যাত্রাবদল’, ‘তালনবমী’, ‘কিন্নরদল’, ‘উপলখণ্ড’ ইত্যাদি।

‘মেঘমল্লার, নাস্তিক: প্রথম গল্পসংকলন ‘মেঘমল্লার’-এর প্রথম দুটি গল্প ‘মেঘমল্লার’ ও ‘নাস্তিক’ বৌদ্ধ ও জৈন যুগের কাহিনি। ‘মেঘমল্লার’ গল্পটি ঐতিহাসিক রোমান্স। কলালক্ষ্মী সরস্বতীর বন্ধন ও বন্ধনমোচনের কাহিনি এই গল্পের বিষয়। ‘নাস্তিক’ গল্পটি জৈন যুগের এক অজ্ঞেয়বাদী দার্শনিকের কাহিনি।

পুঁই মাচা, ‘মৌরীফুল কিন্নরদল: পরিত্যক্ত পল্লির বিত্তহীন পরিবারের সুখ-দুঃখ নিয়ে করুণরসের গল্প ‘পুঁইমাচা’। দারিদ্র্যের শেষ সীমায় পৌঁছে একটি ব্রাহ্মণ পরিবার কীভাবে সর্বহারার দোসর হয়ে উঠেছে, তারই কথা বর্ণিত হয়েছে এই গল্পে। ‘পুঁইমাচা’র মতোই করুণ গল্প ‘মৌরীফুল’ শ্বশুরগৃহে বধূনির্যাতনের কাহিনি। নিরানন্দ পল্লিজীবনের আনন্দঘন ছবি প্রকাশিত হয় ‘কিন্নরদল’ গল্পে।

আহ্বান: ‘আহ্বান’ গল্পটি সমগ্র বাংলা সাহিত্যের একটি দুর্লভ সম্পদ। হিন্দু-মুসলমানের অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা এ গল্পের বিষয়বস্তু।

বুধীর বাড়ি ফেরা: পশুপ্রীতি, নিসর্গপ্রীতির সহোদর। বিশেষত, গোজাতির প্রতি প্রীতি কৃষিনির্ভর গ্রামীণ মানুষের সহজাত বৃত্তি। ‘বুধীর বাড়ি ফেরা’ গল্পে কসাইখানা থেকে প্রৌঢ়া গাভী বুধীর নিজগৃহে প্রত্যাবর্তনের কাহিনি বর্ণিত।

ছোটোগল্পগুলির তন্বিষ্ঠ পাঠক মাত্রেই অনুভব করেন বিভূতিভূষণ অসাধারণ জীবনাসক্তির শিল্পী।

১২। বাংলা ছোটোগল্পের ধারায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা করো।

আত্মপ্রকাশ: “….তোমার মতো গাঁয়ের মানুষের কথা আগে পড়িনি” স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁর কথাসাহিত্য প্রসঙ্গে এমন মন্তব্য করেছিলেন, তাঁর সাহিত্যে ভিড় করে এসেছিল রাঢ় বাংলার অন্তেবাসী মানুষদের বিচিত্র সব গল্প। বেদে, পটুয়া, হাঁড়ি, ডোম, বাগদি-সাহিত্যের আঙিনায় সমাজের যে প্রান্তটা আড়ালেই থেকে যেত বরাবর, তাঁর গল্প জুড়ে রইল তাদেরই কথা। হ্যাঁ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ‘বাংলা ছোটোগল্পের মহাকবি’, ‘রসকলি’ গল্পের মধ্য দিয়ে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনে ছোটোগল্পকার তারাশঙ্করের আবির্ভাব ঘটল ‘কল্লোল’ পত্রিকায়।

বৈশিষ্ট্য: বাংলা কথাসাহিত্যে ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন, তারাশঙ্করের ছোটোগল্পে একদিকে যেমন চিত্রিত হল জমিদারতন্ত্রের সঙ্গে বণিকতন্ত্রের সংঘাত, অন্যদিকে রাঢ় বাংলার সভ্যতা-সংস্কার-গোষ্ঠী-জীবন, অন্ত্যজ মানুষদের জীবনচিত্র মহাকাব্যের ন্যায় উপস্থাপিত হল। তাঁর গল্পের ভাষায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে মাটির মানুষদের ঘাম, রক্ত। চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব, নাটকীয়তা, কাহিনি ও ঘটনার গতিময়তা তারাশঙ্করের রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নিয়তির কাছে মানুষের অসহায় আত্মসমর্পণ, আদিম প্রবৃত্তি, প্রবীণ-নবীনের দ্বন্দ্ব, যাযাবর জীবনবৃত্তির পাশাপাশি বৈয়ব সমাজচিত্র, মনুষ্যেতর প্রাণীর সঙ্গে মানুষের আত্মিক সম্পর্কের জাল রচনা, এমনকি, পঞ্চাশের মন্বন্তরক্লিষ্ট বাংলার জীবন্ত চিত্র প্রকাশ পেয়েছে তাঁর গল্পসমূহে।

গল্পসম্ভার: জীবনের বিপরীতে মৃত্যুর অমোঘ লীলা, আদিম প্রবৃত্তি টানাপোড়েন, জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষা প্রভৃতি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে ‘তারিণী মাঝি’ গল্পে। অন্যদিকে ‘অগ্রদানী’ গল্পে নিয়তির নিষ্ঠুর লীলায় নিজের সন্তানের পিণ্ডই গলাধঃকরণ করতে বাধ্য হয়েছে অগ্রদানী ব্রাহ্মণ পূর্ণ চক্রবর্তী। সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে বণিকতন্ত্রের, নবীনের সঙ্গে প্রবীণের দ্বন্দ্ব রচিত হয়েছে ‘জলসাঘর’ গল্পে। আদিম প্রবৃত্তির আদিম মহাকাব্যিক গল্প ‘নারী ও নাগিনী’-এক নাগিনীর উপর মানবসত্তা আরোপিত হয়েছে এই গল্পে। আদিম জৈব প্রবৃত্তির প্রতিফলন ঘটেছে ‘বেদেনী’ গল্পে। তারাশঙ্করের ‘ডাইনি’ গল্পটি সামাজিক অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে কুসংস্কারাচ্ছন্ন পল্লিবাংলার দর্পণস্বরূপ।

এ ছাড়া বৈয়ব সমাজচিত্র বর্ণনায় ‘রসকলি’, মানুষ-মনুষ্যেতর প্রাণীর আত্মিক সম্পর্কের চিত্রণে ‘কালাপাহাড়’, পঞ্চাশের মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে ‘পৌষলক্ষ্মী’, ‘বোবাকান্না’ বাংলা কথাসাহিত্যের কালজয়ী আখ্যান। ছোটোগল্পের স্বল্প পরিসরে লেখনীর বিষয়বৈচিত্র্যে বাংলা কথাসাহিত্যে তারাশঙ্কর চিরসমুজ্জ্বল।

১৩। বাংলা ছোটোগল্প রচনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা করো। 

ভূমিকা: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা কথাসাহিত্যের ‘স্বয়ংসিদ্ধ গদ্যকার’। যে বাস্তববাদী ও বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা তিনি সতত পরিবর্তনশীল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করতে চাইলেন নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যে তা অভিনব। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নানা জটিল ও মৌলিক জিজ্ঞাসা বিংশ শতাব্দীর অস্থির সময় পর্বের লেখকদের উন্মুখ করে তুলেছিল, কথাসাহিত্যে তার বিজ্ঞানসম্মত উপস্থাপনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা সর্বাগ্রে।

প্রেক্ষাপট: বিংশ শতাব্দীর ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পরাধীনতার গ্লানি, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং অন্যদিকে মন্বন্তর ও কালোবাজারির ফলে মধ্যবিত্তের জীবনে ঘনায়মান দুর্যোগ জীবনের প্রচলিত মূল্যবোধ ও প্রত্যয় সম্পর্কে আধুনিক লেখকদের উতলা করে তুলেছিল। মানিক তার ছোটোগল্পে সেই দোদুল্যমান জীবনজিজ্ঞাসারই উত্তর খুঁজেছেন। লেখক বলছেন “ছেলেবেলা থেকে ‘কেন?’ নামক মানসিক রোগে ভুগেছি….. খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জানা চাই।” (গল্প লেখার গল্প)

গ্রন্থসমূহ: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত গল্পগ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু গল্পগ্রন্থ হল- ‘অতসী মামি’, ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘সরীসৃপ’, ‘আজ-কাল-পরশুর গল্প’, ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’, ‘হলুদপোড়া’ প্রভৃতি।

উপসংহার: রবীন্দ্র পরবর্তী পর্যায়ে বাংলা কথাসাহিত্যের ধারায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাস্তবচেতনা, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা ও বাম মতাদর্শের জন্য স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী।

আরও পড়ুনLink
নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তরClick Here
চার্বাক সুখবাদ প্রশ্ন উত্তরClick Here
পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা প্রশ্ন উত্তরClick Here

Leave a Comment