ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা এক স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্রচিন্তা, যার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
(i) স্বতন্ত্র রাষ্ট্রভাবনা
ম্যাকিয়াভেলি ইউরোপের প্রচলিত রাজনৈতিক গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিলেন না। জন প্লামেনাজ (John Plamenatz) –এর মতে, ম্যাকিয়াভেলি প্রচলিত ইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তার বাইরে ছিলেন। গেটেল বলেছেন যে, ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রতত্ত্ব রচনায় উৎসাহী ছিলেন না, রাষ্ট্রকে রক্ষা করার উপায় আবিষ্কার করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তিনি প্লেটো বা অ্যারিস্টটলের মতো জগৎ, ঈশ্বর, মানুষ, ধর্ম, চার্চ- এসব বিষয়ে ভাবতে বসেননি। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রের ক্ষমতা, মর্যাদা ও স্থায়িত্ব রক্ষার পথ উদ্ভাবন করা।
(ii) আধুনিকতা
ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল চিন্তার আধুনিকতা। এজন্যই ম্যাকিয়াভেলিকে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার অগ্রদূত বলা হয়। তিনি সমস্তরকম মধ্যযুগীয় কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ধ্যানধারণা অতিক্রম করে যুক্তিবাদী, বাস্তববাদী, ধর্মনিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন।
(iii) ধর্মনিরপেক্ষতা
মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় ঐশ্বরিক ও মানবিক বিষয়গুলি একই সাথে বিচার করা হত। খ্রিস্টীয় মতবাদ ঈশ্বরের জগতের পবিত্রতা ও লৌকিক জগতের অপবিত্রতার এক ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করেছিল। ম্যাকিয়াভেলি এই ধর্মীয় বন্ধন থেকে রাষ্ট্রনীতিকে মুক্ত করেন। তাঁর মতে, রাজনীতি ও ধর্ম দুটি ভিন্ন জগতের ব্যাপার। রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটলে রাজনীতির নিজস্বতা ব্যাহত হবে। তিনি বলেন, মানুষই রাজনীতির প্রথম ও শেষ কথা। মানবিক সমস্যা ও মানবিকতাই রাজনীতির ধর্ম। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রবিদ যিনি ধর্ম ও নীতিশাস্ত্র থেকে রাজনীতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথক করতে চেয়েছিলেন।
(iv) নৈতিকতা বা মূল্যবোধ
ম্যাকিয়াভেলির জীবনবোধের সঙ্গে বাস্তববাদী চিন্তা বিজড়িত। তাঁর নৈতিকতা বা মূল্যবোধ খ্রিস্টীয় মূল্যবোধ থেকে স্বতন্ত্র। তাঁর বিচারে একজন ব্যক্তির মূল্যবোধ ও শাসকের মূল্যবোধ এক হতে পারে না। রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনে একজন শাসককে শঠতা, বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যাচার, শক্তি প্রয়োগ ইত্যাদির আশ্রয় নিতে হতে পারে। এগুলি তাঁর ক্ষেত্রে অনৈতিকতা নয়। কারণ, এগুলি ছাড়া তাঁর রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখা অসম্ভব হতে পারে। ম্যাকিয়াভেলি মনে করতেন যে, সাফল্যই রাষ্ট্রের শক্তি বিচারের মাপকাঠি, যে পথেই তা অর্জন করা হোক না কেন। স্যাবাইন (Sabine) বলেছেন, ‘এমন ভাবনার জন্য ম্যাকিয়াভেলিকে নীতিহীন বলা চলে না; বরং বলা যায় নীতি সম্পর্কে তিনি ছিলেন উদাসীন।’
(v) প্রয়োজনভিত্তিক রাষ্ট্রনীতি
ম্যাকিয়াভেলি যেমন শাসকের বাহুবল বা সামরিক শক্তির কথা বলেছেন, তেমনি ভালো আইন ও ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপনের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, বাহুবল দ্বারা রাজ্য রক্ষা করা যায়, কিন্তু চিরস্থায়ী খ্যাতি অর্জন করা যায় না। নতুন রাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে সুশাসনের চেয়ে সামরিক শক্তি বেশি জরুরি। তবে রাজতন্ত্রের ভিত সুদৃঢ় করার পর প্রজাদের মঙ্গলের বিষয় দেখা উচিত। তাই Good Arms, Good Laws ও Good Examples-এর প্রয়োজনভিত্তিক প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয় বলে তিনি মনে করতেন।
(vi) সনাতন চিন্তার উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা
ধ্রুপদি বা সনাতন চিন্তার উত্তরাধিকারকে প্রতিষ্ঠা করা ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ম্যাকিয়াভেলি মনে করতেন যে, মধ্যযুগীয় কুসংস্কার ও বাধাকে অতিক্রম করার জন্য গ্রিস-রোমের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ইউরোপে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই সকল প্রাচীন ঐতিহ্য ও সেই সময়কার প্রাচীন সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলার নিদর্শনগুলি থেকেই মানুষ পেতে পারে মুক্ত জীবনযাত্রার আস্বাদ। এইভাবেই পুরোনোর মধ্যে নতুনকে দেখা এবং সেই নতুনকে আহ্বান করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক চিন্তাধারার কৃতিত্ব।
ম্যাকিয়াভেলিই সর্বপ্রথম আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণাকে প্রচার করেছিলেন। তাই তাঁকে আধুনিক জাতীয়তাবাদের রূপকার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর