রেনেসাঁর কারণ: আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট

যেসকল সুপ্রাচীন সভ্যতা মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে, গ্রিক সভ্যতা তাদের মধ্যে অন্যতম। মধ্যযুগে এই গ্রিক শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চার পীঠস্থান ছিল কনস্ট্যান্টিনোপল। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে অটোমান তুর্কিদের হাতে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন ঘটলে ইটালি গ্রিক ও রোমান সাহিত্যচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়- ইউরোপের মানসিক জগতের ভাব পরিবর্তন ঘটে। ক্রুসেডের প্রভাব, সামন্ততন্ত্রের অবসান, পোপের কর্তৃত্ব হ্রাস, ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসার, নগর ও শহরের বিকাশ, যুক্তিবাদের উন্মেষ ইত্যাদি মানুষের জীবনচর্যাকে মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের সুযোগ এনে দিয়েছিল।
(1) ক্রুসেডের অবদান
ক্রুসেডের সূত্রে প্রাচ্য সভ্যতার সঙ্গে পাশ্চাত্য সভ্যতার পরিচয় ঘটে। ইউরোপীয় ধর্মযোদ্ধারা প্রাচ্যে এসে এখানকার ভোগবাদী জীবনাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হন। প্রাচ্যের মানুষের বিলাসপূর্ণ জীবনযাপন পদ্ধতি, জীবনকে আনন্দমুখর ও মোহময় করার নানান প্রক্রিয়া, সুস্বাদু খাদ্য ইত্যাদি তাদের আকৃষ্ট করে। ফলে চার্চের কঠোর ধর্মীয় জীবনযাপনে তারা বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন। প্রাচ্যদেশীয় জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, রসায়ন ইত্যাদি ক্রুসেডারদের মনকে যুক্তিবাদী করে তোলে।
(2) ইটালির নগররাষ্ট্রের পুনরুজ্জীবন
দ্বাদশ শতক থেকে ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী ইতালীয় নগররাষ্ট্রগুলির বাণিজ্যে পুনরুজ্জীবন ঘটে। বাইজানটাইন সাম্রাজ্য এবং ইসলামিক দেশগুলির সঙ্গে ইটালির নবপর্যায়ে বাণিজ্যিক লেনদেন শুরু হয়। মধ্যএশীয় মোঙ্গল শক্তি প্রাচীন রেশম পথ (Silk Route) ধরে চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করলে পশ্চিম ইউরোপের রাজ্যগুলির বাণিজ্যও গতি পায়। এই পুনরুজ্জীবিত বাণিজ্যকর্মে ইটালির নগররাষ্ট্রগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভেনিস (Venice), ফ্লোরেন্স (Florence), জেনোয়া (Genoa), পিসা (Pisa), অ্যামালফি (Amalfi) ইত্যাদি স্বাধীন ও প্রজাতান্ত্রিক নগররাষ্ট্রগুলি মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ ও উদারতাবাদের মহত্তর আদর্শের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করলে পঞ্চদশ শতকের ইউরোপে নবজীবনের সূর্যোদয় ঘটে।
(3) নতুন চেতনার উন্মেষ
বাণিজ্যের বিকাশ ও আনুষঙ্গিক আর্থসামাজিক উপাদানের সমন্বয়ে ইটালিতে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটে।
- নগরসভ্যতার বিকাশ: চতুর্দশ শতক থেকে সপ্তদশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত সময়কালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নগরসভ্যতার পুনরুত্থান ঘটে। একটি স্বতন্ত্র নগরসভ্যতার জন্ম হয়। নগরের অধিবাসীরা গ্রামীণ অধিবাসীদের তুলনায় নিজেদের সংস্কৃতিবান বলে মনে করতে শুরু করেন।
- যুক্তিবাদী সাহিত্যচর্চা: কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের পর গ্রিক পণ্ডিতগণ খুব সহজেই আশ্রয় পান ইটালিতে। ফলে ইটালির বিভিন্ন নগর-শহর বিশেষভাবে ভেনিস এবং ফ্লোরেন্স যুক্তিবাদী, কুসংস্কারমুক্ত এবং ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়।
- অভিজাত সম্প্রদায়ের ভূমিকা: নবজাগরণের বিকাশে ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ, পোপ এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি (Henry VIII), ফরাসিরাজ প্রথম ফ্রান্সিস (Francis ।) প্রমুখ গ্রিক পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। রোমান পোপরাও প্রাচীন পুথি সংগ্রহে বিশেষ উদ্যোগী হন। এ ছাড়া ধনী বণিক, ভূস্বামী ও অভিজাতবৃন্দ শিল্পী-সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে এগিয়ে আসেন। তাঁদের আনুকূল্যে প্রকাশিত হয় নতুন নতুন সাহিত্য, গড়ে ওঠে নতুন শিল্পকলা। ধর্মনিরপেক্ষ, মুক্তমনা এই নবসংস্কৃতি, জগতের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে তাদের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি তোলে।
- বিজ্ঞান সাধনা: আধুনিক বিজ্ঞানসাধকরা চার্চ-প্রচারিত পৃথিবীকেন্দ্রিক জীবনচর্চাকে নস্যাৎ করে দেন এবং সৌরকেন্দ্রিক ভাবনাচিন্তাকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
- নতুন ধর্মচেতনা: নতুন ধর্মচেতনার ফলে মানবসমাজের উপর চার্চের প্রভাব শিথিল হয়। মানুষ ধর্মকে তার নিজ নিজ জীবনচর্চার অংশ হিসেবে স্বাধীনভাবে গ্রহণ করার শিক্ষা পায়।
- ভৌগোলিক আবিষ্কার: নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষের মনে অজানাকে জানার ইচ্ছা বহুগুণ বৃদ্ধি করে। দুঃসাহসিক সামুদ্রিক অভিযানে নামেন উদ্যোগী নাবিকেরা। আবিষ্কৃত হয় নতুন নতুন দেশ-মহাদেশ। ইউরোপের দীর্ঘকালের ধারণা, যে পৃথিবীর কেন্দ্রে ভূমধ্যসাগরের অবস্থান, তা পাল্টে যায়।
(4) মুদ্রণযন্ত্রের প্রভাব
জার্মানির গুটেনবার্গ আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করলে অল্প সময়ে এবং স্বল্পমূল্যে বই ছাপাবার ব্যবস্থা হয়। ফলে কোনও গুণী ব্যক্তির মতাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য আর তাঁর কাছে সশরীরে যাওয়ার কিংবা তাঁর সমসাময়িক হওয়ার প্রয়োজন রইল না। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই জ্ঞানলাভের সুযোগ পায়, ফলে নবজাগরণের গতি দ্রুত হয়।
(5) আদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা
ইউরোপে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় (University) গড়ে ওঠে ইতালীয় নগররাষ্ট্রে। একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে স্থাপিত হয় পাদুয়া (Padua) এবং বোলোনা (Bologna) বিশ্ববিদ্যালয়। ইটালির নগররাষ্ট্রগুলির ক্রমপ্রসারিত বাণিজ্যের সুষ্ঠু পরিচালনার প্রয়োজনে এই ধরনের কেন্দ্রীভূত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়। বৃহদাকার বাণিজ্য পরিচালনার জন্য ইটালির নগররাষ্ট্রগুলির নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক আইনবিধি, আইনজীবি, চুক্তিপত্রের খসড়া লিখনে দক্ষ কেরানি বা নোটারি (Notary), লিপিকার ইত্যাদির আবশ্যিকতা অনুভূত হয়। বোলোনা, পাদুয়া প্রভৃতি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আইনশাস্ত্র রচনা ও পঠনপাঠনের কেন্দ্র হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। বোলোনা ছাড়াও রোম (Rome), পেভিয়া (Pavia), র্যাভেন্না (Ravenna) প্রভৃতি শহরে আইন বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ১১৫০ থেকে ১১৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্যারিস (Paris) বিশ্ববিদ্যালয়ের আবির্ভাব ঘটে। ক্রমে দর্শনচর্চার কেন্দ্র হিসেবে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় শ্রেষ্ঠত্বের কৃতিত্ব অর্জন করে।
(6) আদি মানবতাবাদী ধারণা
বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যুক্তিনিষ্ঠ, ধর্মনিরপেক্ষ এবং রোমান ও গ্রিক ঐতিহ্যের সমন্বয়ে সমাজ, রাষ্ট্র ও জীবনের পথনির্দেশ করে। ধর্মভাবনার বাইরে এবং ঊর্ধ্বে ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞান আহরণের এই প্রাথমিক প্রয়াসকেই পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকরা মানবতাবাদ (Humanism) নামে অভিহিত করেছেন।
(7) আরব পণ্ডিতদের ভূমিকা
মধ্যযুগের ইউরোপে খ্রিস্টান সন্ন্যাসী ও যাজকদের সঙ্গে গ্রিক ও রোমান রচনাবলির পরিচয় ছিল। তবে এই জ্ঞানের বিস্তার ছিল সীমিত। চতুর্দশ শতকের গোড়ার দিকে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এই সময় গ্রিক পণ্ডিত প্লেটো (Plato) ও অ্যারিস্টটল (Aristotle)-এর রচনাবলির ব্যাপক চর্চা শুরু হয়। তবে গ্রিক সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ব্যাপকতর প্রসারের কৃতিত্ব ইউরোপীয় পন্ডিতদের প্রাপ্য ছিল না, এই কাজের কৃতিত্ব প্রাপ্য আরব অনুবাদকদের। তাঁরা এই সময়ে প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের প্রাচীন নথিপত্র রক্ষণাবেক্ষণ ও অনুবাদ করে ইউরোপীয় জগতকে ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানভাণ্ডারের হদিস দেন।
(8) আরবি ও ফারসি সাহিত্যের প্রভাব
আরব পণ্ডিতদের করা গ্রিক সাহিত্যের অনুবাদ পাঠ করে যেমন প্রাচ্যের চিন্তাবিদরা সমৃদ্ধ হন, তেমনই গ্রিক পণ্ডিতরাও আরবীয় ও পারসিক সাহিত্য অনুবাদ করে মননশীলতার জগতে রূপান্তর আনেন। এই রচনাগুলির বিষয়বস্তু ছিল মূলত প্রকৃতি বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, জোতির্বিদ্যা, রসায়ন ও চিকিৎসাবিদ্যা। টলেমি (Ptolemy) রচিত জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক Almagest গ্রন্থটি গ্রিক ভাষা থেকে আরবি ভাষায় অনূদিত হয়। এই রচনায় আরব সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যায়। ইটালির শিক্ষাজগতে জ্ঞানীগুণী পণ্ডিত হিসেবে সম্মানিত সমকালীন মুসলমান পণ্ডিতদের অন্যতম ছিলেন ইবন সিনা (Ibn Sina, ৯৮০-১০৩৭ খ্রি.)। তিনি ছিলেন মধ্য এশিয়ার বুখারা প্রদেশের চিকিৎসক ও দার্শনিক।
অপর একজন দক্ষ পারসিক চিকিৎসক ও দার্শনিক ছিলেন অল-রাজি (Al- Razi, ৮৬৫-৯২৫ খ্রি.)। তিনি ইথানল উৎপাদন, বিশোধন ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ আবিষ্কার করেন। সালফিউরিক অ্যাসিডও তাঁরই আবিষ্কার। মুসলিম চিন্তাবিদ, বহুবিদ্যা বিশারদ ও আইনবিদ আবু ওয়ালিদ ইবন রুশদ (Ibn Rushd, ১১২৬-১১৯৮ খ্রি.) দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান, গণিত-সহ নানা বিষয়ে অমূল্য সব পুস্তক রচনা করেছেন। তিনি ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনতত্ত্বের শিক্ষার মধ্যে একটা সমন্বয়সাধনকারী পথের সন্ধান দেন। খ্রিস্টান চিন্তাবিদরা ইবন রুশদের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। এঁদের রচনাবলি নবজাগরণ যুগের মানবতাবাদী চিন্তাভাবনার গোড়াপত্তন করে।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর