ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ

ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ

ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ
ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ

ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ঘোষিত মূল কারণ ছিল বিপথগামী ক্যাথলিক চার্চ এবং যাজকতন্ত্রের অনাকাঙ্খিত স্বেচ্ছাচার থেকে খ্রিস্ট ধর্মকে মুক্ত করা। তবে শেষপর্যন্ত এটি বিশুদ্ধ ধর্মকেন্দ্রিক ছিল না। ধর্মভাবনার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক স্থাপিত হলে এই আন্দোলন এক নতুন চরিত্র লাভ করে। যাইহোক, ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পশ্চাদ্গটে নানা কারণ সক্রিয় ছিল।

(1) ক্যাথলিক চার্চের বিপথগামিতা

প্রাথমিকভাবে খ্রিস্টান ধর্ম একটি অনাড়ম্বর, আচারবর্জিত, সৎ ও সরল ধর্মীয় জীবনের আদর্শ হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কালক্রমে রোমান ক্যাথলিক চার্চ সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়। ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সেবার আদর্শ থেকে সরে এসে পোপ এবং যাজকেরা দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, বিলাসী ও অনৈতিক জীবনযাপনের প্রতি আসক্ত হয়ে ওঠেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায় ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির মন্ত্রী ও ক্যাথলিক কার্ডিনাল উলসি (Thomas Wolsey)-র কথা। ক্ষমতালোভী এই সন্ন্যাসী সারা জীবনে বহু অর্থ উৎকোচ হিসেবে গ্রহণ করে প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন। ধর্মের এই বিপথগামিতার প্রতিবাদেই ইউরোপে সংস্কার আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল।

(2) পোপের আধিপত্য

সমগ্র খ্রিস্টান জগতে পোপের সীমাহীন আধিপত্য এবং ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে জাহির করার প্রবণতা ইউরোপের রাজা এবং জনগণের একাংশের মনে অসন্তোষের জন্ম দেয়। ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পোপবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।

(3) পোপের অধঃপতন

ধর্মক্ষেত্রে যাবতীয় দুর্নীতি ও অনাচারের কেন্দ্রে ছিল পোপতন্ত্র। পোেপরা ব্যক্তিগত জীবনে প্রকাশ্য বিলাসব্যসনে অভ্যস্ত হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পোপ ইটালির লৌকিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতা দখল করে প্রায় স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন। নানা ছুতোয় পোপ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে থাকেন। যাজকদের দুটি কর অ্যানেটস (Annates) ও টেনথস্ (Tenths) বাবদ প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। উচ্চ যাজকদের পদ বিক্রয় বা সিমনি (Simony), বিবাহ সংক্রান্ত আইনভঙ্গ, অপরাধের জন্য মার্জনাপত্র বা ক্ষমাপত্র বিক্রয় (Indulgence) ইত্যাদি খাতে পোপের হাতে বিপুল অর্থ সঞ্চিত হয়। ত্যাগব্রতে দীক্ষিত পোপ ভোগবিলাসী হয়ে উঠলে ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বৃদ্ধি পায়।

(4) ক্যাথলিক ধর্মমতের বিতর্কিত সংস্কারসমূহ

রিফরমেশন বা ধর্মসংস্কার আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, ক্যাথলিক ধর্মমতের নানান বিতর্কিত সংস্কার। মেরি ও জিশুখ্রিস্টের মূর্তিপূজা, ক্রুশ নিয়ে সংস্কার, দেহ ও রক্তের পরিবর্তন তত্ত্ব (Transubstantiation) এবং সম্ভদের মূর্তি নিয়ে উন্মাদনা যুক্তিবাদী মানুষরা মেনে নিতে পারেননি।

(5) কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন ও নবজাগরণ

১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্ট ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টান চার্চগুলি মুসলিমদের হাতে চলে যায়। ফলে খ্রিস্ট ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নটি সংশয়াধীন হয়ে পড়ে। আবার পঞ্চদশ শতকে নবজাগরণের হাত ধরে যে মানবতাবাদী চেতনা ও যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটে, তার প্রাবল্যে মানুষ ক্যাথলিক চার্চের অনাচার ও দুর্নীতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।

(6) মহামারির প্রভাব

চতুর্দশ শতকে ইউরোপে প্লেগ ও মহামারির (কৃষ্ণমৃত্যু) কারণে মানুষের জীবনে অস্থিরতা দেখা দেয়। মানুষ বিশ্বাস করে যে, পাপের শাস্তিরূপেই এই মহামারি নেমে এসেছে এবং চার্চ বা যাজকেরা ধর্মপথে মানুষকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। ফলে চার্চের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়। গ্রামাঞ্চলে যাজক-ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে ঘটতে থাকে কৃষক বিদ্রোহ। ফ্রান্সে (১৩৫৮ খ্রি.), ইংল্যান্ডে (১৩৮১ খ্রি.) যাজক-ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে কৃষকরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ক্ষুব্ধ কৃষকসমাজ ধর্মসংস্কার আন্দোলনের মধ্যে তাদের মুক্তির পথ খুঁজে নিলে আন্দোলন দ্রুত প্রসার লাভ করে।

(7) অর্থনৈতিক কারণ

অধ্যাপক ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) ও আর এইচ টনি (RH Tawney) মনে করেন, পুঁজিবাদের উত্থানের প্রেক্ষাপটে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মতত্বের পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। রক্ষণশীল ক্যাথলিক ধারায় যেখানে অতীন্দ্রিয়বাদ শিক্ষা দেওয়া হয়, সেখানে প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ শেখায় মিতব্যয়িতা, কঠোর পরিশ্রম ও সহিষ্ণুতা। প্রোটেস্ট্যান্ট মতানুসারে পার্থিব সকল কাজই ঈশ্বরনির্দিষ্ট। সুশৃঙ্খল জীবন ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই পুঁজি সঞ্চয় করা সম্ভব। যদিও এই মতটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়।

(8) স্থানীয় ভাষায় বাইবেল

ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে স্থানীয় ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ইংল্যান্ডে ত্রয়োদশ শতকে উইলিয়ম টিন্ডেল (William Tyndale) বাইবেলের অনুবাদ করেন। পঞ্চদশ শতকে নানা আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ শুরু হয়। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে দ্রুত বাইবেল ছাপানো ও ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ কথ্য ভাষায় বাইবেলের মর্মবাণী পাঠ করতে পারেন। তাদের চেতনা সমৃদ্ধ হয়। মানুষ বুঝতে পারেন যে, যাজকদের নির্দেশিত আচার-অনুষ্ঠানের উল্লেখ বাইবেলে নেই। যাজকেরা নিজেদের পেশাগত আর্থিক লাভের কথা ভেবেই ধর্মীয় আচার পালনের নির্দেশনামা তৈরি করেছেন।

(9) এলিট (Elite) শ্রেণির উদ্ভব

চতুর্দশ শতকে জার্মানিতে ব্যাবসাবাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। নগরের পুনরুজ্জীবন ঘটে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক লরেন্স স্টোন (Lawrence Stone)-এর মতে, এইসূত্রে শিক্ষিত বুর্জোয়া শ্রেণির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। কার্ল মার্কসও এই পর্বে বণিক-বুর্জোয়া শ্রেণির ক্ষমতা বৃদ্ধি লক্ষ করেছেন। এই বুর্জোয়া শ্রেণি যাজকতন্ত্রের অনাচারের বিরুদ্ধে সংস্কারপন্থীদের হাত শক্ত করেন। অবশ্য কেউ কেউ এই মত মানতে চাননি। তাঁদের মতে নগর-বুর্জোয়া শ্রেণির প্রবল অস্তিত্ব তখন ছিল না। তবে একদল শিক্ষিত অযাজকীয় বুদ্ধিজীবী (Elite) শ্রেণি যাজকদের অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।

(10) রাজন্যবর্গের সমর্থন

ধর্মসংস্কার আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। রোমান পোপদের দাবি ছিল যে, তাঁরা লৌকিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। তাই সম্রাটকে অভিষিক্ত করার অধিকার যেমন পোপের হাতে ন্যস্ত, তেমনই সম্রাটকে পদচ্যুত করাও পোপের অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। মধ্যযুগে সামন্তপ্রথার পরিণতি হিসেবে আঞ্চলিক রাজন্যদের উত্থান হলে পোপের এই দাবি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। পোপ ও রোমান সম্রাট উভয়পক্ষই সামন্ত রাজাদের নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ করতেন।

ইতিমধ্যে সম্রাট ও পোপ উভয়েরই ক্ষমতা অনেকটা হ্রাস পেয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবীরা অ্যারিস্টটলের ভাষ্য পুনরুদ্ধার করে প্রচার করেন যে, রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের উৎস ধর্ম নয়- জনগণ। ফরাসি সন্ন্যাসী জন (John) তাঁর ‘On Royal and Papal Power’ গ্রন্থে বলেন যে, রাজশক্তি সৃষ্টি করেছে মানুষ। তাই ধর্মযাজকরা রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করতে পারেন না। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক রোমান আইন বিশেষজ্ঞ মার্সিলিয়ো বা মার্সিলিয়াস (Marsilias of Padua)-ও তাঁর The Defender of Peace (The Defensor Pacis) বইয়ে একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন।

জার্মান রাজন্যবর্গ এই সুযোগে পোপ ও সম্রাটের কর্তৃত্বমুক্ত হওয়ার জন্য ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পক্ষ নেন। ইতিহাসবিদ মীনাক্ষী ফুকন (Meenaxi Phukan) তাঁর Rise of the Modern West: Social and Economic History of Early Modern Europe গ্রন্থে বলেছেন যে, পরবর্তী মধ্যযুগে যে রাজনৈতিক রূপান্তর সাধন হয়েছিল, তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চার্চের গুরুত্ব হ্রাস করেছিল।

(11) জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান

ষোড়শ শতকে ইউরোপের নানা অঞ্চলে জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সদর্থক ভূমিকা পালন করেছিল। কারণ সেইসব জাতীয় রাষ্ট্রের রাজন্যবর্গ সার্বভৌম রাজতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন। রাষ্ট্রযন্ত্র বা শাসনতান্ত্রিক কার্যাবলির উপর তাঁরা পোপ ও যাজক শ্রেণির হস্তক্ষেপ চাইতেন না। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ক্যাথলিক চার্চের বাইরে গিয়ে জাতীয় চার্চ প্রতিষ্ঠা। কাজেই ধর্মসংস্কার আন্দোলন তাঁদের অনভিপ্রেত ছিল না।

(12) ধর্মসংস্কারকদের উদ্যোগ

উপরিউক্ত কারণগুলি ছাড়াও ইউরোপের ধর্মসংস্কারকদের উদ্যোগ ‘রিফরমেশন’-কে দৃঢ় ভিত্তি দান করেছিল। ফ্লোরেন্সের সাভোনারোলা (Girolamo Savonarola), ইংল্যান্ডের জন ওয়াইক্লিফ (John Wycliffe) প্রমুখ ধর্মসংস্কারকগণ খ্রিস্টীয় চার্চের দুর্নীতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানান এবং চার্চের সংস্কারের পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। হল্যান্ডের ডেসিডেরিয়াস ইরাসমাস তাঁর In Praise of Folly নামক গ্রন্থে সমসাময়িক যুগের চার্চের ত্রুটিবিচ্যুতি, অ-খ্রিস্টীয় নীতি ও মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করেন। এই সকল মনীষীদের বক্তব্য ও প্রচার চার্চের অনাচার ও দুর্নীতির প্রতি ইউরোপীয় জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল।

(13) প্রত্যক্ষ কারণ

ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল জার্মানিতে মার্জনাপত্র বা ইনডালজেন্স বিক্রয়ের বিরুদ্ধে মার্টিন লুথারের প্রতিবাদ। ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির স্যাক্সনি প্রদেশে টেটজেল (Johann Tetzel) নামক একজন ডোমিনিকান যাজক কর্তৃক পোপ স্বাক্ষরিত মার্জনাপত্র বা মুক্তিপত্র বিক্রির তীব্র প্রতিবাদ জানান ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় চরিত্র মার্টিন লুথার। লুথারের এই আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রকৃতপক্ষে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের মশাল প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছিল। তা ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপের দেশে দেশে।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment