আঞ্চলিক শক্তির উত্থান | অষ্টম শ্রেণি ইতিহাস প্রথম অধ্যায় | Ancolik Shoktir Utthan | Class 8 History

আঞ্চলিক শক্তির উত্থান | অষ্টম শ্রেণি ইতিহাস

আঞ্চলিক শক্তির উত্থান | অষ্টম শ্রেণি ইতিহাস
আঞ্চলিক শক্তির উত্থান | অষ্টম শ্রেণি ইতিহাস

পলাশির যুদ্ধের গুরুত্ব কী ছিল?

ভারতের ইতিহাসে পলাশির যুদ্ধের (১৭৫৭ খ্রি.) গুরুত্ব অপরিসীম। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা তথা ভারতে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়েছিল। তাই অধ্যাপক পি জে মার্শাল বলেছেন, ‘পলাশির যুদ্ধ নিছক যুদ্ধই ছিল না, পলাশির ঘটনা হল একটি বিপ্লব।’

সূচিপত্র

পলাশির যুদ্ধের গুরুত্ব

  1. পলাশির যুদ্ধের ফলে বাংলার নবাব ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে নতুন নবাব মির জাফরের কোনো ক্ষমতাই ছিল না, প্রকৃত ক্ষমতা ছিল ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। কোম্পানি নবাবের সিংহাসনের পশ্চাতে প্রকৃত শক্তি-তে পরিণত হয়েছিল।
  2. পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইংরেজ কোম্পানি ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার সুযোগ পাওয়ার ফলে বাংলা থেকে অন্যান্য বণিকগোষ্ঠী পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।
  3. পলাশির যুদ্ধে জয়ের ফলে কোম্পানির মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই যুদ্ধে কোম্পানির সামরিক ও কূটনৈতিক দক্ষতা প্রমাণিত হয়েছিল।
  4. পলাশির যুদ্ধের ফলে দাক্ষিণাত্যে ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধে ইংরেজদের চূড়ান্ত জয়লাভ তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি বহুলাংশে বৃদ্ধি করে।
  5. ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশির যুদ্ধে জয়লাভ করে বাংলার সম্পদ হস্তগত করেছিল। এই সম্পদ লাভের ফলে তারা দক্ষিণ ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার এবং বাণিজ্যের উন্নতি ঘটিয়েছিল।
  6. পলাশির যুদ্ধের পর বাংলা তথা ভারতে পাশ্চাত্য ভাবধারার অনুপ্রবেশ ঘটে, ফলে এক নবদিগন্তের উন্মোচন হয়।

পলাশির যুদ্ধের গুরুত্ব প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বলেছেন, “পলাশির যুদ্ধ মধ্যযুগের অবসান ও আধুনিক যুগের সূচনা ঘটিয়েছিল”।

পলাশির যুদ্ধ কি ভারতে ব্রিটিশদের ক্ষমতালাভে সাহায্য করেছিল?

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশির প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ-দৌলা ও রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত পলাশির যুদ্ধে নবাবের বাহিনী ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়। এই যুদ্ধের ফলে-

(i) ব্রিটিশ কোম্পানির বাণিজ্যিক ক্ষমতালাভ: পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের ফলে কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের বাণিজ্যে দস্তকের প্রয়োগ ঘটাতে শুরু করে এবং এর মধ্য দিয়ে বাংলার ব্যাবসাবাণিজ্যে ব্রিটিশ কোম্পানির একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

(ii) বাংলায় কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই যুদ্ধে জয়লাভের মধ্য দিয়ে ভারতে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় ও সেই সূত্র ধরেই কোম্পানি সমগ্র ভারতে তাদের সাম্রাজ্যবিস্তারের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

(iii) ব্রিটিশ কোম্পানির দ্বারা ফরাসি শক্তির পরাজয়: পলাশির যুদ্ধে ব্রিটিশদের জয়লাভ ফরাসি শক্তির মধ্যে ভীতির জন্ম দেয় এবং এরপর তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধে মনোবল হারিয়ে তারা ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়।

(iv) ব্রিটিশ কোম্পানির সামরিক দক্ষতা বৃদ্ধি: এই যুদ্ধে বাংলার নবাবের পরাজয় তার সামরিক দক্ষতার অভাব ও অন্যদিকে ব্রিটিশ কোম্পানির রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিবৃদ্ধিকে চিহ্নিত করে।

(v) ভারতব্যাপী আধিপত্যের সূচনা: বাংলার বিপুল ধনসম্পদকে ব্যবহার করে ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলগুলি নিজেদের অধিকারে আনতে সচেষ্ট হয়। ফলে সমগ্র ভারতব্যাপী তাদের আধিপত্য বিস্তারের সূচনা হয়।

(vi) নবাবের উপর ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা: ব্রিটিশ কোম্পানি যুদ্ধে জয়লাভের ফলে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং এই অধিকারের বলে বাংলার নবাব যেমন মির জাফর, মির কাশিম, ইংরেজদের হাতের পুতুলে পরিণত হন। পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের ফলে একদিকে যেমন ভারতে কোম্পানির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয় ঠিক তেমনই কোম্পানি বাংলার সিংহাসনের প্রকৃত নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতে থাকে। বাংলার নবাব পদে কোম্পানি তার মনোমতো ব্যক্তিকে বসাতে থাকে। অতএব, একথা বলা যেতে পারে পলাশির যুদ্ধ ভারতে ব্রিটিশদের ক্ষমতালাভে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।

বক্সারের যুদ্ধের কারণগুলি আলোচনা করো।

অথবা, ইংরেজদের সঙ্গে মির কাশিমের যুদ্ধের কারণগুলি লেখো।

বক্সারের যুদ্ধ হয়েছিল ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে। এই যুদ্ধ হয়েছিল বাংলার নবাব মির কাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজা উদ-দৌলা ও মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পূর্ববর্তী নবাব মির জাফরকে সরিয়ে মির কাশিমকে বাংলার সিংহাসনে বসায়। কিন্তু সিংহাসনে আরোহণের পর মির কাশিম স্বাধীনভাবে রাজত্ব চালনা করতে চাইলে ইংরেজদের সঙ্গে তার বিরোধ বাধে।

বক্সারের যুদ্ধের কারণ

রাজনৈতিক কারণ

(i) মুঙ্গেরে রাজধানী স্থানান্তর: সিংহাসনে আরোহণের পর মির কাশিম স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার জন্য রাজধানী স্থানান্তরিত করেন মুঙ্গেরে। বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ ছিল ইংরেজ প্রভাবিত। তাই তিনি রাজধানী স্থানান্তরের পরিকল্পনা করেছিলেন।

(ii) বৈধ ফরমান লাভ: মির কাশিম ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে অবৈধভাবে বাংলার সিংহাসন লাভ করেন। তিনি নিজেকে বৈধ নবাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা রাজস্ব প্রদানের অঙ্গীকার করে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের ফরমান নিয়েছিলেন। এই ব্যবস্থা ইংরেজরা মেনে নিতে পারেনি।

সামরিক কারণ :

(i) ইউরোপীয় রণকৌশল গ্রহণ: নবাব মির কাশিম চিরাচরিত রণকৌশলের পরিবর্তে উন্নত ইউরোপীয় ধাঁচে সেনাবাহিনীকে মজবুত করতে চেয়েছিলেন। এর জন্য তিনি আর্মেনীয় গ্রেগরিকে প্রধান সেনাপতি, ফরাসি সমরুকে এবং আর্মেনীয় মার্কারকে সহসেনাপতি পদে নিযুক্ত করেছিলেন।

(ii) আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাণের কারখানা প্রতিষ্ঠা: মির কাশিম উপলব্ধি করেছিলেন তার সেনাবাহিনীর অন্যতম দুর্বলতার কারণ- উন্নত আগ্নেয়াস্ত্রের অভাব। এই অসুবিধা দূর করার জন্য তিনি মুঙ্গেরে কামান, বন্দুক, গোলাবারুদের কারখানা গড়ে তুলেছিলেন। বলা বাহুল্য মির কাশিমের এইসব কার্যকলাপ ইংরেজদের সহ্য হয়নি।

অর্থনৈতিক কারণ

(i) আর্থিক সমস্যা: 

  • চুক্তিমতো নবাব বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলার রাজস্ব ইংরেজদের দিয়ে নিয়ন্ত্রণমুক্ত হন, 
  • এরপর তিনি ১৩% ভূমিরাজস্ব এবং সেস ও আবওয়াব বৃদ্ধি করেন,
  • হিসাব পরীক্ষা করে অর্থ তছরূপকারী রাজস্বকর্মীদের জরিমানা করেন, 
  • আলিবর্দি ও মির জাফরের পরিবারের সঞ্চিত অর্থ বাজেয়াপ্ত করেন, 
  • জগৎ শেঠ পরিবারের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ আদায় করেন। এর ফলে নবাবের আর্থিক সচ্ছলতা এলেও ইংরেজদের সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ হয়।

(ii) দেশীয় বণিকদের শুল্ক প্রত্যাহার: ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ফাররুখশিয়রের কাছ থেকে বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যাবসাতে এই ফরমানের অপব্যবহার করতে থাকে। এতে নবাব ও দেশীয় বণিকগণ ক্ষতিগ্রস্ত হন। এমতাবস্থায় নবাব দেশীয় বণিকদের শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। ফলে ইংরেজদের সঙ্গে তার বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এই সমস্ত ঘটনার মিলিত পরিণামেই ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধ হয়।

বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব উল্লেখ করো।

বক্সারের যুদ্ধ হয়েছিল ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সার নামক জায়গায়। এই যুদ্ধ হয়েছিল বাংলার নবাব মির কাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজা উদ-দৌলা ও মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজদের। ভারতের ইতিহাসে বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র বলেছেন, ‘বক্সারের যুদ্ধ সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ’।

বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব

(i) চূড়ান্ত বিজয়: পলাশির যুদ্ধে ভারতে ইংরেজদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও বক্সারের যুদ্ধে তা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পলাশির যুদ্ধে ইংরেজ কোম্পানি কূটনীতি ও বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে অনভিজ্ঞ নবাবকে পরাজিত করে। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হন দিল্লির সম্রাটসহ প্রাদেশিক দুই নবাব। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বলেন, ‘পলাশির যুদ্ধ ছিল কয়েকটি কামানের লড়াই, কিন্তু বক্সারের যুদ্ধ ছিল চূড়ান্ত বিজয়’।

(ii) ভারতে ইংরেজদের আধিপত্যের সূচনা: বক্সারের যুদ্ধে কেবলমাত্র বাংলার নবাব মির কাশিমই নন, তার সঙ্গে পরাজিত হন অযোধ্যার নবাব ও দিল্লির মুঘল বাদশাহ। এর ফলে ভারতবর্ষের উপর ইংরেজদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়। ‘নামসর্বস্ব’ মুঘল সম্রাট ইংরেজ কোম্পানির বৃত্তিভোগীতে পরিণত হন।

(iii) দেওয়ানি লাভ: বক্সারের যুদ্ধের পর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি অধিকার লাভ করে। এর ফলে কোম্পানির বৈধ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

(iv) বাংলায় কোম্পানির প্রতিষ্ঠা লাভ: বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর ইংরেজ কোম্পানি মির জাফরকে পুতুল নবাব হিসেবে সিংহাসনে বসায়। তার মৃত্যুর পর তার নাবালক পুত্র নজম উদ-দৌলাকে সিংহাসনে বসিয়ে ইংরেজরা সমস্ত সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অধিকার করে।

মূল্যায়ন

এককথায় বলা যায়, পলাশির যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা যে ক্ষমতালাভ করেছিল তা পরিপূর্ণতা লাভ করে বক্সারের যুদ্ধের পর। এই যুদ্ধের পর বাংলাদেশে স্বাধীন নবাবির অবসান ঘটে। বস্তুত ইংরেজদের প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।

পলাশির যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধের মধ্যে কোনটি ব্রিটিশ কোম্পানির ভারতে ক্ষমতা বিস্তারের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল? তোমার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দাও।

সামগ্রিক ফলাফল ও গুরুত্বের বিচারে পলাশি যুদ্ধের তুলনায় বক্সারের যুদ্ধ ভারতে কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির ক্ষমতা বিস্তারে বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব

ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির ক্ষমতা বিস্তারের ক্ষেত্রে বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। ঐতিহাসিক স্মিথ বলেছেন যে, ‘পলাশির যুদ্ধ ছিল কয়েকটি কামানের লড়াই, কিন্তু বক্সারের যুদ্ধ ছিল চুড়ান্ত বিজয়।’

(i) ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির ক্ষমতা বৃদ্ধি: বক্সারের যুদ্ধে কোম্পানির কাছে পরাজিত হয়েছিলেন বাংলার নবাব মির কাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজা উদ-দৌলা এবং ভারতের মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম। ফলে ভারতের রাজনীতিতে কোম্পানির ক্ষমতা ও মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

(ii) কোম্পানির দেওয়ানি লাভ: বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল ছিল কোম্পানির দেওয়ানি লাভ। বক্সারের যুদ্ধের সুবিধা লাভ করার জন্য বাংলার গভর্নর লর্ড ক্লাইভ ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে এলাহাবাদের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধিতে বছরে ২৬ লক্ষ টাকা সম্রাটকে দেওয়ার বিনিময়ে কোম্পানি সুবা বাংলার দেওয়ানি অধিকার লাভ করে।

(iii) বাংলায় কোম্পানির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা: বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে বাংলার নবাবের উপর কোম্পানি পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল, বাংলার নবাব নামমাত্র শাসকে পরিণত হয়েছিলেন।

(iv) ইংরেজ বাহিনীর মর্যাদা বৃদ্ধি ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা: বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ করার ফলে ভারতে ইংরেজ বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছিল। ফলে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছিল।

এইভাবে ক্রমশ ভারতে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়। তাই সব দিক থেকে বিচার করলে ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির ক্ষমতা বিস্তারের ক্ষেত্রে পলাশির যুদ্ধের তুলনায় বক্সারের যুদ্ধ ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব আলোচনা করো।

বক্সারের যুদ্ধের পর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধি স্বাক্ষর করে (১২ আগস্ট, ১৭৬৫ খ্রি.)। এই সন্ধির দ্বারা ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাটকে কারা ও এলাহাবাদ অঞ্চল এবং বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা কর প্রদানের অঙ্গীকার করে। বিনিময়ে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি বা রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত অধিকার প্রদান করেন।

দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব

(i) কোম্পানির বৈধতা প্রতিষ্ঠা: দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলা তথা ভারতের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইনগত বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে কোম্পানির বিরুদ্ধে নবাবের সংগ্রাম করার ক্ষমতা লোপ পায়। এর ফলে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত হয়।

(ii) নবাবের ক্ষমতা হ্রাস: ইংরেজ কোম্পানির দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলায় নবাবের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছিল। নবাব সম্পূর্ণভাবে ইংরেজ কোম্পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে নামসর্বস্ব শাসকে পরিণত হয়েছিলেন।

(iii) দ্বৈতশাসনের সূচনা: কোম্পানির দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলায় দ্বৈত শাসনব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল। এই ব্যবস্থায় নবাবের হাতে ছিল নিজামত বা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব। আর কোম্পানির হাতে ছিল দেওয়ানি বা রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত অধিকার। বাস্তবে নবাবের ছিল ক্ষমতাহীন দায়িত্ব, অপরপক্ষে কোম্পানির হাতে ছিল দায়িত্বহীন ক্ষমতা।

(iv) অর্থনৈতিক গুরুত্ব: কোম্পানির দেওয়ানি লাভের আর্থিক গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। মুঘল সম্রাটকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা এবং বাংলার নবাবকে বার্ষিক ৫৩ লক্ষ টাকা দেওয়ার পর উদ্বৃত্ত রাজস্ব কোম্পানির হাতে থাকে। এই বিপুল অর্থকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজরা তাদের বাণিজ্যকে বৃদ্ধি করেছিল।

(v) ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের প্রসার: কোম্পানির দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলার রাজস্বের লভ্যাংশ ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হত। ফলে ইংল্যান্ডের ধনভাণ্ডার পূর্ণ হয়েছিল- যা সেখানকার শিল্পবিপ্লবে সহায়ক হয়েছিল। অনেক ঐতিহাসিক বলেন, বাংলার এই সম্পদ ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল।

বাংলার দ্বৈত শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো। 

বাংলায় দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তক ছিলেন লর্ড ক্লাইভ। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা প্রদেশের দেওয়ানি লাভ করার ফলে বাংলায় যে নতুন শাসনব্যবস্থার সূচনা হয়, তাকে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা বলা হয়।

দ্বৈত বা দ্বিকেন্দ্রিক শাসন

মুঘল আমলে প্রাদেশিক প্রশাসনের দুটি প্রধান বিভাগ হল নিজামত বা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব এবং ② দেওয়ানি বা রাজস্ব সংক্রান্ত অধিকার। দ্বৈত শাসনব্যবস্থায় বাংলার নবাবের হাতে ছিল নিজামত বা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ও কোম্পানির হাতে ছিল দেওয়ানি বা রাজস্ব সংক্রান্ত অধিকার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নবাবের প্রচুর দায়িত্ব থাকলেও তার কোনো ক্ষমতা ছিল না, অপরপক্ষে কোম্পানির প্রচুর ক্ষমতা ছিল, অথচ কোনো দায়িত্ব ছিল না।

প্রবর্তনের কারণ

বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বৈত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণ হল- বাংলার প্রশাসনিক বিষয়ে ইংরেজদের অনভিজ্ঞতা। বাংলার অর্থ বা রাজস্ব শোষণ করাই ছিল ইংরেজদের মূল লক্ষ্য।

ফলাফল

(i) আর্থিক শোষণ: বাংলায় কোম্পানির আর্থিক শোষণ চরম আকার ধারণ করেছিল। ১৭৬৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা এবং ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানি আদায় করেছিল ২ কোটি ২০ লক্ষ টাকা।

(ii) ছিয়াত্তরের মন্বন্তর: দ্বৈত শাসনব্যবস্থায় কোম্পানির শোষণের ফলে বাংলায় ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সৃষ্টি হয়েছিল। এতে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ লোক অনাহারে প্রাণত্যাগ করে। শেষ পর্যন্ত বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়েছিলেন।

সমালোচনা

অনেকে ইংরেজ ও নবাবের এই শাসনব্যবস্থাকে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা বলতে রাজি নন। কারণ তখন বাংলার নবাবের হাতে কোনো ক্ষমতাই ছিল না, প্রকৃতপক্ষে সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী ছিল ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাই একে অনেকে মুখোশ ঢাকা শাসনব্যবস্থা (Masked system) বলে অভিহিত করেন।

মির কাশিমের সঙ্গে ব্রিটিশ কোম্পানির বিরোধের ক্ষেত্রে কোম্পানির বণিকদের ব্যক্তিগত ব্যাবসার কী ভূমিকা ছিল? বাংলায় দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রভাব কী হয়েছিল?

মির কাশিম ও কোম্পানির বণিকদের ব্যক্তিগত ব্যাবসা: ব্রিটিশ কোম্পানির বণিকদের ব্যক্তিগত ব্যাবসাবাণিজ্যকে কেন্দ্র করে কোম্পানির সঙ্গে বাংলার নবাব মির কাশিমের বিবাদ শুরু হয়।

১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ফাররুখশিয়রের কাছ থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি যে ফরমান লাভ করেছিল তাতে শুধুমাত্র ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করেছিল। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাবসাতে এই ফরমান ব্যবহার করতে শুরু করে। এই প্রেক্ষিতে-

  1. কোম্পানির বণিকদের বেআইনি ব্যাবসার ফলে বাংলার অর্থনীতি সমস্যার মুখে পড়ে।
  2. কোম্পানির বণিকরা শুল্ক ফাঁকি দেওয়ায় নবাবের রাজস্বে ঘাটতি দেখা দেয়।
  3. দেশীয় বণিকরা শুল্ক দিতে বাধ্য হওয়ায় তারা ব্যাবসাতে অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়।

বাংলায় দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রভাব

১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় দ্বৈতশাসন চলেছিল। বাংলায় দ্বৈতশাসনের প্রভাব ছিল ভয়াবহ।

(i) আর্থিক শোষণ: দ্বৈতশাসনের ফলে বাংলায় কোম্পানি চরমভাবে অর্থ শোষণ করেছিল। ১৭৬৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা। দেওয়ানি লাভের পর ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি বাংলায় রাজস্ব আদায় করেছিল ২ কোটি ২০ লক্ষ টাকা।

(ii) অরাজকতা: দ্বৈতশাসন বাংলাদেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। প্রশাসনে দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ প্রজার নিরাপত্তায় সংকট সৃষ্টি করে। সেইসঙ্গে কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীরাও বেনামিতে জমির ইজারা নিয়ে প্রজাদের শোষণ শুরু করে।

(iii) ৭৬-এর মন্বন্তর: দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রভাবে বাংলায় ৭৬-এর মন্বন্তর হয়েছিল (১১৭৬ বঙ্গাব্দে বা ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে)। এই মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ লোক অনাহারে প্রাণত্যাগ করেছিল।

এর ফলস্বরূপ বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার অবসান করেছিলেন।

মূল্যায়ন

পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের পর ইংরেজ কোম্পানি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে শক্তিশালী ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তা পরিপূর্ণতা পায়। এরপর থেকে বাংলার রাজনীতি ও অর্থনীতি কোম্পানির অঙ্গুলি হেলনে চলতে থাকে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের দস্তকের বেআইনি ব্যবহারের ফলে বাংলার অর্থনীতি কীভাবে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল? নবাব মির কাশিম কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করেছিলেন?

মুঘল সম্রাট ফাররুখশিয়র ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলায় বাণিজ্য করার জন্য যে দস্তক বা ছাড়পত্র প্রদান করেছিলেন তার ফলে বাংলার অর্থনীতি একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হয়।

দস্তকের অপব্যবহার ও বাংলার অর্থনীতি

  1. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের দস্তকের অপব্যবহারের ফলে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা ঘোরতর সমস্যার মুখোমুখি হয়। নবাব সিরাজ উদ-দৌলার আমলেই কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক স্বার্থপূরণে দস্তক ব্যবহার করতে থাকলে নবাব তার প্রাপ্য শুল্ক থেকে বঞ্চিত হন।
  2. দস্তকের অপব্যবহারের মাধ্যমে কোম্পানির কর্মচারীরা প্রচুর ধনসম্পদ সংগ্রহ করে, ফলে সেই অর্থসম্পদের বলে বলীয়ান হয়ে তারা পরবর্তীকালে ভারতে সাম্রাজ্যবিস্তারে প্রয়াসী হয়।
  3. নবাব মির কাশিমের শাসনকালে কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যে দস্তকের অপব্যবহার করতে শুরু করলে নবাবের রাজস্বে ঘাটতি দেখা দেয়। অন্যদিকে দেশীয় বণিকদের থেকে বাধ্যতামূলক শুল্ক আদায়ের ফলে তারাও অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়। এ ছাড়া অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকরাও ব্রিটিশ কোম্পানির দস্তকের অপব্যবহার সম্পর্কে নবাবের কাছে নালিশ জানাতে থাকে।

এভাবে কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাবসাবাণিজ্যে দস্তককে বেআইনিভাবে ব্যবহার করার ফলে বাংলার অর্থনীতি নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়।

নবাব মির কাশিম গৃহীত পদক্ষেপ

কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যাবসায় দস্তকের অপব্যবহার রুখতে নবাব মির কাশিম দেশীয় বণিকদের উপর থেকে বাণিজ্য শুল্ক তুলে নেন। এর ফলে দেশীয় বণিকরা বাণিজ্যিক সংকট ও অসম প্রতিযোগিতার হাত থেকে রক্ষা পেলেও নবাবের রাজকোশে অর্থ আদায় না হওয়ার ফলে তিনি প্রবল অর্থসংকটের মুখোমুখি হন।

ভারতে ইংরেজ ‘বণিকের মানদণ্ড’ কীভাবে ‘রাজদণ্ডে’ পরিণত হয় ব্যাখ্যা করো। 

অথবা, ১৭১৭ থেকে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় ইংরেজ শক্তির উত্থানের বিবরণ দাও।

ইংরেজ বণিকরা ভারতে এসেছিল ব্যাবসা করার জন্য, কিন্তু কালক্রমে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে ভারতের শাসকে পরিণত হয়। তারা প্রথমে পলাশির যুদ্ধ ও পরে বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ করে বাংলায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। ফলে বণিক ইংরেজরা শাসক ইংরেজে পরিণত হয়।

বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে রূপান্তরের ক্রমপর্যায়

(i) ভারতে বণিক ইংরেজদের আগমনের সূচনা: রানি এলিজাবেথের রাজত্বকালে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর লন্ডনে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের সুপারিশপত্র নিয়ে ক্যাপ্টেন হকিন্স মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের দরবারে আসেন। জাহাঙ্গিরের কাছ থেকে ইংরেজ কোম্পানির জন্য সুরাটে একটি বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অধিকার লাভ করেন হকিন্স। ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ দূত স্যার টমাস রো ভারতে এসে সুরাট, আগ্রাসহ অনেকগুলি স্থানে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেন।

(ii) ফাররুখশিয়র ফরমান লাভ: এরপর ইংরেজরা মুঘল সম্রাট ফাররুখশিয়রের কাছে সুরম্যান-এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলার ব্যাবসাবাণিজ্যে বিশেষ সুযোগসুবিধা লাভ করা। মুঘল সম্রাট ফাররুখশিয়র ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির অনুকূলে একটি ফরমান জারি করে বাংলায় ইংরেজদের বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকারসহ দস্তক প্রদান করেন।

(iii) পলাশির যুদ্ধ জয়: ক্রমে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাব সিরাজ উদ-দৌলাকে পলাশির যুদ্ধে (১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন) পরাজিত করে। পরে ইংরেজরা বাংলার নবাব পদে মির জাফরকে বসালেও তারাই বাংলার প্রকৃত শাসনকর্তা হয়ে ওঠে। বণিক ইংরেজরা বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে।

(iv) বক্সারের যুদ্ধ জয়: ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বক্সারের যুদ্ধে (১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর) একযোগে বাংলার নবাব মির কাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজা উদ-দৌলা, দিল্লির মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত জোটকে পরাজিত করে। বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইংরেজদের ক্ষমতা বাংলা ছাড়িয়ে দিল্লি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

(v) দেওয়ানি লাভ: বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ইংরেজদের সঙ্গে এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধি স্বাক্ষর করেন। ফলে কোম্পানি বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বাংলার দেওয়ানি বা রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে (১৭৬৫ খ্রি.)। বাংলার রাজস্বের উপর ইংরেজ কোম্পানির আইনগত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

মূল্যায়ন

এইভাবে ধীরে ধীরে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থানীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এইভাবেই বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়।

‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ কেন হয়েছিল? এর ফলাফল লেখো।

১১৭৬ বঙ্গাব্দ এবং ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে এক মহাদুর্ভিক্ষ ও মন্বন্তর ঘটে, যা ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। এই মন্বন্তরের পিছনে বিভিন্ন কারণ ছিল এবং এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

কারণ

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কারণগুলি হল নিম্নরূপ-

(i) চড়া হারে রাজস্ব আদায়: মুঘল ও নবাবি আমলে ভূমিরাজস্বের হার ছিল উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ। দেওয়ানি লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লক্ষ্য হয়, যত বেশি সম্ভব রাজস্ব আদায় করা। কোম্পানির নিযুক্ত নায়েব-সুবা রেজা খাঁ ও সিতাব রায় প্রজাপীড়ন চালিয়ে রাজস্ব আদায় করেন। ফলে বিগত বছরের তুলনায় মন্বন্তরের বছরে রাজস্ব আদায় বেশি হয়।

(ii) অনাবৃষ্টি: বাংলার চাষবাস প্রকৃতিনির্ভর ছিল। ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে কম বৃষ্টির কারণে ধান নষ্ট হয়ে যায়। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে অনাবৃষ্টির কারণে চাষবাস হয়নি। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে কম বৃষ্টির জন্য অল্প ফসল হলেও কোম্পানি, রেজা খাঁ ও অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্য মজুত করে। ফলে খাদ্যসংকট দেখা দেয়।

(iii) রোগ-ব্যাধি: খাদ্যের অভাবে ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ গাছের পাতা, মরা পশুর মাংস এমনকি মানুষের মাংস খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তি করে। পুকুরের জল দূষিত হয়ে যায়। ফলে কলেরা, গুটি বসন্ত রোগ মহামারির রূপ নেয় এবং গ্রামের পর গ্রাম মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

ফলাফল

(i) মৃত্যু: এই মন্বন্তরের ফলে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু ঘটে। 

(ii) কৃষি-শিল্পে বিপর্যয়: মাঠের পর মাঠ চাষের কাজ বন্ধ হয়ে জমি পতিত হয়ে পড়ে, বনজঙ্গলে পরিণত হয়। বহু শিল্পী ও কারিগরের মৃত্যু হওয়ায় কুটিরশিল্পের বিপর্যয় ঘটে।

(iii) অর্থসংকট: কৃষি, শিল্প-বাণিজ্যে বিপর্যয় ঘটলে কোম্পানির রাজস্ব থেকে আয় কমে যায়। প্রবল অর্থসংকটের মুখে পড়ে কোম্পানি ব্রিটিশ সরকারের কাছে অর্থসাহায্য প্রার্থনা করে। এই সূত্রে রেগুলেটিং অ্যাক্টের মাধ্যমে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কোম্পানির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

(iv) দ্বৈতশাসনের অবসান: এই বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে কোম্পানি দ্বৈত শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটায়। কোম্পানি এদেশের শাসন-দায়িত্ব নিজ হাতে গ্রহণ করে।

মূল্যায়ন

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা আনন্দমঠ উপন্যাসে চিত্রিত এই করুণ ও মর্মস্পর্শী কাহিনি কারও মতে ‘মানুষের সৃষ্ট’, আবার কারও কারও মতে তা ‘প্রাকৃতিক বিপর্যয়’। তবে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।

Read More – The Garden Party Question Answer

Leave a Comment