প্রাচীন যুগে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্ন ও উত্তর 2nd Semester Eleven WBCHSE

প্রাচীন যুগে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্ন ও উত্তর

প্রাচীন যুগে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্ন ও উত্তর
প্রাচীন যুগে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্ন ও উত্তর

১। প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে কয় ভাগে ভাগ করা যায় ও কী কী, সংক্ষেপে আলোচনা করো

সূচিপত্র

২। প্রাচীন ভারতের শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা করো

৩। বৈদিক পরবর্তী যুগ বা উপনিষদের যুগের শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো

৪। সমাবর্তন বলতে কী বোঝো? বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্যগুলি লেখো

৫। বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার যে-কোনো দুটি অনুষ্ঠান ও তার গুরুত্ব লেখো

৬। পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যা বলতে কী বোঝো? পরা ও অপরাবিদ্যার লক্ষ্যগুলি আলোচনা করো

৭। বৈদিক যুগে শিক্ষার পাঠক্রম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।  বর্ণাশ্রম প্রথা কী?

৮। বৈদিক যুগের নারীশিক্ষা সম্পর্কে লেখো। প্রাচীন বৈদিক শিক্ষায় শিক্ষকের কী কী বৈশিষ্ট্য থাকত?

৯। অশ্বারোহণ বলতে কী বোঝো? বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার অবদান আলোচনা করো।

১০। বৈদিক যুগে গুরু ও শিষ্যের সম্পর্ক কেমন ছিল? বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা আলোচনা করো

১১। বর্তমান শিক্ষায় বৈদিক যুগের শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা লেখো।

১২। বৈদিক যুগ, পরবর্তী বৈদিক যুগ এবং ব্রাহ্মণ্য যুগে কীভাবে নারীশিক্ষার অগ্রগতি ঘটেছিল?

১৩। ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো

১৪। প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার উপাদানগুলি কী কী? সেগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো

১৫। বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে যা জান লেখো

১৬। বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য ও পাঠক্রম সম্পর্কে লেখো

১৭। বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার তিনটি পর্যায় কী কী?

১৮। বৌদ্ধ যুগের শিক্ষণ পদ্ধতি, শৃঙ্খলা, মূল্যায়ন ও বৌদ্ধ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে লেখো।

১৯। প্রাচীন ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যে বৈশিষ্ট্যগুলি আধুনিক শিক্ষায় গ্রহণযোগ্য- সেগুলি আলোচনা করো

২০। প্রাচীন সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্ভব ও বিকাশের প্রক্রিয়া আলোচনা করো

২১। উদারনৈতিক ভক্তিবাদ, সুফিবাদ ও ধর্মসমন্বয় বলতে তে কী বোঝো?

২২। গুরুকুল বলতে কী বোঝো? বৈদিক যুগের শিক্ষাদান পদ্ধতির সঙ্গে তোমার পরিচিতি দাও।

অথবা,

পরবর্তী বৈদিক যুগে শিক্ষার প্রধান দিকগুলি কী কী

গুরুকুল

বৈদিক যুগের বিদ্যালয় ছিল গুরুকুল। গুরুর কাছে এসে ছাত্ররা একত্রিত হত। একজন গুরুকে কেন্দ্র করে এক একটি গুরুকুল গড়ে উঠত। গুরুকুল কেবলমাত্র তপোবনে অবস্থিত ছিল এমন নয়, অধিকাংশ গুরুকুল ছিল জনপদ বা লোকালয়ে। এই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গুরুকুল বলা হত।

বৈদিক যুগের শিক্ষাদান পদ্ধতি

(1)  আদি বৈদিক যুগ: বৈদিক যুগে ব্যক্তিগতভাবে এবং দলগতভাবে গুরু শিক্ষা দিতেন। শিক্ষণ পদ্ধতি ছিল মৌখিক। গুরুর মুখে শুনে আবৃত্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন পাঠ মুখস্থ করতে হত। তবে না বুঝে কোনো কিছু মুখস্থ করার রীতি ছিল না। মুখস্থ করার রীতিকে নীচু চোখে দেখা হত, বিষয়বস্তুর অর্থ উপলব্ধির উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত।

  • প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি: প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হত। গুরু শিক্ষার্থীর কাছে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যাখ্যা করতেন।
  • যোগ পদ্ধতি: বৈদিক যুগে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হল যোগ পদ্ধতি। একাগ্রচিত্তে ধ্যানের মাধ্যমে বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিত পদ্ধতি উপলব্ধি করা সম্ভব বলে মনে করা হত। ধ্যানের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্ভব, তাই ধ্যানকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত। সাধারণত আলোচনা, বিতর্ক, বক্তৃতা ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হত।

(2) ঋগাবাদর পরবর্তী যুগ বা বৈদিক ব্রাহ্মণ্য যুগ: বৈদিক ব্রাহ্মণ্য যুগে পাঠদান পদ্ধতির মূল পর্যায়গুলি হল-

  • উপক্রম: শিক্ষাদানের প্রথম এই স্তরে গুরুর কাছ থেকে শেখার জন্য শিশুর মনে আকাঙ্ক্ষা জন্মায়।
  • শ্রবণ: এই স্তরে গুরু যে যে শ্লোক শিষ্যদের শোনাতেন সেগুলো শিষ্য মন দিয়ে শুনত।
  • আবৃত্তি: শিক্ষাদানের এই স্তরে শিষ্য গুরুর শেখানো বিষয়গুলি আবৃত্তি পদ্ধতিতে আত্মস্থ করত।
  • অর্থবাদ: এই স্তরে শিষ্যরা যা কিছু শিখেছে গুরুর কাছ থেকে তা উপলব্ধি করত।
  •  উপপত্তি: উপপত্তি স্তরে শিষ্য তার নিজের যুক্তির দ্বারা শেখার বিষয়গুলি যাচাই করে, জ্ঞানকে দৃঢ় করত।
  •  মনন: মনন স্তরে আচার্যের শেখানো শিক্ষা তারা গভীরভাবে চিন্তা করত।
  • নিদিধ্যাস: একাগ্র মনে ধ্যানের মাধ্যমে শিষ্যরা সত্যকে উপলব্ধি করত এই স্তরে।

(3) সূত্র সাহিত্য যুগের শিক্ষাপদ্ধতি: সূত্র সাহিত্য যুগের শিক্ষাপদ্ধতি ছিল মৌখিক অর্থহীন মুখস্থ করা নয়, বিষয়কে গভীরভাবে অনুধাবন করে মনে রাখতে হত। মৌখিক পদ্ধতিতে শিখন ছিল সময়সাপেক্ষ। জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করাই ছিল উদ্দেশ্য। শিক্ষার বিষয়কে গভীরভাবে অনেকদিন ধরে মনে রাখাই শিক্ষার বৈশিষ্ট্য ছিল। কারণ সেই সময় পুস্তক-এর ন্যায় কৌশল অজানা ছিল মানুষের কাছে।

২৩। প্রাচীন বৌদ্ধ শিক্ষার পাঠক্রম ও সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিগুলি সম্পর্কে লেখো

বৌদ্ধশিক্ষার সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি

ভারতের প্রাচীন সাহিত্যগুলির উপজীব্য বিষয় হল ধর্ম। বৌদ্ধ শিক্ষাগ্রন্থ থেকে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির নিদর্শন পাওয়া যায়। শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বিষয়াদির উন্নয়নের কথা ভেবে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি রাখা হয়। সেগুলি হল-

(1) সমর শিক্ষা: সমর শিক্ষার কথা রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত, অর্থশাস্ত্র ইত্যাদি গ্রন্থে। গ্রন্থগুলি থেকে জানা গেছে সামরিক ক্ষেত্রে রথ, অশ্ব, হস্তী পরিচালনা, পদব্রজে দ্রুতগমন, দুর্গপ্রবেশ, সন্তরণ প্রভৃতি শিক্ষাগ্রহণ করতে হত।

(2) চিকিৎসাবিজ্ঞান : চিকিৎসাবিজ্ঞানকেও সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আয়ুর্বেদশাস্ত্র উল্লেখযোগ্যভাবে বিস্তার লাভ করে। রামায়ণ, মহাভারতে এরূপ চিকিৎসাবিদ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়রা চিকিৎসাবিদ্যায় এই শিক্ষালাভ করতে পারতেন। জীবক, চরক প্রমুখ প্রসিদ্ধ চিকিৎসকের নাম পাওয়া গেছে বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায়। চরকসংহিতা, নন্দীপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থ শল্যচিকিৎসার প্রমাণ বহন করে। এ ছাড়া উল্লেখ রয়েছে বিভিন্ন উদ্ভিদের গুণাগুণ সম্পর্কে, পথ্যের নাম ও তাদের ব্যবহার সম্পর্কে।

(3) শিল্প-বাণিজ্য-কৃষি: প্রাচীন বৌদ্ধ শিক্ষায় শিল্প বাণিজ্যের দিকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিল্পকর্ম করার জন্য শিল্পীদের পৃথকভাবে পড়াশোনা করতে হত। আবার পূর্বে ‘অথর্ববেদে’ এরূপ 32টি শিল্পশাস্ত্রের উল্লেখ আছে। পৌরাণিক কাহিনির উপর নির্ভর করে শিল্পীরা বিভিন্ন মূর্তি তৈরি করত। কৃষক ও শিল্পীরা তাদের পিতৃপুরুষদের পোশাক গ্রহণ করতেন।

(4) বিনোদনমূলক কাজ : বৌদ্ধ শিক্ষায় কঠোর অনুশাসন থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আনন্দ পেত। যেমন- বলখেলা, তির চালানো, কুস্তি করা, পাশা খেলা প্রভৃতি বিনোদনমূলক কাজকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। মেয়েদের সঙ্গে নাচার প্রথাও অনুমোদিত ছিল তবে কঠোর ব্রহ্মচর্যের সময় এই সবকিছুই নিষিদ্ধ ছিল।

(5) প্রাথমিক চাহিদা : নিজেদের জীবনে প্রাথমিক চাহিদা মেটায় এরূপ কাজও শিক্ষার্থীরা করত যেমন দর্জির কাজ, সুতো কাটা, কাপড় বোনা ইত্যাদি।

২৪। প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগসুবিধা বা অবদান বা গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করো। শিষ্ট এবং দণ্ডনীতিক বলতে কী বোঝো

প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগসুবিধা

(1) গণশিক্ষা: বৌদ্ধধর্মে চোর-ডাকাত, বিকলাঙ্গ বাদ দিয়ে সবার জন্যই শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত ছিল। ফলে জনসাধারণের পক্ষে শিক্ষাগ্রহণ সহজ হয়ে গিয়েছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা দূরদূরান্তে গিয়ে জনসাধারণের মধ্যে বুদ্ধদেবের বাণী প্রচার করতেন।

(2) নারীশিক্ষা: নারীরা শিক্ষার সুযোগ পেতেন। তাদের জন্য পৃথক সংঘ স্থাপিত হওয়ায় নিজেদের সুবিধামতো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত।

(3) জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিক্ষাব্যবস্থা: বৌদ্ধধর্মে জাতিভেদ প্রথা ছিল

না। সংঘে প্রবেশের পর ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, ব্রাহ্মণ-শূদ্র প্রত্যেককেই একই নিয়মনীতি অনুসরণ করতে হত।

(4) মাতৃভাষার মাধ্যাম শিক্ষাদান: বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা হওয়ায় শিক্ষার বিষয়বস্তু উপলব্ধি করা শিক্ষার্থীদের পক্ষে সহজ হয়। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান সর্বপ্রথম বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলিত হয়।

(5) পাঠ্য বিষয়বস্তু: বুদ্ধদেবের বাণীই ছিল শিক্ষার প্রধান বিষয়বস্তু। পরবর্তীকালে তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক উভয় ধরনের বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

(6) শারীরশিক্ষা: ভিক্ষুদের শারীরশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। পাশাপাশি ছাত্রদেরও শারীরশিক্ষা দেওয়া হত।

(7) বৃত্তিশিক্ষার প্রচলন: এই শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের বৃত্তিশিক্ষার প্রচলন করেছিল, যাতে শিক্ষার্থীরা সামাজিক দিক থেকে উপযোগী হয়ে উঠতে পারে।

(৪) গুরুশিষ্য সম্পর্ক : গুরুশিষ্যের সম্পর্ক পিতা-পুত্রের মতো হলেও উভয়েই উভয়ের আচরণের উপর দৃষ্টি রাখতে পারত।

(9) শিক্ষণ পদ্ধতি: এই শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যক্তিগত ও দলগত শিক্ষণের সমন্বয় দেখতে পাই। কোনো শিক্ষার্থী ব্যক্তিগতভাবে যেমন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত তেমনই দলগতভাবেও নির্দেশনা গ্রহণ করতে পারত। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যেমন উপকৃত হত, তেমনই শিক্ষা প্রশাসনের কাজও সুষ্ঠুভাবে চালানো যেত।

(10) গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা: গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রত্যেকেই মত প্রকাশের সমান সুযোগ পেত। আবার গুরু বা আচার্য হওয়ার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সকলেই সমান সুযোগ পেত। 

(11) সংযম জীবনযাপনের শিক্ষা : এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের মানসিক, নৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি বিকাশের শিক্ষা দেওয়া হত।

(12) সংঘভিত্তিক শিক্ষা : বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা সংঘভিত্তিক হওয়ায় খুব শৃঙ্খলিত জীবনযাত্রা করতে হত।

(13) আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি বিনিময়: চিন, নেপাল, তিব্বত, কোরিয়া, সিংহল প্রভৃতি দেশ থেকে বহু ছাত্র অধ্যয়ন করতে আসত। ফলে সংস্কৃতির আদানপ্রদান হত। ফলে সমস্ত মহাবিহারগুলি আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি বিনিময়ের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

(14) ব্যক্তিগত ও দলগত নির্দেশনা : বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগতভাবে কোনো গুরুর অধীনে থেকে নির্দেশনা গ্রহণ করলেও দলগতভাবে তাকে নির্দেশনা গ্রহণ করতে হত। ফলে শিক্ষাপরিচালনার কাজ সহজ হত।

শিষ্ট ও দণ্ডনীতিক

(1) শিষ্ট: তক্ষশিলায় ধর্ম ও দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপকদের বলা হত শিষ্ট।

(2) দণ্ডনীতিক: তক্ষশিলায় রাজনীতিতে অভিজ্ঞ অধ্যাপকদের দণ্ডনীতিক বলা হত।

২৫। বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার যে-কোনো একটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা করো।’

অথবা,

প্রাচীন ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে নালন্দা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা

প্রাচীন ভারতের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে নালন্দা হল সর্বাধিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। বৌদ্ধদর্শন ও ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞানলাভের জন্য দেশ-বিদেশের শিক্ষার্থীরা এখানে এসে সমবেত হত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি শুনে ভারত ও তার প্রান্তবর্তী বিভিন্ন দেশ, যেমন- তিব্বত, চিন, কোরিয়া, জাভা, সিংহল, ব্রহ্মদেশ, জাপান, সুমাত্রা প্রভৃতি থেকে শিক্ষার্থীরা বিদ্যাশিক্ষার জন্য আসত।

(1) ভৌগোলিক অবস্থান: বিহারের পাটলিপুত্রের (বর্তমান পাটনা) চল্লিশ মাইল দক্ষিণে প্রাচীন মগধের রাজধানী রাজগৃহের সাত মাইল উত্তরে (বর্তমান বিহার শরীফ জেলার) বড়গাঁও-এর নিকটে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত ছিল।

(2) প্রতিষ্ঠা: তিব্বতীয় ঐতিহাসিক তারানাথ মনে করেন, মাধ্যমিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা নাগার্জুন আনুমানিক 300 খ্রিস্টাব্দে নালন্দা শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এ কথাও প্রচলিত আছে যে, ভগবান বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজাদের প্রচেষ্টায় এক- একটি সংঘারাম প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশেষে এইভাবে 6 জন রাজার প্রতিষ্ঠিত সংঘারামগুলি একত্রে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছে।

(3) নামকরণ: নালন্দার নামকরণ নিয়ে নানা মতভেদ আছে। যেমন-  সংঘারামের নিকটবর্তী নাগানন্দ সরোবর থেকে নালন্দা নাম হয়েছে।  ফা হিয়েন নালন্দাকে ‘নাল’ নামে অভিহিত করেছেন। বুদ্ধদেব এখানে তাঁর পূর্বতন বোধিসত্ত্ব জীবনে একসময় অফুরন্ত দান করেন। ন- অলম্ দা অর্থাৎ ‘অবিশ্রান্ত দাতা’ তাই এর নাম হয় নালন্দা।

(4) গঠন : নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এক মাইল দীর্ঘ ও আধ মাইল বিস্তৃত ছিল। এটি উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। কেন্দ্রীয় মহাবিদ্যালয় সংলগ্ন 7টি বড়ো হলঘর। 300টি ছোটো পড়ার ঘর, 13টি ছাত্রাবাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। ইটের প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত এই অট্টালিকার একটি তোরণদ্বার দিয়ে প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা যেত। এই প্রতিষ্ঠানটি ছিল একেবারে সংঘারামের মাঝখানে এবং এর থেকে দূরে ৪টি বড়ো বড়ো দালান ছিল।

(5) ব্যয়ভার: রাজা, শিক্ষানুরাগী ও গ্রামের আয় থেকে নালন্দার খরচ চলত। হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণী থেকে জানা যায় 100টি গ্রামের আয় থেকে নালন্দার খরচ চলত।

(6) প্রবেশাধিকার: মেধার ভিত্তিতে যে-কোনো ধর্মের শিক্ষার্থীরা ভরতি হতে পারত। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে প্রবেশদ্বারে দ্বার পণ্ডিতদের কাছে নিজের বিদ্যা ও বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে প্রবেশ করতে হত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের মধ্য থেকে একজন দ্বার-পণ্ডিত নিযুক্ত হতেন।

(7) আবাসিক ও অবৈতনিক শিক্ষা: নালন্দা ছিল আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রদের থাকা, খাওয়ার খরচ, পড়াশোনার ব্যবস্থা নালন্দাই বহন করত।

(৪) পাঠক্রম: এখানে যে-সমস্ত বিষয় পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল তা হল- বেদ, বেদাঙ্গ, সাংখ্যদর্শন, সাহিত্য, ন্যায়শাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, রসায়নশাস্ত্র, ব্যাকরণ, বৌদ্ধশাস্ত্র, তন্ত্রশাস্ত্র, যাদুবিদ্যা ইত্যাদি।

(9) শিক্ষণ পদ্ধতি: ব্যক্তিগত ও দলগত উভয় পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। তর্ক ও আলোচনাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত। শিক্ষার্থীদের প্রবন্ধ রচনা ও বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস করানো হত।

(10) গ্রন্থাগার: খ্যাতির প্রধান কারণ তিনটি সুরম্য প্রাসাদ, যথা- রত্নসাগর (Ocean of jewels), রত্নরঞ্জিক (Jewel adorned), রত্নদধি (Sea of jewels) নামক গ্রন্থাগারগুলি অবস্থিত ছিল। সমগ্র গ্রন্থাগার অঞ্চলটিকে ধর্মগঞ্জ বলা হত। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মেটানোর মতো বহু পুথি এখানে ছিল। শুধু বৌদ্ধধর্মের বই নয় অন্যান্য ধর্মের গ্রন্থও এখানে ছিল।

(11) অধ্যাপকমন্ডলী: নালন্দায় খ্যাতনামা অধ্যাপকমণ্ডলী ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- শীলভদ্র, নাগার্জুন, চন্দ্রপাল, স্থিরমতি, গুণমতি প্রমুখ। নালন্দার অধ্যাপকদের জ্ঞানগরিমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা ভারতে আসত শিক্ষা গ্রহণ করতে।

(12) পরিচালনা: নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকমণ্ডলী কর্তৃক পরিচালিত হত। নালন্দার প্রধান সচিবকে বলা হত সর্বাধ্যক্ষ। সর্বাধ্যক্ষকে সাহায্য করার জন্য দুজন মহাস্থবির নিয়োগ করা হত। এঁদের বলা হত কর্মদান ও স্থবির।

(13) পরীক্ষা ব্যবস্থা: এখানকার পরীক্ষা পদ্ধতি ছিল মূলত মৌখিক। নিজের কৃতিত্বের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা রাজসভায় উপনীত হত। এখানে কৃতী ছাত্রদের ‘স্থবির’, ‘বহুশ্রুত’ ইত্যাদি উপাধি প্রদান করা হত। এ ছাড়া ভূমিও দান করা হত। যিনি প্রথম হতেন তাকে ‘কুলপতি’ উপাধি দেওয়া হত।

(14)  ধ্বংস: দ্বাদশ শতাব্দীতে মহম্মদ ঘোরীর সেনাপতি বখতিয়ার খিলজি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেন।

(15) গণতান্ত্রিকতা : মঠের জীবনযাত্রা কঠোর নিয়মশৃঙ্খলায় আবদ্ধ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যাবলি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হত। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আদর্শগত মতপার্থক্যকে বিতর্ক ও আলোচনার সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করতে হত।

(16) শৃঙ্খলা: নালন্দায় শিক্ষার্থী এবং অধ্যাপক উভয়কেই শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলতে হত। শৃঙ্খলা মেনে চলার ক্ষেত্রে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সকলের জন্যই নিয়মশৃঙ্খলা সমান ছিল এবং সকলকেই তা মেনে চলতে হত।

(17) খ্যাতি: নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি চিন, তিব্বত, কোরিয়া, জাভা, সুমাত্রা, সিংহল, যবদ্বীপ প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিক্রমশীলা বিহার প্রতিষ্ঠার পর নালন্দার খ্যাতি কিছুটা ম্লান হয়ে আসে। খননকার্য চালিয়ে নালন্দার ধ্বংসাবশেষ যেটুকু উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, তা আজও মানুষের মনে বিস্ময়ের সঞ্চার করে

২৬। অষ্টাঙ্গিক মার্গ কী? বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রে বৌদ্ধ শিক্ষার প্রভাব উল্লেখ করো

অষ্টাঙ্গিক মার্গ

বোধিলাভের পর ‘বুদ্ধ’ নাম নিয়ে মানুষের কাছে ফিরে এসে বুদ্ধদেব তাঁর দীর্ঘ সাধনালব্ধ সত্য বা জ্ঞানকে প্রচার করেন। জীবনের দুঃখ নিরোধের উপায় হিসেবে বৌদ্ধদর্শনে আটটি মার্গ বা পথের নির্দেশ করা হয়েছে। এগুলিকে একত্রে ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’ বলা হয়। এই মার্গই হল বৌদ্ধ নীতিশাস্ত্র। এইগুলিই মানুষের নৈতিক জীবনের ভিত্তি। বৌদ্ধদর্শনের নৈতিক মানগুলি নিম্নরূপ-

(1) সম্যক দৃষ্টি: বৌদ্ধদর্শনের চারটি আর্যসত্য সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানই হল সম্যক দৃষ্টি।

(2) সম্যক সংকল্প : জীবনকে দুঃখ থেকে মুক্ত করার জন্য কেবলমাত্র জ্ঞানলাভই যথেষ্ট নয়। জ্ঞানকে কার্যকরী করতে না পারলে জীবনের উদ্দেশ্য সফল হবে না। অর্থাৎ সম্যক দৃষ্টির দরুন যে জ্ঞান ব্যক্তি উপলব্ধি করেছে, তার ভিত্তিতে নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার সংকল্প তাকে গ্রহণ করতে হবে। এটিই হল বৌদ্ধ নীতিশাস্ত্রে সম্যক সংকল্প।

(3) সম্যক বাক্: জ্ঞান ও তার প্রয়োগের সংকল্পই জীবনের দুঃখ নিবারণের জন্য যথেষ্ট নয়, গৃহীত সংকল্পকে বাস্তবায়িত করতে হবে। উপলব্ধ জ্ঞানকে বাস্তবায়িত করার জন্য ভাষামূলক বা বাচনিক আচরণে প্রয়োগ করতে হবে। কথ্যবাক্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একেই বলা হয়েছে সম্যক বাক্। অর্থাৎ অপ্রিয় কথন, পরনিন্দা ত্যাগ করাই বৌদ্ধ নীতিশাস্ত্র অনুযায়ী সম্যক বাক্।

(4) সম্যক কর্মান্ত: সম্যক সংকল্প মতে, কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সম্যক বাক্য ছাড়াও বৌদ্ধদর্শনে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, অহিংসা, ইন্দ্রিয়সেবা থেকে বিরতি ইত্যাদিকে সম্যক কর্মান্ত বলে।

(5) সম্যক আজীব: বৌদ্ধদর্শনে (Buddhist Philosophy) সৎ উপায়ে জীবিকা অর্জনের কথা বলা আছে। জীবনে কোনোরকমের অসৎ উপায় গ্রহণ না করাই হল দুঃখ নিবারণের উপায়। অর্থাৎ উদ্দেশ্য এবং পদ্ধতি উভয় ক্ষেত্রে সততাই বৌদ্ধ নীতিশাস্ত্রের মূলকথা। অর্থাৎ প্রাণীহত্যা, পশু শিকার, মদ বিক্রয় ইত্যাদি হীন কাজ বর্জন করে সৎ উপায়ে জীবনযাপন করতে হবে।

(6) সম্যক ব্যায়াম: এই দর্শনে ব্যায়াম বলতে মানসিক পর্যায়ের অনুশীলনকে বোঝানো হয়েছে। পূর্বে সঞ্চিত অসৎ চিন্তা নির্মূল করার প্রয়াস, নতুন অসৎ চিন্তাকে রোধ করার প্রয়াস, মনকে সকল সময় সৎ চিন্তায় নিয়োজিত রাখার প্রয়াস এবং সৎ চিন্তাকে মনে স্থায়ী করার জন্য অনুশীলন করাই হল সম্যক ব্যায়াম।

(7) সম্যক স্মৃতি: দেহ, মন, মানসিক অবস্থা, বিষয়বাসনা সবই অনিত্য। এগুলি থেকে মনকে মুক্ত করলে তবেই দুঃখ মোচন হবে। এই নির্দেশ বৌদ্ধদর্শনে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়গুলিতে বিকর্ষণ যে স্মৃতির প্রভাবে হয়ে থাকে, তাকেই বলা হয়েছে সম্যক স্মৃতি।

(8) সম্যক সমাধি : পূর্বোক্ত সাতটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে মানুষ যে অবস্থা লাভ করে, তাকেই বৌদ্ধ নীতিশাস্ত্রে বলা হয় সম্যক সমাধি। মনঃসংযোগের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে নিরুদ্বিগ্ন, নিস্পৃহ এবং আত্মসমাহিত হওয়াই সম্যক সমাধি। এই পর্যায়ে ব্যক্তি নির্বাণ লাভ করে।

বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রে বৌদ্ধ শিক্ষার প্রভাব

এ কথা সত্য যে বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় ছিল। নালন্দা ও তক্ষশিলার মতো বিশ্ববিদ্যালয় যে-কোনো যুগে যে-কোনো জাতির পক্ষে গৌরবান্বিত অধ্যায় ছিল। বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রেও বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব সর্বক্ষেত্রেই বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়।

(1) শিল্ডার লক্ষ্য: প্রাচীন ভারতের শিক্ষার লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীর সৎ চরিত্রগঠন এবং উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী করে গড়ে তোলা। স্বামীজি থেকে শুরু করে ড রাধাকৃষ্ণন পর্যন্ত সকল মনীষীগণ চরিত্রগঠনের উপর জোর দিয়েছেন, যা বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রেও বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

(2) গুরু-শিষ্য সম্পর্ক : বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা গুরু ও শিষ্য উভয়কেই শৃঙ্খলাবদ্ধ হওয়ার উপর জোর দিয়েছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাতেও তা বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। বৌদ্ধ শিক্ষায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর ছিল। বর্তমানে শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে এই মধুর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক খুব জরুরি।

(3) বৌদ্ধবিহার: বৌদ্ধশিক্ষায় বৌদ্ধবিহার বা আবাসিক বিদ্যালয় শিক্ষার প্রধান অঙ্গ ছিল। এই ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মনির্ভর, দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণ করে তোলে। বর্তমানে আবাসিক ব্যবস্থাপনার গুরুত্বও যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য।

(4) সার্বজনীন অধিকার: বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য সংঘের প্রবেশাধিকার ছিল। যা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করে।

(5) আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি: বৌদ্ধ শিক্ষা বাস্তব দৃষ্টান্তের মাধ্যমে দেওয়া হত। আলোচনা সভা বা বিতর্কের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও বুদ্ধির বিচার হত। অর্থাৎ শিক্ষাপরিকল্পনা বর্তমানের মতো আধুনিক ও প্রগতিশীল ছিল।

(6) মানবতাবাদ: বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর মধ্যে গভীর ও সুস্থ প্রগতিশীল এবং দায়িত্বশীল মানবতাবোধের জন্ম নেয়। অর্থাৎ বৌদ্ধ শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ছিল মানবতাবাদ বা মানবসেবা। বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রে যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তাই অতীতের ভালো দিকগুলিকে ধরে রেখে খারাপদের বর্জন করতে হবে।

(7) সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য : পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ত্বরান্বিত হয় বৌদ্ধধর্ম প্রসারের সময় থেকে। যেহেতু বহু শিক্ষার্থী বৌদ্ধধর্মে শিক্ষালাভের জন্য এদেশে এসেছিলেন তাই বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক আবেদন ছিল। যা বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রে এইরকম দৃষ্টান্ত অসীম। সবশেষে এ কথা বলা যায় যে বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল না। তাই সেই শিক্ষাব্যবস্থা সর্বক্ষেত্রে, সর্বস্তরে সর্বাঙ্গীণভাবে অনুকরণযোগ্য। তাই বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করার দিকে নজর দেওয়া উচিত।

২৭। সর্দার পড়ো প্রথা (Monitorial System) কী? বৈদিক যুগে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য শিক্ষার যে ব্যবস্থা ছিল, সেই সম্পর্কে আলোচনা করো

প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় সর্দার পড়ো প্রথা (Monitorial System) প্রচলিত ছিল। উঁচু শ্রেণির ছাত্রদের ছোটো ছোটো ছেলে- ও মেয়েদের পড়ার ভার দেওয়া হত। এই শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ুয়া-শিক্ষক সম্পর্কের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। গুরুপুত্র শিক্ষকতা কাজে পিতাকে সাহায্য করতেন। একে ‘সর্দার পড়ো প্রথা’ বা Monitorial System হিসেবে গণ্য করা হয়। বেল এই প্রথায় মুগ্ধ হয়ে ইংল্যান্ডে এটি প্রবর্তন করেন। যা প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে বিশেষ সাহায্য করেছিল।

বৈদিক যুগে শিক্ষার্থীদের সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য ধরনের শিক্ষাদানেরও ব্যবস্থা ছিল। সেগুলি হল- 

(1) সমর বিদ্যা: বৈদিক ও পরবর্তী বৈদিক যুগেও আর্যদের নিজেদের আধিপত্য রক্ষার জন্য যুদ্ধবিদ্যার গুরুত্ব ছিল। আর্যরা রথ ও অস্ত্র চালনায় অতি নিপুণ ছিলেন। এ ছাড়া তির-ধনুক ও বর্শা চালনায় তারা দক্ষ ছিল। যুদ্ধবিদ্যা ক্ষত্রিয়দের জন্য হলেও অন্যরাও এতে পারদর্শী ছিলেন। ক্ষত্রিয়দের উপনয়ন ছাড়া ধনুর্বেদ উপনয়নের ব্যবস্থা ছিল। বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র দেওয়া হত। সামরিক শিক্ষা শেষে শিক্ষা সমাপ্তির স্বীকৃতিসূচক এখানে ছুরিকানন্দন উৎসবে শিক্ষার্থীদের ছুরিকা দেওয়া হত। একে অস্ত্রবিদ্যার সমাবর্তন বলা হত।

(2) চিকিৎসাবিদ্যা: বৈদিক গ্রন্থে অশ্বিনী কুমারদ্বয়কে দেববৈদ্য বলে অভিহিত করা হয়েছে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রকে উপবেদ বলা হত। আনুমানিক খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে আয়ুর্বেদের অন্যতম প্রণেতা সুশ্রুতের আবির্ভাব হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে সব বর্ণের অধিকার ছিল। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র সংস্কৃতে লেখা। তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করতে হত। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রদের শল্যবিদ্যা শিক্ষাকালে নরদেহ ব্যান্ডেজ বাঁধা ও সেলাই শিখতে হত। সেই যুগেও চিকিৎসাশাস্ত্রের বিভিন্ন বিভাগে বিশেষজ্ঞ হওয়ার ব্যবস্থা ছিল। শিক্ষা সমাপ্তির পর সমাবর্তন উৎসব হত। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে চিকিৎসার পরীক্ষায় ছাড়পত্র মিলত।

(3) কারিগরি শিক্ষা: বৈদিক যুগে ঋগ্বেদে বিভিন্ন শিল্পের উল্লেখ রয়েছে। সে যুগে তক্ষণ শিল্পীদের আদর ছিল। তক্ষণ শিল্পীরা যুদ্ধের জন্য রথ ও অস্ত্র এবং কৃষিকাজের জন্য নানা ধরনের উপকরণ তৈরি করত। ঋগ্বেদে মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প, চর্মশিল্প ও সীবনশিল্পের উল্লেখ রয়েছে। গৃহ নির্মাণ, নগর নির্মাণ, যাতায়াতের যানবাহন নির্মাণের জন্য লোক নিযুক্ত থাকত। এইসব বিষয়ে কুশলী শিল্পীদের কাছে শিক্ষানবিশী প্রথা প্রচলিত ছিল। শিক্ষাকালে গুরুগৃহে থাকাকালীন আহার ও বাসস্থানের জন্য কোনো খরচ দিতে হত না। শিক্ষার্থীদের তৈরি জিনিসে গুরুর অধিকার থাকত, বিক্রয়মূল্য গুরু গ্রহণ করতেন। শিক্ষা শেষে উপযুক্ত গুরুদক্ষিণা দিয়ে শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি পেত। যে-কোনো বৃত্তিতে প্রাথমিক জ্ঞানের জন্য সাধারণ লেখাপড়ার বিশেষ প্রয়োজন হত না। তবে ভাস্কর্য, চিত্রাঙ্কন, স্থাপত্য প্রভৃতি উচ্চশিক্ষা লাভ করতে হলে সংস্কৃতের প্রাথমিক জ্ঞানের প্রয়োজন হত।

(4) বাণিজ্য বিষয়ক শিক্ষা : ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বৈশ্য বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বৈদিক যুগে বণিক সম্প্রদায়ের বিশেষ সামাজিক মর্যাদা ছিল না। বণিক সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের যেসব বিষয়গুলি জানতে হত, সেগুলি হল-  যেসব জিনিস নিয়ে ব্যবসা চলে তার প্রকারভেদ ও গুণগত বৈষম্য, বাণিজ্যিক ভূগোল-কোথায়, কোন্ জিনিস উৎপাদিত হয় এবং কোথায়, কোন্ পথে সেই জিনিস রপ্তানি হয়। বণিকদের শিক্ষার জন্য বণিক সমিতি বা সংঘ থেকে ব্যবস্থা করা হত। বণিক সংঘ বিদ্যালয় পরিচালনা করত। এখানে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে বৃত্তিশিক্ষারও ব্যবস্থা ছিল।

(5) শিল্ডার সাঙ্গ যুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিষদ :  বৈদিক ও পরবর্তী বৈদিক যুগের আর একটি শব্দের সঙ্গে পরিচিত হওয়া দরকার, সেটি হল পরিষদ। পরিষদ হল জ্ঞানীদের জনসমাবেশ।

সেই যুগে তপোবনের শিক্ষালয়ের বাইরে জ্ঞানী ব্রাহ্মণগণের সমাবেশে বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয় ও শিক্ষা সম্পর্কিত সমস্যার মীমাংসা করা হত। যাঁদের নিয়ে পরিষদ গঠিত হত তাদের বিষয় সম্বন্ধে যথেষ্ট পাণ্ডিত্য থাকত, কোনো সমস্যাসমাধানের জন্য শিক্ষার্থীরাও পরিষদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করত। সেযুগের ধর্মীয় ও সামাজিক আচার নিয়ন্ত্রণে পরিষদের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। পরিষদের অধিবেশনে অনেক দূর থেকে পণ্ডিতগণ এসে যোগ দিতেন। পরিষদের মধ্যে পাঞ্চাল পরিষদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সুতরাং প্রাচীন ভারতে শিক্ষার ধারণা সেই সময়কার মানুষের জীবনাদর্শ থেকে বিকাশ লাভ করেছিল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ছিল জাতির আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, যার মধ্য দিয়ে সভ্যতার প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হত। প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা বলতে মূলত বৈদিক ও বৌদ্ধ শিক্ষার ধারাকে বোঝায়। বর্তমান ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা কয়েকটি পর্যায়ের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে এবং এই পর্যায়গুলি এক একটি সময়কালে বিভক্ত হয়ে পরিগণিত হয়েছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাতেও প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাধারার প্রতিফলন দেখা যায়। বিবর্তনের মধ্য দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার ধারাবাহিকতা চলে এবং সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই বর্তমানের বিজ্ঞান প্রযুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও সমৃদ্ধ।

২৮। বৌদ্ধ ধর্ম তথা বৌদ্ধ শিক্ষার প্রবর্তক কে? বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা। উদ্ভবের কারণগুলি উল্লেখ করো

বৌদ্ধ ধর্ম তথা বৌদ্ধ শিক্ষার প্রবর্তক হলেন গৌতম বুদ্ধ।

বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা উদ্ভবের কারণ

প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা, ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে প্রাচীন ভারতে সগৌরবে বিরাজ করেছে। তাদের অন্তর্নিহিত সাদৃশ্য এবং সমাজজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, এই দুই শিক্ষাব্যবস্থার সহ-অবস্থানে বিশেষ বাধা সৃষ্টি করেনি। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থার মতোই বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেও আধুনিক শিক্ষাতত্ত্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধারণার সূত্রপাত হয়েছিল। প্রাচীন ভারতীয় বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আমরা প্রথম শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণের প্রয়াস দেখতে পাই।

(1) সর্বজনীন অধিকার: বৌদ্ধধর্মে জাতি, ধর্ম, বর্ণের ভেদাভেদ ছিল না। ব্রাহ্মণ, অব্রাহ্মণ, উচ্চ-নীচ সবরকম মানুষ বৌদ্ধ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতেন যার ফলে সহজে এই শিক্ষা সকলের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভ করে।

(2) আধুনিক মানসিকতা: বৌদ্ধ শিক্ষার পদ্ধতি ছিল আধুনিক ধরনের- বাস্তব নমুনা বা দৃষ্টান্তকে ভিত্তি করে শিক্ষা দেওয়া হত, যা ছিল সহজবোধ্য। শিক্ষাব্যবস্থা খুবই প্রগতিশীল ছিল। শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও বুদ্ধির মাত্রা নির্ণায়ক বিতর্কসভার আয়োজন করা হত।

(3) সুশৃঙ্খল: শিক্ষক-শিক্ষার্থীর জীবন ছিল সুনিয়ন্ত্রিত। মঠের সমস্ত বিধিনিষেধ তারা মেনে চলত। বিহারের জীবনযাত্রা ছিল শৃঙ্খলাযুক্ত। শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ভিক্ষা করা ছিল আবশ্যক। দিনরাত্রি মিলিয়ে তিন বারের বেশি তাদের খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল।

(4) শিক্ষাকেন্দ্র: বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রগুলি ছিল খুব খ্যাতিসম্পন্ন, নালন্দা, তক্ষশিলা, বিক্রমশিলায় শিক্ষাব্যবস্থা ছিল অনেক উন্নত ধরনের।

(5) ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার ত্রুটি: বৌদ্ধ শিক্ষা উদ্ভাবনের প্রধান কারণ হল ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি, যা আলোচিত হল-

  •  শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব না দেওয়া: এই শিক্ষায় গুরু যা বলবে তাই শুনতে হবে, গুরুর কথাই সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত। শিক্ষার্থীদের কল্পনাশক্তি, যুক্তি, বিচার কোনো কিছুর উপরই গুরুত্ব দেওয়া হত না।
  • আচার-বিচারের আড়ম্বর: বেদপাঠ, যাগযজ্ঞ, আহুতি এইসকল অনুষ্ঠান ক্রমাগত আড়ম্বরে পরিণত হয়, যা আচারধর্মী শিক্ষার উৎকর্ষ বৃদ্ধি করেছিল।
  • ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া ক্ষমতা: ব্রাহ্মণরা একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করতে করতে উদ্ধত আচরণসম্পন্ন হয়ে পড়ে। সমাজে বৈষম্য বাড়তে থাকে, নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষজন এর ফলে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।
  • অন্যান্য শিক্ষার প্রতি অবহেলা: বৃত্তিমূলক শিক্ষা, শিল্প শিক্ষা যথেষ্ট অবহেলিত হচ্ছিল।
  • দীর্ঘকাল গুরুগৃহে বাস: ব্রাহ্মণ্য শিক্ষায় দীর্ঘসময় ধরে গুরুগৃহে বসবাস করতে হত। এর ফলে শিক্ষার্থীরা সমাজে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্নভাবে থাকত যা সমস্যাজনক।
  • ধর্মীয় শিক্ষা: পাঠক্রমে ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়ের উপর বেশি জোর দেওয়া হত। জীবনমুখী শিক্ষা তথা ব্যাবহারিক শিক্ষার প্রয়োগ প্রায় ছিলই না।
  • জাতির উন্নতি: সংকীর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা জাতির সামগ্রিক উন্নতির জন্য – বাধা সৃষ্টি করেছিল। অবশেষে বলা যায় গৌতম বুদ্ধের প্রবর্তিত বৌদ্ধধর্ম ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সীমাবদ্ধতাগুলিকে ভেঙে বিপ্লব এনেছিল। সাধারণের মধ্যে তথা সকলের মধ্যে অমৃতত্বের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল। হিন্দুধর্মের মধ্য থেকেই বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব ঘটে।

আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment