সামুদ্রিক নৌ-অভিযানের অনুকূল প্রেক্ষাপট ও কারণ কী ছিল

সামুদ্রিক নৌ-অভিযানের অনুকূল প্রেক্ষাপট ও কারণ কী ছিল

অথবা, ইউরোপীয় দেশগুলি কেন ভৌগোলিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল

অথবা, পঞ্চদশ শতকে ইউরোপে ভৌগোলিক আবিষ্কারে অংশগ্রহণের পটভূমির বিবরণ দাও

সামুদ্রিক নৌ-অভিযানের অনুকূল প্রেক্ষাপট ও কারণ কী ছিল
সামুদ্রিক নৌ-অভিযানের অনুকূল প্রেক্ষাপট ও কারণ কী ছিল

পঞ্চদশ শতকে ইউরোপের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিভিন্ন ভৌগোলিক আবিষ্কার ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের প্রসারের কথা বলা যেতে পারে। বস্তুত মধ্যযুগে পৃথিবীর আকৃতি, নদনদী, সমুদ্র, মানুষজন ইত্যাদি সম্পর্কে নানান কল্পিত ধারণা প্রচলিত ছিল। এ যুগের মানচিত্রগুলিও ছিল অবৈজ্ঞানিক ও অজস্র ভুলভ্রান্তিতে ভরা। এসবের ফলে তখন সমুদ্রযাত্রার কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। তবে মধ্যযুগের শেষদিকে ইউরোপে জ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ সামুদ্রিক অভিযানে প্রেরণা জোগায়।

সামুদ্রিক অভিযানের অনুকূল প্রেক্ষাপট ও কারণ

অধ্যাপক রীলা মুখার্জী লিখেছেন যে, ভৌগোলিক অন্বেষণের মূল কারণগুলিকে গুণগতভাবে ব্যাখ্যা করলে তিনটি শব্দের মুখোমুখি হতে হয়- Gold, God এবং Glory অর্থাৎ, স্বর্ণ, ঈশ্বর ও গৌরব। বলা যায় অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক নানা কারণ এই সকল অভিযান সংগঠনে সক্রিয় ছিল।

(1) পাটিকদের বিবরণ: পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপের বাইরে সামুদ্রিক অভিযানের অন্যতম প্রেরণা ছিল পর্যটকদের নির্ভরযোগ্য বিবরণ। মধ্যযুগের শেষের দিকে আরব পর্যটকদের কাছ থেকে আফ্রিকা সম্পর্কে নানান তথ্য আহরণ করে ইউরোপ। আর এশিয়ায় ইউরোপীয় পর্যটকদের ভ্রমণ এবং তার বৃত্তান্ত তথ্যভাণ্ডারকে খানিকটা সমৃদ্ধ করেছিল। এই পর্বে মার্কোপোলোর বিবরণ ভারতবর্ষ সম্পর্কে ইউরোপে গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করে। এ ছাড়াও নিকোলো কন্টির (Niccolo de’ Conti) ভ্রমণবৃত্তান্ত ও গণনা, আফ্রিকাকে কেন্দ্র করে পূর্ব দুনিয়া এবং মশলাদ্বীপে সামুদ্রিক অভিযান চালানো সম্ভবপর করে তুলেছিল।

(2) মানচিত্র অঙ্কন: পঞ্চদশ শতকে মানচিত্র অঙ্কনের বিষয়টি সামুদ্রিক অভিযানে বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছিল। গ্রেগোরাস, আন্দ্রে ওয়ালসপারজার, গারহার্ডাস মার্কেটরের মতো ব্যক্তিত্বদের তৈরি মানচিত্র যেমন উদ্যোগী নাবিকদের সমুদ্রযাত্রায় উৎসাহী করে তোলে, তেমনি নাবিকদের অভিজ্ঞতা অধিক নির্ভরযোগ্য মানচিত্র অঙ্কনে সাহায্য করেছিল। তাছাড়া মেরিনারস কম্পাস, অ্যাস্ট্রোল্যাব ইত্যাদির আবিষ্কারও ইউরোপীয় দেশগুলিকে সামুদ্রিক অভিযানে উদ্যোগী করে তোলে।

(3)  উন্নত নৌযান: পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে ভূমধ্যসাগরে ব্যবহৃত নৌযানগুলি ছিল নৌকাকৃতির ছোটো পোতবিশেষ। এগুলি উপকূল ধরে চলাচলের উপযোগী ছিল, কিন্তু সামুদ্রিক অভিযানের পক্ষে এগুলি যথাযথ ছিল না। মাঝসমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার জন্য দরকার ছিল বৃহদাকার জলযান। এই শতকের মাঝামাঝি সময়ে সেই চাহিদা পূরণ করেন আইবেরীয় প্রযুক্তিবিদগণ। দীর্ঘ পরীক্ষানিরীক্ষা ও গবেষণার পর তাঁরা আরবের ধাও/ধৌ (Dhow) এবং চিনের জাঙ্ক (Junk) নৌযানের উপাদান সমন্বিত করে সমুদ্রযাত্রার উপযোগী নৌযান নির্মাণ করেন। ত্রিকোণাকৃতির এই পোত (Caravel) বাতাসের অনুকূলে সমুদ্রযাত্রায় সক্ষম ছিল। তবে এই জাতীয় পোতগুলির ব্যবহার ছিল সীমাবদ্ধ। এসময় নতুন জগতের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির ফলে বড়ো জাহাজের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়-উদ্ভব ঘটে ক্যারাক (Carrack) জাহাজের। এইসব আবিষ্কারসমূহ সমুদ্রযাত্রায় প্রেরণা দান করেছিল।

(4) বারুদের আবিষ্কার: চিন থেকে আরবদের মাধ্যমে বারুদ ইউরোপে পৌঁছায়। এই বারুদের আবিষ্কার নিঃসন্দেহে রূঢ় প্রকৃতির বিরুদ্ধে সামুদ্রিক অভিযানে নাবিকদের উৎসাহ বৃদ্ধি করেছিল। আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা লঘুগামী পোতগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে সেগুলি আটল্যান্টিক মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরে ইউরোপীয়দের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়ে ওঠে। আর এভাবেই নাবিকদের দুঃসাহসিক অভিযানে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।

(5) নব্য রাজতন্ত্রের উদ্যোগ: চর্তুদশ-পঞ্চদশ শতকে ইটালির নগররাষ্ট্রগুলিতে জোরালো হয় ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের ধারণা। এই নব্যচেতনা যে নতুন শক্তির জাগরণ ঘটায়, তা ইউরোপের ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের বাইরে নতুন জগতের সন্ধানে নামার পথের মানসিক ও শারীরিক বাধাগুলিকে দূর করে। এসময় ইউরোপীয় কর্মকাণ্ডের ভরকেন্দ্র ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে সরিয়ে আটল্যান্টিক সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে স্থাপন করা হয় এবং এই কাজে প্রাথমিক উদ্যোগ নেয় পোর্তুগাল, স্পেন, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের নব্য রাজতন্ত্রগুলি।

(6) অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য: ইউরোপীয় দেশগুলির আর্থিক চাহিদা পূরণছিল ভৌগোলিক অভিযানের অন্যতম কারণ বা উদ্দেশ্য। সুতিবস্ত্র, মশলা, সুগন্ধির জন্য এই দেশগুলি নির্ভর করত প্রাচ্যের দেশগুলির উপর, যে বাণিজ্যের মধ্যস্থতা করত আরব বণিকগণ। কিন্তু পঞ্চদশ শতকে নানা কারণে এই বাণিজ্য ব্যয়বহুল হয়ে পড়লে ইউরোপীয় দেশগুলি সরাসরি বাণিজ্যের জন্য নতুন পথের সন্ধানে নামে। অপরদিকে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের (১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ) পর ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যে অটোমান তুর্কিদের আধিপত্য স্থাপিত হয়। ফলে আরব বাণিজ্যে ভাঙন ধরে। তুর্কিরা ইউরোপের সঙ্গে প্রাচ্যদেশের যোগাযোগের স্থলপথগুলি বন্ধ করে দেয়। ফলস্বরূপ, প্রাচ্যের পণ্যদ্রব্য বিশেষত মশলা, রেশম বস্ত্র ইত্যাদি ইউরোপে সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। পণ্যের পরিবহণ মূল্যও বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি প্রাচ্যের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বিকল্প পথের সন্ধানে নামতে বাধ্য হয়। 

(7) ধর্মীয় উদ্দেশ্য: সামুদ্রিক অভিযানের পশ্চাতে ধর্মীয় উদ্দেশ্যও বিশেষভাবে কার্যকরী ছিল। কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের পর ইউরোপে ইসলাম ধর্মের প্রভাব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। ইউরোপীয়দের মনে এই ধারণা দৃঢ় হয় যে, পৌত্তলিকদের খ্রিস্টান চার্চের শরণাগত করে তোলা ঈশ্বরসেবার সমতুল্য কাজ হবে। তাছাড়া ইউরোপের বাইরে স্থাপিত প্রেস্টার জন (Prester John)-এর কাল্পনিক শেষ খ্রিস্টান দেশের অনুসন্ধান খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের অন্যতম পবিত্র কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। এখন সামুদ্রিক অভিযান ও ভৌগোলিক আবিষ্কার দ্বারা ইউরোপীয় বণিকেরা নতুন ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে এগিয়ে আসেন। স্বর্ণলাভের সাথে স্বর্গলাভের স্বপ্ন এই কাজে বিশেষ শক্তি জোগায়।

(8) রেনেসাঁর অবদান: পঞ্চদশ শতকের রেনেসাঁ ইউরোপীয়দের মধ্যে জাগিয়েছিল আবিষ্কারের নেশা। আর এই নেশাতেই পরবর্তীকালে মেতে উঠেছিল পোর্তুগাল, স্পেন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের মতো বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তিগুলি। 

(9) গৌরব বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা: অন্বেষণের যুগে নাবিকদের দুঃসাহসিক অভিযানের অন্যতম কারণই ছিল সাম্রাজ্যিক গৌরব বা গরিমা বৃদ্ধির বাসনা। এর কারণেই ভৌগোলিক আবিষ্কারের ঝুঁকিবহুল কাজে ইউরোপীয়রা নিয়োজিত হয়েছিল।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment