সামুদ্রিক অভিযান ও ভৌগোলিক আবিষ্কারে পোর্তুগালের ভূমিকা ব্যাখ্যা করো

পঞ্চদশ শতকে ভৌগোলিক অন্বেষণ ও সামুদ্রিক অভিযানের কাজে অগ্রণী ভূমিকা ছিল পোর্তুগালের। বিশেষত পোর্তুগিজ নাবিকদের প্রচেষ্টার ফলে নতুন জলপথ ও ভূখণ্ড আবিষ্কার সম্ভবপর হয়েছিল।
সামুদ্রিক অভিযান ও ভৌগোলিক আবিষ্কারে পোর্তুগালের ভূমিকা
(1) অনুকূল উপাদান: পোর্তুগালের ভৌগোলিক আবিষ্কারের পথ সহজতর হয়েছিল তার পারিপার্শ্বিক অনুকূল পরিবেশের জন্য। ভৌগোলিক দিক থেকে আইবেরীয় উপদ্বীপে পোর্তুগালের অবস্থান এক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তাছাড়া পোর্তুগালে রাজনৈতিক সুস্থিতি ও শান্তি স্থাপিত হয়েছিল, নৌ-প্রযুক্তিতেও এই দেশ ছিল বেশ সুদক্ষ। এসকল নানান অনুকূল উপাদান পোর্তুগালকে সামুদ্রিক অভিযান ও ভৌগোলিক আবিষ্কারে প্রেরণা জুগিয়েছিল।
(2) পোর্তুগালের সামুদ্রিক অভিযানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্যোগ: পোর্তুগালের নৌ-অভিযানে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল-
- প্রিন্স হেনরির ভূমিকা: প্রিন্স হেনরি বা নাবিক হেনরি (Henry the Navigator) ভৌগোলিক অভিযানে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। উত্তর মরক্কো উপকূলে অবস্থিত কিউটা দখলের (১৪১৫ খ্রিস্টাব্দ) সময় তিনি পোর্তুগিজদের নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। পরবর্তীতে ব্যক্তিগতভাবে হেনরি কোনও সমুদ্র অভিযানে অংশ না নিলেও তাঁর কর্মকাণ্ড সমুদ্রযাত্রায় ও অভিযানে গতিময়তা প্রদান করে। তিনি নৌবিদ্যা, জাহাজ নির্মাণ প্রযুক্তি, সামুদ্রিক অভিযান ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষাদান ও গবেষণার জন্য সাগ্রেস (Sagres)-এ একটি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলেন।
- রাজা পঞ্চম আলাফোনসো: হেনরির মতো রাজা পঞ্চম আলফোনসো (Alfonso V) সরাসরি সমুদ্র অভিযানে অংশ না নিলেও নাবিকদের বিশেষভাবে সহায়তা করেছিলেন।
- রাজা দ্বিতীয় জন: ১৪৮১ খ্রিস্টাব্দে আলফোনসোর পুত্র দ্বিতীয় জন (John II)-এর রাজত্বকালে আবিষ্কারের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বহু অভিযান সংগঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয় জন ১৪৮১ খ্রিস্টাব্দে নাইজেরিয়ার বেনিনের কাছে মিনা (স্বণখনি) অভিযানের জন্য এক অভিযাত্রীকে প্রেরণ করেন। তাছাড়া ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার প্রাপ্ত দেশ অনুসন্ধানের জন্যেও তিনি অভিযান পাঠিয়েছিলেন।
- বার্থোলোমিউ দিয়াজ : যুবরাজ হেনরির নৌ-বিদ্যালয় থেকে শিক্ষালাভের পর রাজা দ্বিতীয় জনের উদ্যোগ ও উৎসাহে নাবিক বার্থোলোমিউ দিয়াজ (Bartolomeu Dias / Bartholomew Diaz) প্রাচ্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে অভিযানে নামেন। নৌ-অভিযান চালিয়ে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল ধরে তিনি দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছান (১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ)। এখানে সমুদ্রের উত্তাল রূপ দেখে দিয়াজ এর নাম দেন ঝড়ের অন্তরীপ (Cape of Storm)। কিন্তু রাজা দ্বিতীয় জন বিশ্বাস করতেন যে, এই উত্তাল জলরাশি অতিক্রম করতে পারলেই প্রাচ্যে পৌঁছোনো সম্ভব হবে। তাই তিনি এই অঞ্চলের নতুন নাম দেন উত্তমাশা অন্তরীপ (Cape of Good Hope)। এসময় দিয়াজ ভারত মহাসাগরের পথেই এশিয়ায় পৌঁছোনোর আভাস দিয়েছিলেন। তাছাড়া কেব্রালের নেতৃত্বে ব্রাজিল অভিযানেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন।
- ভাস্কো-ডা-গামা: পোর্তুগালের রাজা প্রথম ম্যানুয়েল (Manuel I)-এর উদ্যোগে ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে ৪টি জাহাজ ও ১১৮ জন নাবিক-সহ ভাস্কো-ডা-গামা (Vasco da Gama) অভিযান শুরু করেন। দিয়াজের পথ ধরেই ১৪৯৭-তে তিনি উত্তমাশা অন্তরীপ অতিক্রম করে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে পৌঁছোন। পথিমধ্যে চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অধিকাংশ নাবিক অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার মধ্যেও ধৈর্য না হারিয়ে তিনি জনৈক আরবীয় নাবিকের সাহায্যে ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে কালিকট বন্দরে উপস্থিত হন। ভারতে তিন মাস থাকার পর তিনি এখান থেকে মশলা, চন্দন কাঠ, সুগন্ধি দ্রব্য ইত্যাদি বহু জিনিস নিয়ে স্বদেশে ফিরে যান। ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কো-ডা-গামা দ্বিতীয়বার ভারতে এসে এখানে প্রথম পোর্তুগিজ বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেন।
- আলফোনসো ডি আলবুকার্ক: ভারতে পোর্তুগিজ শক্তির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত আলফোনসো/আফোনসো ডি আলবুকার্ক (Afonso de Albuquerque) ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারতে আসেন। ১৫১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি গোয়া দখল করে একটি শক্তিশালী পোর্তুগিজ ঘাঁটি স্থাপন করেন। পোর্তুগিজ গভর্নর হিসেবে আলবুকার্ক ভারতে পোর্তুগিজদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
- পেড্রো আলভারেজ কেব্রাল : পেড্রো আলভারেজ কেব্রাল (Pedro Alvares Cabral) ছিলেন একজন প্রখ্যাত পোর্তুগিজ নাবিক ও অভিযাত্রী। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে ১৩টি জাহাজ নিয়ে সমুদ্রযাত্রায় উদ্যোগী হয়ে কেব্রাল দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূলে পৌঁছোন। নতুন এই স্থানটির তিনি নাম দেন ব্রাজিল এবং এখানে পোর্তুগালের আধিপত্য ঘোষণা করেন। উক্ত বছরের সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ কেব্রাল কালিকট বন্দরে পৌঁছান। ভারত থেকে প্রচুর মশলা নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি।
মূল্যায়ন
পরিশেষে বলা যায় যে, পোর্তুগালের রাজা, অভিযাত্রী ও বণিকদের মিলিত প্রচেষ্টায় পোর্তুগালের সমুদ্র অভিযান এবং নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। সমুদ্রপথের মাধ্যমে বাণিজ্যের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হওয়ার পাশাপাশি এরই পরিণতিতে পরবর্তীকালে আমেরিকা, এশিয়ার নতুন ভূখণ্ডগুলিতে উপনিবেশ বিস্তারের কাজটিও সম্পন্ন হয়েছিল।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর