সামুদ্রিক অভিযান ও ভৌগোলিক আবিষ্কারে স্পেনের ভূমিকা  আলোচনা করো

সামুদ্রিক অভিযান ও ভৌগোলিক আবিষ্কারে স্পেনের ভূমিকা  আলোচনা করো

অথবা, সামুদ্রিক অভিযানে স্পেনের উদ্যোগ আলোচনা করো

সামুদ্রিক অভিযান ও ভৌগোলিক আবিষ্কারে স্পেনের ভূমিকা  আলোচনা করো
সামুদ্রিক অভিযান ও ভৌগোলিক আবিষ্কারে স্পেনের ভূমিকা  আলোচনা করো

পোর্তুগালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমুদ্রযাত্রা ও ভৌগোলিক আবিষ্কারে নামে স্পেনীয়রাও। স্পেনও ছিল আইবেরীয় উপদ্বীপের একটি রাজ্য। পোর্তুগালের অনেক পরে ভৌগোলিক অভিযানে এই দেশ অংশগ্রহণ করলেও বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে স্বল্পকালের মধ্যেই তারা ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে।

সামুদ্রিক অভিযান ও ভৌগোলিক আবিষ্কারে স্পেনের ভূমিকা

(1) অনুকূল উপাদান: পোর্তুগালের মতোই স্পেনেও সমুদ্র অভিযানের অনুকূল প্রেক্ষাপট ও পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। কাস্তিলের রানি ইসাবেলা ও আরাগনের ফার্দিনান্দ-সহ বিভিন্ন রাজকীয় উদ্যোগ থেকে শুরু করে নাবিকদের অনুপ্রেরণা, অজানাকে জানার আকাঙ্ক্ষা, সর্বোপরি নতুন ভূখণ্ড দখল ও সাম্রাজ্যবিস্তারের প্রবল বাসনা স্পেনকেও সামুদ্রিক অভিযানের পথে এগিয়ে দিয়েছিল।

(2) স্পেনের সামুদ্রিক অভিযানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্যোগ: স্পেনের নৌ-অভিযানে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্যোগ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল-

  • ক্রিস্টোফার কলম্বাস: স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলার পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রিস্টোফার কলম্বাস (Christopher Columbus) পশ্চিমমুখী নৌযাত্রা শুরু করেন। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ৩ আগস্ট সান্টা মারিয়া, নিনা, পিন্টা নামক তিনটি জাহাজ ও ৮৭ জন নাবিক-সহ অভিযান শুরু করে বাহামার একটি অংশে কলম্বাস পদার্পণ করেন। তিনি এই দ্বীপের নামকরণ করেন সালভাদোর দ্বীপ। কলম্বাস নিশ্চিত ছিলেন যে, তিনি এশিয়ায় পৌঁছেছেন। তাই স্পেনে প্রত্যাবর্তনের পর কলম্বাস দাবি করেন যে তিনি ইন্ডিজ আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ছিল নতুন মহাদেশ আমেরিকা। পরবর্তীতে কলম্বাস ওয়েস্ট ইন্ডিজের বহু দ্বীপপুঞ্জ, কোস্টারিকা ও হন্ডুরাসের বিস্তীর্ণ উপকূলও আবিষ্কার করেন।
  • আমেরিগো ভেসপুচি: ফ্লোরেন্সের ভূগোলবিদ ও স্পেনীয় অভিযাত্রী আমেরিগো ভেসপুচি (Amerigo Vespucci) ১৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে পৌঁছোন ব্রাজিলে। জানা যায় যে, ১৪৯৭ থেকে ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মোট ৪ বার তিনি আমেরিকার অভ্যন্তরে অভিযান চালিয়েছিলেন। ভেসপুচি কলম্বাসের আবিষ্কৃত নতুন মহাদেশটিকে New World বা নতুন বিশ্ব বলে অভিহিত করেন। জার্মান ভূগোলবিদ মার্টিন ওয়াল্ডসিমুলার আমেরিগো ভেসপুচির নামানুসারে এই নতুন মহাদেশের নাম দেন আমেরিকা।
  • ভাস্কো নুনেজ ডি বালাবোয়া: স্পেনীয় নাবিক ভাস্কো নুনেজ ডি বালবোয়া (Vasco Nunez de Balboa, ১৪৭৫-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ) ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ার উদ্দেশে শুরু করেন তাঁর যাত্রা। পরবর্তীতে তিনি সোনায় পরিপূর্ণ এক নতুন রাজ্যের সংবাদ শোনেন। এতে উৎসাহী হয়ে তিনি প্রায় ১৯০ জন স্পেনীয় নাগরিক, অন্যান্য কয়েকজন মানুষ, কয়েকটি কুকুর নিয়ে নৌ- ভাস্কো নুনেজ ডি বালবোয়া অভিযান চালিয়ে আটল্যান্টিক মহাসাগরের অন্য তীরে পানামার পশ্চিমে একটি নতুন সাগরের সন্ধান পান (১৫১৩ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি এর নাম দেন দক্ষিণ সমুদ্র (South Sea)। আসলে এটি ছিল প্রশান্ত মহাসাগর (Pacific Ocean)। অন্বেষণের যুগে বালবোয়ার এই আবিষ্কারটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা।
  • ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান: ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে স্পেনরাজ প্রথম চার্লসের পৃষ্ঠপোষকতায় ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান (Ferdinand Magellan) অভিযান শুরু করে আটল্যান্টিক পেরিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ দিক ঘুরে আরও এগিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে (দক্ষিণ সাগর) পৌঁছোন। এই মহাসমুদ্রের শান্তরূপের কারণেই তিনি এরূপ নামকরণ করেন। এরপর ম্যাগেলান অপর এক দ্বীপপুঞ্জে এসে উপস্থিত হন। স্পেনের যুবরাজ ফিলিপের নামানুসারে এর নাম রাখা হয় ফিলিপাইনস দ্বীপপুঞ্জ।
  • কোর্টেস, পিজারো ও অন্যান্যরা:(a) আলোচ্য পর্বে প্রাচীন অ্যাজটেক (Aztec) সভ্যতার ধ্বংসপ্রাপ্তি ঘটে এবং তা স্পেনীয়দের অধিকারভুক্ত হয়। এক্ষেত্রে হার্নান্দো কোর্টেস (Hernando Cortes)-এর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর নেতৃত্বেই মেক্সিকোতে স্পেনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মধ্য আমেরিকার পানামাও চলে আসে স্পেনের দখলে। (b) ১৫৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী সভ্যতা ইনকা (Inca) স্পেনের অন্তর্ভুক্ত হয়। স্পেনীয় নাবিক ফ্রান্সিসকো পিজারো (Francisco Pizarro) ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে পেরু অভিযান করেন এবং নির্বিচারে এখানকার অধিবাসীদের হত্যা করে পেরু দখল করা হয়। ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ফিলিপাইনস দ্বীপপুঞ্জের বহু দ্বীপ স্পেনের অধিকারে চলে আসে।

মূল্যায়ন

১৭০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উত্তর আমেরিকার টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা-সহ বিভিন্ন স্থানে স্পেনীয়দের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পাশাপাশি পশ্চিমদিকে অভিযান চালিয়ে কলম্বিয়া, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, বলিভিয়া ইত্যাদি স্থানের উপরেও স্পেন নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। কালক্রমে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার অধিকাংশই চলে আসে স্পেনের দখলে। এভাবে পরপর একাধিক সফল নৌ-অভিযানের সূত্র ধরে স্পেনীয় অর্থনীতি দারুণভাবে সমৃদ্ধ হতে থাকে।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment