সামরিক বিপ্লব কাকে বলে ? ইউরোপে সামরিক বিপ্লবে প্রযুক্তির অগ্রগতি আলোচনা করো
অথবা, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ইউরোপে সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পরিচয় দাও
অথবা, প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি ইউরোপের সামরিক দিকে কীরূপ পরিবর্তন এনেছিল
অথবা, ইউরোপে আগ্নেয়াস্ত্র ও যুদ্ধের আধুনিক রীতিকৌশলের পরিচয় দাও
অথবা, নবজাগরণের যুগে সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি আলোচনা করো

সামরিক বিপ্লব
আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার প্রভাবে সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন দেখা যায়। ১৪৫০ থেকে ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দ-ইউরোপীয় নবজাগরণের এই পর্বে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন ও কারিগরি উন্নয়নের প্রতিক্রিয়া অনুভূত হয়েছিল সমরাস্ত্র ও রণনীতির উপরেও। পঞ্চদশ শতকের মাঝমাঝি সময়ে ইউরোপে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে যে তাৎপর্যপূর্ণ রূপান্তর ঘটেছিল, পরবর্তী দুই শতাব্দীতে সেই রূপান্তরই হয়ে উঠেছিল বৈপ্লবিক। ঐতিহাসিকগণ এই বৈপ্লবিক রূপান্তরকেই সামরিক বিপ্লব (Military Revolution) বলে অভিহিত করেছেন
ইউরোপে সামরিক বিপ্লবে প্রযুক্তির অগ্রগতি
ইউরোপে পঞ্চদশ শতকে যে সামরিক বিপ্লবের সূচনা ঘটেছিল, তার মূল উপাদান ছিল বারুদের আবিষ্কার ও ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার।
(1) সামরিক বিপ্লবের কারণ: ইউরোপে সামরিক বিপ্লবের পশ্চাৎপটে সক্রিয় বিভিন্ন কারণগুলি হল- ধাতুশিল্পের উন্নতি, নব প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রসমূহের সম্প্রসারণ ও যুদ্ধে জয়লাভের আকাঙ্ক্ষা, যুদ্ধের প্রয়োজনে পদাতিক বাহিনীর সংস্কার, রাজশক্তির সমর্থন, আর্থিক সহায়তালাভ ইত্যাদি।
(2) বারুদের আবিষ্কার ও ব্যবহার: বাবুদ (Gunpowder) প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল চিনদেশে। প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেফ্রি পার্কার (Geoffrey Parker)-এর মতে, সোরা (Salt Peter/Potassium Nitrate), গন্ধক (Brimstone) এবং কাঠকয়লার সংমিশ্রণে বারুদ তৈরির জ্ঞান নবম শতকের মধ্যেই চিন আয়ত্ত করেছিল। এরপর সম্ভবত ত্রয়োদশ শতকে এই প্রযুক্তি আরবদের হাত ঘুরে ইউরোপে আসে এবং তা আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে যুদ্ধের ক্ষেত্রে অপরিহার্য স্থান দখল করে নেয়।
(3) আগ্নেয়াস্ত্রের প্রাথমিক ব্যবহার : ত্রয়োদশ শতকের ফ্রান্সিস্কান বৈজ্ঞানিক রজার বেকন তাঁর লেখায় আগ্নেয়াস্ত্রের বর্ণনা দান করেছিলেন। ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে একটি ফ্লোরেন্সীয় নথিতে প্রথম বন্দুকের উল্লেখ মেলে। বস্তুত চতুর্দশ শতকের গোড়া থেকেই ইউরোপে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ও বন্দুক নির্মাণের সূচনা হয়েছিল বলে জানা যায়। এরপর চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপের বহু দেশে ব্যাপকভাবে আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদিত হতে থাকে।
(4) উন্নত বন্দুক ও কামান ব্যবহার: ইউরোপে পঞ্চদশ শতক থেকে রণক্ষেত্রগুলিতে কামান ও বন্দুকের ব্যবহার বাড়তে থাকে। বারুদের সাহায্যে পাথরের গোলা ছুঁড়ে শত্রুপক্ষের দুর্গদ্বার বা দুর্গের প্রাকার ভাঙার কাজে এই কামান ছিল কার্যকরী। কনস্ট্যান্টিনোপল অবরোধের সময়
(১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ) তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদ ১৪ টি বড়ো কামানের সঙ্গে কাজে লাগিয়েছিলেন ৩৫৬টি ছোটো কামান এবং ২টি বিশালাকার কামান। এই দুটি অতিকায় কামান থেকে প্রায় ৩ ফুট ব্যাসবিশিষ্ট এবং ৮০০ পাউন্ড ওজনের পাথরের গোলা নিক্ষেপ করে কনস্ট্যান্টিনোপল দুর্গ ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, ধাতুবিদ্যার অগ্রগতির ফলে লোহা বা সিসা নির্মিত কামানের গোলার ব্যবহার রনাঙ্গণে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল।
(5) ইউরোপে অস্ত্রশস্ত্রে পরিবর্তন: সামরিক বিপ্লবের অভিঘাতে ইউরোপে এতকাল যাবৎ ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের জায়গায় নতুন নতুন অস্ত্র নির্মিত হতে থাকে। ব্যবহৃত হতে থাকে উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি নলযুক্ত নতুন পিস্তল। ষোড়শ শতকে স্পেনে নাবিকদের মধ্যে গাদাবন্দুকের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। পাশাপাশি নির্মিত হতে থাকে যুদ্ধোপযোগী দ্রুতগতিসম্পন্ন নৌযানও। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে তিরধনুক ও তরোয়াল যথেষ্ট উন্নত হয়ে ওঠে। এ ছাড়া নতুন ধরনের হেলমেট, লম্বা বর্শা, যুদ্ধ হাতুড়ির (War Hammer) ব্যবহারও শুরু হয়েছিল।
(6) যুদ্ধরীতিতে পরিবর্তন: যুদ্ধকৌশল বা যুদ্ধরীতিতে পরিবর্তন হল সামরিক বিপ্লবের একটি আবশ্যকীয় দিক। এই পর্বে মধ্যযুগের অভিজাত বীর অশ্বারোহী নাইট (Knight)-দের বীরগাথার অবসান ঘটে এবং পদাতিক বাহিনীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে চতুর্দশ লুই (Louis XIV)-এর নেদারল্যান্ড আক্রমণের সময় ১,২০,০০০ সেনার মধ্যে পদাতিক বাহিনী ছিল ৭৫ শতাংশ। এই পদাতিকরা মূলত ছিলেন সাধারণ শ্রেণির মানুষ। হাতে টানা পালক লাগানো তির ছোঁড়া ধনুক ও বল্লমধারী পদাতিক বাহিনী নতুন যুদ্ধকৌশলের মাধ্যমে অশ্বারোহীদের পরাস্ত করতেন। অন্যদিকে পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে আর্কেবুস (Arquebus) বন্দুক এবং ষোড়শ শতকে মাস্কেট (Musket) বন্দুক সৈন্যদের হাতে আসায় গোলন্দাজ বাহিনীর গুরুত্বও বৃদ্ধি পেতে থাকে। যুদ্ধক্ষেত্রে বল্লম ও বন্দুকধারী বাহিনীর পারস্পরিক নির্ভরশীল রণনীতির প্রচলন ঘটে।
(7) নতুন ধরনের দুর্গ নির্মাণ: আগ্নেয়াস্ত্র আবিষ্কারের পর থেকে নতুন ধরনের দুর্গ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে ফরাসি স্থপতি ভবাঁ (Vauban) অনেকগুলি প্রতি-আক্রমণাত্মক ও রক্ষণাত্মক দুর্গের নকশা প্রস্তুত করেছিলেন। এই শৈলীর দুর্গগুলি ত্রাস ইতালিয়ান (Trace Italienne) নামে পরিচিত।
মূল্যায়ন
পরিশেষে বলা যায় যে, সামরিক বিপ্লবের ফলস্বরূপ আগ্নেয়াস্ত্রের প্রচলন যুদ্ধের রাজকীয়করণে সাহায্য করেছিল। পাশাপাশি গুরুত্ব হারিয়েছিল সামন্তপ্রভুদের বাহিনী। আসলে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে ইউরোপের রাজনীতিতে রাজাদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে এই সকল রাজারা নতুন নতুন আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাণ এবং যুদ্ধনীতি গ্রহণ করেছিলেন। ফলত অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল রাজন্যদের হাতে। আর এর প্রভাবেই ইউরোপে রাজতান্ত্রিক জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর