শিশুর বিকাশের মূল নীতিগুলি লেখো। বৃদ্ধি ও বিকাশের নীতিগুলির শিক্ষাগত তাৎপর্য লেখো

বিকাশের মূল নীতি
বিকাশ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি কতকগুলি নীতির উপর নির্ভরশীল। এগুলি নীচে আলোচনা করা হল –
(1) নিরবচ্ছিন্নতার নীতি (Principle of Continuity): বিকাশ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কখনও থেমে থাকে না। এই পরিবর্তন কখনও ব্যক্তির চোখে ধরা পড়ে আবার কখনও পড়ে না। আসলে বিকাশ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে হয় বলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তার পরিবর্তন চোখে পড়ে।
(2) ক্রশসংযোজনশীলতার নীতি (Principle of Cummulativeness): বিকাশ ক্রমসংযোজনশীলতার নিয়ম মেনে পরিচালিত হয়। বিকাশের স্তরে যে-কোনো পর্যায়ে ব্যক্তির অবস্থা তার পূর্ববর্তী সকল পর্যায়ের বিকাশের সমষ্টিগত ফল। বিকাশের যে-কোনো পর্যায়ের অবস্থা ঠিক তার পূর্ববর্তী অবস্থা থেকে আসে। মনোবিদরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, বাল্যকালের বিভিন্ন আচরণ ও অভিজ্ঞতা ব্যক্তির পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করে।
(3) সামঞ্জস্যতার নীতি (Principle of Orderness): বিকাশ একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রক্রিয়া, কোনো বিক্ষিপ্ত প্রক্রিয়া নয়। কোন্ আচরণের পর কোন্ আচরণ বিকশিত হবে তা পূর্ব নির্দিষ্ট বা সামঞ্জস্যপূর্ণ।
(4) সেফালোকডাল নীতি (Cephalocaudal Principle): বিকাশ সর্বদাই মস্তিষ্ক থেকে পায়ের দিকে অগ্রসর হয়। সর্বপ্রথম শিশুর মস্তিষ্কের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াগুলি বিকশিত হয় যার দরুণ শিশু তার মাকে চিনতে পারে। এরপর শিশু বসতে শেখে, তারপর হামা দেয়, পরবর্তীকালে হাঁটতে শেখে।
(5) প্রক্সিমোডিস্টাল নীতি (Proximodistal Principle): এই নীতির মূলকথা হল বিকাশ কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে অগ্রসর হয়। মস্তিষ্কের বিকাশ আগে হয়, তারপর শিশুর চক্ষুর উন্মোচন হয়।
(6) ঐক্যের নীতি (Principle of Unity): বিকাশের ধারা ব্যক্তিজীবনের ঐক্য বজায় রাখে। শিশুর দৈহিক বিকাশ অন্য বিকাশকে প্রভাবিত করে। শিশুর দৈহিক বিকাশ যথাযথ না হলে মানসিক বিকাশ হ্রাস পায়। কোনো ধরনের বিকাশই এককভাবে সম্পন্ন হতে পারে না।
বৃদ্ধি ও বিকাশের নীতিগুলির শিক্ষাগত তাৎপর্য
(1) নিরবচ্ছিন্নতা: মানুষের জীবন বিকাশ নিরবচ্ছিন্ন। ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্নতা প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য শিক্ষার প্রতিটি স্তরে শিক্ষার্থীদের চাহিদা, আগ্রহ ও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। প্রতিটি স্তরে বিষয়ের এককগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বিভিন্ন এককগুলি এমনভাবে উপস্থাপন করা দরকার, যাতে শিক্ষার্থীর বিষয় সম্বন্ধে ধারণায় নিরবচ্ছিন্নতা নষ্ট না হয়। বিষয়ের নিরবচ্ছিন্নতার ফলে বিকাশের নিরবচ্ছিন্নতা বজায় থাকবে।
(2) ব্যক্তিগত পার্থক্যের নীতি: শিশুদের বৃদ্ধি ও বিকাশের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পার্থক্য রয়েছে। তাই ব্যক্তিগত পার্থক্যের নীতি অনুসরণ করে বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা দরকার। বয়স, পরিবেশ, বংশগতি ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে ব্যক্তিগত পার্থক্য হতে পারে। তাই বিকাশের ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তিগত পার্থক্যকে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়া হয়, তবে বিকাশের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
(3) ধারাবাহিকভার নীতি: শিশুর বিকাশ ঘটে সাধারণ থেকে বিশেষের দিকে। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে এই নীতি অনুযায়ী পাঠদানের ব্যবস্থা করা দরকার। যেমন- শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সহজ থেকে কঠিন বা মূর্ত থেকে বিমূর্ত বা জানা থেকে অজানা এই ধারাবাহিকতা অনুযায়ী পাঠদান বিকাশের পক্ষে সহায়ক।
(4) মিথস্ক্রিয়ার নীতি: বিকাশ হল বংশগতি ও পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ার ফল। শিক্ষাক্ষেত্রে বংশগতি ও পরিবেশের উপর ভিত্তি করে শিক্ষাদান করলে শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়া যথাযথ সম্ভব হয়।
(5) সম্পর্কযুক্ত: সব ধরনের বিকাশ (দৈহিক, বৌদ্ধিক, মানসিক, নৈতিক ইত্যাদি) পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষনীয় বিষয়গুলি এমন হওয়া দরকার, যাতে শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সম্ভব হয়।
(6) লিঙ্গগড পার্থক্যের নীতি: বিকাশের ক্ষেত্রে লিঙ্গগত পার্থক্যের নীতিকে কার্যকরী করতে হলে এমন কিছু বিষয় পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার যাতে বিকাশের ক্ষেত্রে লিঙ্গগত পার্থক্যকে কার্যকরী করা যায়। যেমন- উচ্চমাধ্যমিক স্তরে গৃহবিজ্ঞান, পুষ্টিবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। শিক্ষার্থীরা সেই বিষয় নিয়ে পড়তে পারে।
(7) ভবিষ্যদ্বাণীর নীতি: বৃদ্ধি ও বিকাশের ক্ষেত্রে একটি নীতি হল ভবিষ্যদ্বাণীর নীতি। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে এমনসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যেগুলি ভবিষ্যৎ জীবনে কার্যকরী হয়। সুতরাং বৃদ্ধি ও বিকাশের নীতিগুলিকে কাজে লাগিয়ে বিষয়বস্তু নির্বাচন, পাঠক্রম তৈরি, পাঠদান পদ্ধতি ইত্যাদি নির্বাচন করা প্রয়োজন যা, শিক্ষাক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।