মুদ্রণ জগতে চিনের অবদান কীরূপ ছিল

মুদ্রণ জগতে চিনের অবদান কীরূপ ছিল

অথবা, ইউরোপে মুদ্রণবিপ্লবের পটভূমি তৈরিতে চিনের ভূমিকার মূল্যায়ন করো

মুদ্রণ জগতে চিনের অবদান কীরূপ ছিল
মুদ্রণ জগতে চিনের অবদান কীরূপ ছিল

কাগজ এবং কম্পাসের মতো মুদ্রণ প্রযুক্তির জন্যও পাশ্চাত্য সমাজ চিনের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে চিনে প্রথম মুদ্রণশিল্পের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যদিও এর আগেই ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ একটি রাজকীয় অনুজ্ঞায় সেদেশে যান্ত্রিক মুদ্রণ পদ্ধতির উল্লেখ মেলে। এরপর অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে মুদ্রণব্যবস্থা চিন-সহ জাপান এমনকি কোরিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে মুদ্রণ প্রযুক্তি চিন থেকে আরব হয়ে পাড়ি দেয় ইউরোপে।

মুদ্রণ জগতে চিনের অবদান / ইউরোপে মুদ্রণবিপ্লবের পটভূমি তৈরিতে চিনের ভূমিকা

(1) কাগজ তৈরি: সম্ভবত খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে (১০৫ খ্রিস্টাব্দ) চিনদেশে প্রথম কাগজের উদ্ভাবন ঘটে। তুঁত গাছের ছাল, ছেঁড়া কাপড়, শন প্রভৃতির প্রক্রিয়াকরণ করে কাগজ প্রস্তুত হয়। এরপর চিন থেকে আরব, সেখান থেকে স্পেন ও পরবর্তীতে ইউরোপের নানান দেশে কাগজ তৈরির প্রযুক্তি পৌঁছে যায়।

(2) ব্লক মুদ্রণশিল্প: মার্কিন ঐতিহাসিক ইউজিন এফ রাইস তাঁর ‘The Foundations of Early Modern Europe, 1460-1559’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, পশ্চিম ইউরোপে মুদ্রণের সূচনার পশ্চাতে চিনের দুটি আবিষ্কার দায়ী ছিল- কাগজ এবং ব্লক মুদ্রণ (Block Printing) বা জাইলোগ্রাফি (Xylography)। অষ্টম শতকের প্রথম দিকে চিনে ব্লক মুদ্রণ প্রথম আবিষ্কৃত হয়। ইউজিন এফ রাইসের মতে, চিন থেকে মোঙ্গোলিয়া হয়ে মধ্য এশিয়াতে ব্লক মুদ্রণ প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ে। এই পদ্ধতি এরপর মধ্য এশিয়া থেকে আরও পশ্চিমে মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে সম্প্রসারিত হতে থাকে। ১২৫০-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চৈনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে এই মুদ্রণ প্রযুক্তি ইউরোপে আসে। কাঠের ফলকে হরফ খোদাই করে পুথি ছাপানো এবং ছবি দেওয়া খেলার তাস বানানো-এই দুটিই সেই সময় পশ্চিমী দুনিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

(3) প্রাথমিক মুদ্রণ পদ্ধতির মাধ্যমে মুদ্রিত পুস্তক: চিনে মুদ্রণ প্রযুক্তির উদ্ভাবনের যুগে ভারতবর্ষ থেকে এসময় অনেকগুলি ছাপানোর যোগ্য অমূল্য বৌদ্ধ পাণ্ডুলিপি চিনে সরবরাহ করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে চিনে তাং বংশের (Tang Dynasty) রাজত্বকালে মুদ্রিত বৌদ্ধ ধরণী সূত্র নামক সূত্রটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি জাইলোগ্রাফি পদ্ধতিতে মুদ্রিত পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থটি হল চিনের হীরক সূত্র (Diamond Sutra, ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ)। বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গ্রন্থটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। অবশ্য কেবল বৌদ্ধ ধর্মবিষয়ক পুথিই নয়, মুদ্রণের গোড়ার দিকে চিনে সংবাদপত্র, ক্যালেন্ডার, মানচিত্রও ছাপানো হত।

(4) হরফ-মুদ্রণ: ব্লক মুদ্রণের মতো হরফ (টাইপ)-মুদ্রণের আবিষ্কার ও ব্যবহারেও চিন অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। মার্কিন পণ্ডিত টি এফ কার্টার (Thomas Francis Carter) তাঁর ‘The Invention of Printing in China and its Spread Westward’ নামক গ্রন্থে জনৈক পি শেঙ (Pi Sheng) বা বি শেঙ (Bi Sheng) কর্তৃক একাদশ শতকে মাটির হরফ তৈরি করে মুদ্রণ পদ্ধতি আবিষ্কার করার কথা বলেন। পি শেঙ-কেই প্রথম চলমান হরফ প্রযুক্তি (আনুমানিক ১০৩৯-১০৪৮ খ্রি.) আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। পি শেঙ-এর প্রায় সমসাময়িক সেন কুয়া / কুয়ো (Shen Kuo)-এর বিবরণীতে হরফ-মুদ্রণ আবিষ্কার ও এর পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়।

(5) মাটি, কাঠ ও ধাতুর হরফের ব্যবহার: পি শেঙ মাটির হরফের পাশাপাশি কাঠের হরফও ব্যবহার করেছিলেন। যদিও কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে তিনি পুনরায় পোড়ামাটির হরফই ব্যবহার করতে থাকেন। এরপর পি শেঙ পরবর্তী জনৈক অজ্ঞাতনামা মুদ্রাকর ধাতুর হরফ প্রচলনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তবে চৈনিক বর্ণমালার সংখ্যাধিক্যের কারণে চলন্ত হরফের সাহায্যে মুদ্রণকার্য চিনে প্রথম চালু করা সম্ভপর হয়নি। অবশ্য চতুর্দশ শতকে অপর একজন চিনা মুদ্রাকর ও কৃষিবিদ্যায় পারদর্শী ওয়াং চেন (Wang Zhen) চলন্ত হরফ পুনরাবিষ্কার করেছিলেন। 

(6) আনুষঙ্গিক প্রযুক্তি: চিনে মুদ্রণের ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক উপকরণগুলির প্রযুক্তিতেও এসেছিল উন্নয়ন। মুদ্রণের জন্য ব্যবহার্য কাঠের ব্লকটি শক্তভাবে টেবিলে স্থাপন করে ব্লকের বর্ণমালায় কালি লেপন করা হত। এই লেপনের কাজটি করতে ব্যবহার করা হত ঘোড়ার লোম দিয়ে তৈরি ব্রাশ। এরপর ব্লকে মুদ্রণযোগ্য কাগজটিকে রাখা হত। মূলত একটি কাগজের এক পিঠেই মুদ্রণের কাজটি চলত। নমুনা কপি ছাপার ক্ষেত্রে লাল বা নীল রঞ্জক ব্যবহৃত হলেও ব্যাবসায়িক উৎপাদনে কালো কালিকেই প্রাধান্য দেওয়া হত।

(7) নোট মুদ্রণ: চিনদেশে সম্ভবত নবম শতকের প্রথমভাগে (৮০৭ খ্রি.) মুদ্রার পরিবর্তে নোটের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। মূলত ধাতুনির্মিত হরফ বা টাইপ থেকে এই জাতীয় নোটগুলি মুদ্রিত হত। মার্কোপোলো, পেগোলেত্তি (Pegolotti), ইবন বতুতা প্রমুখের রচনায় চৈনিক নোটের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে।

মূল্যায়ন

পরিশেষে বলা যায় যে, মুদ্রণ বা ছাপাখানার প্রযুক্তির উদ্ভাবনকে যদি আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, তাহলে সেই আধুনিকতার পথপ্রদর্শকরূপে চিনকেই উক্ত মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে মুদ্রণশিল্পের প্রসার ঘটেছিল ইউরোপে, চিনে নয়। তাই সেইদিক থেকে বিচার করলে জার্মানি তথা ইউরোপকেই আধুনিক মুদ্রণের মূল কারিগর বলা যুক্তিসংগত।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment