মুদ্রণবিপ্লবের ফলাফল বা গুরুত্ব আলোচনা করো

মুদ্রণশিল্পের উদ্ভাবন ও বিকাশের গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। The New Cambridge Modern History-তে বলা হয়েছে যে, মুদ্রণ মানুষের চিন্তার জগতকে উন্মোচিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। বস্তুতপক্ষে, মানুষের জীবন, সমাজ, সংস্কৃতির রূপান্তরের কাজে মুদ্রণশিল্পের অবদান ব্যাপক ও বহমান।
মুদ্রণবিপ্লবের ফলাফল বা গুরুত্ব
(1) চেতন্যের বিকাশ: মুদ্রিত পুস্তকের মাধ্যমেই দর্শনতত্ত্ব, রাষ্ট্রচেতনা, মানবিকতার আদর্শ, স্বাধিকারবোধ সম্পর্কিত মনীষীদের চিন্তাভাবনা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বস্তুতপক্ষে, মুদ্রণ প্রযুক্তি ও ছাপাখানাই পুস্তক পাঠের সুযোগকে সর্বস্তরে পৌঁছে দিয়েছে। ফলে মানুষের চৈতন্য বিকাশের সম্ভাবনা হয়েছে সুদৃঢ়।
(2) ক্রমবর্ধমান বইয়ের চাহিদা পূরণ: ইউরোপে ১৩০০-১৫০০ খ্রিস্টাব্দ-এই পর্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সংখ্যা ২০ থেকে বেড়ে হয়েছিল ৭০টি, একইসঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছিল কলেজের সংখ্যাও। এর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ের বইয়ের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। হাতে লেখা বই এই ক্রমবর্ধমান বইয়ের চাহিদা পূরণ করতে পারেনি- তা পেরেছিল ছাপা বই। তবে এক্ষেত্রে ছাপা বইকেও বহু বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও মেইনজ থেকে ছাপাখানা স্ট্রাসবার্গ, কোলন, অগসবার্গ, লাইপজিগ ইত্যাদি শহরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ছাপা হতে থাকে প্রায় ৪০ হাজার বই, নিঃসন্দেহে যা ছিল একটি বৈপ্লবিক ঘটনা।
(3) ল্যাটিন ভাষার একাধিপত্যের অবসান: মধ্যযুগে সাহিত্যচর্চার প্রধান মাধ্যম ছিল ল্যাটিন ভাষা। মুদ্রণশিল্পের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি, স্পেনীয়, ফরাসি, জার্মানি-সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় গ্রন্থ মুদ্রণ ও তাদের জনপ্রিয়তা আঞ্চলিক ভাষাসমূহের প্রসার ঘটায়। দেশে দেশে এসময় মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনার কাজও শুরু হয়ে যায়। এভাবে ইউরোপের শিক্ষা-সংস্কৃতির জগতে ল্যাটিন ভাষার একাধিপত্য অনেকাংশেই বিনষ্ট হয়ে যায়।
(4) ধর্মসংস্কার আন্দোলনের বিস্তার: মুদ্রণ ও ছাপাখানা সংস্কারমূলক ভাবধারা প্রচারের কাজ সহজতর করে দেয়। অসংখ্য মুদ্রিত পুস্তকের মাধ্যমে ইরাসমাস, মার্টিন লুথার, ক্যালভিন প্রমুখের চিন্তাধারা দ্রুত বহুসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ছাপাখানাই ছিল যাজক বিরোধিতা প্রচারের প্রধান হাতিয়ার। তাছাড়া মুদ্রণবিপ্লবের ফলস্বরূপ স্থানীয় ভাষায় বাইবেল ছাপা হলে সাধারণ মানুষ পোপতন্ত্রের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়। সংস্কার ভাবধারার যৌক্তিকতায় আকৃষ্ট হয়ে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সংস্কারকদের সমর্থন জানাতে এগিয়ে এলে ধর্মসংস্কার আন্দোলন গতি পায়।
(5) বৌদ্ধিক একাকিত্বের অবসান: ইউজিন এফ রাইস-এর মতে, ছাপাখানা আবিষ্কারের আগে রাষ্ট্র, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে চিন্তাবিদরা এককভাবে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গবেষণা ও মননশীল চর্চায় নিয়োজিত থাকতেন। ছাপাখানা আবিষ্কৃত হলে একের চিন্তাচেতনা পুস্তকের মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছে যায়। এইভাবে পারস্পরিক ভাববিনিময় ঘটে এবং ভাবনাচিন্তা একাকিত্ব মুক্ত হয়।
(6) স্মৃতির মুক্তি: মুদ্রিত পুস্তক প্রকাশের আগে মানুষের লব্ধ জ্ঞান বা শিক্ষা স্মৃতির কোঠায় সংরক্ষিত থাকত। কালপরম্পরায় গুরুর স্মৃতি থেকে শিষ্য বা শিক্ষার্থীর স্মৃতিতে জ্ঞান স্থানান্তরিত হত। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হলে মুদ্রিত পুস্তকের পৃষ্ঠায় আরব্ধ জ্ঞান সংরক্ষিত রাখা এবং বৃহত্তর সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। তাই বলা হয় ‘Printing freed the memory.’
(7) বিজ্ঞানচর্চা ও ভৌগোলিক আবিষ্কার: বিজ্ঞানচর্চা ও ভৌগোলিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে মুদ্রণবিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ক্রমেই বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার এবং ভৌগোলিক আবিষ্কারের কাহিনি পুস্তকাদির মাধ্যমে জনসমাজে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় কোপারনিকাস ও ভেসালিয়াসের গ্রন্থ। শুধু তাই নয়, মুদ্রণযন্ত্রের দৌলতেই কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, টাইকো ব্রাহে, কেপলার প্রমুখের রচনাসমূহ পৌঁছে যায় মানুষের কাছে। ইউরোপ তথা সমগ্র বিশ্ববাসী তাঁদের আবিষ্কারের কথা জানতে পারে। ফলস্বরূপ, গতানুগতিক ধর্মীয় চিন্তাভাবনার বদলে মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী হয়ে ওঠে। আবার এই মুদ্রণবিপ্লবের সূত্রেই আমেরিকা ও এশিয়া আবিষ্কারের কথা ইউরোপের মানুষ জানতে পারে। মুদ্রিত মানচিত্রের ব্যবহার করতে শেখে তারা। আবিষ্কার হয় গ্লোবের।
(8) সাধারণ শিক্ষার প্রসার: সুস্থ সমাজ ও সবল রাষ্ট্র গড়ার কাজে সাধারণ শিক্ষার প্রসার হল এক অপরিহার্য শর্ত, যা ছাপাখানার আবিষ্কার পূরণ করে। সহজলভ্য, সুদৃশ্য পুস্তকের পৃষ্ঠা থেকে সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন-সহ আধুনিক সমাজজীবনের অগ্রগতির শিক্ষা দ্রুত শহর থেকে গ্রামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়।
মূল্যায়ন
বহুমুখী ইতিবাচক ও গঠনমূলক প্রভাবের দ্বারা সমৃদ্ধ হলেও মুদ্রণ ও ছাপাখানার প্রথম পর্বের যাত্রাপথ খুব সুগম ছিল না। প্রথমদিকে মুদ্রিত পুস্তকের বিষয় ছিল মূলত ধর্মীয়। ধর্মপুস্তক, ধর্মবাণী, সাধুসন্তদের জীবনী ইত্যাদি ছিল পুস্তকের আলোচ্য বিষয়। পরবর্তী পর্বে ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রচলিত ধর্মের সমালোচনামূলক আলোচনা মুদ্রিত পুস্তকের বিষয়বস্তু হলে রক্ষণশীল সমাজপতি ও ধর্মগুরুদের কাছ থেকে প্রবল বাধা আসতে শুরু করে।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর