ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করো
অথবা, পঞ্চদশ শতক ও তার পরবর্তীকালে ইউরোপীয় দেশগুলির সামুদ্রিক অভিযান বা ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করো

পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতকের ভৌগোলিক অন্বেষণ এবং নতুন নতুন সমুদ্রপথ ও দেশ আবিষ্কারের ফলাফল ছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী।
ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফলসমূহ
(1) সুফল: ভৌগোলিক আবিষ্কারের সুফলগুলি হল নিম্নরূপ-
- ভৌগোলিক জ্ঞানবৃদ্ধি: ইউরোপীয় দেশগুলির নৌ-সামুদ্রিক বিস্তৃতি তথা অন্বেষণ ভৌগোলিক জ্ঞানের জগতে পরিবর্তন নিয়ে আসে। নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের ভূগোল এবং প্রাচীন ইতিহাস বিষয়ে মানুষের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করে। বিভিন্ন দেশের জলবায়ু, মানুষের আচার-আচরণ সম্পর্কে তথ্যাদি জানা যায়। এমনকি বিভিন্ন দেশের সুপ্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কেও মানুষ জানতে পারে। মানচিত্র অঙ্কনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। বলাবাহুল্য, নতুন ভৌগোলিক এবং প্রযুক্তিগত আবিষ্কারগুলি ষোড়শ শতকের ইউরোপীয় সাহিত্যকেও বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন নতুন ভূখণ্ডের আবিষ্কার ইউরোপীয়দের আরও উদ্যমী করে তুলে সম্পদ লাভ করার প্রেরণা জোগাতেও সহায়ক হয়েছিল।
- ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের গুরুত্ব হ্রাস: পঞ্চদশ শতকের গোড়া পর্যন্ত সময়কালে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলসমূহ। আটল্যান্টিক মহাসাগরের জলপথ ও উপকূলবর্তী নতুন নতুন দেশ আবিষ্কৃত হলে ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্য নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে।
- নতুন বাণিজ্যকেন্দ্রের উদ্ভব: ইতিপূর্বে ভেনিস, জেনোয়া, মার্সেই, বার্সেলোনা প্রভৃতি বন্দর ব্যস্ততম ও সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। সামুদ্রিক অভিযানের ফলে এই সকল বন্দরের গুরুত্ব শিথিল হয়ে যায়। পরিবর্তে আটল্যান্টিক উপকূলবর্তী বন্দরগুলি, যেমন- স্পেনের কাদিজ, ফ্রান্সের বর্দো, হল্যান্ডের আমস্টারডাম, অ্যান্টওয়ার্প, ইংল্যান্ডের লন্ডন, ব্রিস্টল প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে (ষোড়শ শতক)। এই পর্বে জলপথে পণ্য পরিবহণের উদ্দেশ্যে নৌ-নির্মাণ কেন্দ্র এবং বিভিন্ন বন্দরগুলিরও ব্যাপক প্রসার ঘটতে দেখা যায়।
- বাণিজ্যে নতুন গতি: ইতিপূর্বে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন চালু ছিল। নতুন মহাদেশ আবিষ্কৃত হলে ইউরোপীয় বাণিজ্যে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। এখন প্রাচ্যের দেশগুলির পাশাপাশি আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলির সঙ্গেও ইউরোপের সমৃদ্ধ বাণিজ্য শুরু হয়। প্রাচ্য থেকে ইউরোপে আমদানি হয় সুগন্ধি, মশলা, রেশম ইত্যাদি। আমেরিকা থেকে আসতে থাকে বিপুল সোনা-রুপো ইত্যাদি মূল্যবান ধাতু। অন্যদিকে আফ্রিকা থেকে আনা হয় অসংখ্য ক্রীতদাস। এদের শ্রম ও বিক্রয়লব্ধ অর্থ ইউরোপকে সমৃদ্ধ করে। বস্তুতপক্ষে, নতুন আবিষ্কৃত দেশসমূহের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূচনা ঘটলে তৈরি হয় বাণিজ্য বিপ্লবের প্রেক্ষাপট।
- নতুন সামাজিক শ্রেণির উত্থান: সামুদ্রিক অভিযান ও বাণিজ্য বৃদ্ধির সূত্রে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরাই বুর্জোয়া (Bourgeois) বা পেটি-বুর্জোয়া নামে অভিহিত হন। এই নব্য সামাজিক শ্রেণি শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রণী এবং গুরুত্বপূর্ণ বৃত্তিতে নিয়োজিত ছিলেন। এই কারণে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজের উপর এদের প্রভাব ছিল সর্বাধিক। ক্রমে সংস্কার বা পরিবর্তনের কাজে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করেন।
- বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিকাশ: সামুদ্রিক বিস্তৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাণিজ্যের যে বিস্তার ঘটে, তার ফলে নতুন নতুন একাধিক যৌথ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। লাভের আশায় ঝুঁকি নিয়ে যারা এই প্রতিষ্ঠানে অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা বেশ লাভবান হয়ে উঠতে থাকেন। কালক্রমে এই যৌথ বাণিজ্যিক সংস্থাগুলিই আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিকাশে সহায়ক হয়েছিল।
(2) কুফল: ভৌগোলিক আবিষ্কারের কুফলগুলি হল নিম্নরূপ-
- উপনিবেশ স্থাপন ও শোষণ: সামুদ্রিক অভিযান ও সেইসঙ্গে বাণিজ্যিক সূত্র ধরে বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশসমূহ আফ্রিকা, আমেরিকা এবং প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনে উদ্যোগী হয়ে উঠতে থাকে। পোর্তুগাল, স্পেন এবং পরবর্তীতে ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, ফ্রান্স পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়। শুধু তাই নয়, নতুন আবিষ্কৃত দেশগুলিতে বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতিদের প্রবেশ ও বসতি বিস্তারের দরুন উক্ত ভূখণ্ডগুলির আর্থসামাজিক জীবনেও ঘটে যায় পরিবর্তন। নব আবিষ্কৃত দেশগুলিতে উপনিবেশ গড়ে তোলার পাশাপাশি সেখানকার স্থানীয় মানুষদের উপর অত্যাচার ও শোষণ নির্বিচারে চলতেই থাকে। অনেকক্ষেত্রেই স্থানীয় সংস্কৃতি, সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়।
- প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতির ধ্বংসসাধন: ইউরোপীয় দেশগুলি নতুন নতুন অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে স্থানীয় সংস্কৃতি, ধর্ম, জীবনধারাকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে তোলে। স্পেনীয় কনকুইসটেডর বা পেশাদার বিজয়ীরা কোর্টেসের নেতৃত্বে মেক্সিকো, পিজারোর নেতৃত্বে পেরু দখল করে। তারা সেখানে নির্বিচারে হত্যা ও লুণ্ঠন চালায়। অ্যাজটেক, মায়া, ইনকার মতো সপ্রাচীন সভ্যতাগুলি ধ্বংসপাপ হয়।
- ক্রীতদাস ব্যাবসা: ক্রীতদাস ব্যাবসার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ছিল ভৌগোলিক আবিষ্কারের অন্যতম একটি কুফল। জানা যায় যে, পোর্তুগালেই প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৮০০ জন আফ্রিকার ক্রীতদাস আমদানি করা হত। এদের মধ্যে অনেককেই আনা হত পোর্তুগালের রাজধানী লিসবনে। লাভজনক হওয়ায় স্পেনীয়রাও দাস আমদানি-রফতানির ব্যাবসা করত। পরবর্তীতে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলিও দাসব্যাবসায় মেতে ওঠে, যা চরম নৃশংসতার সাক্ষ্য বহন করে।
মূল্যায়ন
নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বলা যায় যে, নৌ-সামুদ্রিক অভিযান ও ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে সমগ্র বিশ্বেই এক পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। সর্বোপরি বলা যায়, ভৌগোলিক আবিষ্কার এক নবদিগন্তের সূচনা করে। সৃষ্টি করে এক মিশ্র সংস্কৃতির। ক্রমশ বিভিন্ন উপনিবেশে ইউরোপের সংস্কৃতি এবং খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটানো সকল ইউরোপীয় দেশসমূহের বিশেষ লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর