বিকাশের পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক শর্তগুলি আলোচনা করো

পরিবেশগত শর্ত
পরিবেশ হল আমাদের চারিদিকে যেসব বস্তু বা ঘটনা রয়েছে, সবকিছুর সমষ্টি। বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবেশগত শর্তের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল- আমাদের চারপাশে যেসব ভৌত, – রাসায়নিক ও জৈবিক উপাদান রয়েছে, যা আমাদের দেহ, মন, বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের এবং বাস্তুতন্ত্রের উপর ক্রিয়াশীল যা বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা যা ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। বিভিন্ন ধরনের ভাষাগত উপাদান মানুষের বিকাশে প্রভাব বিস্তার করে। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে বিভিন্ন ধরনের নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যা পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত সেগুলিও বিকাশে প্রভাব বিস্তার করে। দূষণজনিত সমস্যা সমস্ত ধরনের বিকাশ প্রক্রিয়ার অন্তরায়। পরিবেশ সুতরাং পরিবেশ শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশের সহায়ক। এ ছাড়াও পরিবেশগত শর্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
(1) পারিবারিক পরিবেশ: পরিবারের বাবা ও মা-এর সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক, বাবা-মায়ের সন্তানের প্রতি ভালোবাসা অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের শিশুকে স্নেহ ও ভালোবাসা শিশু বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। বাবা-মা- আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সুস্থ সম্পর্ক থাকলে শিশু সহজেই সমাজের অন্যান্য মানুষজনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে শেখে। ফলে শিশুর সামাজিকীকরণ সহজতর হয়। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের ভালো অভ্যাস জন্মায় এবং বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা গড়ে ওঠে যা পরবর্তী জীবনে কার্যকরী হয়। শিশুর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের বিভিন্ন ভালো বা মন্দ বিষয়গুলি দ্যাখে এবং তাদের মধ্যে ভালো ও মন্দ সম্বন্ধে ধারণা জন্মায়। সুতরাং বাবা-মা-এর জীবনধারা, শিশুদের যত্ন করার কৌশল তাদের বিকাশকে প্রভাবিত করে। যেসব বাবা-মায়েরা শিশুর সঙ্গে যথাযথ সময় কাটান তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা, সমস্যাসমাধান কীভাবে করতে হয় তা বোঝান, তাদের বিভিন্ন সমস্যাসমাধানে উৎসাহিত করেন। সেক্ষেত্রে শিশুরা তাদের স্বাধীন মতামত জানাতে পারে। এইসব কার্যগুলি শিশুর মধ্যে ধনাত্মক আচরণের সহায়ক, যা শিশুদের বিভিন্ন ধরনের বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
(2) সামাজিক পরিবেশ : শিশুর বিদ্যালয়, সামাজিক পরিসেবা, সুযোগসুবিধা ও স্বাস্থ্য পরিসেবা ইত্যাদি সামাজিক পরিবেশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
- বিদ্যালয়ের পরিবেশ: শিশুরা দিনের অধিক সময় বিদ্যালয়ে অতিবাহিত করে। তাই বিদ্যালয়ের পরিবেশ শিশুর উপর যথেষ্ট পরিমাণ প্রভাব বিস্তার করে। যথাযথ বিদ্যালয় পরিবেশের জন্য প্রয়োজন-
- বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো : বিদ্যালয় পরিকাঠামো, বিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের সুযোগসুবিধা দান করে। সুযোগসুবিধা বলতে উপযুক্ত বসার ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় খেলাধুলার ব্যবস্থা, পড়াশোনার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদিকে বোঝায়।
- উপযুক্ত শিক্ষক: শিক্ষক দ্বারা শিশুরা বেশি পরিমাণে অনুপ্রাণিত হয়। শিক্ষকদের আচার-আচরণ, সহযোগিতার মনোভাব, পাঠদানের দক্ষতা, শিশুদের প্রতি স্নেহশীল দৃষ্টিভঙ্গি, নিরপেক্ষতা, সততা, অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য গুণাবলি, সমস্যাসমাধানের দক্ষতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলি শিশুর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- উপযুক্ত সহপাঠী: একটি শিশুকে সহপাঠীদের সঙ্গে অধিক সময় কাটাতে হয়। তাই সহপাঠীদের কাছ থেকে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন বিকাশ হয়। শিক্ষা পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষক নজর রাখবেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেসব বিভিন্ন ধরনের সমস্যামূলক আচরণ রয়েছে, তাদেরকে অনুসন্ধান করে তাদের মধ্যেকার সমস্যা দূরীকরণের চেষ্টা করা দরকার। এইভাবে শ্রেণি তথা বিদ্যালয়ের পরিবেশকে উন্নত করা দরকার যাতে প্রতিটি শ্রেণিতে শিশুরা উপযুক্ত সহপাঠী পেতে পারে।
- উপযুক্ত শিক্ষাকর্মী: শিক্ষাকর্মীদের ব্যবহার, আচার-আচরণ এমন হবে যাতে শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যালয় সম্পর্কে ধনাত্মক মনোভাব গড়ে ওঠে।
- উপযুক্ত প্রশাসন: উপযুক্ত প্রশাসন বিদ্যালয় পরিবেশকে শৃঙ্খলাযুক্ত করে রাখতে সাহায্য করে, ফলে শিক্ষার্থীদের শিখন যথাযথ হতে পারে।
- অভিভাবক: সহযোগিতা মনোভাবাপন্ন অভিভাবক শিক্ষার্থীদের বিকাশের জন্য বিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। বিদ্যালয়ে শিক্ষক- অভিভাবক সমিতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধার ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য প্রশাসনকে জানাতে পারেন ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেন। এইভাবে অভিভাবক বিদ্যালয় পরিবেশকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করেন যা শিক্ষার্থীদের বিকাশের সহায়ক। এ ছাড়াও বিদ্যালয়ে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা শিক্ষার্থীদের বিকাশের সহায়ক।
- সামাজিক পরিবেশ: বিভিন্ন ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন- ক্লাব, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে থাকে, যেগুলিতে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারে। এইভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক বিকাশ ঘটানো সম্ভব। তবে শহরাঞ্চলে এই ধরনের পরিবেশ গ্রামাঞ্চলের পরিবেশের তুলনায় অনেক বেশি।
- বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা: উন্নত সামাজিক ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক বিকাশ, মানসিক বিকাশ ও সামাজিক বিকাশে সাহায্য করে।
- স্বাস্থ্য পরিসেবা: বিকাশের জন্য স্বাস্থ্য পরিসেবা অতি গুরুত্বপূর্ণ। বিকাশকালীন অবস্থায় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের অসুখের সম্মুখীন হতে পারে, যেগুলি বিকাশকে ব্যাহত করে। তবে স্বাস্থ্য পরিসেবা যথাযথ হলে শিক্ষার্থীকে সহজে সুস্থ করে তোলা যায়। ফলে বিকাশ তেমন বিঘ্নিত হতে পারে না।
সাংস্কৃতিক শর্ত
বিভিন্ন বিশ্বাস, মূল্যবোধ, মনোভাব, আচার- আচরণ ইত্যাদি এক প্রজন্ম থেকে অপর প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। আবার একই সমাজের বিভিন্ন জাতি, ধর্মের মানুষ বাস করে, তাদের সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। কোনো শিশুর বিকাশ পরিবারের সংস্কৃতি ও সমাজের সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়। একজন শিশুর বিভিন্ন ধরনের অভ্যাস, মনোভাব, দক্ষতা ও বিচারকরণ ক্ষমতা ইত্যাদি জন্মায় সামাজিকীকরণের মাধ্যমে। সুতরাং সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক শর্ত অতি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- আমাদের বাঙালিদের সংস্কার হল অপর কোনো ব্যক্তিকে নমস্কার বিনিময় বা বড়োদের প্রণাম করা, কিন্তু পশ্চিমী সংস্কার হল চুম্বন বা হ্যান্ডসেক ইত্যাদি।