বিকাশের জৈবিক ও মনস্তাত্ত্বিক শর্তসমূহ লেখো

বিকাশের শর্তসমূহ
একজন শিশুর জন্মাবস্থা থেকেই নানাধরনের বিকাশ ঘটতে শুরু হয়। এই প্রত্যেক ধরনের বিকাশ কোনো- না-কোনো অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে। এই অবস্থাই হল বিকাশের শর্ত। শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ শর্তগুলি হল- জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক, পরিবেশগত, সাংস্কৃতিক, আর্থ সামাজিক, ভৌগোলিক, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ।
(1) জৈবিক শর্ত: শিশুর বিকাশ বলতে বোঝায় দৈহিক, ভাষাগত, চিন্তাগত, প্রাক্ষোভিক ইত্যাদি বিকাশগুলিকে যা ক্রমান্বয়ে শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে বয়ঃসন্ধিক্ষণের শুরু পর্যন্ত ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের জৈবিক ও পরিবেশগত শর্ত রয়েছে। এই প্রভাবগুলি শিশুর বিকাশ ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এগুলি হল যথাক্রমে-
- বংশগতি: বাবা, মা-এর কাছ থেকে যেসব বৈশিষ্ট্যগুলি শিশুদের মধ্যে প্রবাহিত হয়, তাই-ই হল বংশগতি। বংশগতি শিশুর উচ্চতা, ওজন, দৈহিক গঠন, চোখের রঙ, চুলের গঠন ইত্যাদির উপর প্রভাব বিস্তার করে। এ ছাড়া বংশগতি বুদ্ধি, প্রবণতামূলক দক্ষতার উপর প্রভাব ফেলে। অনেক রোগ যেমন হৃদযন্ত্রঘটিত রোগ, ডায়াবেটিক, স্থূলতা, রক্তচাপের অস্থিরতা ইত্যাদি হল বংশগতিজনিত কারণ।
- লিঙ্গ: বিকাশের শর্ত হিসেবে শিশুর লিঙ্গ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে বিকাশগত পার্থক্য ঘটে। যেমন- বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে দৈহিক বিকাশের পরিবর্তন ঘটে যা সর্বজনীন। কিন্তু মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের তুলনায় দ্রুত পরিণমন ঘটে। আবার একই বয়সে ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় বেশি শক্তিশালী হয়। সুতরাং বিকাশের ক্ষেত্রে লিঙ্গগত পার্থক্য দেখা যায়।
- হরমোন: মানবদেহের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থি থাকে, যেগুলি থেকে হরমোন নিঃসৃত হয়, যা দৈহিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। হরমোন নিঃসরণ যথাযথ হলে তা শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে। কোনো কারণে হরমোন নিঃসরণে অসাম্য দেখা দিলে বৃদ্ধি ও বিকাশ উভয়ই ব্যাহত হয়।
- গর্ভাবস্থা: গর্ভাবস্থায় শিশু যে পরিবেশে থাকে, সেখানে যদি কোনোভাবে সমস্যা সৃষ্টি হয়, তবে জিনের বহিঃপ্রকাশে সমস্যা সৃষ্টি হয়।
- মস্তিষ্ক রসায়ন: শিশুর মস্তিষ্কের যথাযথ বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটবে যদি গর্ভাবস্থায় মনের প্রতি যথাযথভাবে যত্ন নেওয়া হয়। যেমন- পুষ্টির প্রতি নজরদান, মানসিক চাপ না দেওয়া ইত্যাদি।
(2) মনস্তাত্ত্বিক শর্ত: যেসব মনস্তাত্ত্বিক শর্ত বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সেগুলি হল –
- প্রজ্ঞামূলক বিকাশ: প্রজ্ঞামূলক বিকাশের অর্থ হল- একটিশিশুর বৌদ্ধিক বিকাশ যার অন্তর্ভুক্ত হল শিশুর চিন্তার ক্ষমতা, কার্যকারণ বিচার করার ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, বোঝার ক্ষমতা, বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা অর্জনের ক্ষমতা যেমন- স্মৃতি, চিন্তন, ভাষার বিকাশ ইত্যাদি। আবার যেসব কারণগুলি বৌদ্ধিক ক্ষমতা ও শিখনে অসুবিধা সৃষ্টি করে সেগুলিও প্রজ্ঞামূলক বিকাশের মধ্যে পড়ে। এগুলির বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।
- প্রাক্ষোভিক বিকাশ: প্রাক্ষোভিক বিকাশ বলতে বোঝায় কোনোকিছু বস্তু বা ঘটনা সম্বন্ধে শিখনের প্রক্রিয়া এবং শিখনের ফলে যে অনুভূতি সৃষ্টি হয় যার মাধ্যমে ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ঘটে, যেমন- বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বোন, প্রতিবেশী ও সহপাঠীদের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক যা প্রাক্ষোভিক বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ট্রমা, অবহেলা, উদ্বেগ ইত্যাদি প্রাক্ষোভিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যার ফলে মানসিক চাপ, উদ্বিগ্নতার সৃষ্টি হয়।
- ব্যক্তিসত্তার সংলক্ষণ: ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তার বৈশিষ্ট্যগুলি বিকাশের ক্ষেত্রে সারাজীবনব্যাপী ক্রিয়াশীল। যেমন- ব্যক্তির আচরণ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, প্রেষণা, অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া, ইত্যাদি যা ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশের ক্ষেত্রে একটি সার্বিক রূপ দেয়। কিছু কিছু ব্যক্তিসত্তার বৈশিষ্ট্যে বিভিন্ন ধরনের আচরণ বা বিভিন্ন অবস্থা ব্যক্তির মধ্যে সৃষ্টি করতে পারে। যেমন- বহির্মুখী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিরা অন্তর্মুখী ব্যক্তির তুলনায় সামাজিক অবস্থাকে অধিক বুঝতে পারে। তাই বিভিন্ন ব্যক্তিসত্তার বৈশিষ্ট্য বিকাশে সাহায্য করে।
- আত্মশ্রদ্ধা ও আত্মবিকাশ: আত্মশ্রদ্ধা বলতে বোঝায় একজন ব্যক্তি তার নিজস্ব মূল্যবোধ ও নিজস্ব দক্ষতা সম্বন্ধে কতটা সচেতন। আত্মশ্রদ্ধা সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। যেমন- উচ্চ আত্মশ্রদ্ধা সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাফল্য, বিভিন্ন কাজে সাফল্য এবং সার্বিক মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশের ক্ষেত্রে কার্যকরী। নিম্নমানের আত্মশ্রদ্ধা মানসিক স্বাস্থ্যঘটিত বিভিন্ন সমস্যা, সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে। আবার আত্মবিকাশ হল নিজেকে সঠিকভাবে প্রকাশ করা। আত্মবিকাশ বিভিন্ন ধরনের বিকাশে সাহায্য করে।
- মানসিক স্বাস্থ্যঘটিত সমস্যা: মানসিক স্বাস্থ্যঘটিত সমস্যা যেমন- দুশ্চিন্তা, মানসিক অবসাদ, খাওয়ায় অনিচ্ছা ইত্যাদি বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায়। মানসিক স্বাস্থ্যহানি, পড়াশোনায় অবনতি, নেতিবাচক সামাজিক সম্পর্ক, দৈহিক স্বাস্থ্যহানি ইত্যাদি ঘটাতে পারে। এইসমস্ত মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে তার জন্য যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে বিভিন্ন বিকাশকে যথাযথ করা সম্ভব।
- ধৈর্য: ধৈর্য হল কোনো সমস্যামূলক অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষমতা। যেসব ব্যক্তি অধিক ধৈর্যশীল তারা সহজেই বিভিন্ন বাধাকে অতিক্রম করতে পারে। ধৈর্য সর্বাঙ্গীণ বিকাশে সাহায্যকারী। বিভিন্ন ধরনের শর্ত যেমন- বিভিন্ন বিষয়ে ধনাত্মক অনুভূতি, হিতকর প্রক্ষোভ, ভালো সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা ইত্যাদি ধৈর্য বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। সুতরাং উপরোক্ত মনস্তাত্ত্বিক শর্তগুলি পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে যে মানসিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবার এই শর্তগুলি বিভিন্ন ধরনের জৈবিক, সামাজিক ও পরিবেশমূলক শর্তের উপরও নির্ভরশীল।
- প্রসবকালীন অবস্থা: গবেষণা দ্বারা। প্রমাণিত হয়েছে যদি শিশু স্বাভাবিকভাবে জন্মায়, তবে শিশুর সঞ্চালনগত বিকাশ সিজারের মাধ্যমে হওয়া শিশুর তুলনায় অনেক ভালো হবে।
- পুষ্টি: শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশের ক্ষেত্রে সুষম খাদ্যের প্রয়োজন অর্থাৎ যথাযথ পরিমাণ প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ, কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট থাকা। উচিত যা শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশে সাহায্য করে।
ভৌগোলিক শর্ত: অঞ্চলভেদে শিশুদের দৈহিক বিকাশের ক্ষেত্রেও পার্থক্য লক্ষ করা যায়, এক্ষেত্রে ভৌগোলিক পরিবেশ অত্যন্ত কার্যকরী। যেমন- একই দিনে একই সময়ে দুটি স্বাভাবিক শিশু একজন কলকাতায় ও একজন টোকিওতে জন্মগ্রহণ করল। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে চেহারা ও গঠনগত দিকে পার্থক্য দেখা যাবে। এক্ষেত্রে ভৌগোলিক অঞ্চল এই শিশু দুটির দৈহিক বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।