বই কেনা প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর Class 11 Second Semester WBCHSE

‘সে একই সময়ে সমস্ত পৃথিবীটা দেখতে পায়।’-প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বক্তার এমন উক্তির তাৎপর্য লেখো
প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটি সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘বই কেনা’ রচনা থেকে নেওয়া হয়েছে। মাছি ধরা যে ভয়ানক কঠিন কাজ, সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়েই লেখক তথা বক্তা উক্ত কথাটি বলেছেন।
আমাদের মনে হয় যে, মাছির মাথার সামনের দিকেই চোখ আছে, তাই তাকে সহজেই ধরা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে তা নয়, মাছির রয়েছে পুঞ্জাক্ষি অর্থাৎ সমস্ত মাথাজুড়েই মাছির অসংখ্য চোখ রয়েছে। আমরা তা খেয়াল করি না। তাই মাছিরা তার চতুর্দিকের সবটা একসঙ্গে দেখতে পায়। ফলে কেউ যদি পিছন থেকেও মাছিকে ধরতে চায়, মাছিরা তাও দেখে ফেলে সতর্ক হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ মাছির মাথায় চক্রাকারে চোখ বসানো আছে বলেই তারা একই সময়ে সমস্ত পৃথিবীটাকে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। প্রশ্নোদ্ভূত উক্তির মাধ্যমে বক্তা সে-কথাই বলতে চেয়েছেন।
আনাতোল ফাঁস-এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে তাঁর দুঃখের কারণ লেখো
উনবিংশ শতকের শেষার্ধ থেকে বিংশ শতকের প্রথম দুই শতক পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বের একজন জনপ্রিয় কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ছিলেন আনাতোল ফ্রাঁস। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল ফ্রান্সে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর সাহিত্যজীবনের সূচনা ঘটেছিল একজন কবি হিসেবে। তাঁর পিতার বইয়ের দোকানে ফ্রান্সের বহু খ্যাতিমান লেখক ও গবেষকদের যাতায়াত ছিল, ফলে যৌবনেই তিনি সাহিত্যসেবার পরিমণ্ডল পেয়েছেন। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে আনাতোল ফ্রাঁসকে ফরাসি সিনেটের গ্রন্থাগারিক নিযুক্ত করা হয়েছিল। ফলে বই পড়ার আগ্রহ এখান থেকেই বৃদ্ধি পেয়েছিল। উদার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, বাস্তববাদী মনোভাব ও ব্যঙ্গ ছিল তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হল-‘দেবতারা তৃষ্ণার্ত’, ‘নীলার আংটি’, ‘সোনালি কবিতা’, ‘ক্ষুধাতুর মুমূর্ষু বেড়াল’ ইত্যাদি। চতুর্দিকটা একসঙ্গে দেখার জন্য মাছির সমস্ত মাথাজুড়ে যেমন অসংখ্য চোখ রয়েছে, তেমনই তাঁর মাথার চতুর্দিকে চোখ বসানো নেই বলে সুন্দরী ধরণির সম্পূর্ণ সৌন্দর্য তিনি একসঙ্গে দেখতে পান না-এটাই আনাতোল ফ্রাঁস-এর দুঃখের কারণ।
‘এইখানেই ফ্রাঁসের সঙ্গে সাধারণ লোকের তফাৎ।’ -উক্তিটির মাধ্যমে বক্তা কী বোঝাতে চেয়েছেন বুঝিয়ে দাও
লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী ‘বই কেনা’ রচনায় প্রশ্নে উদ্ধৃত উক্তিটি করেছেন। মাছিকে কেন ধরা যায় না, সেই প্রসঙ্গে কথা শুরু হয়েছিল। জানা গেল মাছির মাথার চতুর্দিকে অসংখ্য চোখ থাকাই তার কারণ। সেই সূত্রেই ফরাসি সাহিত্যিক ফাঁস রসিকতার সঙ্গে বলেন, তাঁর যদি মাথার চতুর্দিকে চোখ থাকত তবে এই সুন্দরী পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য তিনি একবারেই দেখতে সক্ষম হতেন। তবে এটা তো শুধু ফ্রাঁস-এর কথা নয়, প্রায় সকলেরই কথা। তবে ফ্রাঁস-এর সঙ্গে অন্যদের তফাৎ আছে। অন্যরা কেবল চর্মচোখের কথাই চিন্তা করেন। চর্মচক্ষু ছাড়াও যে মর্মচক্ষু থাকতে পারে তা সকলে ভাবেন না। ফ্রাঁস-এর মতে চোখের সংখ্যা বাড়ানো-কমানো তো সম্পূর্ণ নিজের হাতেই থাকে। যতই আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করতে থাকব ততই আমাদের মনের চোখের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকবে আর তখনই সমগ্র পৃথিবীর বহু ঘটনাই আমাদের অন্তরের চোখে আমরা দর্শন করে মুগ্ধ হব। সাধারণ মানুষ এ কথা ভাবেন না বলেই বহু চোখ নেই বলে আপসোস করেন, যা ফ্রাঁস করেননি। প্রশ্নোদ্ভূত উদ্ধৃতির মাধ্যমে লেখক এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন।
‘ভবযন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার ততই বেশি হয়’- উক্তিটির তাৎপর্য লেখো।
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’ রচনা থেকে প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি নেওয়া হয়েছে। মনের চোখ বাড়ানোর পন্থা ও প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে বারট্রান্ড রাসেল প্রশ্নে উক্ত মন্তব্যটি করেছেন।
মনের চোখ ফোটাতে পারলে আমরা এই পৃথিবীর অনেক অজানা তথ্যের সন্ধান পাব, তাতে আমাদের জ্ঞানের পরিধিও বৃদ্ধি পাবে। মাত্র দুটি চর্মচক্ষের কারণে বহু বিষয় আমাদের অজানা-অদেখা থেকে যায়। এই অভাব ঘোচাতে পারে কেবল মনের চোখ। প্রখ্যাত দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল এই প্রসঙ্গে বলেছেন-“সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভিতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভিতর ডুব দেওয়া।” এটা বই কেনা তথা বই পড়ার মাধ্যমে হওয়া সম্ভব। যে ব্যক্তি যত বেশি মনের চোখের বিচরণক্ষেত্র বৃদ্ধি করতে পারবেন, তিনি সেই বিচরণক্ষেত্রে অর্থাৎ সেই ভুবনে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে সক্ষম হবেন এবং এভাবেই তিনি সাংসারিক দুঃখ-তাপ থেকে মুক্ত থাকবেন। প্রশ্নে উদ্ধৃত উক্তিটির মাধ্যমে বক্তা একথাই বোঝাতে চেয়েছেন।
‘তাই ভেবেই হয়ত ওমর খৈয়াম বলেছিলেন,’-ওমর খৈয়াম কে এবং তিনি কী বলেছিলেন?
ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন পারসিক জ্যোতির্বিদ, কবি-সাহিত্যিক এবং গণিতবিদ। তিনি কখনও বর্ষপঞ্জিকা নিয়ে কাজ করেছেন, আবার তিনিই চতুষ্পদী কবিতার অমর সংকলন ‘রুবাইয়াত’ রচনা করেছেন।
বই পড়ে এবং দেশভ্রমণ করে মনের মধ্যে অসংখ্য ভুবন সৃষ্টি করা যায় কিন্তু ভ্রমণের সুযোগ সকলের থাকে না সামর্থ্য ও স্বাথ্যের কারণে। তাই বই-ই হল শ্রেষ্ঠ পথ মনের ভুবনে বিচরণ করার। এই প্রসঙ্গেই কবি-দার্শনিক ওমর খৈয়াম বলতে চেয়েছেন-“রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা -যদি তেমন হয়।” অর্থাৎ বইয়ের মতো ভালো সাথি আর কিছুই হতে পারে না। বই সর্বক্ষণই জ্ঞানালোকের সন্ধান দেয়, বইয়ের প্রকৃত কোনো ক্ষয় নেই, তাই সে অনন্ত-যৌবনা। পাঠকের সঙ্গেও বইয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। ওমর খৈয়াম এই কথাগুলিই বলতে চেয়েছেন যে- রুটি, মদ, প্রিয়ার সৌন্দর্যে মলিনতা আসলেও বই পাঠকের মনকে সজীবতা দান করতে সক্ষম।
‘তবে তারা দেবভ্রষ্ট হবে’-কারা, কীভাবে দেবভ্রষ্ট হবে বলে বক্তার অভিমত?
প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটি রম্যরচনাকার সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা ‘বই কেনা’ রচনা থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে লেখক ‘কারা’ বলতে তাদেরকে বুঝিয়েছেন, যারা পুস্তকের সম্মান করতে জানে না।
‘বই কেনা’ প্রবন্ধে লেখক আলোচনার মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন বাঙালিদের জ্ঞানার্জনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা থাকলেও বই কেনার প্রতি তাদের অনিহা রয়েছে। বাঙালি তথা হিন্দুদের বিরাটতম গ্রন্থ নিজহাতে রচনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ‘গণপতি’ অর্থাৎ গণেশ। দেব গণেশকে হিন্দুরা সকল মঙ্গল কাজের শুরুতেই বিঘ্নহন্তা রূপে স্মরণ করেন, পূজা করেন। অথচ সেই দেবতার মাধ্যমে সৃষ্ট পুস্তককে হিন্দু তথা বাঙালিরা সঠিক সম্মান করে না। ‘গণপতি’ অর্থাৎ ‘গণ’ বা ‘জনগণের’ দেবতা। সেই ‘গণ’-ই যদি পুস্তকের সম্মান না-করে তবে তারা তো তাদের ‘পতি’ অর্থাৎ দেবকেই অসম্মান করছে বলে লেখকের অভিমত।
বই কেনার ক্ষেত্রে পাঠকের বিভিন্ন মনোভাব ‘বই কেনা’ রচনায় কেমনভাবে প্রকাশিত হয়েছে লেখো।
সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘বই কেনা’ প্রবন্ধে বই কেনার প্রতি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। যেসকল ব্যক্তি ঘোর সংসারী অর্থাৎ সংসারের প্রয়োজন না-হলে কোনোভাবেই অযথা খরচ করবেন না তাঁরা অনেক ভেবেচিন্তে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা, করে তবে বই কেনেন।
যাঁরা পাঁড় পাঠক অর্থাৎ যাঁরা বই পড়তে ভালোবাসেন বা বইয়ের মধ্যেই নানান ভুবনের সন্ধান পান তাঁরা বই কেনেন মনের আনন্দে। প্রথমটায় তাঁরা দাঁতমুখ খিচিয়ে, তারপর চেখে চেখে সুখ করে করে অর্থাৎ বইয়ের ভালো-মন্দ গুণাগুণ যাচাই করে বই কেনেন। শেষে যখন বইয়ের মধ্যে নিজেদের মনের জমিকে খুঁজে পান তখন তাঁরা আগে-পিছে না-ভেবেই খ্যাপার মতো বই কেনেন এবং তারই মাঝে নেশাতুরের মতো বুঁদ হয়ে ডুবে থাকেন। তবে এই নেশায় তাঁদের শারীরিক বা মানসিক কোনো ক্ষতির শিকার হতে হয় না।
‘তাই এই অচ্ছেদ্য চক্র’-অচ্ছেদ্য চক্রের পরিচয় দিয়ে তা থেকে বেরোনোর পথনির্দেশ করো।
সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ‘বই কেনা’ প্রবন্ধে প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন যে, বই সস্তা নয় বলে লোকে বই কেনে না, আবার লোকে বই কেনে না বলেই বইয়ের মূল্য সস্তা হয় না-এই দুই ঘটনাই চক্রাকারে পরস্পর যুক্ত। একেই লেখক ‘অচ্ছেদ্য চক্র’ বলেছেন।
এই চক্রকে ছিন্ন করে এ থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুব কঠিন। প্রকাশকের পক্ষে কঠিন-কারণ এই বিক্রির থেকে উপার্জিত অর্থেই তার পেটের ভাতের সংস্থান হয়। তাই বইয়ের দাম কমানো বা অনেক সংখ্যায় বই ছাপানোর ঝুঁকি সে নিতেই পারবে না। তাহলে বই পড়ে ক্রেতা, একমাত্র ক্রেতাই পারে পকেটের পয়সা একটু খরচ করে বই কিনে বই বিক্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে। লেখকের মতে বই কিনে কেউ দেউলে হয়নি কখনও। বরং বই পড়ে অনেকগুলি মনের চোখ বা নতুন নতুন ভুবন সৃষ্টি করতে পারবেন পাঠক। এভাবেই উক্ত চক্র থেকে বের হওয়ার পথ পাওয়া যেতে পারে।
‘কেউ কেনে না বলে আমি consumer’-প্রসঙ্গসহ উক্তিটির তাৎপর্য লেখো।
প্রশ্নোদ্ভূত কথাটি সৈয়দ মুজতবা আলি রচিত ‘বই কেনা’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। বই কেনার ক্ষেত্রে নানা মানুষের নানা প্রকারের চিন্তাভাবনা কাজ করে থাকে। সেই প্রসেঙ্গ আলোচনা করতে গিয়েই লেখক প্রশ্নোদ্ভূত মন্তব্যটি করেছেন।
বই কেনাকে কেন্দ্র করে লেখকের নিজের কার্যকলাপের কথাও এখানে বিবৃত হয়েছে। লেখক নিজেকে একাধারে producer এবং consumer রূপে বর্ণনা করেছেন। রসিকতার সুরেই লেখক জানিয়েছেন তিনি হয়তো একটা বই produce করেছেন, অথচ বই কেনার ক্রেতার অভাবে বইটি অবিক্রীত থাকছে, তখন তিনিই আবার সেই বইটি কিনে নিচ্ছেন। অর্থাৎ তিনিই বইটির consumer। কথাটির মধ্যে রসিকতার সুর থাকলেও অত্যন্ত বেদনাবহ একটি সুরও এখানে অন্তর্লীন আছে। অর্থাৎ বাঙালিদের মধ্যে বই কেনার প্রতি যে চিরকালীন অনিহা বা দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে সে-কথাকেই উদ্ধৃত উক্তিটির মাধ্যমে লেখক তুলে ধরেছেন।
‘শেলফ তো আর বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধার চাওয়া যায় না।’-কে, কোন্ কথা প্রসঙ্গে উক্তিটি করেছে?
প্রশ্নে উদ্ধৃত উক্তিটির বক্তা হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা রম্যরচনাকার মার্ক টুয়েন।
মার্ক টুয়েনের বিখ্যাত একটি লাইব্রেরি ছিল। লাইব্রেরিটির বৈশিষ্ট্য হল মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত গাদা গাদা বই স্তূপীকৃত হয়েছিল, মেঝেতে পা রাখার পর্যন্ত জায়গা ছিল না। তবে সেই লাইব্রেরিতে কোনো শেলফ ছিল না। মার্ক টুয়েনের এক বন্ধু মার্ককে বলেন-বইগুলো মেঝেতে পড়ে নষ্ট হচ্ছে, গোটা কয়েক শেলফ জোগাড় করছ না কেন। সেই কথার সূত্র ধরেই মার্ক টুয়েন বন্ধুকে জানায় যে, সে যে কায়দায় লাইব্রেরিটা গড়ে তুলেছে, সেই কায়দায় তো শেলফ জোগাড় করতে পারেনি। অর্থাৎ লাইব্রেরির বইয়ের অধিকাংশই বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকেই ধার করে নেওয়া বা উপহার হিসেবে পাওয়া কিন্তু “শেলফ তো আর বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ধার চাওয়া যায় না।”
‘তবে একটা জিনিস আমি লক্ষ করেছি,’-কে, কোন্ জিনিস লক্ষ করেছেন?
প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটি সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘বই কেনা’ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। উক্তিটির বক্তা হলেন জনৈক আরব পণ্ডিত।
আরব পন্ডিত ধনী ও জ্ঞানীর একটি তফাত প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেন, তিনি যে জিনিসটি লক্ষ করেছেন, তা বিচক্ষণ মানুষের দৃষ্টিগোচর করাতে চান। তিনি বলেন, ধনীর মেহন্নতের ফল হল টাকা। সেই ফল জ্ঞানীর হাতে তুলে দিলে তিনি সেটা পরমানন্দে কাজে লাগাবেন এবং শুধু তাই নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় জ্ঞানীরা অর্থ খরচ করেন ধনীদের থেকেও ভালো পথে এবং উত্তম পদ্ধতিতে। অন্যদিকে জ্ঞানচর্চার ফল যে পুস্তকরাজিতে সঞ্চিত থাকে, তা ধনীদের হাতে গায়ে পড়ে তুলে ধরলেও তাঁরা তার সঠিক ব্যবহার জানেই না, কারণ তাঁরা বই পড়েন না। আরব পণ্ডিত এই জিনিসই লক্ষ করেছেন।
‘একখানা বই-ই তাদের পক্ষে যথেষ্ট।’-প্রসঙ্গসহ উক্তিটি তাৎপর্য আলোচনা করো।
প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘বই কেনা’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। উক্তিটির বস্তা হলেন স্বয়ং লেখক। লেখক তাঁর বন্ধুর মুখে একটি গল্প শুনেছিলেন। এক ড্রইংরুম বিহারিণী তাঁর স্বামীর জন্মদিনে তাকে কী উপহার দেবেন, সেই প্রসঙ্গেই লেখক উক্তিটি করেছেন। জনৈক বধূ স্বামীর জন্য উপহার কিনতে দোকানে এটা-সেটা দেখেও কোনোকিছুই পছন্দ করতে পারছিলেন না। তখন দোকানদার তাঁকে একটি গল্পের বই কিনতে বলেন। গরবিনী বধূ নাসিকা কুঞ্চিত করে বলেন-“সেও তো ওঁর একখানা রয়েছে।” অর্থাৎ বিষয়টি এমন যে একখানা বই-ই যথেষ্ট, এর বেশি দরকারই নেই। অর্থ থাকা সত্ত্বেও বই কেনার প্রতি তাদের এই অনিহাই প্রমাণ করে, অধিকাংশ মানুষের মনোভাবই এমন-বই কিনে পয়সা খরচ করতে তাঁরা মোটেই চান না। এটাকে তাঁরা অপব্যয় বলেই মনে করেন। তাঁদের তাই কিছুটা বিদ্রুপ করেই লেখক প্রশ্নোদ্ভূত মন্তব্যটি করেছেন।
‘অথচ এই বই জিনিসটার প্রকৃত সম্মান করতে জানে ফ্রান্স।’-বক্তা কীভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন?
প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘বই কেনা’ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। উক্তিটির বক্তা লেখক নিজেই।
লেখক তাঁর আপন অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করেছেন যে, ফরাসিরা কাউকে অপমান করতে হলেও বইকেই অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করে। যদি দেখা যায় কোনো ব্যক্তি তার দেশকে প্রাণ-মন দিয়ে ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন; তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সেই ব্যক্তির সামনে তার দেশ সম্পর্কে কটূক্তি করা বা দেশকে অপমান করা হলে সেই ব্যক্তি কোনোভাবেই সেটা মেনে নিতে পারবেন না। তাই যে ব্যক্তি দেশপ্রাণ ব্যক্তিকে অপমান করতে চায়, সে অবশ্যই দেশপ্রাণ ব্যক্তির দেশকেই অপমান করবে। নিজের অপমান অনেক সময় চোখ-কান বন্ধ করে মেনে নেওয়া যেতে পারে কিন্তু দেশের অপমান বহুদিন দংশন করবে। ফ্রান্সের খ্যাতনামা সাহিত্যিক আঁদ্রে জিদ তাকে উপহাররূপে দেওয়া বন্ধুদের বই নিলাম ডেকে বিক্রি করে, তার বন্ধুদের এমন অপমান করেছিলেন যে, বন্ধুরা তড়িঘড়ি সেই বইগুলি দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে কিনে নিয়েছিলেন, যাতে ঘটনাটা বেশি লোক জানতে না-পারে। এভাবেই বক্তা প্রশ্নোদ্ভূত সিদ্ধান্তে পৌঁছান।
এদের একটা শিক্ষা দিতে হবে।’-কে, কাদের, কেন শিক্ষা দেওয়ার কথা ভেবেছেন?
ফ্রান্সের খ্যাতিমান সাহিত্যিক আঁদ্রে জিদ তাঁর সেইসকল সাহিত্যিক বন্ধুদের শিক্ষা দিতে চেয়েছেন, যাঁরা তাঁর হয়ে লড়েননি।
জিদ-এর অনেক নামকরা লেখক বন্ধু ছিল। একবার জিদ সোভিয়েত রাজ্যের বিরুদ্ধে একটি প্রাণঘাতী গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তখন প্যারিসের স্তালিনীয়রা গালিগালাজ ও কটূক্তি করে জিদ-এর প্রাণ অতিষ্ট করে তোলে। সেইসময় জিদ-এর অধিকাংশ লেখকবন্ধু নীরব হয়ে ছিলেন, তাঁরা জিদ-এর পক্ষে লড়েননি। বন্ধুদের এমন নেতিবাচক মনোভাব জিদ-এর অহংবোধে আঘাত করেছিল। এই কারণেই জিদ স্থির করেছিলেন উক্ত বন্ধুদের তিনি একটা শিক্ষা দেবেন।
‘এরকম অদ্ভুত সংমিশ্রণ আমি ভূ-ভারতের কোথাও দেখিনি।’-কে, কেন এরূপ উক্তি করেছেন?
প্রশ্নে উদ্ধৃত উক্তিটি করেছেন ‘বই কেনা’ প্রবন্ধের লেখক, রম্যরচনাকার সৈয়দ মুজতবা আলী।
বাঙালির বই কেনার প্রতি অনিহার কথা বলতে গিয়েই লেখক উক্তিটি করেছেন। লেখক কিছুটা বেদনাহত এই কারণেই যে, বাঙালির জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবল অথচ বই কেনার সময়েই তারা নানা প্রকার অজুহাত তৈরি করে। জ্ঞানতৃষ্ণা আছে অথচ জ্ঞনের আধার যে বই, তা তারা কিনতে চায় না। কেউ কেউ আবার এ কথাও বলে যে বাঙালির পয়সার অভাব আছে। তবে লেখক মনে করেন এই কারণটি সঠিক নয়। তাই জ্ঞানতৃয়া আছে অথচ বই কেনায় অনিহা-এই দুই ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বাঙালির চরিত্রে বর্তমান দেখে লেখক বিস্মিত হয়েছেন, যা কিনা সমগ্র ভারতেই বিরল। এই কারণেই লেখক প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটি করেছেন।
‘মরার ভয়ে বই কেনা, বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে।’ -প্রসঙ্গসহ তাৎপর্য আলোচনা করো।
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতাংশটি নেওয়া হয়েছে। জনৈক রাজা এক হেকিমের একটি বই বাগাতে হেকিমকে খুন করেন কিন্তু সেই বইটি পড়তে গিয়েই বইয়ের পাতায় পাতায় লাগিয়ে রাখা বিষ নিজের অজান্তের গলাধকরণ করেন এবং তারই পরিণতি রাজার মৃত্যু। এই গল্প প্রসঙ্গে লেখক প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটি করেন।
বাঙালির বই পড়া এবং বই কেনার প্রতি অনিহার কথা বলতে গিয়েই লেখক প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছেন। লেখক রসিকতার সুরে কথাটি বলেছেন যে বাঙালি হয়তো রাজার উক্ত পরিণতির কাহিনিটা জানে, তাই বই কিনে এবং তারপর সেই বই পড়তে গিয়ে নিজেদের বিপদ আর ডেকে আনতে চাইবেন না বলেই বই কেনায় তাদের অনিহা। গল্পের ছলে লেখক এই কথাগুলি বললেও বাঙালির এমন মানসিকতার জন্য লেখক কিছুটা বিদ্রুপের সুর মিশিয়ে দিয়েছেন এ কথা বলাই যায়।